X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ম্যান বুকারজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ এবং হান ক্যাং

দুলাল আল মনসুর
১৮ মে ২০১৬, ১৪:১০আপডেট : ১৮ মে ২০১৬, ১৫:০৮

ম্যান বুকারজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ এবং হান ক্যাং ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসের জন্য এ বছর ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান ক্যাং। মনুষ্য নিষ্ঠুরতা এড়িয়ে চলার জন্য এক নারী মাংস খাওয়া বর্জন করেন। তাকে নিয়েই উপন্যাসের কাহিনী তৈরি হয়েছে।
কোরীয় ভাষা থেকে এ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ব্রিটিশ অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ। স্মিথ মাত্র ২০১০ সালে কোরীয় ভাষা শেখা শুরু করেন। একুশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর ভাষা ছিল শুধু ইংরেজি। ইংরেজি সাহিত্যের ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন কোরীয় সাহিত্য অনুবাদের। সে লক্ষ্যেই তিনি কোরীয় ভাষা শেখেন।
এ উপন্যাসটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিচারকদের প্রধান বয়েড টনকিন এটিকে ‘অবিস্মরণীয় রকমের শক্তিধর এবং মৌলিক’ বলে উল্লেখ করেন।
এবারই প্রথম লেখকের একক কোনো সৃষ্টিকর্মের ওপর ভিত্তি করে এ পুরস্কার দেয়া হলো। এর আগে লেখকের সামগ্রিক লেখা মূল্যায়ন করে এ পুরস্কার দেয়া হতো। আর এবারই প্রথম অনূদিত গ্রন্থের জন্য পুরস্কারের অর্থের অর্ধেক পাবেন অনুবাদক। বিচারক এবং সমালোচকগণ অনুবাদকের দক্ষতারও প্রশংসা করেন। তিনি মূল উপন্যাসের মিতবাক স্বর বজায় রেখেছেন ইংরেজিতেও।
এ উপন্যাসটির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল নোবেলজয়ী তুর্কি কথাসাহিত্যিক ওরহান পামুকের ‘আ স্ট্রেঞ্জনেস অব মাই মাইন্ড’, ইতালির এলেনা ফেরান্তের ‘লস্ট চাইল্ড’, অ্যাঙ্গোলার হোসে এডুয়ার্ডো আগুয়ালুসার ‘আ জেনালের থিওরি অব অবলিভিয়ন’, এবং অস্ট্রিয়ার রবার্ট সিথালারের ‘আ হোল লাইফ’।


বইয়ের প্রচ্ছদ উপন্যাস সম্পর্কে

যেহেতু কবিতার প্রতি তাঁর টান ছিল ছোটবেলা থেকেই, বলা হয়ে থাকে, কলেজ জীবনে ই-স্যাংয়ের কবিতার একটি পঙক্তি হানের মনস জগতে নাড়া দিয়ে যায়। পঙক্তিটি হলো : ‘আমি বিশ্বাস করি, মানুষের উচিত বৃক্ষে রূপান্তরিত হওয়া।’ ঔপনিবেশিক আমলে যে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো উৎসাহ তিনি এখান থেকেই পান এবং এখানকার উৎসাহের বলেই তিনি তাঁর সবচেয়ে সফল সৃষ্টিকর্ম ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ লিখতে পারেন।
মূলত তিনটি উপন্যাসিকার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসটি । ইংরেজি অনুবাদের আগে কোরিয়ায় তিনটি উপন্যাসিকারূপেই প্রকাশ করা হয়েছিল। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম ইয়ং-হে। উপন্যাসটির তিনটি অংশের সমন্বিত রূপের সবটুকুরই কেন্দ্রে আছে ইয়ং-হে। তবে তিনজন আলাদা চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে কাহিনী। ইয়ং-হের স্বামী মি. চিয়ং, ইয়ং-হের বোন ইন হে এবং বোনের স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে তিনটি অংশে। প্রথম অংশের বয়ানকারী মি. চিয়ংয়ের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় সংবেদনশীলতার অভাব; সে কর্পোরেট জগতের একজন অতি সাধারণ প্রতিনিধি। ইয়ং-হে কোনো দিক থেকেই লক্ষণীয় স্বভাবে ছিল না বলেই তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে সে। জোর গলায় কিছু বলবে না এমন একজন স্ত্রীই তার দরকার ছিল। ইয়ং-হে সম্পর্কে তার নিজের ভাষ্য হলো:
তার অভ্যাস ছিল খুব কম কথা বলা। আমার কাছে তার কখনও তেমন কিছু চাওয়ার ছিল না বললেই চলে। আমি যত দেরি করেই বাড়ি ফিরি না কেন, সে নিজে থেকে কখনও কিছু বলত না। কোনো রকম ঝগড়া-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করত না। এমনকি আমাদের দুজনের ছুটির দিন একই হয়ে গেলেও সে কখনও আমাদের দুজনের এক সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথাও তোলেনি। বিকেলবেলাটা আমি টিভির রিমোট হাতে আলস্যে পার করে দিতাম। সে তার নিজের রুমেই একাকী কাটিয়ে দিত। শুধু খাবার সময়ই নিজের রুমের দরজা খুলে বের হতো; খাবার তৈরি করার জন্য নীরবে বের হতো রুম থেকে। এরকম স্ত্রী থাকার কারণে আর তার জীবন যাপন প্রণালী এমন হওয়ার কারণে আমার দিনগুলো কেটে যেত কোনো রকম উত্তেজনা ছাড়াই।

এভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবন। তবে হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখার পর ইয়ং-হে সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর মাংস খাবে না। স্বামী এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের চাপাচাপির পরও তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে সে। তার বাবা একদিন জোর করে মুখে মাংস গুঁজে দিতে চেষ্টা করে। এরপর সে আত্মহত্যারও চেষ্টা করে।
ইয়ং-হের বোনের স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গিতে উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ বয়ান করা হয়েছে । সে পেশায় একজন ভিডিও আর্টিস্ট। প্রথমত ইয়ং-হের দিকে তার তেমন নজর ছিল না। কথা প্রসঙ্গে তার স্ত্রী একদিন উল্লেখ করে, ইয়ং-হের নিতম্বে একটা জন্ম দাগ আছে। তারপর থেকে ইয়ং-হের ওই জন্ম দাগটা তার আর্টের ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টায় সে বুঁদ হয়ে থাকে।
আর তৃতীয় অংশ তৈরি হয়েছে উপন্যাসের কাহিনীর শুরুর তিন বছর পরের ঘটনা নিয়ে। ইয়ং-হে তখন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি। তাকে দেখাশোনার জন্য আছে শুধু তার বোন। বাকি সবাই তাকে ত্যাগ করেছে। এক পর্যায়ে সে সব ধরণের খাবার বর্জন করে। তার এই আত্ম-উপোস নিয়ে তার বোন বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়ে। তার বোন ইন-হে এমন সংকটকালে মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে যায়। সেও ঘন ঘন স্বপ্ন দেখে। এক রাতে সেও বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তার ঘুমন্ত স্বামী সন্তান ফেলে।
স্বপ্নের অভিজ্ঞতা লাভ করে ইয়ং-হে, তার বোন, তার বোনের স্বামী। স্বপ্নে নিজেদের বিকৃত চেহারা দেখতে পায় তারা। তাদের মুখ হয় বদলে যায়, নয়তো অস্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। এটাই তাদের আদি সত্তা। এই আদি সত্তার কাছে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিতে পারে শুধু ইয়ং-হে। ইন-হে এবং তার স্বামী এই সত্তার কাছে নিজেদের সার্বক্ষণিক কিংবা পুরোপুরি সমর্পণ করতে পারে না; নিজেদের শুধু আংশিক সমর্পণ করতে পারে তারা দুজন।
খুব স্পষ্ট আর আবেগঘন চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে এ উপন্যাসটিতে। নিজের খুব কাছের মানুষদের সম্পর্কে জানার বিষয়ে ব্যর্থতাই এখানে প্রধান হয়ে ওঠে। এমনকি নিজের ভেতরও অনেক সময় অচেনা কোনো অনুভূতি উপস্থিত হতে পারে। এমনই এক অপার্থিব মুহূর্তের মধ্যে ডুবে যায় ইয়ং-হের বোনের স্বামী যখন সে ইয়ং-হের পিঠ থেকে শুরু করে নিতম্ব পর্যন্ত ফুলের ছবি আঁকে। তার ঘাড়ের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে নিচের দিকে আঁকতে আঁকতে এগিয়ে যায়। এই মুহূর্তে তার মধ্যে যে শিহরণ জাগে সেটাকে শুধুই যৌন অনুভূতি বললে খাটো করা হয়। তার সমস্ত সত্তার ভেতর দিয়ে অবিরাম বহমান এক বৈদ্যুতিক ঝাঁকুনি বলা যায় এটাকে। এই উপটন্যাসটি এরকম আরো অনেক রং রূপ আর রহস্যময় আবেগের প্রবাহে ভরা ।

হান ক্যাং লেখক সম্পর্কে

হান ক্যাংয়ের জন্ম ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায়। তিনি বেড়ে উঠেছেন সাহিত্যিক আবহে। বাবা হান সিউং-ওন ঔপন্যাসিক। তাঁর ভাই হান ডং রিমও লেখক। হান ক্যাং ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরীয় সাহিত্যে পড়াশোনা করেন। তাঁর লেখালেখির শুরু কবিতা এবং ছোটগল্প দিয়ে। ১৯৯৩ সালে লিটরেচার অ্যান্ড সোসাইটি পত্রিকার শীতকালীন সংখ্যায় তাঁর পাঁচটি কবিতা প্রকাশিত হয়। সেগুলোর একটি হলো ‘উইন্টার ইন সিউল’। পরের বছর দৈনিক সিউল শিনমিং পত্রিকার বসন্ত সংখ্যায় ছোটগল্প শাখার প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার পায় তাঁর প্রকাশিত প্রথম ছোটগল্প ‘দ্য স্কারলেট অ্যাংকর’। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘লাভ অব ইয়েওসা’। তিনি পাঠকদের মাঝে ব্যাপক পরিচিতিলাভ করেন ১৯৯৫ সালে তাঁর উপন্যাস ‘আ কনভিট্কস লাভ’ প্রকাশের পর। বাহুল্যবর্জিত যথার্থতার জন্য তাঁর এ রচনাটি বোদ্ধাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তাঁর অন্যান্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ‘ফ্রুটস অব মাই উওম্যান’ (২০০০), ‘দ্য ব্ল্যাক ডিয়ার’ (১৯৯৮), ‘ইওর কোল্ড হ্যান্ড’ (২০০২), ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ (২০০৭), ‘ব্রিদ ফাইটিং’ (২০১০) ‘গ্রিক লেসনস’ (২০১১) ইত্যাদি। হান তাঁর উপন্যাস ‘ভেজিটেরিয়ান’ এবং ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ লেখেন হাতে। কারণ কিবোর্ডের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে তাঁর কব্জিতে সমস্যা হয়। বুকার পুরস্কারসহ এযাবৎ তিনি আরো অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন; তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে অন্য শিল্পও তৈরি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে তিনি উপন্যাসিকা ‘বেবি বুদ্ধ’-এর জন্য পঁচিশতম কোরিয়ান নভেল অ্যাওয়ার্ড জয় করেন। ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’-এর জন্য ২০০০ সালে পান ইয়াং আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৫ সালে ই-স্যাং লিট্রারি অ্যাওয়র্ড। আর ‘ব্রিদ ফাইটিং’-এর জন্য ২০১০ সালে লাভ করেন ডং-নি লিটরারি অ্যাওআর্ড। তাঁর উপন্যাস ‘ব্রিদ ফাইটিং’, ‘বেবি বুদ্ধ’ এবং ’দ্য ভেজিটেরিয়ান’ চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ’দ্য ভেজিটেরিয়ান’ই তাঁর প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত উপন্যাস।
১৯৯৫ সালে হান ক্যাং আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি কথাসাহিত্য রচনার সঙ্গে সিউল ইনস্টিটিউটে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের পাঠদান করেন। এখন লিখছেন তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্টয়নিস ঝড়ে পাত্তা পেলো না মোস্তাফিজরা
স্টয়নিস ঝড়ে পাত্তা পেলো না মোস্তাফিজরা
রানা প্লাজা ধস: ১১ বছরেও শেষ হয়নি তিন মামলার বিচার
রানা প্লাজা ধস: ১১ বছরেও শেষ হয়নি তিন মামলার বিচার
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট