X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
হাজার চুরাশির মা : একালের প্রাসঙ্গিকতা

হামীম কামরুল হকের পর্যালোচনার প্রতিক্রিয়া

শারমিনুর নাহার
০৯ আগস্ট ২০১৬, ১৫:০৩আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০১৬, ১৬:৫২


হামীম কামরুল হকের পর্যালোচনার প্রতিক্রিয়া ব্রতীরা সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে চায়। ব্রতী তার ভেতরে আলো দিয়ে মা সুজাতাকেও বদলাতে চায়। ‘তুমি এত প্যাসিভ কেন মা’, ব্রতী তার মাকে মানসিকভাবে দৃঢ় হতে শেখায়। ব্রতীরা কবিতা রেখে, নাটক করে, ছোটকাগজ করে, অন্যের পাশে দাঁড়ায়, নেশাখোরদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়। তাদের সবার প্রতি মমত্ববোধ থাকে। কিন্তু জঙ্গিরা কি নিশংসভাবেই না নারীদের হত্যা করে। কণ্ঠস্বর দিয়ে, আবেগ দিয়ে মানুষকে ভয় দেখায়

হাজার চুরাশির মা : একালের প্রাসঙ্গিকতা শিরোনামে কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক-এর লেখার কয়েকটি প্রসঙ্গই মূলত এ আলোচনার উপজীব্য। ভেবেছিলাম আলোচনাটা একেবারে গোঁড়া থেকে করব। গোঁড়া থেকে অর্থাৎ জ্ঞানের বিকাশে একমাত্র মার্ক্সবাদী জ্ঞানই যে দুনিয়া পাল্টানোর বিজ্ঞান সেই আলোচনা দিয়ে। যদিও এই আলোচনা করতে গেলে স্বভাবতই এসে পড়বে মার্ক্সবাদী আন্দোলনের ইতিহাস, এর সঙ্গে আসবে প্যারি কমিউনের বিপ্লব, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ব্যর্থতা, মাও-সে-তুং এর নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব ও সাংষ্কৃতিক আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, উপনিবেশবাদ থেকে মার্কিনের নয়া উপনিবেশবাদ নীতি, বিশ্বব্যাপি জঙ্গিবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং সবশেষে আজকের বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা। কিন্তু এতখানি আলোচনা করতে গেলে রাজনৈতিক আলোচনাই প্রাধান্য পাবে। আসবে নানা মত-পথ, তর্ক-বিতর্ক এবং অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে যাবে মহাশ্বেতা এবং হাজার চুরাশির মা  উপন্যাসের প্রেক্ষিত। তাই আলোচনাটি শুধুমাত্র ‘হাজার চুরাশি মা’ উপন্যাসের টেক্সট-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলাম। টেক্সট আলোচনা করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আসবে। কেননা ঔপন্যাসিকের মনস্তত্ত্ব সমাজ ও সময়ের প্রেক্ষিতেই বিবেচ্য। এছাড়া মহাশ্বেতা দেবী নিজেই ‘হাজার চুরাশির মা’ (১৯৭৪ সালে প্রকাশিত) উপন্যাসে সময়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। উপন্যাসের অন্তত দুই জায়গায় তিনি সময় প্রসঙ্গে প্রায় একই বাক্য ব্যবহার করেছেন। বলেছেন-
‘সময় শোকের চেয়ে বলশালী। শোক তীরভূমি, সময় জাহ্নবী। সময় শোকের ওপর পলি ফেলে আর পলি ফেলে। তারপর একদিন প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী, সময়ের পলিতে চাপা পড়া শোকের ওপর ছোট ছোট অঙ্কুরের আঙুল বেরোয়।’ [পৃ: ৫৯ ও ৭৩]
উপন্যাসের তথ্য অনুযায়ি, সুজাতা চ্যাটার্জির ছেলে ব্রতী চ্যাটার্জির জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। তখন মা সুজাতার বয়স ছিল ৩১ বছর। সুজাতা ব্রতীকে যখন বয়ান করছেন (কেবলমাত্র একদিনের কাহিনি নিয়ে উপন্যাসটি রচিত) তখন তাঁর নিজের বয়স ৫৩, ব্রতীকে বিশ বছর বয়সে মেরে ফেলা হয়। এর দুই বছর পরে অর্থাৎ ব্রতীর বাইশতম জন্মদিনে সুজাতা ব্রতীকে খুঁজে ফিরছেন। যদিও তিনি জানেন ‘কোন কোন স্মৃতি হীরের মত উজ্জ্বল, কঠিন, স্বয়ংপ্রভ।’ তাই সবাই ভুলে গেলেও তিনি ভুলতে চান না। তিনি ব্রতীকে নিয়েই বাঁচতে চান, যে বাড়িতে ব্রতী নেই সেই বাড়িতেও তিনি থাকতে চান না। পুরো পরিবার, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একা মা সুজাতার এই বিদ্রোহ নতুন করে ভাবনার উদ্বেগ করে- কেন ব্রতীদের মৃত্যু? কেন সমাজের জুয়েলগুলোকে রাষ্ট্র সেই সত্তর দশকে মেরে ফেলেছিল? আজকের বাস্তবতায় আমাদের দেশে রাষ্ট্র যাদের জঙ্গি বলে মেরে ফেলছে, তার সঙ্গে আদৌ কোন সাদৃশ্য বা বহির্সাদৃশ্য আছে কিনা?
আমরা হামীম কামরুল হকেও বক্তব্য খণ্ডণের আগে খুবই সংক্ষেপে ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলব, যা সময়টা বুঝতে সহায়তা করবে।


উপন্যাসের প্রেক্ষাপট

হামীম কামরুল হকের পর্যালোচনার প্রতিক্রিয়া ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’, ‘উত্তাল সত্তর’, ‘অগ্নিস্ফূলিঙ্গের সত্তর’ ইত্যাদি নানা শিরোনামে সত্তর দশককে বর্ণনা করা হয়। সত্তর দশকে বিশ্বব্যাপি উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন হয়েছিল যার ঢেউ পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশেও এসে লাগে। বিশ্বব্যাপি এসব পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- এসময় দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিজয় লাভ। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ এই সময় স্বাধীনতা লাভ করে। পর্তুগীজ কলোনিগুলোতেও চলছিল সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম। পুরাতন উপনিবেশবাদের পতন ঘটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়া উপনিবেশবাদের তত্ত্ব প্রয়োগ করতে শুরু করে। এই সময় আলজেরিয়ার মুক্তি আন্দোলন, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলন, বেলজিয়ামের আন্দোলন, কঙ্গোর আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কিউবার বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা বলিভিয়া চলে গিয়েছিলেন সেখানকার আন্দোলনকারীদের প্রেরণা দিতে। মার্কিন চক্ষুশূল বিপ্লবী চে’কে দমন করবার জন্য তখন সিআইএ ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। অবশেষে ১৯৬৭ সালের ৯ আগষ্ট চে গুয়েভারাকে তারা মেরে ফেলতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে শীতল যুদ্ধ (কোল্ড ওয়ার) তা ষাটের দশকে এসে চরমরূপ লাভ করে। সরাসরি দখল নয়, দালাল বসিয়ে, প্রয়োজনে সৈন্য পাঠিয়ে এবং সামরিক ঘাঁটি বানিয়ে নতুনভাবে দখলের প্রয়াস চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটাই নয়া উপনিবেশবাদ বলে পরিচিত। এই নয়া উপনিবেশবাদের হিংস্র চেহারা প্রথমেই আঘাত হানে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে। পুরো সত্তরের দশকের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছিল ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চালানো ধ্বংসলীলার খবর। এর প্রতিবাদে আমাদের দেশেও মওলানা ভাসানি আওয়াজ তুলেছিলেন। খোদ আমেরিকাতেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। দেশে দেশে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি, লেখক, শিল্পী সবাই ভিয়েতনামের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিল। আইনস্টাইন, বার্টান্ড রাসেল, মার্ক টোয়াইন কে ছিল না সেই প্রতিবাদের মিছিলে! এরও প্রায় এক দশক আগে আমেরিকায় বর্ণবাদ প্রথা বিলুপ্ত করে আইন পাস হয়। কালো মানুষেরা ভোটাধিকার পায়। এটা না হলে হয়ত আজকের বারেক ওবামা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না। এই সময়ের আরো একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন (১৯৬৮ সালে) ফ্রান্স ও জার্মানির ছাত্র বিক্ষোভ। ছাত্রদের সঙ্গে তখন বিক্ষোভে শ্রমিকরাও যুক্ত হন। এসবই মোটা দাগে ছিল পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন। তখন পশ্চিম জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। সমাজতন্ত্রী মানে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ’। পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রের প্রভাবকে প্রতিহত করার জন্য ইউরোপের দেশগুলোতে তথাকথিত ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’র কর্মসূচি নেয়া হয়। এই সময়েই কমিউনিস্ট আন্দোলনে ‘মহা বিতর্ক’ শুরু হয়। চীনের সাংস্কৃতির আন্দোলন ব্যাপক গণভিত্তি পায়।
১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম কংগ্রেস বিরোধী সরকার গঠিত হয়। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএম) বিধান সভায় প্রাধান্য বিস্তার করে। কংগ্রেস সরকার বিরোধী এই চেতনাই ‘নকশালবাড়ি’র কৃষক আন্দোলেন নেতৃত্ব দিয়েছিল। নকশালবাড়ি আন্দোলনের চেতনার ধারকরাই নকশালিস্ট নাামে পরিচিত। শুধুমাত্র নকশালবাড়ি আন্দোলন নয়, তেভাগা আন্দোলনসহ সে সময় গড়ে ওঠা কৃষক, শ্রমিক আন্দোলনগুলো নকশালবাদী চেতনায় দীক্ষিত হয়। পরবর্তীতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বের নকশালবাদীর এই অংশটিই সিপিএমকে কৃষক বিরোধী বলে অভিহিত করে। কারণ সিপিএম এরই মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে আপোষ করেছে। পরে নকশালবাদীরা নতুন আর একটি পার্টি গঠন করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নাম নেয়। চারু মজুমদার ‘শ্রেণি শত্রু খতমের লাইন’ নিয়েছিলেন, পরে এই অবস্থান থেকে তারা ফিরে আসেন।
সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে আপোস করে, আর এই আপোষের ফলেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমর্থকদের কংগ্রেস সরকার দমন করতে শুরু করে। নকশালিস্টদের মূল ঘাটি ছিল যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সে সময় তরুণদের বড় অংশ নকশালবাড়ী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের বিদ্রোহ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। প্রচলিত সমাজ ভেঙে তারা নতুন শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে বিরোধটা এখানেই। নকশালিস্টরা ক্ষমতায় থাকা সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের খতম করে সবার জন্য শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু কিভাবে এই আদর্শ বাস্তবায়ন হবে, কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে, এই নিয়ে ছিল প্রয়োগগত মতভেদ। নকশালিস্টদের কংগ্রেস সরকার সন্ত্রাসী নাম দেয়। নানাভাবে হয়রানি, জেল, কনডেম সেল, পারিবারের থেকে আলাদা, অভিনব পন্থায় গোয়ন্দা ব্যবহার করে তাদের গ্রেফতার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ করে নকশাল হত্যার মহোৎসব চালায় পুরো সত্তর দশক জুড়ে। কিন্তু চেতনাগতভাবে এখনো নকশাল আদর্শ বহমান। আজকে ভারতের প্রায় ৪০ শতাংশ অঞ্চল মাওবাদীদের দখলে। যে মাওবাদীরা নকশাল আন্দোলনের চেতনার উত্তরসূরি। শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয় সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাববিস্তারকারী নকশালিস্ট আদর্শ, চেতনা শুধু পশ্চিমবাংলার নয় পুরো ভারতের শিল্প সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করে আছে। ১৯৯৮ সালেই মহাশ্বেতার এই উপন্যাসটি নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘হাজার চৌরাসি কি মা’ চলচ্চিত্র।


হামীম কামরুল হকের লেখার প্রতিক্রিয়া

হামীম কামরুল হক কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক আজকের প্রাসঙ্গিকতায় ব্রতী এবং নিবরাসকে এক করে দেখেছেন। যদিও তিনি বলেছেন, ‘মিলটা উল্টো দিক থেকে’। কিন্তু সেই উল্টো দিকের মিলটা কি, সেটা তেমনভাবে তুলে ধরতে পারেননি। এটা শুধু লেখক নন, অনেকেই এভাবে ভাবছেন। নকশালবাড়ী আন্দোলন আর আজকের বাংলাদেশে (সারা বিশ্বে) জঙ্গিবাদী আন্দোলন যেন এক সূত্রে বাঁধতে চাইছেন। আসলে আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হতে পারে। অর্থাৎ আমরা যদি সরলীকরণ করি তাহলে দুটো আন্দোলনের পার্থক্য বুঝে ওঠা দুরূহ। কারণ দুটোরই বাইরের দিকে অর্থাৎ প্রকাশভঙ্গিতে অনেক মিল রয়েছে। কারণ ব্যক্তি মানুষ যখন কোন একটি আদর্শ (মতাদর্শ) দ্বারা পরিচালিত হয় অর্থাৎ কোন একটি লক্ষ্য পূরণই যখন তার জীবনের, বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াই, তখন ব্যক্তিটি অনবরত সেই কাজেই/ দিকেই পরিচালিত হয়। এর বাইরে অন্য কাজকে সে অপ্রাসঙ্গিক, অহেতুক, সময় নষ্ট করা বলে মনে করে। ইতিহাসের চাকায় ব্রতী এবং নিবরাস (ব্যক্তি আদর্শ) দুজনেই আদর্শ থেকে পরিচালিত হয়েছেন বলে তাদের কর্ম প্রণালি, জীবন, চলাফেরা এক। এটিই তাদের দুজনকে একই দিকে পরিচালিত করেছে এবং একই পরিণতিতে পৌঁছে দিয়েছে। ফলে সাধারণভাবে যে কারো মনে হতে পারে দুটোই এক। কিন্তু এই দুই কখনই এক নয়। এটা দুটো দুই দর্শন দুই আকাঙ্খা থেকে চালিত।


দুটোর মধ্যে মিল

১. ব্রতী এবং নিবরাস দুজনেই এই সমাজের বিরোধীতা করেছে। তারা শুধু বিরোধীতাই করেনি বরং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেছে। যে বিদ্রোহের পরিণতি হয়েছে আত্মত্যাগ।
২. ব্রতী এবং নিবরাস দুজনেই সামাজিকভাবে তথাকথিত ভালো ছেলে বলে খ্যাত। সমাজ ধর্মকে সমর্থন করে। একজন তরুণ সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন, সে যখন প্রার্থনা করে তখন তাকে ভালো বলেই সবাই মনে করে। ব্রতী কখনও মিথ্যে বলত না। এটা শুধু তার মা নয় সবাই জানত।
৩. তারা দুজনেই সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণি থেকে আগত। মানে দুজনেই সমাজের উপরের তলার মানুষ। সাধারণভাবে সংকট বলতে যা বোঝায় তা তাদের জীবনে নেই। ব্রতীর বাবা তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। এটা নিবরাসের মা-বাবার চেয়েছিলেন কিনা সে তথ্য আমরা জানি না। কিন্তু সাধারণভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের মানসিকতাকে বিদেশে যাবার আকাঙ্খা থাকে।
৪. তারা মেধাবী, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামোতে তারা ভালো করেছে।
৫. দুটো আদর্শেরই একটা আন্তর্জাতিকতাবাদ আছে।
এই দুটো ধরণের আবার প্রয়োগগত কিছু মিলও আছে। যেমন. প্রচার প্রচাগাণ্ডা চালানো। ব্রতীরা সমাজের নিচু শ্রেণির মধ্যে তাদের আদর্শ প্রচার করে। জঙ্গিরাও করে যদিও সবার মধ্যে করে না। মজার বিষয় হলো, জঙ্গিরা তাদের আদর্শ প্রচার করে সেইসব তরুণদের মধ্যে যারা নিজেদের মধ্যে গুটানো। অন্যের সঙ্গে মিশতে পারার প্রবণতা কম। চারিত্রিকভাবে ইনট্রোভার্ট বলা যেতে পারে। কিন্তু মার্ক্সবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয় একেবারে বিপরীত চরিত্রের বৈশিষ্ট্রের মানুষ। যে অন্যের কাজে এগিয়ে যায়। সদা প্রাণ উচ্ছ্বল তারুণ্য।


এবার অমিলগুলো

শারমিনুর নাহার ১. উপরের মিলগুলোর কারণে সাধারণভাবে মনে হতে পারে তারা এক। কারণ তারা বিদ্রোহ করেছে। তারা এই রাষ্ট্রকে ভাঙতে চেয়েছে। তারা দুজনই নতুন কিছু করতে চেয়েছে। ব্রতী করতে চেয়েছে নতুন সমাজ, রাষ্ট্র নয়। কারণ খোদ রাষ্ট্র কাঠামোটাই তারা বদলাতে চায়। তারা জাতি হতে চায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন করতে চায়, রাষ্ট্র নয়। কিন্তু জঙ্গিরাও নতুন রাষ্ট্র করতে চায়। সেই রাষ্ট্র হল ‘ইসলামী স্ট্রেট’ বা খেলাফতের রাষ্ট্র। এখানে সমাজ আর রাষ্ট্রের পার্থক্য আছে। তারা দুজনেই রাষ্ট্রকে ভাঙতে চায় এবং নতুন কিছু গড়তে চায়। একজন গড়তে চায় রাষ্ট্র আর একজন সমাজ।
২. ব্রতীরা এই সমাজের সব কিছুকে বিরোধীতা করে। তার বিরোধীতার ধরণ শ্রেণি অবস্থান থেকে। যেমন, ব্রতী তার বাবাকে ঘৃণা করে-
‘বাবাকে মানে বাবাকে নয় একক ব্যক্তি হিসেবে তিনি আমার শত্রু নন। তবে উনি যে বস্তু ও মূল্যে বিশ্বাস করেন, সেগুলোতেও অন্য বহুজন বিশ্বাস করেন। এই মূল্যবোধ যারা লালন করেছেন, সেই শ্রেণিটাই আমার শত্রু। উনি সেই শ্রেণিরই একজন।’[ হাজার চুরাশির মা]
নিবরাসরা ঘৃণা করে কিন্তু শ্রেণি থেকে নয়। তারা বলে- একজনের ভিডিও বার্তার উদাহরণ দিলাম, যেটা পড়লে বোঝা যাবে তারা কি চায়-
[তার পরিবারের প্রতি বার্তা, মারা যাবার আগে] ‘আমি সেহজাদ রউফ অর্ক। আমার পরিবারের প্রতি বার্তা। আমার পরিবারের সদস্য তাওহিদ রউফ এবং অন্যান্যরা যারা শেখ হাসিনাসহ তাগুদের সমর্থক। আমাদের শরিয়া আইন সমর্থন করতে হবে যাতে আমরা বেহেশতে যেতে পারি। আর এটাই বেহেশতে যাওয়ার একমাত্র পথ। আমাদের সবকিছু এর জন্যই করতে হবে। আর এজন্য আমাদের জিহাদ করতে হবে। আমরা হত্যা করবো অথবা হত্যার শিকার হবো। আর এটা করতে পারলেই তবে বেহেশত আমাদের জন্য। আমরা গণতন্ত্র সমর্থন করতে পারি না। শেখ হাসিনাকে সমর্থন করতে পারি না। আমার পরিবারের সদস্য এবং যারা এটা সমর্থন করে তারা মুরতাদ। আমরা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু আমাদের বিপুল সংখ্যক মানুষের ওপর জয়ী হতে হবে। আমরা জয়ী হবো। আমরা ঘোষণা করছি, পুলিশ র‌্যাব যেই আমাদের প্রতিরোধ করতে আসুক, তাদের আমরা হত্যা করবো। আমরা বেহেশতে যাবো।’
তারা শুধুমাত্র বেহেস্তে যেতে চায়। এটা জঙ্গিদের একটা বিনিয়োগ। পরিবারের উপর নির্ভর করে সে জীবন ধারণ করেছে এতদিন। এখন যদি সে কাউরে মারে বা কেউ তাকে মারে- যেভাবে হোক তার মৃত্যু হল এবং এই মৃত্যুর পর তার সামনে জান্নাত, অনন্ত সুখ। সেই সুখের জন্য তাঁর এই ক্ষুদ্র (জীবন) বিনিয়োগ। কেউ তাকে মেরে ফেলুক।
৩. ব্রতীরা হঠাৎ করে তৈরি হয় না। ব্রতীরা ছোটবেলা থেকেই আলাদা থাকে। (যেটা উপরেই উল্লেখ করেছিলাম)
‘ওকে যুক্তি দিয়ে বুঝালে ও বুঝত’- ব্রতী মা বলেছেন। কিন্তু যারা জঙ্গি হয়েছে তাদের অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, তারা হঠাৎই আলাদা মানুষ হয়ে যায়। যে ছেলে কোনদিন নামাজ পড়েনি। একদিন সেই নামাজ পড়তে যায়। মা বোনদের হিজাব পড়বে বলে।

৪. ব্রতীরা সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে চায়। ব্রতী তার ভেতরে আলো দিয়ে মা সুজাতাকেও বদলাতে চায়। ‘তুমি এত প্যাসিভ কেন মা’, ব্রতী তার মাকে মানসিকভাবে দৃঢ় হতে শেখায়। ব্রতীরা কবিতা রেখে, নাটক করে, ছোটকাগজ করে, অন্যের পাশে দাঁড়ায়, নেশাখোরদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়। তাদের সবার প্রতি মমত্ববোধ থাকে। কিন্তু জঙ্গিরা কি নিশংসভাবেই না নারীদের হত্যা করে। কণ্ঠস্বর দিয়ে, আবেগ দিয়ে মানুষকে ভয় দেখায়।
৫. দুটো দর্শনের আন্তর্জাতিকতাবোধ থাকলেও খুব প্রবল পার্থক্য রয়েছে। আজকে নিবরাস ইসলাম, খায়রুল- যারা ইংরেজি মাধ্যম বা মাদ্রাসা- যেখানেই পড়াশুনা করুক না কেন, তাদের চিন্তায় একটা দৈন্য স্পষ্ট। তারা বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করতে পারেনি। তাদের কাছে বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে ইসলামের পরিচয় অনেক বেশি গৌরবের, অহংকারের। সে যেন মুসলান এটা ভাবলে নিজেকে অনেক বড় ভাবতে পারে, গৌবরবোধ করতে পারে। কিন্তু বাঙালি ভাবলে সেটা পারে না। ব্রতীরা নিজেদের ইতিহাসকে, সংস্কৃতিকে আরো উন্নত করবার চেষ্টা চালায়।

হামীম কামরুল হক শেষে লিখেছেন, ‘আমাদের শুরু করতে হবে নতুন কোনো অন্ধবিন্দু থেকে, যেটি এখনো অচিহ্নিত ও অনির্দিষ্ট’। এই কথার জবাবে এটুকুই বলব, শুরু করতে হবে কিন্তু সত্যিই কোন অন্ধবিন্দু থেকে নয়, অন্ধবিন্দু থেকে শুরু করলে আবারো সব কানাগলিতে পড়বে

হামীম কামরুল হক লিখেছেন, ‘তারা দাবানলের গুটি হয়েছেন, কে তাদের পেছন থেকে চালায়’। জঙ্গিদের পেছনে শত শত কোটি টাকা ঢালার তথ্য শুরু থেকে নানা সংবাদ মাধ্যমের বরাতে আমাদের জানা। আইএস-এর গাড়ির বহর দেখলেই তার কিছুটা ঠাহর করা যায়। কাদের গুটি তারা এটা সহজে অনুমানও করা যায়। কিন্তু ব্রতীদের কেউ চালায় না। ব্রতীদের চালায় তাদের ভেতরের আলো। তাদের যুক্তিবোধ, নৈতিকতা, শিক্ষা। ব্রতীদের মতাদর্শের আলোকে সত্তরের দশকে দেশে দেশে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ঘটেছিল। সেই সংগ্রাম, আলোকে নষ্ট করবার জন্যই তালেবানদের তৈরি করা হয়েছিল। যাদের একটি অংশ পরে আইএস রাষ্ট্র গঠন করেছে। একটি আদর্শকে চাপা দেবার জন্য সম্পূর্ণ বিপরীত একটি মতকে উস্কে দেয়া হয়েছে। যাদের পেছন অর্থ, অস্ত্র বিনিয়োগ করছে নয়া উপনিবেশবাদীরা। সুতরাং বাইরের আবরণ দেখে দুটিকে এক রং দিয়ে ফেলার মানসিক বদলাতে হবে। যে বস্তু যেমন তাকে তেমনভাবেই দেখতে হবে। যেটা যেমন তাকে যদি আমরা তেমন দেখতে না পারি তাহলে বরাবরই অন্ধের মতো হাতরাতে হবে। হামীম কামরুল হক শেষে লিখেছেন, ‘আমাদের শুরু করতে হবে নতুন কোনো অন্ধবিন্দু থেকে, যেটি এখনো অচিহ্নিত ও অনির্দিষ্ট’। এই কথার জবাবে এটুকুই বলব, শুরু করতে হবে কিন্তু সত্যিই কোন অন্ধবিন্দু থেকে নয়, অন্ধবিন্দু থেকে শুরু করলে আবারো সব কানাগলিতে পড়বে। মার্কেস ‘নো ওয়ান রাইটস্ টু দ্যা কর্নেল’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘জীবনের যেকোন সময়ই শুরু করবার সময়’। তাই মার্কেসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলি, সব সময়ই শুরুর সময়। কখন শুরু হবে সেই অপেক্ষায় বসে না থেকে বরং এখনই শুরু করি।

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে