X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহাশ্বেতা দেবী শান্তিতেও নোবেল পেতে পারতেন

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
০২ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৪২আপডেট : ০২ আগস্ট ২০১৬, ১৪:১০

মহাশ্বেতা দেবী শান্তিতেও নোবেল পেতে পারতেন হ্যাঁ, বঞ্চিত আদিবাসী, নিরন্ন, ন্যাংটো মানুষ, নিরীহ নারীদের অধিকার আদায় থেকে শুরু করে বনভূমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে মাঠ পর্যায়ে বারবার নেমে এসেছেন অরণ্যের অধিকারে। অন্ধকারকে আলোকিত করার জন্য মানুষের সেবায় জীবনকে ব্রত করেছিলেন। এ যেনো আরেক মাদার তেরেসা। প্রান্তিক, পাহাড়ি-বনাঞ্চল, নৃগোষ্ঠীদের স্বজন মহাশ্বেতা দেবী তাদের কাছে সত্যি যেনো এক দেবী হয়ে উঠেছিলেন

২৮ জুলাই ঘুম থেকে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমার রাত্রিকালীন স্বল্পদৈর্ঘ ঘুম ভাঙলো। আর জীবনের গল্পকার জীবনের পর্ব শেষ করে পূর্ণদৈর্ঘ নিদ্রায় নিমজ্জিত হলেন হাজার চুরাশির মা! এই মায়ের সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিলো। গিয়েছিলাম সাঁওতালদের বর্ণমালা অলচিকির জন্য। সেই অসামান্য স্মৃতি আর তাঁর সঙ্গে এক কাপ চা খাবার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। মায়াময়ী মহাশ্বেতা দেবী কি নরম মনের মানুষ। কি ধীর-স্থির, দৃঢ়। সেদিন শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, আমার জন্ম কিন্তু ঢাকায়! আমিও জন্মসূত্রে তোমার দেশের মানুষ! জন্মস্থানটি দেখতে খুব ইচ্ছে করে। সেদিন তাঁর নাড়ীর টানে তাঁকে আরো আপনজন মনে হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো কাছের মানুষ। আজ তিনি দূরের মানুষ হয়ে গেলেন!

সেবার কলকাতায় গিয়েছিলাম এক ঢিলে দুই পাখির আশায়। অর্থাৎ হলদিয়া উৎসবে কবিতা পাঠ এবং আদিবাসীদের বর্ণলামা সংগ্রহ। তখনই জানতে পারি, রবি ঠাকুরের সচিব, কবি অমিয় চক্রবর্তী হচ্ছেন মহাশ্বেতা দেবীর মায়ের মামাতো ভাই! এই সব বলতে বলতে কবি নির্মল (বসাক) দা ফোন করে দিলেন মহাশ্বেতা দিদির কাছে। সেই সঙ্গে জোগাড় করে দিলেন বালিগঞ্জের একটি স্থানীয় ছেলে- নীলকে। আসলে তার নাম সুনীল, সংক্ষেপে নীল। সে একটি দোকানে কাজ করে। সেখানে থেকে ছুটি নিলো আমার গাইড হবার জন্য। সারাদিন আমাকে সময় দিবে। খাওয়া-দাওয়া ছাড়া নীলকে দিয়ে হবে কুড়ি রূপি।

নীল এক অদ্ভুত ছেলে। সাইকেল চালিয়ে কলকাতা ঘুরে বেড়ায়। অচেনা জায়গাও তার নাকি চেনা হয়ে যায়। আমাকে সে তার সাইকেলে চড়ে বেড়ানোর প্রস্তাব দিলো। বলল, বাড়া বেঁচে যাবে। আমি রাজী হলাম না।

নীল তো মহাশ্বেতা দেবীর পাড়ার ছেলে। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। নীল জানালো, উনার বাসাটা তো সদর হাসপাতালের মত সারাদিন দ্বার খোলা থাকে। অনবরত মানুষের যাওয়া-আসা চলছে তো চলছেই। গরীবের মা মহাশ্বেতা দেবী।

নীলের দেয়া নামটা খুব ভালো লাগলো। গরীবের মা মহাশ্বেতা দেবীর সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটে ঘোরানো প্যাচানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে ঢুকলাম। সামনের ছোট্ট বৈঠকখানা ভর্তি বই আর বই। বই দেখছি। একটু পর মহাশ্বেতা দেবী এলেন। কথা বলতে বলতে সকাল বেলার চা-টা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করলেন।

নীল খুব বাচাল। নানান প্রশ্ন কৌতূহলী নীলের। যেনো মহাশ্বেতা দিদির সাক্ষাৎকার নিয়ে এসেছে! নিজেই প্রথমে নিজের নাম বললেন, সুনীল বসাক। ডাক নাম নীল। এক পর্যায়ে নীলের কথা থেকে জানলাম, মহাশ্বেতা দিদির ডাক নাম ‘খুকু’। নয় ভাই বোন। ঢাকার সেই খুকুখুকি যে মনীশ ঘটকের মেয়ে এবং ঋত্বিক ঘটকের ভাস্তি, তা তখন আমার জানা ছিলো না। কারণ, তাঁর সাক্ষাৎকার বা কথা বলার নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে যায়নি। সঙ্গে কোনো ক্যামেরাও ছিল না সেই স্মৃতি ধরে রাখার!

চা খেতে খেতে তিনি তাঁর শৈশব কাটানো লক্ষ্মীবাজার-জিন্দাবাহার লেনের কথা বললেন। স্মৃতিচারণ করলেন বাবার চাকরি সূত্রে ময়মনসিংহ, বরিশাল, দিনাজপুর, ফরিদপুর, রংপুরে ঘুরে বেড়ানোর। বললেন, দেশ বিভাগের কথা। অবশ্য তিনি দেশ বিভাগের আগেই অর্থাৎ দশ বছর বয়সে কলকাতায় চলে যান। এই দেশ বিভাগ কিভাবে স্বজনকে বিভক্ত করে, তা তুলে ধরলেন এই ভাবে, তাঁর সমবয়সী কাকু ঋত্বিক আর পিসি প্রতীতি জমজ ভাইবোন (ধীরেন দত্তের ছেলে সন্দিপ দত্তের স্ত্রী প্রতীতি দেবী। তথ্যসূত্র: মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে এক টুকরো স্মৃতি/ টোকন ঠাকুর।বাংলা নিউজ ) ভাগাভাগি হয়ে গেলো। সাতচল্লিশের দেশভাগে বোন প্রতীতি এপাড়ে আর ভাই ঋত্বিক চলে গেলেন ওপাড়ে। এভাবেই পাক-ভারতের বিভাজনে পবিত্র সরকারও চলে গেছেন কলকাতায় আর যমজ বোন লীলা এখন মানিকগঞ্জের সুয়াপুর থানার ভাদালিয়া গ্রামে।

আমার একটি কবিতা ছিলো- যুক্তাক্ষর। যাতে আমি পূর্ব বাংলা আর পশ্চিমবঙ্গকে প্রতীকী অর্থে তুলে ধরেছিলাম। তা তাঁকে বলার পর বললেন, আমি কবিতা কম বুঝি। নবারুণ ভালো বলতে পারবে। ছেলে নবারুণের কথা এবং স্বামী বিজনের কথা জানতে চাইলাম। তিনি খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না।

তাঁর স্বামী বিজন ভট্টাচার্য নাট্যকার-নির্দেশক, ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। আর ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন ভিন্ন ধারার কবি। মন হলো, তাঁদের সঙ্গে তাঁর কিছুটা দূরত্ব ছিলো কিনা। আজ হঠাৎ সেই সূত্র ধরে একটু ইঙ্গিত পেলাম নন্দিতা বসুর লেখায়। নন্দিতা লিখেছেন, “প্রায় উপার্জনহীন স্বামী বিজন ভট্টাচার্যকে ফেলে ঝাঁসী চলে গেলেন নিজের ২৫/২৬ বয়সে লক্ষীবাই-এর জীবনী রচনার মালমশলা সংগ্রহ করবেন বলে... (দ্র: ভারতের দলিত কণ্ঠের আপোষহীন ভাষ্যকার মহাশ্বেতা দেবীর প্রয়াণে/ নন্দিতা বসু| বিডি আর্টস, ৩১ জুলাই ২০১৬, ঢাকা।)

যাহোক, দিদি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন, তোমাদের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কেউ কি কাজ করছে? সেখানেও তো অনেক সমস্যা।

আমি বলেছিলাম, এনজিওগুলো করছে। কিন্তু লেখকেরা করছেন না।

-ইলিয়াস?

-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস? না তো।

-ইলিয়াস, হাসান এঁরা করতে পারে। হাসান আজিজুল হকের একটা গল্প পড়েছি, সাঁওতালদের নিয়ে। হাসান আজিজুল হকের ওই অঞ্চলে তো বেশ কিছু আদিবাসী রয়েছে।

-তবে আপনার মতো কেউ আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি। আপনি নগরে থেকেও অরণ্যবাসী।

তিনি ‘হুম’ বলে একটু হতাশ হলেন। বললেন, আমার কাছে সাঁওতালিদের বর্ণমালা নেই। ধীরেন বাস্কের কাছে পাবে। ওর তো ফোন নেই। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। এটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করো। তিনি তাঁর লেখার টেবিলে গেলেন। আমিও উঠে থরে থরে সাজানো বই দেখছি। তাঁর লেখা শতাধিক বই। অনেক বই ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা বইগুলো এক দিকে। পরে জেনেছি, হিন্দি, অসমীয়া, গুজরাটী, মারাঠী, মালয়মি, পাঞ্জাড়িয়াবি, তেলুগু এবং আদিবাসী হো ভাষায়। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদের কারণে তাঁর নোবেল অর্জন উঠেনি বলে আমার বিশ্বাস। অথচ অনেক ইংরেজি দূর্বল লেখাও নোবেলে মূল্যায়ন হচ্ছে।

মহাশ্বেতা দিদির চিরকুট নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। এবং পেয়েছিলাম অলচিকি বর্ণমালা। তাঁর কাছে জানলাম, ভারত সরকার সংসদে অলচিকির স্বীকৃতি দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

আমি দিদিকে জানালাম, আমি বন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে, লাইব্রেরি ওয়ার্ক করে আদিবাসীদের প্রায় ডজন খানেক বর্ণমালা জোগাড় করেছি।

তিনি শুনে খুশি হয়ে বললেন, খুব ভালো কাজ। তাদের বর্ণমালা প্রতিষ্ঠা করাটাও একটা ভাষা আন্দোলন। তুমি ভালো কাজ করছো। তোমরা বাহান্নে যা করেছো, তা তো আমাদের ইতিহাস। কিন্তু আমরা পারছি না।

-কেনো দিদি?

-দেখো না, কলকাতা থেকে বাংলা উঠে যাচ্ছে।

-হিন্দি কি বাংলা গ্রাস করছে।

-আমি হিন্দি বিরোধী নই। কিন্তু বাঙালিরা মাতৃভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় আশ্রয় নিবে?

আলাপকালে জানলাম, তাঁর গল্প ‘দ্রৌপদী’র কলাক্ষেত্র মঞ্চায়িত করেছে। ফেরার সময় নীল সেই প্রসঙ্গ তুলে। দিদি তখন বললেন, এখন তো শো চলছে। তুমি দুলালকে দ্রৌপদীটা দেখিয়ে দাও।

সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় ‘অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’এ দেখালাম, অনেকটা নীলের কারণে। আমার ইচ্ছে ছিলো না। আজ মনে হচ্ছে, না দেখলেই একটা দারুণ বিষয় থেকে বঞ্চিত হতাম। আজো মনে আছে, সেনা-নায়কের সামনে মণিপুরের নারীর কাপড় খোলা নগ্ন প্রতিবাদের চিত্র। দ্রৌপদী চরিত্রে সাবিত্রী হেইসনেমের চোখ ধাঁধানো অভিনয়, সংলাপ: ‘কাপড় কী হবে, কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে?’

যাই হোক, মহাশ্বেতা দেবী ২০০৬ সালে ফ্রাংফুর্ট বইমেলায় গিয়ে ডয়েচ ভেলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যাঁরা ইংরেজিতে লিখেন, তাঁদের পক্ষে বন জঙ্গল জায়গা জমি এবং এই সব অঞ্চলের মাটির মানুষদের কাছাকাছিও যেতে পারবেন না। আমরা পেরেছি। করেছি পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন। তাদের নতুন জীবন দিতে চেষ্টা করছি!

হ্যাঁ, বঞ্চিত আদিবাসী, নিরন্ন, ন্যাংটো মানুষ, নিরীহ নারীদের অধিকার আদায় থেকে শুরু করে বনভূমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে মাঠ পর্যায়ে বারবার নেমে এসেছেন অরণ্যের অধিকারে। অন্ধকারকে আলোকিত করার জন্য মানুষের সেবায় জীবনকে ব্রত করেছিলেন। এ যেনো আরেক মাদার তেরেসা। প্রান্তিক, পাহাড়ি-বনাঞ্চল, নৃগোষ্ঠীদের স্বজন মহাশ্বেতা দেবী তাদের কাছে সত্যি যেনো এক দেবী হয়ে উঠেছিলেন। শুধু শক্তিমান লেখক হিসেবেই নন; তিনি শান্তির জন্যও নোবেল পাবার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক