X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রাণপ্রাচুর্যের কিয়ারোস্তামি

বিধান রিবেরু
১৪ জুলাই ২০১৬, ১০:৪০আপডেট : ১৪ জুলাই ২০১৬, ১১:২৩

আব্বাস কিয়ারোস্তামি ‘তুমি যদি গাছকে এক জায়গা থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় নাও, তো সেটি আর ফল দেবে না। আমি যদি দেশ ত্যাগ করি, আমার পরিণতিও হবে গাছের মত।’

ফরাসি ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ লুক গদার ফারসি ভাষার চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্র শুরু হয় ডি ডব্লিউ গ্রিফিথকে দিয়ে, আর শেষ হয় আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে দিয়ে।’ ইরানের এই ক্যামেরা-কবি মারা গেছেন গত ৪ জুলাই, প্যারিসে। ৭৬ বছরের জীবনে তিনি স্বদেশে তো বটেই বিশ্বের অন্য দেশের পরিচালকদের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন চলচ্চিত্রের এক মরমী কবি হিসেবে।
অস্কারজয়ী ইরানি চলচ্চিত্রকার আজগর ফরহাদি কিয়ারোস্তামিকে শুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাতা বলে মনে করতেন না, ফরহাদি বিশ্বাস করতেন, কিয়ারোস্তামি ছিলেন আধুনিক কালের এক মিস্টিক ওরফে মরমী প্রাণ, সেটা যেমন চলচ্চিত্রে, তেমনি ব্যক্তি জীবনেও। ‘আ সেপারেশন’ ছবি দিয়ে অস্কার জয় করা ফরহাদির কাছে কিয়ারোস্তামি ছিলেন সেই মাপের নির্মাতা যিনি অন্য নির্মাতাদের জন্য অনেক বাধাকে দূর করেছেন, সুগম করেছেন পথচলা, আর অনুপ্রাণিত করেছেন অনেককে, বহুগুণে।
মোহসেন মাখমালবাফ, আরেক ইরানি চলচ্চিত্রকার, বিশ্বে তাঁরও নামডাক হয়েছে। কিয়ারোস্তামির প্রয়াণের পর তিনিও স্বীকার করেন কিয়ারোস্তামির ঋণ। মাখমালবাফ বলেন, আজ ইরানের আধুনিক সিনেমা যে দুনিয়ার বুকে এতটা পরিচিতি পেয়েছে, সেটার গৌরব অনেকটাই কিয়ারোস্তামির প্রাপ্য। তবে পরিতাপের বিষয়, মাখমালবাফ বলছেন, নিজের দেশেই নাকি এই গৌরবের প্রাপ্যটুকু সম্পূর্ণ পাননি কিয়ারোস্তামি। ইরানের অধিকাংশ মানুষই দেখেননি বিশ্ববিখ্যাত, তাদেরই মাটির সন্তান কিয়ারোস্তামির অনেক কাজ। যে মানুষটি দাপুটে হলিউডের উল্টো স্রোতে গিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের চেহারা পাল্টে দিল, নতুন রক্ত সঞ্চালন করল, আরো বেশি মানবিক করে তুলল, সেই মানুষটির কাজই দেখা হয়নি অনেক ইরানি দর্শকের।
কিয়ারোস্তামির মৃত্যুর পরপরই ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মাখমালবাফ বোধহয় সবচেয়ে সঠিক কথাটিই বলেছেন কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে, বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন প্রাণপূর্ণ মানুষ, তিনি জীবনকে যাপন করতে ভালোবাসতেন, আর চলচ্চিত্রও তৈরি করতেন জীবনের মহিমাকীর্তনের জন্য।’ তাই তো এই মানুষটির মৃত্যুকে কোনো শব্দ দিয়ে ঠিক ধরা যায় না- যোগ করেন মাখমালবাফ। তবে যা ধরা যায় তা হলো তাঁর সৃষ্টি। কাব্যিক সৃষ্টি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল কিয়ারোস্তামির সৃষ্টি করা এক চরিত্র- বদি। সেই ‘চেরির স্বাদ’ (১৯৯৭) ছবিতে। বদি কি মৃত্যুকে ছুঁতে পেরেছিল শেষ পর্যন্ত, ঘুটঘুটে অন্ধকারে, বিদ্যুৎ চমকের রাতে? নিজের জন্য খুড়ে নেয়া কবরে শুয়ে আপন মৃত্যুকে যেভাবে বদি আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল, কিয়ারোস্তামি কি দীর্ঘ আঁধারের পর্দা সরিয়ে ছবির কলাকূশলী সমেত আবির্ভুত হয়ে, সিনেমার ভাষায় যাকে বলে চতুর্থ দেয়াল, সেটাকে ভেঙে দর্শকের সামনে এসে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে ঠেলে দিয়ে জীবনকেই প্রতিষ্ঠা করেননি?
১৯৪০ সালে তেহরানে জন্ম নেয়া কিয়ারোস্তামির যাত্রা- অতর চলচ্চিত্রকার হিসেবে- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটু ধীর লয়েই শুরু হয়েছিল। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলায় লেখাপড়া করা কিয়ারোস্তামির পেশাজীবন শুরু হয় গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে। তিনি ইরানি টিভির অনেক বিজ্ঞাপন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি যোগ দেন কানুন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। পুরো অর্থ করলে কানুনের পরিচয় পাওয়া যায়- শিশু ও কৈশোর উত্তীর্ণদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের চলচ্চিত্র বিভাগটির দেখভাল করতেন কিয়ারোস্তামি। এখান থেকেই ছবি বানানোর সূচনা কিয়ারোস্তামির। গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কিয়ারোস্তামি জানিয়েছিলেন, শিশুদের নানা সমস্যা নিয়ে তারা ওই কেন্দ্র থেকে চলচ্চিত্র বানাতেন। শুরুতে বিষয়টি বিশুদ্ধ চাকরি হলেও, পরে এই চাকরিই কিয়ারোস্তামিকে পুরোদস্তুর নির্মাতা হতে সহায়তা করে।
এই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালেই কিয়ারোস্তামি প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, ১৯৭৭ সালে, ‘প্রতিবেদক’। এরপর ইতিহাসের পালাবদল ঘটে ইরানে। ইসলামি বিপ্লব সাধিত হয়, অনেক কিছুতেই নেমে আসে বিধিনিষেধ। এমন দমবন্ধ করা পরিবেশে অনেক নির্মাতাই ইরান ছেড়ে যান। কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে যাননি কিয়ারোস্তামি। নিজেকে তিনি তখন তুলনা করতেন বৃক্ষের সাথে। বলতেন, ‘তুমি যদি গাছকে এক জায়গা থেকে সরিয়ে আরেক জায়গায় নাও, তো সেটি আর ফল দেবে না। আমি যদি দেশ ত্যাগ করি, আমার পরিণতিও হবে গাছের মত।’ তাই দেশে থেকেই ফলদায়ী হওয়ার চেষ্টা করেছেন কিয়ারোস্তামি। সমালোচনা করেছেন বিদ্যমান অনেক কিছুর।
আব্বাস কিয়ারোস্তামি তখন ইরাকের সাথে যুদ্ধ করছে ইরান- এই যুদ্ধের ডামাডোলের ভেতরেই কিয়ারোস্তামি তৈরি করলেন ‘বাড়িরকাজ’ (১৯৮৮)। সেখানে তিনি আধুনিক ইরানি শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করলেন। এরপর ‘কাছের ছবি’র (১৯৮৯) মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে যখন তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তখন মৌলবাদী সরকারের কাঁচি আরো বেশি ধারালো ও বড় হচ্ছিল। শৃঙ্খলিত অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কানুনের চাকরিটা ছেড়ে দেন কিয়ারোস্তামি। তবে ছেড়ে দেননি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তাঁর কাব্যময় মরমী যাত্রা।
এতদিন একটি ছকের ভেতর থেকে ছবি বানালেও ধীরে ধীরে মুক্ত নির্মাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন কিয়ারোস্তামি। তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি বা ত্রয়ীর প্রথম ছবিটি চাকরি করাকালে নির্মাণ করলেও, পরের দুটি ছবি বানান চাকরি ছাড়ার পর। ‘আমার বন্ধুর বাড়ি কোথায়?’ (১৯৮৭), ‘এবং জীবন বয়ে চলে’ (১৯৯২) ও ‘জলপাই গাছ পেরিয়ে’ (১৯৯৪) এই তিন ছবিতেই ধরা দেয় রহস্যময়তা, প্রকৃতির ভয়াবহতা ও সৌন্দর্য। ‘বাতাস আমাদের ভাসিয়ে নেবে’ (১৯৯৯) কিয়ারোস্তামির আরেক কাব্যিক চলচ্চিত্র। ‘বাতাস আমাদের ভাসিয়ে নেবে’- ইরানি কবি ফোরাফ ফারুখজাদের (১৯৩৫-১৯৬৭) একটি কবিতা।
ততদিনে শুধু ইরানে নয়, বিশ্ব দরবারে এক পরিচিত নাম আব্বাস কিয়ারোস্তামি। দেশের বাইরে যতই তাঁর কাজ করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ততই যেন বন্ধ হচ্ছিল ঘরের দুয়ার। মোহাম্মদ আহমাদিনেজাদ ইরানের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে ইরানে চলচ্চিত্র বানানো বেশ জটিল হয়ে পড়ছিল কিয়ারোস্তামির জন্য। তাই তাঁর পরবর্তী দুই ছবি, বলতে পারেন জীবনের শেষ দুটি ছবিই শুটিং করেন ইতালি ও জাপানে- ছবিগুলো হল ‘সত্ত্বায়িত নকল’ ও ‘মনে হচ্ছে কেউ প্রেমে পড়েছে’। এই দুটো ছবিতেও আগের কাব্যিক যাত্রা অব্যাহত ছিল। সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল কেন্দ্রীয় বিষয়। দুটো ছবিই কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
কিয়ারোস্তামি একবারই বিয়ে করেছিলেন, ১৯৬৯ সালে, স্ত্রীর নাম পারভিন আমির-গলি। তবে তাদের বিচ্ছেদ হয় ১৯৮২ সালে। কিয়ারোস্তামির দুই ছেলে- আহমাদ ও বাহমান। আহমাদ প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত আর বাহমান প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
এত সংক্ষেপে কিয়ারোস্তামির মাপের চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আন্দাজ করা সম্ভব নয়, তারপরও সীমার মাঝে অসীমকে ধরার চেষ্টা করে মানুষ, আমরা এর ব্যতিক্রম নই। আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রও এই কাজ করেছে- সীমিত জীবনের ভেতরে অসীম প্রাণপ্রাচুর্যের সন্ধান করেছে- তাই কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রপাঠ চলতে থাক- জীবনের নানা রকম পাঠ সেখানে জারি আছে, তাই।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়