X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মধ্বনি থেকে

কুমার চক্রবর্তী
১৮ জুন ২০১৬, ১৪:২৫আপডেট : ১৮ জুন ২০১৬, ১৪:৪০

আত্মধ্বনি থেকে আমি আমার জন্যই দুঃখ পাই না, অন্যের জন্য দুঃখ পাই। অন্যের জীবনকে চিন্তা করে আমি বিচলিত ও আক্রান্ত হয়ে পড়ি। অন্যের জন্য ঠিক ঠিক আমি অশান্ত হয়ে উঠি। এইসব অস্তিত্ব নিয়েই যেন আমি। তাদের ভালোবাসি, তাদের সম্ভাব্য উদ্বেগগুলোকে নিয়ে আমি কাতরতাবোধ করি। এভাবেই আমার আত্মর উন্মেষ। তারা যেন আমার আত্মন। তাদের নিয়ে যা কিছু ভাবি, তা-ই পরিণত হয় ভালোবাসায়

আমার কবিতা হয়ে থাকুক এক অনুপস্থিতির কবিতা। যাবতীয় অলংকার, আর অবয়ব থেকে মুক্ত হয়ে সে থাকুক শুধু ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্যনির্ভর। কবিতা হোক নিরবয়ব। অপ্রয়োজনীয় অলংকার আর ছন্দের মুন্সিয়ানা থেকে সে নিজেকে রক্ষা করে চলুক। অনাচ্ছাদিত এক গভীরতা, হস্তান্তরহীন এক মনোদলিল হয়ে সে সবাইকে না বলে দিক। বাহ্যিকতার সমস্ত শর্ত ও শাসন থেকে সে মুক্ত হয়ে উঠুক। কবিতা হোক জীবনের শ্বাসাঘাত, হোক সে বাচালতাহীন। কবিতা এক অভিজ্ঞতা যা জীবন পায় অস্তিত্ব এবং ভাষার ব্যঞ্জনায়, যার ভেতর দিয়ে সমগ্র উন্মোচিত হয়, আর এই সমগ্র সেই সম্ভাবনাকেই সার্থক করে―যা নতুন এবং অজানা। ব্যক্তি এবং সমষ্টি এখানে হাজির হয়, তারা সুর মেলায়। ব্যক্তির অনুভূতিকে সমষ্টি গ্রহণ করে।
পৃথিবীতে জীবিতদের সহাবস্থান কখনোই পূর্ণ হয় না, শুধু মৃতদের পক্ষেই সহাবস্থান সম্ভব। সহাবস্থান পূর্ণ হলে আর ভাষার প্রয়োজন হয় না। এজন্যই জীবিতদের ভাষা তখনই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে যখন তা মৃতদের ভাষাতীত স্তব্ধতাকে ছুঁয়ে যায়। আমাদের ভাষা এই মরণশীলতাকেও স্পর্শ করুক। মৃতরাও পাঠ করুক এই লেখা, যেমন তারা জীবিতাবস্থায় পাঠ করেছে। প্রতিটি লেখা তাই আত্মগোপনকারী মানুষের কাছে ছুটে যাবে তাদের গোপন জীবনকে মূল্যবান করে তুলতে।

অনুভূতি আর অনুভাবকে আমি রেখে দিতে চাই আমার কবিতায়। সাধারণ আবেগের প্রশ্নে একটু নিচু স্বর, দর্শনের উঁচু ছায়া, উদ্দীপনার বিভ্রম, এসবই কবিতাকে মহার্ঘ করে। কবিতা নৈঃশব্দ্যের ভাষা, কবিতা শূন্যতার ভাষা। শূন্য থেকে পূর্ণ করাই কবিতা। দূরত্ব যে নির্জনতার জন্ম দেয় তা আমাদের আলাদা করে ফেলে। দূরত্ব বস্তুকে অবলুপ্ত করে, তাকে দৃষ্টিসীমার বাইরে পাঠিয়ে দেয়। এটা এক ধরনের বিলুপ্তি। কবিতা এই বিলুপ্তিকে বাঙ্ময় করে।
অস্তিত্বের দরদাম, বেঁচে থাকার ঔচিত্য ইত্যাদি নিয়ে যখন ভাবি, মনে হয় বড়োই আপেক্ষিক। অস্তিত্বকে মনে হতে থাকে অনুচিত একটি ব্যাপারও। মূল্যহীন, অস্বাভাবিক, উদ্ভট। জীবনকে বহন করা ভোগান্তিও, কারণ তা অর্থহীন। আমাদের চিন্তাই এই কথা বলে দেয় যে জীবন হলো এক অনিবার্য পীড়ন, এক অন্যায্যতা, যে নিজের সাথে নিজেই তামাশা করে। বেঁচে থাকা মানে মৃত্যুকে বরণ করা। সবকিছু অর্থহীন, সবকিছু অন্যায্য, সবকিছু এক উপর্যুপরি ঠাট্টা। যাপনের এতসব আড়ম্বর আয়োজন তবু জীবন কতটা অধরা, কতটা যাপনোর্ধ্ব। সমস্ত ব্যবস্থাদি সুসজ্জিত থাকা সত্ত্বেও কতটা ফাঁকা আর অন্তঃসারশূন্য এবং কৃচ্ছ্রসাধনময়। জীবন যেন এক গুরুভার। ক্ষয়, বিনাশ, ক্লান্তি, অবসাদ আর অমোচনীয় বেদনা নিয়ে সে অব্যবস্থিত। কে যেন অজানা পিরামিড চাপিয়ে রেখেছে তার ওপর । অর্থহীন জীবন, অর্থহীন পৃথিবী। কিন্তু অর্থহীন একটি পৃথিবীতে ততোধিক অর্থহীন জীবনকে নিয়ে বেঁচে থাকার বাস্তবতাকে আমরা কীভাবে মোকাবেলা করতে পারি? এই প্রাথমিক বা অনিবার্য অর্থহীনতাকে নিয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে কি আমরা আবিষ্কার করতে পারি না? জীবন যদি অর্থহীন না হতো, তাহলে তা হয়তো এতটা চিহ্নিত হতো না। এই যে অসম্ভবপরতা, তার কারণেই জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। অর্থহীনতা হলো শিল্প। জীবন অর্থময় ও সম্ভবপর হলেই বরং গোলমাল দেখা দিত। জীবনের অর্থময়তার এক দিক হলো অমরত্ব। অর্থাৎ ধারণা করা হয়, মানুষ না মরলেই তার জীবন অর্থময় হয়ে উঠত হয়তো। কিন্তু মানুষ যদি না মরত তাহলে কি জীবনের অর্থহীনতা আরও বেড়ে যেত না? আসলে মানুষ মরে বলেই জীবন অর্থময় হয়ে ওঠে। সুতরাং অমরত্ব আসলে অর্থহীনতা। পৃথিবীতে সমস্ত শিল্পেরই জন্ম হয়েছে মানুষের মরত্বের কারণে। সে যে উপস্থিতিটাকে রেখে দিতে চায় অনন্তের সমীপে, তা-ই তার জীবনে শিল্প হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকার শর্তই এমন যে ভোগান্তি আর নিরর্থকতাকে সে শান্ত মেজাজে সহ্য করে যাবে। বেঁচে থাকার প্রধান শর্তই হলো তাই আপন মহিমায় এই কিম্ভূত সময় ও সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়া। অতএব জীবনকে নিরর্থকতাময় করো আগপাশতলা। অতএব শান্তভাবে বাঁচো। বাঁচো দিবা আর অবসানের মধুরিমাকে নিয়ে। বাঁচো আকুলতা আর অভিপ্রায়কে সাঙ্গীকৃত করে। বেঁচে ওঠো অনুপ্রাস আর অন্ত্যমিলে। যদি না-ই বাঁচো তাহলে মৃত্যুকে মুখরিত করবে কে! বাঁচতে হবে তোমাকে হাহাস্বরে, না-হয় মৃত্যু তোমাকে চিরদিনের মতো নিয়ে নেবে। তবে যা-ই করো তা হতে হবে উৎকর্ষময়। আমাদের প্রতিটি কাজই যেন হোক পথ ও পাথেয়কে সঙ্গ করে। আমরা এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে নন্দনের ফুল ফোটাব। জীবন হলো এমন এক ভ্রমণ যেখানে অনুধ্যানী মন বস্তুবিশ্বের ভেতর দিয়ে পথ করে নেয়।
আমি আমার জন্যই দুঃখ পাই না, অন্যের জন্য দুঃখ পাই। অন্যের জীবনকে চিন্তা করে আমি বিচলিত ও আক্রান্ত হয়ে পড়ি। অন্যের জন্য ঠিক ঠিক আমি অশান্ত হয়ে উঠি। এইসব অস্তিত্ব নিয়েই যেন আমি। তাদের ভালোবাসি, তাদের সম্ভাব্য উদ্বেগগুলোকে নিয়ে আমি কাতরতাবোধ করি। এভাবেই আমার আত্মর উন্মেষ। তারা যেন আমার আত্মন। তাদের নিয়ে যা কিছু ভাবি, তা-ই পরিণত হয় ভালোবাসায়। এটি এক আক্রান্ত হৃদয়ের লক্ষণ। দুঃখ নিঃসঙ্গ, দুঃখ একা, দুঃখ নেপথ্যচারী। দুঃখ অন্তঃপ্রবাহী। সুখ সকলকে খোঁজে, সকলকে ধরে আরও বেড়ে ওঠে, কিন্তু দুঃখ অন্তর্ঘাতী। ভেতরে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে সে বেঁচে থাকে, শুধু তা-ই না, সেখানে সে চাষাবাদ করে দুঃখের যা থেকে জন্ম নেয় বিষাদের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। কখনও কখনও নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবি, কিন্তু জানি না, আমরা হয়তো নিঃসঙ্গ নই। কারণ আমার মধ্যে অন্যের বিষয়গুলো এসে হাজির হয়। আমি তাদের নিয়ে মশগুল থাকি। আমার হৃদয়ের গোপনতম জায়গাগুলো অন্যের স্পর্শে হয়তো পূর্ণ থাকে। এগুলোই হয়তো নিঃসঙ্গের মধ্যে সঙ্গ। যারা অন্যের জন্য দুঃখ পায়, তারাই জগতে প্রকৃত আগন্তুক। আগন্তুক সেই ব্যক্তি যে নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হয়ে রয়। নিজেকে বুঝি বলে সুখ হয় না, অন্যকে বুঝি বলে ভালো লাগে। যারা অন্যকে বুঝতে চায়, অব্যক্তকে অনুভব করতে চায়, পৃথিবীতে তারা প্রকৃত কষ্ট পেতে থাকে। তারা অন্তরস্থিত। তারা আসলে আগন্তুক। এক উদ্বিগ্ন বিষণ্নতা, সুষুুাকাণ্ডে এক প্রতিবর্তী শীতলতা, ব্যথাদীর্ণ মন, খড়খড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়া এক চিলেকোঠা আজ আমাদের অন্তর্মানচিত্রের রূপক হয়ে রয়। চারদিকে জীবনের ছায়া অদ্ভুত সব ভাঙারি রচনা করে রেখেছে। এক পাথুরে সময়, এক অন্ধকার দেয়াল ঢুকে গেছে আমাদের ভেতরে। এই এক আত্মবিয়োগ―আমরা শূন্য হয়ে যাই, এক দুর্বোধ আর্তনাদ উৎস থেকে গন্তব্যের দিকে চলেছে একা একা। আমরা স্খলিত, জীবনের ব্যঞ্জনাহীন বুনুনে আটকে গেছি। পাহাড়ে আটকে যাওয়া মেঘ যার গতি ঘুমিয়ে পড়েছে এখন। মনে হয় আরও কিছুকাল ঘাসে ঘাসে থাকি, থাকলে ভালো হতো, কিন্তু কোনো জমেপড়া জটিল ভাবনার কাঁটাতারে বিদ্ধ আমরা। একটি দীর্ঘ বিলাপে শুরু হয়েছিল আমাদের জীবন আর দীর্ঘ বিলাপে শেষ হয়ে যায় তা।
এইসবকে রেখেই আমাদের জীবন কবিতা লিখে যায়। আমরা কবিতা লিখি কবি হওয়া ছাড়াই, কবি হতে আমাদের খেয়াল নাই। কেউ কেউ কবি হয়ে রয় সারা জীবন এমনকি মৃত্যুর পরেও, কবিতা ছাড়াই। কেউবা কবিতা লিখে কবি। কিন্তু আমরা কবি হওয়া ছাড়াই কবিতা লিখে যাই আজীবন। আনন্দ পাই এতে কারণ আমাদের আনন্দ কবিতালেখায়, কবিখ্যাতিতে নয়।
কবিতায় প্রকাশের আড়ালে ভাষার গোপনীয়তা থাকে। আমরা এটাই হয়তো প্রকাশ করতে চাই যে, ভাষা যা করেছে তার চেয়ে অধিক কিছু গোপনও করেছে ভাষা। আমরা জানি ভাষার ব্যবহার বিচিত্র, ভাষা নানাভাবে নানা উপায়ে যোগাযোগ ও জাহির করে যাতে মানুষের অর্থময়তা প্রসারিত হয়। কিন্তু কবিতায় ভাষা গোপনও করে। করে কারণ কবিতা অপ্রকাশিতেরও ভার নেয়। ভাষা যে গোপন করে এটা কবিতার জ্ঞেয় ও দুর্জ্ঞেয়ের মাঝে সৃষ্টি করে রহস্য।
কবিতা কি প্রতিদিন লেখার জিনিস! কী করে প্রতিদিন কবিতা লেখা যায়! প্রতিদিন তো লেখা যায় প্রতিবেদন, বাজার-ফিরিস্তি বা অফিসের টোকা, আর প্রতিদিনই লেখা হয় রাশি রাশি দলিল-দস্তাবেজ। অসংখ্য এসব লেখার ভেতর কত সরল আর বক্ররেখা, কিন্তু ছবি তাতে ফোটে? কত ছন্দ, কত মিল, কত অনুপ্রাস কিন্তু একটি কবিতার জন্মের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেকটা সময়। অনেকটা পথ হেঁটে, অনেকটা উপত্যকা অতিক্রম করে উপস্থিত হতে হয় সেই মহান স্তব্ধতার কাছে, যে প্রকৃত ছাড়পত্র দেয় একটি কবিতার আবির্ভাবের। তার আগে কবিতাটি কোথায় থাকে? থাকে কবিজীবনের গোপন-গভীরে, অনুবোধ হয়ে, অলীকত্ব হয়ে, বিমূর্ত ধারণা হয়ে, অথবা কিছু না হয়ে, যেখানে সময় তার বয়সীকরণ ঘটায়। স্তব্ধতার অনুবাদ ঘটতে থাকে, আর কবিতাটি তার শরীরী রূপের দিকে অগ্রসর হয়। তারপর সে আসে রংধনুর অনাবিল স্বচ্ছতায়, আর সেই আস্ত রংধনুটা নিয়ে সে স্নায়ুতে ঢুকে যায়। অনেকেই দিনানুদৈনিক সব চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে কবিতা করতে চায়। কিন্তু সবকিছুকে কবিতা করার দরকার নাই, হয়ও না। কারণ কবিতা আসলে কোনো উপায় নয়, গন্তব্য। কবিতা দীর্ঘকে হ্রস্ব করে, হ্রস্বকে করে অনুপম, অবাঙ্মনসোগচর। কবিতার ভরকেন্দ্র থাকে, থাকতে হয়, যা সমগ্রের প্রতিভাসকে তুলে ধরে, ধরতে চায়। সুতরাং সারা জীবন হয়তো কবিতা নিয়ে থাকা যায় কিন্তু কবিতা লেখা যায় না। অবশ্য বেশি লিখেছেন আবার কিছু ভালো কবিতাও লিখেছেন, এমন কবিও আছেন, তবে তাঁরা নিয়ন্ত্রিত ও সংবারিত হলে অনেক ভালো হতো, অতিরেক লেখাগুলো তাঁদের দুর্বলতারই দিক। সাধারণ আর গড্ডল কবিতার চাপে তাঁদের ভালো কবিতাগুলো যেন হারিয়েই যেতে চায়, আর তা না-হলেও হয়ে থাকে ব্রীড়ানত ও সংকুচিত। কোনটা ভালো, অল্পের মধ্যে বেশি নাকি বেশির মধ্যে অল্প? কিন্তু এমন কবির সংখ্যাই বেশি যারা লিখেছেন বা লিখে যাচ্ছেন সহস্র-অযুত-লক্ষ কবিতা যা জীবিতাবস্থাতেই ক্রন্দনসহযোগে সহমরণে গেছে খোদ কবিকে নিয়ে। এখন ছাইও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অতএব সংবরণ করতে হয়, নিয়ন্ত্রিত হতে হয়। সারা জীবন পুনরুক্তিসর্বস্ব আর সম্প্রসারিত কবিতা লেখার চেয়ে অল্প অথচ আসল কবিতার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক প্রাপ্তির। মনে রাখা দরকার, একটি পর্যায়ের পর সব কবির কবিতাই আসলে আগের লেখা কবিতার নিষ্ফল ও হাহাকারময় প্রতিধ্বনি। আগের কবিতার বোধ বা চিন্তাই বিশেষত্বহীনভাবে একটু বদল নিয়ে আসতে থাকে, আর কবি ভাবতে থাকেন, তিনি প্রজননশীল এখনও। তবে এই প্রতিধ্বনি সৃষ্টির প্রচেষ্টা থেকে তারাই নিজেকে রক্ষা করতে পারেন যারা নিজস্বতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। যারা পারেননি, তারা সারা জীবন গোল্লাছুট খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের কাছে ক্রিয়ার চেয়ে তৎপরতা অধিক মূল্যবান। মনে হয়, শারীরিক মৃত্যুর পরই জন্ম হোক প্রকৃত কবির, কারণ কেউ কেউ মৃত্যুর পরই জন্মলাভ করেন, কারণ তারা ভবিষ্যতের কবিতা লেখেন।
একটি কবিতা লেখার পর মনে হয় আমার, বোধহয় আর কবিতা লিখতে পারব না। এ-ই আমার শেষ কবিতা, এ-ই শেষ, এর সাথেই আমার কবিতাবিষয়ক সমস্ত অন্বীক্ষার যবনিকাপাত হলো। লিখিত কবিতাটিতেই আমার মুক্তিদান নিহিত থাকবে। কিন্তু মুক্তি মেলে না। আবার জায়মানিত হয় এক অন্ধশক্তি। ওদুসসেউস যেমন ক্যালিপসোর অমরত্বের প্রতিশ্রুতিকে অস্বীকার করে মর্ত্যভূমি ইথাকায় প্রত্যাবর্তন করেছিল, তেমনি আমিও মুক্তিপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে আবার কবিতায় ফিরে আসি। সেই অন্ধশক্তি আমাকে আবার চালিত করে কবিতালেখায়। পুনরায় বন্দি হয়ে যাই কবিতার ঘেরাটোপে, তার মধু আর মোমে মাখামাখি হই। কবিতা আমাকে স্বাধীন করতে পারে না কিন্তু আমি কবিতাকে স্বাধীন করে দিই। সে ওড়ে আকাশে, মেঘের আঁচল ধরে ধরে। আমি তাকে নিয়ে থেকে যাই পরাধীন, সারা জীবনের মতো।
প্রকৃত কবিতাকে চেনা যায়। তার ভেতরে এক খেলা থাকে, শব্দ আর অনুভূতির নিরন্তর স্পর্শে যা জন্ম নেয় তা আসলে বিনিময়ের অতীত, অনুবাদেরও অতীত। প্রতিটি শব্দের মধ্যে এই যে অনুবাদ-অসাধ্য অসংজ্ঞার্থ, তা-ই আসলে কবিতার খেলা। প্রকৃত পাঠক এই খেলাকে টের পায়। আর কবিতার চূড়ান্ত দায়ই হলো এই খেলার উন্মীলন। অনেক সময় ভাবি, একটি তরঙ্গমুগ্ধ নদী, তাতে পড়ে আছে এক চিরনিবিষ্ট জ্যোৎস্না, চরাচরে আর কিছু নেই। বিমূঢ়, বিলোড়িত এক অবস্থা। নদীটি খেলছে। কার সাথে? সে তো খেলছে নিজের সাথে, সংশয়হীনভাবে। এমনই এক অনুভূতিগ্রাহ্য ভাবনার কথা মনে হয়। কবিতা খেলছে। লব্ধপ্রদেশে তার আধারআধেয়ভাব।
কবিতা হলো আত্মসম্পর্কায়ন, কবিতা হলো কৌশল, কবিতা হলো শব্দান্ধতা, কবিতা হলো বিমূর্তকরণ। প্রতিটি কবিতা শুরু হয় আত্মসম্পর্কের সংবেদ থেকে। কিন্তু আত্মগত জায়গা থেকে শুরু করে তা বস্তুগত জায়গায় উপনীত হয়। নির্জ্ঞাত প্রেষণা থেকে শুরু হয়ে তা জ্ঞাতের প্রতীকপরিণতিতে পৌঁছায়। এভাবে কবিতা সম্পূরিত হয় বস্তুবিশ্বের উপস্থিতি ও চেতনাতে। কবিতা হলো কৌশল, প্রত্যেক মৌলিক কবি এর বিকাশের সাধনা করেন। তবে কারও কারও এই সাধনা অনুকরণেই ফুরিয়ে যায়, কেউবা পূর্বেকার কবিদের উপস্থাপিত কৌশলের উন্নয়ন করে থাকেন, আর অতি অল্প কিছু কবি নতুন কৌশলের জন্ম দিতে সক্ষম হন। কিন্তু কৌশলই শেষ কথা নয়, তা প্রয়োজনীয় শর্ত কিন্তু সর্বশেষ নয়। কবিতার জন্য দরকার উদ্ভাসন যা সারবস্তুকে নিয়ে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। কখনও কখনও কোনো কোনো কবির কবিতায় আধেয় প্রকাশপদ্ধতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কখনও বা প্রকাশপদ্ধতি বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কখনও বা দুটোই অন্যোন্য হয়ে ওঠে। আঙ্গিক আর অনুভূতি এভাবেই পরম্পরীণ হয়। কবিতা হলো শব্দান্ধতা, কারণ কবিতা হয়ে ওঠার পর সেই কবিতাটির শব্দদের আর দেখা যায় না বা আলাদাভাবে শোনাও যায় না, শব্দান্ধতা তাৎপর্যপূর্ণভাবে অস্বচ্ছ করে কবিতাকে। আর কবিতা হলো বিমূর্তায়ন, কবিতা অনেক কিছুকে নিয়ে অবশেষে সবকিছুকে মুছে বা অস্পষ্ট বা অধরা বা সমাচ্ছন্ন করে দিয়ে এক নতুন গোধূলিচৈতন্যাবস্থার সৃষ্টি করে। এভাবেই কবিতা জীবনের আধেয় যা কখনও বা আধার হয়ে যায়।
দৃশ্য আচ্ছাদিত চিহ্নে, এবং তা-ও এক দৈবনির্দেশনা: সমুদ্র কথা বলে, সমুদ্রতাড়িত হাওয়া বলে, ঝাউবনের বাতায়ন আর কোনায় দাঁড়ানো নীরব গাছ বলে, জানায় ভাষা। সবাই কিছু একটা বলছে, এই নয় যে কবি বলেন, কিন্তু অবশেষে সর্বদা কিছু একটা নিরুক্তই থেকে যায়। অনুপস্থিতি শুধু নিঃস্বতা নয়, এক উপস্থিতির পূর্ববোধ যা নিজেকে পুরোপুরি দেখায় না কখনও। গোপন কবিতা এবং গান মিলেমিশে যায়, মিলেমিশে যায় হাওয়া ও হর্ষ, নীরবতা আর বিষণ্নতা, উন্মোচিত হয় পাখিদের নির্মিত সাঁকো: উপস্থিতিতে, আমাদের অবাস্তবতায়, আমাদের অলীকত্বে, কিছু একটা উপস্থিত। মানুষ আর বস্তুরাশির মাঝখানে চকিত কবি পথ ধরে হেঁটে চলে যান সমুদ্রের দিকে, প্রান্তরের দিকে। তিনি বনে যান আর পাতারা নড়ে ওঠে। কী যেন তারা বলতে উদ্গ্রীব...না, তারা কিছুই বলে না। বিকেলের শেষ আলোতে জগতের অবাস্তবতা, নৈশ কাফেতে মুখোমুখি বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার প্রাতিস্বিক স্তব্ধতা, ভোরের প্রথম আলোতেও জগতের এই অবাস্তবতা। সবকিছুই স্থির, অপেক্ষমাণ; সবকিছুই ত্রাসিত, স্বতশ্চালিত। এখন এভাবেই, বা যাবতীয় অসম্বন্ধতায়, বা দ্বিধাব্যক্তিত্বের সংশয়ে কবি জেনে যান যে তাঁর কোনো পরিচয় নেই এই বস্তুবিশ্বের না-গাওয়া গান রচনা ছাড়া, এই মনস্তাত্ত্বিক প্রাণীর আধুনিক আর্তনাদ রচনা ছাড়া। তিনি আসলে অনুবিশ্ব ও আবিশ্বের গুপ্ত স্বরকেই ধরতে চান কবিতায়। মুহূর্তে ভেসে থাকা প্রায় বাস্তব গাছগুলোর মতো নোঙর ফেলেন তিনি, নিজেকে ত্যাগ করেন। যা আবির্ভূত হয়, সুকৌশলে নিজেকে ঢুকিয়ে দেয়, তার অন্যত্ব, যার কোনো নাম নেই, যা বলা হয় না, আর আমাদের মামুলি শব্দরা আহ্বান করে। এই কি কবিতা? না, কবিতা হলো যা অবশিষ্ট থাকে এবং আমাদের প্রবোধ দেয়, সেই অস্পষ্টতা ও অনুপস্থিতির সচেতনতা, যা আসলে প্রযোজনা করে প্রতীকপরিণতির, যা শেষমেশ তার স্নায়ুর বল্কলকে খসিয়ে দেয়। খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে কবিকে অস্বচ্ছ হতে হয়, হতে হয় পরোক্ষগামীও। বাস্তব অপেক্ষা অবভাসে তার স্বস্তি ও সম্ভাবনা, তিনি জানেন কী করে বস্তুকেন্দ্রিক বাস্তবতাকে আত্মকেন্দ্রিক বাস্তবতায় পরিণত করতে হয়, তাই তার প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে হতে অবশেষে অপরিহার্যতায় যেতে চায়। কবি পরিণত হন ভিন্ন এক দৃষ্টিক্ষেত্রে।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা