X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৩

ফিরোজ আহমেদ
৩১ জুলাই ২০১৬, ১৩:০৪আপডেট : ৩১ জুলাই ২০১৬, ১৪:০৩

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৩ তাত্ত্বিকভাবে এইটুকু মেনে নিলে বৃটিশ আমলের আগে সাম্প্রদায়িকতা ছিল কি না, তা অনুধাবনের জন্য প্রাক-বৃটিশ আমলে স্বার্থের বিরোধ ছিল কি না, সেটা সমঝে রাখলেই চলবে। বৃটিশ আমলে যা ছিল চাকরি আর ক্ষমতার জন্য মুসলমান আর হিন্দুর মাঝে প্রতিযোগিতা, একাদশ শতকের পর একটা পর্বে তাই ছিল ভাগ্যান্বেষী মধ্য এশিয় সমরপুরুষদের রাজ্য দখলের এবং তা প্রতিরোধের লড়াই

পূর্ব প্রকাশের পর

দুই.
তারপরও, যুদ্ধ তো রাজা-রাজরাদের গদি দখলের বিষয়, প্রাত্যহিক রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা বৃটিশপূর্ব দৈনন্দিন জীবন ও রাজনীতিতে কতটুকু ছিল(১৪) এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষীয় সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস যখন প্রবলতম, বিংশ শতকের সেই প্রথম দশকগুলোতেও পরমার্থিক ধর্ম প্রচার নয়, সম্প্রদায়ের মহিমা কীর্তন নয়, নিজ বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনও নয়, বরং একেবারে নিছক নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য চাকরি-ব্যবসা-ক্ষমতার বন্দোবস্তই ছিল সংঘাতের মূল প্রেরণা।(১৫) ধর্ম নয়, জাগতিক স্বার্থ নিয়ে বিবাদই যে সকল সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎস, স্বয়ং অধ্যাপক রাজ্জাকের মাঝেই সেই উপলদ্ধির পরিচয় পাওয়া যাবে তাকে নিয়ে এক সাবেক সহকর্মী আহরার আহমদ এর কথোপকথনের স্মৃতিচারণ থেকে:
“অন্য একটি ঘটনায়, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা ঘরোয়া আলোচনায় আমি দুঃখ করছিলাম কিভাবে নির্বোধ এবং অশিক্ষিত লোকজন ভয়াবহ ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে অন্যদের প্রতি তাদের ঘৃণা লালন ও প্রকাশ করে। তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন আর দেখিয়ে দিলেন যে, সত্যিকারার্থে গরিব আর অশিক্ষিত লোকজন নয় (যারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যরা কি বিশ্বাস করে তার সামান্যই পরোয়া করে), বরং শিক্ষিত আর বুদ্ধিমান লোকজনই এই সব সংঘাত আর সহিংসতার অধিকাংশগুলোর জন্য দায়ী। তিনি দেখিয়ে দিলেন বৃটিশ শাসনে মধ্যবিত্তের বিকাশ এবং চাকরি আর ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতাই দেশে সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগির জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে।(১৬)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দিক থেকে বিবেচনা করলে বিবাদে জড়িত ব্যক্তিদের সাম্প্রদায়িক পরিচয় থাকাটাই সাম্প্রদায়িকতার অনুভূতির উৎস। তাত্ত্বিকভাবে এইটুকু মেনে নিলে বৃটিশ আমলের আগে সাম্প্রদায়িকতা ছিল কি না, তা অনুধাবনের জন্য প্রাক-বৃটিশ আমলে স্বার্থের বিরোধ ছিল কি না, সেটা সমঝে রাখলেই চলবে। বৃটিশ আমলে যা ছিল চাকরি আর ক্ষমতার জন্য মুসলমান আর হিন্দুর মাঝে প্রতিযোগিতা, একাদশ শতকের পর একটা পর্বে তাই ছিল ভাগ্যান্বেষী মধ্য এশিয় সমরপুরুষদের রাজ্য দখলের এবং তা প্রতিরোধের লড়াই। পরবর্তীতে স্থানীয় বনাম বহিরাগতদের মাঝে চাকরি ও প্রতিপত্তি দখল কিংবা রক্ষার লড়াই।

তিন.

মধ্যযুগের বাংলার রাজনীতিতে এই সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য কি কি শর্তের ওপর নির্ভর করতো, সেটাও এই আলোচনায় আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। নগরবাসী মুসলিম সামাজিক অভিজাতদের কাছে শাসককে মুসলিম হতেই হবে, সম্ভবত এটাই ছিল সবচে বড় শর্ত। এরপরে মুসলমান পরিবারগুলো কিংবা বহিরাগতরা নিজেদের মাঝে এই সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে নিজেদের যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে পারতো। যেমন, বাংলায় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ উচ্ছেদ করে গণেশ নামের একজন স্থানীয় জমিদার নতুন রাজবংশের (১৪১৪ খৃষ্টাব্দ) পত্তন করেন। ইলিয়াস শাহী বংশের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য চিশতিয়া তরিকার সুফীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে চিশতিয়া তরিকার প্রধান নূর ই কুতুব ই আলম (মৃত্যু ১৪৫৯) জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে বাংলা আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। নূর কুতুব ই আলম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও সদাশয়। মেহমানদারির প্রায় সকল তুচ্ছ ও নিচু কাজ তিনি নিজের হাতে সম্পন্ন করতেন, তাঁর দরবারে আসা সকল ফকির ও অতিথির কাপড় তিনি নিজে পরিষ্কার করতেন, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতেন। তাঁর পুত্র নিজে মাংস না খেলেও মেহমানদের জন্য ভেড়া মোটাতাজা করার কাজটি করতেন। শর্কিকে লেখা তাঁর পত্রে তিনি তিনশ বছর ধরে ইসলামী শাসনে থাকা দেশটি বিধর্মীদের অন্ধকার এবং অবিশ্বাসীদের শক্তির হাতে চলে যাওয়ার কথা লেখেন এবং আহবান করেন,
‘বিশ্বাসের ঘরের যখন পতন হয়েছে, ইসলাম যখন এমন দুর্ভোগে নিপতিত হয়েছে, কেন তুমি সিংহাসনে মহানন্দে বসে আছো? জাগো, অগ্রসর হও এবং ধর্মকে রক্ষা করো, কেননা এটা তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব।’(১৭)
এই পত্রে আমরা ধর্মবিশ্বাস, স্বাজাত্যবোধ এবং রাজনীতিকে জটিল এক প্রক্রিয়ায় একাকার হয়ে যেতে দেখবো। সাম্প্রদায়িকতা তখনই থাকবে না, যখন ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ক্ষমতার মাপকাঠি নির্ধারিত হবে না, লড়াইয়ের পক্ষ বিপক্ষও নয়। এবং বলা যায়, মধ্যযুগের ওই বিশেষ পরিস্থিতিতে, যখন ধর্মীয় পরিচয়, গোত্রীয় পরিচয় এত গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে, সাম্প্রদায়িকতা তখন বরং সমাজিক সম্পর্কের একটা অন্যতম ভিত্তি। একে ক্ষমতার কেন্দ্র বা ভিত্তিস্বরূপ ধরেই বাকি সব সম্পর্ক অগ্রসর হয়।
এই পত্র পেয়ে ধর্ম রক্ষার তাগিদে (কিংবা হয়তো বাংলাকে জৌনপুরের সাথে যুক্ত করার দীর্ঘদিনের বাসনা পূরণের আশায়, কিংবা অধিকতর সম্ভাবনা হলো উভয় কারণই যৌথভাবে ভূমিকা রেখেছে) ইব্রাহিম শর্কি রাজা গণেশকে সিংহাসনচ্যুত করতে অগ্রসর হন। বাংলার সাথে জৌনপুরের আন্তঃসম্পর্কে কিংবা বাংলা ও জৌনপুর উভয়টির সাথেই দিল্লীর আন্তঃসম্পর্কে গ্রাস করার নীতি এর আগে থেকেই প্রবল ছিল। এখানে কেবল একটা নতুন শর্তের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা সাম্প্রদায়িকতা। এটা অভিযানটিকে আর সব কিছুর পাশাপাশি একটা ধর্মীয় বৈধতা ও তাৎপর্যও উপহার দিচ্ছে। শর্কিকে যুদ্ধে আহবান এবং শর্কির তাতে সাড়া দেয়ার প্রক্রিয়াটির ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ রক্ষার আকাঙ্ক্ষাকে আমরা নজর এড়িয়ে থাকতে পারি না। আরও বেশ কয়েকজন সমকালীন সুফীর কথা পাওয়া যায় যারা ইব্রাহিম শর্কিকে বাঙলা আক্রমণের তাগিদ দিয়েছিলেন, যেমন মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সীমানি।
শর্কি এক অর্থে তার দায়িত্ব পালনে সফল হননি। ঠিক কি ঘটেছিল, তা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে এর বহুতর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইটন উল্লেখ করেছেন দুটি কৌতূহলোদ্দীপক উৎসের কথা। হেরাতের তৈমুর বংশীয় শাহ রুখ মির্জার এক কূটনীতিবিদের রচনায় দাবি করা হয়েছে মির্জা বাংলা-জৌনপুর বিবাদে হস্তক্ষেপ করেন এবং শর্কিকে এর ফল ভোগ করতে হবে, এই মর্মে সতর্ক করেন।(১৮) এর ফলে তিনি এই হামলা থেকে বিরত হন। আরকানী একটি উৎসের কথাও ইটন বলেছেন, যেখানে দাবি করা হয়েছে ইব্রাহিম শর্কি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। বার্মার রাজার আগ্রাসনে আরাকী রাজ গণেশের আশ্রয়ে ছিলেন। তিনিই গণেশকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন, এর দাবি এমনটি।(১৯) আগ্রহী পাঠক বাংলাপিডিয়ায় আবু তাহের লিখিত ভুক্তিতে পাবেন ভিন্নতর একটি আখ্যান। এই সংস্করণে ভীত গণেশ নূর কুতুব ই আলমেরই শরণ নেন, এবং নিজ পুত্রকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করিয়ে তাকেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। মধ্যযুগের ঐতিহাসিক ফিরিশতা (১৫৬০-১৮২০) গণেশকে সুশাসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু হালের বাংলাপিডিয়ার 'রাজা গণেশ' শীর্ষক ভুক্তিটি বলছে তিনি মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করেছেন। বাংলাপিডিয়ায় আরও দাবি করা হয়েছে যে, তিনি পুত্রের হাতে নিহতও হন! (২০)

ধর্মীয় সংঘর্ষ হিসেবে সবচে বিখ্যাত মুসলমান-খ্রিস্টান ধর্মযুদ্ধগুলোর পেছনেও পার্থিব কারণ বিদ্যমান। কিন্তু শত্রুতার অজুহাত হিসেবে যখনই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে ব্যবহার করা হয়, ধরে নিতে হবে যে, এই ব্যবহারের কোন না কোন গ্রহণযোগ্যতা ব্যবহারকারী খুঁজে পান

অধিকাংশ ইতিহাসবিদের কাছে গ্রহণযোগ্য তথ্য এটুকুই যে, ভারতব্যাপী মুসলিম শাসনের ক্রমপ্রাবল্য বিষয়ে সচেতন গণেশ একটা কৌশল অবলম্বন করেন, পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করিয়ে কার্যত নিজের শাসন অব্যাহত রাখেন।(২১) জালালুদ্দীন নামে ধর্মান্তরিত পুত্রও সুশাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। জনপ্রিয় আরেকটি ভাষ্যে বলা হয়েছে নূর কুতুব আলম মৃত্যুবরণ করার পর গণেশ তার পুত্রকে নানান শুদ্ধিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় হিন্দু ধর্মে ফেরত আনেন।(২২) পুত্র অবশ্য নিজে রাজা হয়ে আবারও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এর কারণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে এটাই যে, শুদ্ধিক্রিয়ার পরও সম্ভবত একদিকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি ছিল, অন্যদিকে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে উপেক্ষা করা তার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে কঠিন ছিল।(২৩) আসল ঘটনা যাই হোক, এই ঘটনাপ্রবাহ ও তার ভাষ্যগুলোর নির্মাণে ধর্মীয় মর্যাদাবোধের অনুভূতি ও সাম্প্রদায়িক পরিচয় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তা বিস্মরিত হওয়া কঠিন।

ধর্মীয় সংঘর্ষ হিসেবে সবচে বিখ্যাত মুসলমান-খ্রিস্টান ধর্মযুদ্ধগুলোর পেছনেও পার্থিব কারণ বিদ্যমান। কিন্তু শত্রুতার অজুহাত হিসেবে যখনই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে ব্যবহার করা হয়, ধরে নিতে হবে যে, এই ব্যবহারের কোন না কোন গ্রহণযোগ্যতা ব্যবহারকারী খুঁজে পান। ইতিহাসবিদের কর্তব্য সেটাকে চিহ্নিতও করা।

প্রাক-বৃটিশ সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বের সম্ভাবনা বিষয়ে সাহিত্য কি সাক্ষ্য দেয়?
মধ্যযুগে মুসলিমদের বাংলায় আসার পর বাংলা ভাষায় মঙ্গলকাব্যের ধারাটির সূত্রপাত। মঙ্গলকাব্যের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল স্থানীয় এবং অসংস্কৃত লৌকিক দেবদেবীর অধিষ্ঠানের সংগ্রাম, তাদের প্রতিপক্ষ ইতিমধ্যে আর্য সভ্যতার আত্মীকৃত দেবদেবীগণ। ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, এটি সম্ভব হয়েছিল মুসলমানদের ক্ষমতায় আরোহনের ফলশ্রুতিতে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বিস্তার বাধাগ্রস্ত হবার ফলে। মঙ্গলকাব্য তাই সামাজিক ইতিহাসের সাহিত্যিক সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এই মঙ্গলকাব্যের বহু লেখকই হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদ রাখতেন।(২৪) মঙ্গলকাব্য ছাড়াও অন্য সূত্রগুলোতেও এমন নিদর্শন ঢের আছে।(২৫) অধ্যাপক রাজ্জাকেরই স্নেহধন্য ইতিহাসবিদ মমতাজুর রহমান তরফদারের ‘হোসেন শাহী বেঙ্গল’ গ্রন্থেই এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে।(ক্রমশ)

পড়ুন-

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-২

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-১

 

টিকা

(১৪). অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের এই মতটির সাথে তুলনীয় বদরুদ্দীন উমর-এর মতামতও। প্রাক-বৃটিশ যুগে সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমরের চিত্তাকর্ষক অথচ সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের জন্য দেখুন: সাম্প্রদায়িকতা, পৃষ্ঠা ১০: “আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় এবং সামাজিক চিন্তার ব্যবধান অনেক। এই ব্যবধানের ফলে এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক পর্যায়ে যে পরিমাণ লেনদেন হওয়ার কথা কোন দিনই তা হয়নি। সামাজিক লেনদেন এবং বিবেচনাই ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্র্য প্রীতি এবং মিলন সংস্থাপনের অন্যতম পথ। সে পথ বিভিন্ন কারণে সন্তোষজনকভাবে উন্মুক্ত না থাকাই অন্যতম কারণ যার জন্য ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। হিন্দু-মুসলমানের এ ব্যবধান জনসাধারণের ক্ষেত্রে গোড়াতেই সক্রিয় বিরোধে পরিণত না হলেও ইংরেজদের আবির্ভাবের পূর্বেই পার্থক্যের একটা অস্বাস্থ্যকার চেতনা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বর্তমান ছিল। এই ভেদজ্ঞানকে তাই পুরোপুরি ইংরেজদের সৃষ্ট বলা চলে না।” সম্ভবত এখানে প্রাক-বৃটিশ সাম্প্রদায়িকতার উপস্থিতিকে কিছুটা লঘু করা হয়েছে, তবে এটা সর্বক্ষেত্রেইে সত্যি যে, সাম্প্রদায়িকতার অনুভূতি বৃটিশ আমলের মতো, এবং বিশেষ করে ২০ এর দশকে শুরু হয়ে ৪০ এর দশকের তীব্রতম পর্যায়ে আগে কখনোই ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের পরবর্তীকালের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’তে তিনি আরেক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, “ইংরেজ-অধিকৃত ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত স্বার্থ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের সংঘর্ষ থেকেই হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির জন্ম এবং বিকাশ।” [সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা গ্রন্থভুক্ত ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণীগত ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধের প্রথম বাক্য এটি। মুক্তধারা, ১৯৮০]

(১৫). বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন সাম্প্রদায়িকতা, পৃষ্ঠা ১৪-১৮। বদরুদ্দীন উমর। আরও দ্রষ্টব্য একই লেখকের বাঙলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার।
(১৬). Saturday, August 20, 2011, daily star;  Prof. Razzak: Anti-hero, mentor; Ahrar Ahmad, ‘On another occasion, in a casual discussion on communalism I had lamented how stupid and illiterate people nurture and express their hate towards others in appalling bigotry. He stopped me and pointed out that it was actually not poor and ignorant people (who, for the most part, do not care what someone else believes), but educated and intelligent people who bear the responsibility for most of these conflicts and violence. He indicated that it was the rise of the middle class under the British and the contest for jobs and power that fueled the communal divide in the country’


(১৭). দি হিস্টরি অব ইন্ডিয়ানস টোলড বাই ইটস ওউন হিস্টরিয়ানস থেকে ইটন কর্তৃক উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৫৩।
(১৮). দি হিস্টরি অব ইন্ডিয়ানস টোলড বাই ইটস ওউন হিস্টরিয়ানস থেকে ইটন কর্তৃক উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৫৪।

(১৯). দানি রচিত হাউজ এবং এ পি ফাইরে রচিত হিস্টরি অব বার্মা থেকে থেকে ইটন কর্তৃক উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ৫৪।
(২০). দেখুন বাংলাপিডিয়া, রাজা গণেশ ভুক্তি। কৌতূহলোদ্দীপক এই যে, স্পেনের আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়ে বিখ্যাত একজন ফরাসী রাজা চতুর্থ হেনরিও প্যারিসের প্রজাদের ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি নিষ্ঠার নিকট নতি স্বীকার করে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ১৫৯৩ সালে, এর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট পক্ষের একজন অন্যতম নেতা।
(২১). যেমন, মমতাজুর রহমান তরফদার, হোসেন শাহী আমলে বাংলা, পৃষ্ঠা ১৭।
(২২). [জনপ্রিয় আরেকটি ভাষ্য রিয়াজ উস সালাতিনে বলা হয়েছে নূর কুতুব আলম মৃত্যুবরণ করার পর গণেশ তার পুত্রকে নানান শুদ্ধিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় হিন্দু ধর্মে ফেরত আনেন। মধ্যযুগের ঐতিহাসিক ফিরিশতা (১৫৬০-১৮২০) গণেশকে সুশাসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু হালের বাংলাপিডিয়ার 'রাজা গণেশ' শীর্ষক ভুক্তিটি বলছে তিনি মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করেছেন।]
আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৭২ রিয়াজ উস সালাতিন থেকে উদ্ধৃত: “তাহার মিথ্যা ধর্মের অনুশাসন অনুসারে কয়েকটি গাভী তৈয়ার করেন, জালালউদ্দীনকে তাহাদের সম্মুখভাগে ঢুকাইয়া পশ্চাৎ দিকে বাহির করিয়া আনেন এবং পরে স্বর্ণগুলি ব্রাহ্মণদিগকে দান করিয়া দেন। এইভাবে তাহার ছেলেকে স্বধর্মে পুনরায় দীক্ষিত করেন। জলালউদ্দীন দরবেশ কুতুব আলম কর্তৃক দীক্ষিত হওয়ায় ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করিলেন না এবং বিধর্মীদের প্ররোচনা তাহার অন্তরে কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই।”

(২৩). মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী, অনিল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঠককে জানিয়ে রাখি বইটি নিজেও সাম্প্রদায়িক ও একচোখা দৃষ্টিশক্তির অধিকারী। কিন্তু সেই কারণেই মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক আচরণের প্রায় সকল উপাদান এই গ্রন্থে একত্রে পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, সমন্বয়বাদী কিংবা সহিষ্ণু যে ধারা গড়ে উঠছে, তার উপলদ্ধি এখানে প্রায় মিলবে না।
(২৪). হোসেন শাহী বেঙ্গল, পৃষ্ঠা ২৬৮, মমতাজুর রহমান তরফদার। মুসলমান আমলে মঙ্গলকাব্যের উৎপত্তির মনস্তত্ব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা ভিন্ন, বর্তমান লেখক এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে সহমত নন। কিন্তু সে ভিন্ন আলোচনা।
(২৫). চৈতন্য চরিতামৃত, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি সমকালীন সাহিত্যে কাজী ও রাজকর্মচারীদের নির্যাতনের ধর্মীয় মাত্রার বিষয়ে বহু উল্লেখ আছে।


অলঙ্করণ : মোস্তাফিজ কারিগর 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা