X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর

বিধান রিবেরু
৩০ জুলাই ২০১৬, ১২:২৫আপডেট : ৩০ জুলাই ২০১৬, ১৩:৩০

ইঙ্গমার বারিমানের ও উডি অ্যালেন বিশ্বচলচ্চিত্রে এতএত অসাধারণ রূপালি দৃশ্য উপহার দেয়া ইঙ্গমার বারিমান জন্মগ্রহণ করেন ১৪ জুলাই, ১৯১৮ সালে, সুইডেনের উপসালায়। আর দেহত্যাগ করেন, সুইডেনের ফারোতে, ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই। বেঁচে থাকার কালে তিনি মঞ্চের জন্য লিখেছেন, টেলিভিশন প্রযোজনার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছেন চলচ্চিত্রে এক সরল বয়ানের ভেতর গভীর জীবনদর্শন গেঁথে দেয়ার জন্য। আর বড় পর্দায় দৃশ্যধারণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ধ্রুপদি পর্যায়ে। প্রতিভাবান এই পরিচালক কিন্তু অনেক নির্মাতাকেই করেছেন প্রভাবিত। তাঁর প্রভাব বলয়ে থাকা একজন প্রখ্যাত পরিচালকের নাম উডি অ্যালেন। বারিমানের মৃত্যুর পর উডি অ্যালেনের নাম জুড়ে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গে, এর কারণ ভীষণভাবেই বারিমান প্রভাবিত ছিলেন অ্যালেন

কফিনের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করার মতো ‘বাস্তব’ হাজির হয়েছিল বৃদ্ধ প্রফেসর আইজাক বর্গের স্বপ্নে। এমন অবিস্মরণীয় এক দৃশ্য আমরা দেখি ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস’ নামের এক চলচ্চিত্রে। নির্মাতার নাম ইঙ্গমার বারিমান (Ingmar Bergman)। তাঁকে চেনা শুরু ঐ ছবি দিয়ে। এরপর মুগ্ধ হয়েছি ‘সেভেন্থ সিল’ দেখে। মৃত্যুর নাচন দিয়ে সিগনেচার দৃশ্যপট রচনা করেন তিনি ঐ ছবিতে। বিশ্বখ্যাত সুইডিশ এই নির্মাতার এরপর বহু ছবি দেখেছি আর মুগ্ধতা বেড়েছে।
‘দ্য সাইলেন্সে’ দুই বোনের সম্পর্কের টানাপোড়েন। ‘অটাম সোনাটা’র মধ্যে ধরা পড়ে বিখ্যাত পিয়ানোবাদক মা আর অবহেলিত মেয়ের টানাপোড়েন। আর সুররিয়ালিস্ট ধারার ছবি ‘আওয়ার অব দ্য উল্ফ’ দেখে রীতিমত বিস্মিত হয়েছিলাম। হারিয়ে যাওয়া স্বামীর কথা বলতে বলতে এক স্ত্রী আমাদের নিয়ে যান গা ছমছম করা গল্পের ভেতর। ‘উইন্টার লাইট’ ছবিতে বারিমান আমাদের নিয়ে যান এক পুরোহিতের অস্তিত্বের সংকটে। একদিকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের টান অন্যদিকে কামনা বাসনা।
‘পারসোনা’ ছবিতে বিবি এ্যান্ডারসন আর লিভ উলম্যান অভিনয় করেছিলেন সেবিকা ও রোগীর ভূমিকায়। অসাধারণ অভিনয়ের পাশাপাশি বারিমানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনার কারণে ছবিটি আমার মনে গেথে আছে। দুই নারীর সম্পর্ক নিয়ে বারিমান খেলা করেছেন, স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝামাঝি থেকে। ‘দ্য ম্যাজিক ফ্লুয়েটে’ মঞ্চকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন বারিমান সেটা যে কোন নির্মাতাকেই অনুপ্রাণীত করবে। এমনি আরো কতকত মুগ্ধ করা ছবি যে তাঁর আছে! ‘স্মাইলস অব সামার’, ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’, ‘ফ্যানি এ্যান্ড আলেক্সান্দার’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিশ্বচলচ্চিত্রে এতএত অসাধারণ রূপালি দৃশ্য উপহার দেয়া ইঙ্গমার বারিমান জন্মগ্রহণ করেন ১৪ জুলাই, ১৯১৮ সালে, সুইডেনের উপসালায়। আর দেহত্যাগ করেন, সুইডেনের ফারোতে, ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই। বেঁচে থাকার কালে তিনি মঞ্চের জন্য লিখেছেন, টেলিভিশন প্রযোজনার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছেন চলচ্চিত্রে এক সরল বয়ানের ভেতর গভীর জীবনদর্শন গেঁথে দেয়ার জন্য। আর বড় পর্দায় দৃশ্যধারণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ধ্রুপদি পর্যায়ে। প্রতিভাবান এই পরিচালক কিন্তু অনেক নির্মাতাকেই করেছেন প্রভাবিত। তাঁর প্রভাব বলয়ে থাকা একজন প্রখ্যাত পরিচালকের নাম উডি অ্যালেন। বারিমানের মৃত্যুর পর উডি অ্যালেনের নাম জুড়ে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গে, এর কারণ ভীষণভাবেই বারিমান প্রভাবিত ছিলেন অ্যালেন।
মার্কিন নাট্যকার, অভিনেতা ও চিত্রনির্মাতা উডি অ্যালেন “টেক মানি এ্যান্ড রান”(১৯৯৬) থেকে হালের “ম্যাজিক ইন দ্য মুনলাইট” (২০১৪), ধারাবাহিকভাবেই নিজের কাজের মাধ্যমে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন, কিন্তু এরই ফাঁকে অস্তিত্ত্বের সঙ্কট ও আধুনিক জীবনের অসাড় জায়গাগুলোও তুলে ধরেছেন সূক্ষ্মভাবে।
মার্ক্স ভাইদের* কাজ ছাড়াও অ্যালেনের কাজে অতর পরিচালক ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব চোখে পড়ার মতো। অ্যালেনের উপর বারিমানের ১০টি প্রভাব নিয়ে টেস্ট অব সিনেমায় লিখেছেন রিচার্ড ইনো। রিচার্ডের লেখাটিই এখানে ভাবানুবাদ করা হলো।


১. সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ/ সিন্স ফ্রম আ মল
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর ১৯৭৩ সালে বারিমানের লেখা ও পরিচালিত একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয় টেলিভিশনে (পরে সম্পাদনা করে এটি চলচ্চিত্রও হয়), নাম: “সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ”। মধ্যবয়স্ক এক সুইডিশ দম্পতির সংসার ভাঙার গল্প নিয়ে তৈরি হয় এটি। লিভ উলম্যান ও অ্যারলেন্ড যোসেফসনের অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দীর্ঘ দাম্পত্যের সম্পর্ককে দেখার সুযোগ পান। সেখানে দেখানো হয় সংসার জীবনে মধ্যবয়স্ক নরনারীর পরস্পরের প্রতি কতটুকু প্রেম অবশিষ্ট রয়েছে, সেটি।
চলচ্চিত্রের অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় ক্লোজআপ আর দীর্ঘশট, সেখানে চরিত্ররা মগ্ন হয়ে স্বগতোক্তি করছে আবার কখনো ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছে নিজস্ব গভীর আবেগ নিয়ে। এসব দৃশ্যের সঙ্গে নিজের রোমান্টিক অভিজ্ঞতার কোথাও না কোথাও মিল আপনি পাবেন আর এমন চলচ্চিত্র দেখা এক মগ্ন অভিজ্ঞতাও বটে। বারিমান ২০০৩ সালে এই চলচ্চিত্রের একটি সিক্যুয়াল রচনা ও পরিচালনা করেন- এটি ছিলো পরিচালনায় তাঁর শেষ চেষ্টা- নাম “সারাবান্দ”, যেখানে “সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ” চলচ্চিত্রের চরিত্ররা আবার ফিরে আসে।
এটা ঠিক “সিন্স ফ্রম আ মল” ছবিতে উডি অ্যালেন শুধু অভিনয়ই করেছেন। আর এর চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা করেছেন পল মাজরুস্কি। ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়া কমেডি এই চলচ্চিত্রে অ্যালেনের সহশিল্পী ছিলেন বেত মিডলার।
ছবির গল্পটি এমন- নিক ফিফার (অ্যালেন) ও ডেবোরাহ ফিফার (মিডলার) দুজন মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বামী স্ত্রী, তাদের সন্তান আছে এবং ধীরে ধীরে তারা প্রবেশ করছে মধ্যবয়সে। চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় এক ছেলে কলেজে যাচ্ছে এবং অন্য দুজন কেনাকাটা করতে শপিংমলে যাচ্ছে। দিন যত গড়ায় ততই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয় এই দুই নরনারীর ভেতরকার দাম্পত্য সম্পর্কে টানাপোড়েন বিদ্যমান। আর ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক কোথায় যাবে সেটা নিয়েও তারা নিশ্চিত নয়।
পুরো ছবিতেই দুই বর্ষীয়ান অভিনেতার সংলাপ আমরা দেখি, অনেকটা বারিমানের “সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ” ছবির মত। মাজুরস্কির এই ছবিতেও বারিমানের ছবির মতো দাম্পত্য সম্পর্কের ফাটল তুলে ধরা হয়। কিন্তু মাজুরস্কির এই ছবিকে বারিমানের ছবির শুধু কমেডিক ভার্সন নয়, তার থেকেও বেশি কিছু। যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে এই যুগল সময় পাড় করে সেটা আমাদেরই অতিচেনা বাস্তবতা কিন্তু এর মাঝেই যোগ হয় হাস্যরস।
বারিমানের “সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ” আপনাকে উডি অ্যালেনের “হাজব্যান্ডস এ্যান্ড ওয়াইভস” (১৯৯২) ছবির কথাও মনে করিয়ে দিতে পারে। পরিচালনা ছাড়াও চিত্রনাট্য রচনা ও এ ছবিতে অভিনয়ও করেছেন অ্যালেন। “হাজব্যান্ডস এ্যান্ড ওয়াইভস” নারী ও পুরুষের সম্পর্কের এক জটিল গল্প নিয়ে নির্মিত। ক্যামেরা পরিচালনায় প্রামাণ্যচিত্রের একটা ঢং থাকলেও বারিমানের চলচ্চিত্রের আভাস এই ছবিতে দেখা যায়।


২. পারসোনা/ লাভ এ্যান্ড ডেথ
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর অ্যালেনের ক্যারিয়ার ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় তিনি ইঙ্গমার বারিমানের গুণমুগ্ধ একজন পরিচালক। বিষয়টি পরিষ্কার হবে ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া “লাভ এ্যান্ড ডেথ” চলচ্চিত্রটি দেখলে।
“লাভ এ্যান্ড ডেথ” ছবিটি দস্তয়ভস্কির উপন্যাস ‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’, ‘দ্য ব্রাদারস কারামাজভ’ ইত্যাদির ব্যাঙ্গ। অ্যালেনের এই ছবির সঙ্গে বারিমানের “পারসোনা” চলচ্চিত্রের বেশ মিল পাওয়া যায়, বিশেষ করে ভিজুয়াল স্টাইলের দিকটায়। “পারসোনা” বারিমানের ১৯৬৬ সালের ছবি, এই ছবি সিনেমা জগতে সাইকোলজিকাল ড্রামা হিসেবে শুধু পরিচিতই নয়, একে বলা হয় মানুষের মৃত্যু, মৃত্যুভাবনা ও বেদনা নিয়ে এক ওস্তাদি (মাস্টারপিস) কাজ। শুধু তাই নয়- রং, আলো ও স্থানের নান্দনিক ব্যবহারের জন্যও এই চলচ্চিত্র সমালোচকদের নজর কেড়েছে।
“পারসোনা” চলচ্চিত্রের চমকে ওঠার মত দৃশ্য (স্ট্রাইকিং ভিজুয়াল আসপেক্ট) হল একই ফ্রেমে দুই প্রধান চরিত্রের (প্রোটাগনিস্ট) প্রবেশ। আর এই দুই মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুই বিখ্যাত অভিনেত্রী- একজন সুইডিশ অভিনেত্রী বিবি এ্যান্ডারসন ও অন্যজন লিভ উলম্যান। এই ফ্রেমিং কৌশল পুরো চলচ্চিত্রে দুই চরিত্রের সমান্তরাল চলনকে এক অনন্য গুরুত্ব দান করে। এবং গল্পকে এগিয়ে নিতেও এই কৌশল বর্ণণা করার ফিকির বা ন্যারেটিভ ডিভাইস হিসেবে মতো কাজ করে। তো এই কৌশল দিয়ে একটি বয়ান দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখা যায় দুই নারী স্ক্রিনের জায়গা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে এবং স্বতন্ত্র ফ্রেমিং ও ডিজলভ ট্রানজিশনের মাধ্যমে ধীরভাবে কাহিনী এগিয়ে যায়।
প্রায় দশ বছর পর উডি অ্যালেন বানান এক রুশ প্রহসনের দ্বারা অনুপ্রাণিত চলচ্চিত্র “লাভ এ্যান্ড ডেথ” কিন্তু প্রভাব কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আগেই বলেছি শুধু এই ছবি কেন অন্যান্য আরো অনেক জায়গাতেই বারিমানের প্রভাব স্পষ্ট। অ্যালেনের এই ছবির শেষদিকে দেখা যায় এখানেও দুই চরিত্র “পারসোনা” ছবির মত একই রকম ফ্রেমে বন্দী হচ্ছেন।
এটা অবশ্যই অ্যালেন হুট করে করেননি। অ্যালেনের দুই চরিত্র যখন কথা বলে তখন সম্পাদনা রীতি দেখলেই বোঝা যায় সেখানে কাট, ট্রানজিশন ইত্যাদি “পারসোনা”র মতোই। “লাভ এ্যান্ড ডেথ” চলচ্চিত্রে মজা করা হলেও এটি বারিমানের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই বলা যায়, প্যারোডি নয়।


৩. ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপার্স/ ইন্টেরিয়র্স
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর ১৯৭৭ সালে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র “অ্যানি হল”-এর বিস্ময়কর সাফল্যের পর ১৯৭৮ সালের গ্রীষ্মে নতুন এক কাজ শুরু করলেন উডি অ্যালেন, এই কাজই পরে বাস্তবে রূপ নিলে নাম হয় “ইন্টেরিয়র্স”, এটিই অ্যালেনের প্রথম পূর্ণ আঙ্গিকের ড্রামা ফিল্ম। এই চলচ্চিত্রে যে ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের এক বিষণ্ণ গল্প আছে, আত্মহত্যার প্রবণতা ও মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন আছে, সেগুলোর সবটাই অনেক বেশি বারিমান-সুলভ, কি বিষয়ের দিক থেকে, কি দৃশ্য নির্মাণের দিক থেকে। কাজেই সুইডিশ ওস্তাদের প্রথমদিককার কাজ ‘ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপার্সে’র সঙ্গে অ্যালেনের এই কাজের তুলনা চলে আসে এমনিতেই।
এমনকি পোস্টারে, যেখানে দেখা যায় সাদাকালো ফ্রেমে চলচ্চিত্রের চরিত্ররা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, যেন ঐ ঘরের মনস্তাত্ত্বিক কারাগারে তারা বন্দি- এমন দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় বারিমানের চলচ্চিত্রে নানা কৌশলী ফ্রেমকে। দেখতে যেন অনেকটা “পারসোনা” বা “ক্রাইস অ্যান্ড হুইপার্স” ছবির কোনো দৃশ্য, যেখানে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে কোনো নারী তাকিয়ে আছে দূরে কোথাও, সে গভীরভাবে ভাবছে আত্মহত্যার নৈতিকতা আর মানুষের ভঙ্গুর অবস্থার কথা।
“ইন্টেরিয়র্স” মুক্তির পর বেশ ইতিবাচক সাড়া জাগিয়েছিলো, আর এতে হাফ ছেড়েছিলেন অ্যালেন। কারণ তিনি মনে করছিলেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য এই ড্রামা বাণিজ্যিকভাবে সফল তো হবেই না, পাশাপাশি অ্যালেনের কাজের যারা ভক্ত তারাও হতাশ হবেন।


৪. দ্য সেভেন্থ সিল/ ডেথ নকস
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর অ্যালেনের একাঙ্কিকা ‘ডেথ নকস’ হলো বারিমানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ ছবির প্রহসনমূলক প্যারোডি। অ্যালেনের সংস্করণে মৃত্যু আসে ন্যাট অ্যাকারম্যানের ঘরে। অ্যাকারম্যান একজন মধ্যবয়স্ক পোশাক নির্মাতা, রাত যত ঘনিয়ে আসে ততই তার ঘুম উবে যায়, এমন সমস্যা নিয়েই ভদ্রলোক লড়াই করছে।
মৃত্যুকে, পরকালের পৌরাণিক চরিত্রের পোশাক পরিচ্ছদের রীতি মেনেই, কালো আলখেল্লায় ঢেকে দেন অ্যালেন। নাটকে দেখা যায় এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা শেষে অ্যাকারমেনের কক্ষে এসে হাজির হয় মৃত্যু। এরপর বাকি নাটকেই দর্শক দেখতে পান দুই অসম চরিত্র জীবন ও মৃত্যুর প্রকৃতি নিয়ে আলাপ করছে। নিজের কর্তব্যের প্রতি উদাসীন মৃত্যুর কথা শুনে ন্যাট অ্যাকারম্যান ধীরে ধীরে হতবুদ্ধি বনে যায়।
বারিমানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ ছবিতে বলা হয় মধ্যযুগের এক নাইটের কাহিনী, এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ম্যাক্স ভন জিডো, তিনি জীবন ও মৃত্যুর অর্থ খোঁজেন স্বয়ং মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলতে খেলতে। বারিমানের এই আইকনিক ছবির প্রতি কে না আকৃষ্ট হয়েছেন- সিরিয়াস কিম্বা কমেডিক চলচ্চিত্র নির্মাতা- সকলেই ঋণী এই ছবির কাছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ১৯১৯ সালের কমেডি “বিল অ্যান্ড টেড’স বোগাস জার্নি” চলচ্চিত্রের কথা। সেখানে চরিত্রগুলো মৃত্যুর মুখোমুখি হয় এবং সেসময় তারা নিজেদের আত্মার জন্য দাবা খেলার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এবং জটিল এই খেলায় মৃত্যু পরাজিত হয়।
‘ডেথ নকস’ নাটকে ন্যাট ও মৃত্যু দাবা খেলার বদলে তাস খেললেও প্যারোডিটা পরিষ্কারভাবেই ধরা যায়। মৃত্যু যেমন, তাকে তেমনভাবেই গ্রহণ করার বদলে এখানে ন্যাট সরাসরি তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। আর শুরুতে তো ন্যাট বিশ্বাসই করতে চায় না যে ঘরে অতিথি হয়ে এসেছেন স্বয়ং যমদূত! দৃশ্যের এক পর্যায়ে ন্যাট মৃত্যুকে বলে, “আমি সবসময়ই ভাবতাম তুমি বোধহয় আরো লম্বা হবে”। যমে মানুষের এই তাস খেলায় অবশ্য শেষপর্যন্ত ন্যাটই জয়ী হয়। আর এই জেতার সুবাদে সে আরো একটি দিন বেশি পায় বেঁচে থাকার জন্য। ন্যাট মৃত্যুকে বলে তাকে আবার ফিরে আসতে হবে, কিন্তু মৃত্যুর কাছে কোনো পয়সা নেই, তাই কোনো হোটেল কক্ষ ভাড়া নেয়াও তার পক্ষে সম্ভব না।
শেষ পর্যন্ত দুজন ঐকমত্যে পৌঁছায় মৃত্যু আরেকদিন আবার আসবে এই সুযোগে দুটো পয়সাও রোজগার করে নেয়া যাবে। এই নাটিকাটি শেষ হয় এমনভাবে যে মৃত্যু ন্যাটের জান কবজ করতে আর ফিরে আসে না। মৃত্যুর প্রস্থানের পর ন্যাট তার বন্ধু মোকে ফোন দেয়: “হ্যালো, মো? আমি। শোনো, আমি বুঝতে পারছি না কেউ কি আমার সঙ্গে মশকরা করলো কি না! কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও মৃত্যু এখানে ছিলো। আমরা তাসও খেললাম ... নো ডেথ। সামনাসামনি। যে খেললো সে নিজেকে মৃত্যু বলেই পরিচয় দিলো। কিন্তু মো তোমাকে কি আর বলবো, লোকটা আসলে একটা যাচ্ছে তাই!”


৫. সেন নিকিস্ট: সিনেমাটোগ্রাফার
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর সেন নিকিস্ট সুইডেনের সিনেমাটোগ্রাফার। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁকে অনেকেই অন্যতম বড় ও প্রভাব বিস্তারকারী ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি হিসেবে মান্য করেন। ইঙ্গমার বারিমানের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত অনেক কাজ রয়েছে, যেমন- ‘ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপার’, ‘পারসোনা’, ‘অটাম সোনাটা’ এবং বারিমানের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র, পাঁচ ঘন্টার এপিক, ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেক্সান্দার’।
এদিকে ১৯৮০ সালের দশকে অ্যালেন যখন নিজের চলচ্চিত্রে ড্রামাটাকে বেশ পোক্ত করে আনতে চাচ্ছিলেন তখন ডাক পড়লো নিকিস্টের। সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত অ্যালেনের কমেডি/ড্রামা ‘ক্রাইমস অ্যান্ড মিসডেমিন্যুরস’ চলচ্চিত্রে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন নিকিস্ট। বলা বাহুল্য নয়, নিকিস্ট যেহেতু বারিমানের সঙ্গে কাজ করেছেন তাই তাঁর সূক্ষ্ম নন্দনতাত্ত্বিক আবেগের সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন নিকিস্ট আর সেই বোধ নিয়েই তিনি অ্যালেনের ছবিতে কাজ করেছেন এবং এর ফলাফল ছিলো মুগ্ধ হওয়ার মতো।
একটি বিষয় লক্ষ্য না করে পারা যায় না, সেটি হলো তৎকালের সবচেয়ে মেধাবী সিনেমাটোগ্রাফার নিয়ে কাজ করলেও ‘ক্রাইমস অ্যান্ড মিসডেমিন্যুরস’ অ্যালেনের গল্প বলার রীতি অনুযায়ীই অগ্রসর হয়েছে। পাশাপাশি তাঁর পুরনো ক্লাসিক ‘অ্যানি হল’ এবং ‘ম্যানহাটন’ ছবির একটা ধারাবাহিকতা যেমন দৃঢ়ভাবে এই কাজে চোখে পড়বে তেমনি একধরনের নতুন ভঙ্গিও চোখ এড়াবে না।
‘ক্রাইমস অ্যান্ড মিসডেমিন্যুরস’ যে অ্যালেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সমালোচকপ্রিয় চলচ্চিত্র হয়েছে সেটাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ছবির কাহিনী বিন্যাস দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’কে অনুসরণ করেছে বেশ ভালোভাবেই। তবে এই কাজে আবেগঘন পরিবেশ, মৃত্যু, মরণশীলতা ইত্যাদি কিন্তু বারিমানের ‘ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপার্স’ ছবিরই প্রতিধ্বনি।
সেন নিকিস্ট শুধু অ্যালেন নন অন্য বিখ্যাত অতর পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন, যেমন- রাশিয়ার পরিচালক তারকোভস্কির সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’ চলচ্চিত্রে। নোরা এফ্রনের ‘স্লিপলেস ইন সিটল’ ছবিতেও কাজ করেছেন তিনি।


৬. মার্শাল ম্যাকলুহান/ ইঙ্গমার বারিমান
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর ‘অ্যানি হল’ ছবির একটি বিখ্যাত দৃশ্য আছে, সেখানে আলভি সিঙ্গারের ভূমিকায় অ্যালেন নিজের গার্লফ্রেন্ড অ্যানির সঙ্গে তর্ক করছে। তর্কের বিষয় তাদের সম্পর্ক। এরই মধ্যে একজন বাগাড়ম্বর দাম্ভিক শিক্ষক নিজেকে জাহির করছিলেন ওদের সামনে। তিনি রোমান্টিক জুটিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিলেন ফেলিনি সম্পর্কে বকবক করে।
চলচ্চিত্রে উডি অ্যালেনের চরিত্রটি হুট করেই, নিরুপায় হয়ে, ক্যামেরার দিকে ফেরে আর ঐ শিক্ষক সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করে- ‘কি যে উনি বলছেন তা উনি নিজেই জানেন!’ অ্যালেন এমন এক সময় এই ভঙ্গি করেন যখন দাম্ভিক শিক্ষক, সংস্কৃতি বিষয়ক সমালোচক ও কথক মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘গণমাধ্যম হল বার্তা’ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান ঝাড়ছিলেন।
অ্যালেনের চরিত্রটি অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। সে ঐ লোককে বুঝাতে চায় যে তিনি ম্যাকলুহান সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আর এটা প্রমাণের জন্য সত্যিকারের ম্যাকলুহানকেই ঐ লোকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন অ্যালেন। অনেকেই হয় তো জানেন না, উডি অ্যালেন প্রথমে ম্যাকলুহানকে নয়, এই দৃশ্যের জন্য নির্বাচন করেছিলেন ইঙ্গমার বারিমানকে।


৭. মৃত্যু
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর সুইডেনের নিজ বাড়িতে ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন ইঙ্গমার বারিমান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯। পুরো বিশ্বের গণমাধ্যমে মৃত্যুর এই খবর গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। শুধু তাই নয়, বারিমানের জীবন ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রচিত হয় অসংখ্য রচনা। অধিকাংশ রচনায় বারিমানের চলচ্চিত্রবহুল জীবনের পাশাপাশি আলোকপাত করা হয়েছে অস্তিত্ববাদী নৈতিকতার বয়ান। আর আবশ্যিকভাবে হাজির থেকেছে ‘দি সেভেন্থ সিল’।
বারিমানের মৃত্যুর পর কমবেশি সকলেই উডি অ্যালেনের প্রসঙ্গ টেনে আনতে থাকেন, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। উডি অ্যালেন যে ভাষায় বারিমানের প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর কাজের উপর বারিমানের প্রভাব নিয়ে যা বলেছেন সবই বারবার উচ্চারিত হতে থাকে তখন। বারিমানের মৃত্যুতে যেন দুই পরিচালক পরস্পরের জুটি হয়ে গেলেন- বারিমান ও অ্যালেন। আজও তাঁদের নাম প্রায় সবসময়ই একসাথে উচ্চারিত হয়।
অ্যালেন নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, সেটার শিরোনাম ছিল ‘একটি লোক, যিনি কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন’, এই লেখায় অ্যালেন প্রথমবারের মতো বারিমানের মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া জানান:
‘শেষ পর্যন্ত আপনার শিল্প আপনাকে রক্ষা করে না। যত মহান কর্মই আপনি বুনন করেন না কেন (এবং বারিমান আমাদের সামনে হাজির করেছেন অসামান্য ওস্তাদি চলচ্চিত্রের তালিকা), সেগুলো আপনার ভাগ্যনির্ধারিত টোকার (মৃত্যু) বিপরীতে বর্ম হয়ে দাঁড়াবে না, যে টোকা ‘দি সেভেন্থ সিল’ চলচ্চিত্রে নাইট আর তার বন্ধুদের সমাবেশ পণ্ড করে দিয়েছিল। আর এই গ্রীষ্মে, জুলাই মাসে, বারিমান, নৈতিকতার মহান চলচ্চিত্রিক কবি, নিজের শতরঞ্জিতে অনিবার্য কিস্তিমাতকে আর প্রলম্বিত করতে পারলেন না, কাজেই আমার জীবদ্দশায় অসাধারণ এই নির্মাতাকে হারাতে হল।’


৮. কাজ হিসেবে চলচ্চিত্র
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর ইঙ্গমার বারিমান পরিচালনা করেছেন ৪৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ২০টি প্রামাণ্যচিত্র এবং ১০টিরও বেশি টেলিভিশন, মঞ্চ ও বেতার নাটক। এসকল কাজের জন্য বারিমানকে বলা হয়, বিগত একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ‘উর্বর’ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পী। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর সালের দশক জুড়ে প্রায় প্রতি বছরই তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। পাশাপাশি আবার মঞ্চ ও টেলিভিশনেও কাজ করেছেন।
কাজ করার এই ঝোঁক উডি অ্যালেনের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কর্মক্ষম অবস্থায় তিনিও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বলতে গেলে প্রত্যেক বছরই। চল্লিশটার উপর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তো আছে, আরো আছে ডজনখানেক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ও মঞ্চকর্ম।
শুরু থেকেই অ্যালেনের কাজের ধারা এবং গুরুত্বের সঙ্গে একের পর এক কাজ করে যাওয়া চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারকে স্পষ্ট করে তোলে, যখন বারিমানের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা হত না তখন থেকেই। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ঐ নিবন্ধে অবশ্য অ্যালেন বলেছেন, কি করে তিনি বারিমানের কর্মপ্রক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন:
“আমি তাঁর কাজের ধরণ থেকে শিখেছিলাম কি করে নির্দিষ্ট সময়ে নিজের শ্রেষ্ঠ কাজটাকে বের করে আনতে হয়, কখনোই হিট অথবা ফ্লপের দুনিয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়া যাবে না, কিংবা চলচ্চিত্র পরিচালকের চাকচিক্যময় জীবনের হাতছানিতেও ভোলা যাবে না, কিন্তু ছবি বানিয়ে যেতে হবে, একের পর এক। বারিমান পুরো জীবনে ষাটটির মতো চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, আমি এপর্যন্ত ৩৮টি। তাঁর গুণের কাছাকাছি না যেতে পারি, অন্তত তাঁর সংখ্যাকে ধরার চেষ্টা করেছি।”


৯. নারী
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর বারিমান ও অ্যালেন- দুজনই সমগ্র কর্মে শক্তিশালী, পূর্ণ ও জটিল নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। অ্যালেনের প্রধান নারী চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদের অনেকেই ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন অভিনয় দক্ষতার জন্য, কেউ পেয়েছেন একাডেমি এ্যাওয়ার্ডসহ সম্মানজনক পুরস্কার। একই বিষয়টি খাটে বারিমানের বেলাতেও। তাঁরও সবচেয়ে গভীর মাত্রার চলচ্চিত্রগুলো আবর্তিত হয়েছে নারীকে কেন্দ্র করে।
‘ক্রাইস এ্যান্ড হুইসপার’ চলচ্চিত্রের কথাই ধরুন, সেখানে নারীমনের অন্বেষণ ও মৃত্যুর সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক; অথবা যদি ‘পারসোনা’ ছবির কথা বলি, দুই প্রধান নারী চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, দুই বিন্দু থেকে এক বিন্দুর দিকে তাদের অভিযাত্রা, এক ব্যক্তিত্বের দিকে ধাবমান হওয়া; কিংবা ‘আওয়ার অব দ্য উলফ’ ছবিতে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী আলমার কথাই যদি ধরি, এই নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বারিমানের পছন্দের অভিনেত্রী লিভ উলম্যান- সব চরিত্রই তো বেশ দ্যুতিময়।
এই যে নারীদের জন্য শক্তিশালী চরিত্র তৈরি করা, নারীকেন্দ্রিক চিত্রনাট্য লেখা, নারীর জটিল মনস্তত্ব, তাদের নিজেদের সম্পর্ক, জীবনযাপনে পুরুষের সঙ্গে তাদের মেলামেশা- সবই নিজের প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছিলেন উডি অ্যালেন। ‘এনি হল’ ছবির এক চরিত্র, যেটিতে অভিনয় করেছিলেন ডায়ান কিটন, সেই চরিত্রটি জীবনের প্রতি মোহাবিষ্ট, তার সাথে আবার সম্পর্কিত একজন লোক, এই লোক আবার মৃত্যু চিন্তায় আচ্ছন্ন। কিন্তু ছবিটি আবর্তিত হয়েছে ডায়ান কিটনকে ঘিরেই।
অ্যালেনের আরেকটি ছবি ‘হান্নাহ অ্যান্ড হার সিস্টার্স’, এতে পুরুষদের জীবনযাপনের ধরনের সমান্তরাল করে কয়েকজন নারীকে দেখানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় চরিত্রে। তারা নিজেদের ব্যাপারে বেশ সচেতন। ‘হান্নাহ অ্যান্ড হার সিস্টার্স’ ছবিতে বারিমানের নিয়মিত অভিনেতা ম্যাক্স ভন জিডো অভিনয় করেছেন।
এটা পরিষ্কার যে দুই পরিচালকেরই নারীমনের প্রতি রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা এবং উভয়ই সমগ্র কাজের মধ্য দিয়ে উন্মোচন করেছেন নারী কিভাবে পুরুষের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া করে সেটাকে এবং তাঁরা দুজনই দেখিয়েছে মানবিক পরিস্থিতির অংশ হিসেবে নারী নিজেকে কিভাবে দেখে সেটাকেও। ‘ইন্টেরিয়র্স’ ও ‘ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপার্স’ দুটো ছবিই নারীর আত্মহত্যার মতো বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে, এবং এই আত্মহননের পর সেই নারীদের আশপাশের মানুষের উপর কেমন প্রভাব পড়ে সেটিকেও দেখিয়েছে গুরুত্ব দিয়ে।
অ্যালেনের ‘ব্লু জেসমিন’, যেটাতে ক্যাট ব্ল্যানশেট অস্কারজয়ী অভিনয় করেছেন, সেই ছবি দিয়েও প্রমাণ হয়ে যায় বিপরীত লিঙ্গের জন্য অ্যালেনের লেখনী শক্তি কী রকম জোরালো হতে পারে।


১০. বিষয়ে বৈচিত্র
ইঙ্গমার বারিমানের প্রভাব, উডি অ্যালেনের উপর সর্বশেষে বলা যায় পুরো ক্যারিয়ারে বারিমান ও অ্যালেন দুজনই প্রায় একই ধরনের বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, আর অ্যালেন তো এখনও সক্রিয়। বারিমানের কাজে উঠে এসেছে মানুষের নানা বৈশিষ্ট্যের গল্প, সেসব গল্পে তিনি বলেছেন নৈতিকতার কথা, পুরুষতন্ত্র, বিষমকামী সম্পর্ক, বিশ্বাস এবং স্ত্রী-পুরুষের মনোজগত কেমন করে প্রকাশিত হয় এই ধরাধামে, সেসবের কথা।
একইভাবে, অ্যালেনও এপর্যন্ত বানানো ছবিতে তুলে ধরেছেন মানুষের অযৌক্তিক, অর্থহীন বিভিন্ন দিক। মানব-মানবীর সম্পর্ক যেমন উঠে এসেছে অ্যালেনের ছবিতে, তেমনি তিনি ইহুদি বিশ্বাসকেও ঠেলে দিয়েছেন পরীক্ষার মুখে। একদিকে তিনি তৈরি করেছেন হাস্যরস সমৃদ্ধ ছবি, অন্যদিকে মানুষের নৈতিকতা নিয়ে গম্ভীর ও বিয়োগান্তক ছবিও বানিয়েছেন অ্যালেন।
অ্যালেন বারিমানের কাজে ট্র্যাজেডি যেমন দেখতে পেয়েছেন, তেমনি আবিষ্কার করতে পেরেছেন হাস্যরসও, এগুলোর সাথে আবার মিশেছে অ্যালেনের প্রিয় মার্ক্স ভাইদের কমেডি। সব মিলিয়ে অ্যালেন এমনভাবে দর্শকের সামনে হাজির হন, যাতে দর্শক এক ছবিতেই হাসেন, কাঁদের আবার প্রশ্নও করেন।

 



লেখক পরিচিতি : রিচার্ড পড়ালেখা করেছেন উইনচেস্টারে। ১৯৯৯ সাল থেকে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত রিচার্ড বর্তমানে চলচ্চিত্র বিদ্যা পড়ান যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষা বিষয়ক লেখালেখিও রয়েছে এই লেখকের।
*দ্য মার্ক্স ব্রাদার্স হিসেবে পরিচিত ছিলেন পাঁচ ভাই। চিকো, হার্পো, গ্রুচো, গুমো ও জেপো- এই পাঁচ ভাইয়ের কমেডি অ্যাক্ট প্রথমে মঞ্চে অভিনীত হয়, পরে বড় ও ছোট পর্দায় অভিনীত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে প্রায় পাঁচ দশক পর্যন্ত মার্ক্স ভাইদের নানা প্রযোজনা দেখতে পান দর্শকরা।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
তীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগতীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া