X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-১

ফিরোজ আহমেদ
১৭ জুলাই ২০১৬, ১৫:৩৬আপডেট : ১৮ জুলাই ২০১৬, ১৬:০৭

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-১ তাকে রহস্যময় এবং গোপন ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন এমন মানুষও কম ছিল না। হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে মুখরোচক বহু গল্প যেমন আছে, তেমনি আছে শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রীদের সাথে তার যোগাযোগ নিয়ে প্রচলিত গল্প ও ধারণা। বহু মানুষই বিশ্বাস করতেন তার কাছে কিছু চাইলেই পাওয়া যায়। ৬ দফার প্রণেতা হিসেবে তার নাম আসে

 

‘রাজ্জাক সাহেব ছিলেন প্রকৃতির মতো,’ বলেছিলেন বদরুদ্দীন উমর, তাঁর স্মরণসভায়, কেননা ‘প্রকৃতিতে ঝড়ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বন্যা, ভূমিকম্প যেমন ভালো-মন্দ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই পক্ষপাতহীন, তেমনি তিনি নিজের স্নেহ পক্ষপাতহীনভাবে তাঁর চারপাশের সকলের ওপর বর্ষণ করতেন। তাঁর কাছে কেউ যা কিছু- সে যাই হোক- চাইতেন, তিনি সাধ্যমত পূরণ করতেন। তাঁর সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন ও তাঁর স্নেহ লাভ করেছেন তাঁদের সকলের কাছেই তিনি অবিস্মরণীয়।’*১* ‘তাঁর কোনো বাছ-বিচার ছিল না, তিনি সাজ্জাদ হোসেনরে ভালোবাসতেন- মুনীর চৌধুরী, রবি গুহ ও সরদার ফজলুল করিমকেও ভালোবাসতেন।... আনিস বলেছে, রাজ্জাক স্যারের স্নেহ সূর্যের মতো, সবখানেই পড়ে। যেখানে পড়া উচিত সেখানে পড়ে, যেখানে পড়া উচিত নয়, সেখানেও পড়ে। তাঁর চরিত্রের মেইন দিক হচ্ছে, জ্ঞান তাঁর কাছে খুব প্রিয় ছিল। জ্ঞানীকে নানানভাবে সমাদর করতেন। তাঁর জীবনে আর কোনো কাজ ছিল না। তিনি এসব নিয়েই থাকতেন।’*২* সাক্ষাতকারে বলেছিলেন সরদার ফজলুল করিম।

তাকে ঘিরে যে বলয়টি গড়ে উঠেছিল, সেখানে যেমন ছিলেন মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ কামাল হোসেন, লেখক আহমদ ছফা, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, সরদার ফজলুল করিম, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান, বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান-সহ কয়েকটি দশক ধরে উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল জ্যোতিষ্কই কমবেশি আবর্তিত হয়েছেন। যারা ধূমকেতুর মতো দূর লক্ষ্য পানে সরে গিয়েছেন, তারাও তাঁর আবেশের ফলে নিজ গতিপথে সূক্ষ্ম অথচ দৃশ্যমান ছাপ ধারণ করেছেন।

তাকে রহস্যময় এবং গোপন ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন এমন মানুষও কম ছিল না। হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে মুখরোচক বহু গল্প যেমন আছে, তেমনি আছে শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রীদের সাথে তার যোগাযোগ নিয়ে প্রচলিত গল্প ও ধারণা। বহু মানুষই বিশ্বাস করতেন তার কাছে কিছু চাইলেই পাওয়া যায়। ৬ দফার প্রণেতা হিসেবে তার নাম আসে। মুসলিম লীগ ও জিন্নাহর প্রতি তাঁর ভালোবাসা তিনি কখনোই লুকোবার চেষ্টা করেননি, ফলে সাম্প্রদায়িক তকমাও জুটেছে কখনো কখনো। তাঁর শাস্তি চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করেছে ছাত্রলীগ। আবার বঙ্গবন্ধু তাকে দিয়েছেন জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান। এমন একটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন হাজির করা কঠিন, অথবা, অন্য বিচারে জগতের সকল মূল্যায়নেই নতুন একটি ব্যক্তি নির্মিত হন।

এক.
অধ্যাপক রাজ্জাকের অল্প ক’টি রচনা।*৩* পরিমাণের দিক দিয়ে ওই তালিকা অতি অকিঞ্চিৎকর, সন্দেহ নেই। এগুলোর বাইরে অধ্যাপক রাজ্জাকের পরিচয় বেশ কিছুটা পাওয়া যাবে তার সমকালীন ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণে।
সেগুলোতে অধ্যাপক রাজ্জাকের মতামত, বিশ্বাস কিংবা বিশ্লেষণ প্রতিফলিত (বা হয়তো প্রতিসরিত) হয়েছে। এ ধরনের প্রতিটি রচনায় এক একজন পৃথক ও নতুন অধ্যাপক রাজ্জাক নির্মিত হয়েছেন, প্রতিবার বর্ণনাকারীরাই স্বয়ং ভাস্করের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই সূত্রগুলোর ওপর ভর করে অধ্যাপক রাজ্জাকের কোনো চিন্তাকে বুঝতে যাওয়াটা সম্পূর্ণরূপে কার্যকর কি না, এটা বলা মুশকিল।

বর্ণনাকারী নিজেও বুদ্ধিবৃত্তির জগতে শক্তিমান হলে, বর্ণনার সারবত্তার কতটা হ্রাসবৃদ্ধি হয় তাতে? তাতে বিপদ কখনো বাড়তেও পারে, যেমন প্লেটোর সক্রেটিস চিত্রণকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধরে নেয়া হলেও বিপরীত মতও এসেছে। ‘সক্রেটিসের জীবনোৎসর্গ প্লেটোর কাছে এতই মহৎ একটি কার্য বলে মনে হয়েছিলো যে তাঁর রচনায়, তিনি এক মহিমাময় বিরাট সক্রেটিস নির্মাণ করে থাকতে পারেন। কল্পনাসৃষ্ট এই সক্রেটিসের সাথে প্রকৃত সক্রেটিসের পার্থক্য থাকা আদৌ বিচিত্র নয়। কারণ বিশাল ব্যক্তিত্ব সৃজনের কল্পনাশক্তি প্লেটোর ছিল।’*৪* এভাবে প্লেটো যে সক্রেটিসের চিত্র এঁকেছেন, তা হয়তো লেখকের নিজের স্বাতন্ত্রের গুণেই হয়ে উঠেছে এক নিজস্ব এবং নতুন এক সক্রেটিস। অন্যদিকে স্থুলচিত্তের সৈনিক জেনোফেন সক্রেটিসকে অপবাদ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিভাহীনতার গুণেই হয়তো অন্তত কোনো কোনো ক্ষেত্রে সক্রেটিসকে যথাযথত উপস্থাপন করতে পেরেছেন, এমন যুক্তি দিয়েছেন অনেকেই। আবার বিপরীত সম্ভাবনা ও যুক্তির কথাও বলা হয়েছে, বুদ্ধির স্থুলতার কারণে তিনি হয়তো গুরুকে সামান্যই বুঝেছেন, ফলে নিজের সাধ্যমত সংকীর্ণ চিন্তার খোপে আঁটাতে গিয়ে গুরুর চিন্তাকে বিকৃত কিংবা কাঁটছাট করেছেন, অন্যদিকে প্লেটোর উপস্থাপনায় নিজের সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকলেও হয়তো ব্যক্তিত্ব ও চিন্তার উপস্থাপনা যথাযথ হয়েছে।

এই সব বিতর্কের বাইরেও এই প্রতিফলিত বা প্রতিসরিত প্রতিটি চিন্তারও তো নিজস্ব একটা দাবি আছে, একটা সত্তা আছে। অধ্যাপকের তো অভাব ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আগে-পড়ে, অমন পরশমণি ছিলেন বলেই অধ্যাপক রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসা বক্তিত্বরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন নিজস্ব আয়নায় অধ্যাপক রাজ্জাকের এক একটি ভাস্কর্য নির্মাণে। অজস্র স্মৃতিকথা পড়লে বোঝা যায়, নানান বৈচিত্রের এবং প্রবণতার মানুষের মননে নির্মিত রাজ্জাক সাহেব আসলে তাদের নিজেদেরই স্ব স্ব ব্যক্তিত্বের বিকাশের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অধ্যাপক রাজ্জাকের মুগ্ধ তিন অনুরাগীর আলোচনা ও সাক্ষাতকার থেকে জন্ম নেয়া কিছু অনুভূতি, কিছু মূল্যায়ন ও কয়েকটি খটকা প্রসঙ্গেই আজকের এই রচনা।


১. প্রাক-ব্রিটিশ সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান অধ্যাপক রাজ্জাকের বিশেষ গুণগ্রাহীদের একজন। রাজ্জাক সাহেবকে নিয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লিখেছেন, সাক্ষাতকার দিয়েছেন, বক্তৃতা করেছেন। জীবিত এবং বুদ্ধিবৃত্তির জগতে সক্রিয় যে কজন ব্যক্তির অধিকার ও কর্তৃত্ব আছে অধ্যাপক রাজ্জাকের স্মৃতিচারণ করবার মতো, তিনি নিঃসন্দেহে সেই সংখ্যাল্পদের একজন। অধ্যাপক রাজ্জাকের ভাবনার নানা দিকের ওপর আলোকপাতের জন্য আমরা তার কাছে বিশেষভাবে ঋণী।

সলিমুল্লাহ খানের একটি লেখাতে ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি দিক নিয়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের এই ভাবনার সাক্ষাতটি আমরা পেয়েছি ‘অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সব সময় বলিতেন, ইংরেজরা আসার ৫০০ বছর আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষে যুদ্ধবিগ্রহ ঢের হয়েছে, মাগার একটিও সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ হয় নাই। মানে হিন্দু বনাম মুসলমান যুদ্ধ হয় নাই একটিও। মুসলমান বাহিনিতে হিন্দু সেনাপতি আর হিন্দু বাহিনিতে মুসলিম সেনাপতি থাকাই ছিল প্রায় নিয়ম। সেই সময় যাহারা বিদেশ হইতে আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা বিদেশি পরিচয়েই আসিয়াছিলেন। বিদেশ হইতে আসিয়া তাঁহারা এই দেশেই থিতু হইয়াছিলেন।’*৫*

ইংরেজরা আসার আগে ৫০০ বছরের মাঝে (১২৫৭-১৭৫৭) সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের অনুপস্থিতির এই দাবিটি কৌতুহল উদ্রেক করে। আরেকটি সাক্ষাতকারে সলিমুল্লাহ খান আবারো অধ্যাপক রাজ্জাকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই বিষয়ে তাঁর স্মৃতিকে পুনর্ব্যক্ত করেন : ‘(অধ্যাপক রাজ্জাক) বই পড়ার ক্ষেত্রে আরেকটা বই পড়ার কথা বললেন, সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন। বাংলাদেশের ইতিহাস যদি জানতে চান তাহলে এই বইটা পড়বেন। ৫০০ বছরের ইতিহাস লেখা আছে। বৃটিশরা যে বছর ভারতের ক্ষমতা দখল করেছে তার আগের ৫০০ বছরের ইতিহাস লেখা আছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন, ব্রিটিশরা যেটাকে সাম্প্রদায়িকতা বলছে, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ বলছে, যার ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলো, সেই জিনিসটা কিন্তু ব্রিটিশ আসার আগে এ দেশে ছিল না। প্রমাণ কি? সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন বইটা পড়বেন।’*৬*

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, এই ধারণকৃত সাক্ষাতকারটিতেও অধ্যাপক রাজ্জাকের সেই মহৎ ব্যক্তিত্বটি ধরা পড়বে, যিনি একজন প্রায় অচেনা অথচ উৎসাহী, ছাত্রাবাস নিবাসী শিক্ষার্থীকে মূল্যবান গ্রন্থ পড়তে দিয়েও উদ্বেগহীন থাকতে পারেন। সলিমুল্লাহ খানের এই সাক্ষাতকারটিতে এই শ্রদ্ধা ও ভালবাসার স্বীকৃতিটুকু যথাযথভাবেই এসেছে, এবং এই নতুন নতুন বইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ও বই ধার দেয়ার গুণটুকুর সকৃতজ্ঞচিত্তে উল্লেখ সরদার ফজলুল করিম-সহ তার নিকটবর্তী হওয়া অনেকের রচনায় পাওয়া যাবে। আমরা প্রাক-ব্রিটিশ আমলে সাম্প্রদায়িকতার অনুপস্থিতি বিষয়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের মতামত বিবেচনা করার সুযাগও এই সাক্ষাতকারটির সৌজন্যে পেলাম, এই কারণেই এই সাক্ষাতকারটি বিশেষ মূল্যবান হয়ে থাকবে।

চলবে...






টিকা-
১. অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের স্মৃতি, বদরুদ্দীন উমর, আবদুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ : পৃষ্ঠা ৮৫
২. মোহাম্মদ আলীর নেয়া ‘সাক্ষাৎকারে সরদার ফজলুল করিম : বিষয় অধ্যাপক আবুদর রাজ্জাক’ বিডিআর্টস, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। উল্লেখিত আনিস হলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
৩. অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থে এই অল্পকটি রচনা ও বক্তৃতারও নাম এবং সময় যথাযথভাবে তালিকাবদ্ধ করা হয়নি। এই কাজগুলোর মাঝে আছে তাঁর অসম্পূর্ণ পিএইচডি থিসিস ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া’, অল্প ক’জনের সৌভাগ্য হয়েছে সেটির অনুলিপি পাঠ করার। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ‘প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক অন ইন্ডিয়া’স পার্টিশন অ্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেনস’ শীর্ষক (প্রকাশকাল : ৮ মার্চ ২০১৫) একটি প্রবন্ধে জানিয়েছেন তিনি সেই ভাগ্যবানদের একজন। একটি প্রবন্ধের নাম ‘দি মাইন্ড অব দি এডুকেটেড মিডল ক্লাস ইন দি নাইনটিনথ সেঞ্চুরি’, প্রকাশিত হয়েছিল নিউ ভ্যালুজ, ৯ম ভল্যুম, সংখ্যায়, ১৯৫৭। একটি প্রবন্ধের নাম মিলিটারি ইন পাকিস্তান, এটি তিনি পাঠ করেছিলেন হার্ভাডে ১৯৬০ সালে । অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় যে, প্রবন্ধটি সাথে না নিয়েই তিনি দেশে ফিরে আসেন, এটি আর উদ্ধার করা যায়নি। স্মারকগ্রন্থে ১১৯ পৃষ্ঠায় স্মৃতিচারণে আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘তাঁর মূল বক্তব্য নাকি ছিল এই যে, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি হলে উন্নয়নশীল দেশে সামরিক শাসনের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং প্রতিরক্ষা-বরাদ্দ একেটা মাত্রা অতিক্রম করলে সামরিক শাসন অবশ্যই প্রবর্তিত হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।’ এর বাইরে আরেকটি বক্তৃতার কথা উল্লেখিত আছে সরদার ফজলুল করিমের সাথে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’ নামের তাঁর সাক্ষাতকারের গ্রন্থটির ১০৫ পৃষ্ঠায়। এই বক্তৃতাটি দেয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সম্মেলনে, ১৯৭০ সালে। বক্তৃতাটির নামটি গ্রন্থটিতে উল্লেখ নেই, তবে বিষয়বস্তু সম্পর্কে রাজ্জাক সাহেব ওই সাক্ষাতকারটিতে জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনির ক্রমবর্ধমান শক্তি অনুন্নত দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে যেভাবে সীমাবদ্ধতার মাঝে ফেলে, তাই নিয়ে ওইদিন তিনি আলোচনা করেছিলেন। এর বাইরে স্মারকগ্রন্থে প্রকাশের তারিখ ছাড়া উল্লেখ আছে ‘এ নোট অন ডেভলপমেন্ট প্লানিং ইন পাকিস্তান’ নামের আরেকটি রচনা। এর বিষয়বস্তুও একই, সামরিক বাহিনি ও রাষ্ট্র ও পরিকল্পনা। এছাড়া আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস, ১৯৮৫ সালে প্রধান অতিথির বক্তৃতা; ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমিতে প্রদত্ত ‘ভাষা, শ্রেণি ও সমাজ’ নামে একটি বক্তৃতা এবং ১৯৮৬ সালে সেলিনা হোসেন ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত একুশের স্মারকগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত একুশের আলোচনা-সভায় সভাপতির ভাষণ।
৪. সক্রেটিসের সকল জীবনীকারই এই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলায় এই বিষয়ক আলোচনার জন্য দেখুন হাসান আজিজুল হক রচনাসমগ্র, তৃতীয় খণ্ডভুক্ত ‘সক্রেটিস’ গ্রন্থটি। সাধারণভাবে বলতে গেলে সৈনিক জেনোফেন সক্রেটিসকে অপবাদ মুক্ত করতে চেয়েছেন নিজের বিচারবুদ্ধি মোতাবেক, এবং গুরুত্ব দিয়েছেন মানুষ হিসেবে সক্রেটিসের পরোপকার, বুদ্ধিমত্তা ও পরামর্শদাতা এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর। অন্যদিকে দার্শনিক প্লেটো তাঁর রচনায় চেয়েছেন চিন্তার সক্রেটিসীয় পদ্ধতিটিকে ফুটিয়ে তুলতে, হতেও পারে সেটা প্লেটোর নিজ কল্পনার সক্রেটিস।

৫. সলিমুল্লাহ খান; ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধ, দৈনিক বণিক বার্তা, শনিবার, অক্টোবর ২০, ২০১২, কার্তিক ৫, ১৪১৯ সংখ্যা। পাঠকের কাছে এই প্রবন্ধটি হয়তো সলিমুল্লাহ খানের মানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ঠেকবে, কেননা এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের উক্তি হিসেবে উদ্ধৃতচিহ্নযুক্ত এমন কিছু বাক্য রয়েছে, যা রবীন্দ্রসমগ্রে পাওয়া দুষ্কর হবে। যেমন, ‘প্রথমেই দেখা যাউক, ভারতবর্ষের ইতিহাসকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিভাবে দেখিয়াছেন। ইংরেজি বিশ শতকের গোড়ার দিকে লিখিতে বসিয়া ভারতবর্ষের ইতিহাসের অব্যবহিত আগেকার সাতশত বছরকে ঠাকুর ‘বিদেশি শাসন’ বলিয়া রায় দিয়াছেন। ব্রিটিশ মহাজনেরা ততদিনে প্রায় দেড়শত বছর এই উপমহাদেশ শাসন করিয়াছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যখানে শুরু ধরিলে হিসাব তাহাই দাঁড়ায় বৈ কি! এর আগের সাড়ে পাঁচশত বছরের মুসলিম শাসনকেও রবীন্দ্রনাথ ‘বিদেশি শাসন’ বলিতেছেন। সমস্যার গোড়া এই জায়গায়। ভারতবর্ষ যে মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল বিদেশাগত হইলেও তাহারা মনেপ্রাণে ভারতবর্ষীয় হইয়া গিয়াছিলেন। ব্রিটিশ শাসকশ্রেণি এই সত্য অস্বীকার করিতেন। ভারতে ব্রিটিশ প্রবর্তিত সাম্প্রদায়িকতার মূলে ছিল সরকারের এই নীতি... সাম্প্রদায়িকতা শব্দটিও ঔপনিবেশিক শাসনের জের। প্রমাণস্বরূপ দুইটি কথা উল্লেখ করা যায়। এখন ভারতের ‘ইতিহাস ব্যবসায়ী’দের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সংখ্যাই বেশি। তাঁহারা সাড়ে পাঁচশত বৎসরের মুসলিম শাসনকে বিদেশি শাসনই মনে করেন। সাম্প্রদায়িকতার গোড়া এই জায়গায়। আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে ছুঁইয়া কথা বলিবেন না। সত্যকে স্বীকার করিবেন না। ঘটনার মূলে যাইবেন না। তাঁহারা ভারতের ইতিহাস সাম্প্রদায়িকভাবে পড়িবেন ও লিখিবেন। সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে থাকার মূল কারণ এইখানেই পাওয়া যায়।’ অথচ যে কোনো সন্ধানী পাঠক রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠে দেখতে পাবেন, রবীন্দ্রনাথ মোঘলদের বারংবার এদেশীয় বলেই উল্লেখ করেছেন। ফলে, এই প্রবন্ধে উত্থাপিত অভিযোগটি অসার ও ভিত্তিহীন, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
৬. ব্রাত্য রাইসুর নেয়া ১৬, ২০১৪ তারিখে ইউটিউবে প্রকাশিত সলিমুল্লাহ খানের সাক্ষাতকার। বর্তমানে এটি ইউটিউবে প্রদর্শিত না হলেও বর্তমান লেখক ব্রাত্য রাইসুর কাছ থেকে সাক্ষাতকারটি সংগ্রহ করেছেন। সাক্ষাতকারটিতে সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন-এর লেখকের নামও অসাবধানে ভুল করে গোলাম হোসায়ন সলিম বলা হয়েছে, গ্রন্থটির লেখক আদতে সৈয়দ গোলাম হুসায়ন খান তাবতাবায়ী।


অলঙ্করণ : মোস্তাফিজ কারিগর

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
রাজধানী স্থানান্তর করছে ইন্দোনেশিয়া, বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে জাকার্তা
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে