X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুলতানের রম্যবাদী আদর্শায়ন

শরীফ আতিক-উজ-জামান
১০ আগস্ট ২০১৬, ১০:১৮আপডেট : ১০ আগস্ট ২০১৬, ১০:৫৪

এস এম সুলতানশুধু জ্যামিতিক প্যাটার্নে বাস্তবানুগ ছবি আঁকলেই ভালো ছবি এমন ধারণা নেহায়েত সাধারণ দর্শকের মূল্যায়ন হতে পারে। আর ‘সুলতান এ্যানাটমি জানেন না’ বলে যারা মুখ বাঁকা করে হাসেন তারা শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আর্টিস্টিক এ্যানাটমি’র কথা ভুলে যান। মেডিকেল এ্যানাটমির উপস্থাপনা ছবি আঁকার উদ্দেশ্য হতে পারে না। শিল্পীকে তার নিজস্ব এ্যানাটমি তৈরি করতে হয়

১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন নড়াইল মহকুমার মাছিমদিয়া গ্রামের হতদরিদ্র এক রাজমিস্ত্রির ঘরে যে শিশু জন্মেছিল শিল্পী হওয়ার মতো যথেষ্ট প্রেরণা বা পরিবেশ কোনোটাই তাঁর অনুকূলে ছিল না। তারপরও পিতাই ছিলেন তাঁর প্রাথমিক প্রেরণা, কারণ নড়াইল জমিদার বাড়ির দেওয়ালগাত্রে তাঁর রাজমিস্ত্রি পিতার খোদাইকৃত নকশা তাঁকে আঁকা শিখতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। তার সাথে ছিল তাঁর স্কুলের ড্রইং মাস্টার মশাই ও জমিদার-ভাতুষ্পুত্র অরুণ রায়ের অনুপ্রেরণা। কলকাতা আর্টস্কুলে সুলতানের ভর্তি সম্ভব হয়েছিল কিছুটা এদের আর বাকিটা শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায়। কারণ ইন্টারভিউয়ে প্রথম হয়েও আর্টস্কুলে ভর্তির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ম্যাট্রিকুলেশন না থাকায় সেখানে তাঁর ভর্তির স্বপ্ন যখন ভেঙে যাওয়ার মুখে তখন শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর হস্তক্ষেপেই সেই সমস্যার সমাধান হয়। বিশিষ্ট শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দী তখন ছিলেন স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য, তাঁর সুপারিশেই তিনি সেখানে ভর্তি হতে পেরেছিলেন; এস এম সুলতান নামটাও তাঁরই দেওয়া।
১৯৪১ সালে সুলতান যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন তখন রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকায়নের একযুগ পেরিয়ে গেছে। একাডেমিক কাজের মাঝেও নতুনত্ব এসেছে যদিও সব একাডেমিক কাজই একঘেয়ে। সুলতানের এই রুটিন-ওয়ার্ক ভালো লাগেনি। ফলে ডিগ্রি না নিয়েই ১৯৪৪ সালে তিনি ঐ প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একাডেমিক কাজে দক্ষতা বাড়লেই চিত্রশিল্পী হওয়া যায় না, তাকে তার নিজস্ব সুর, নিজস্ব স্টাইল খুঁজে পেতে হয়। চিত্রশিল্পের আধুনিকতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল স্বচ্ছ। শুধু পাশ্চাত্যের রূপরীতি অনুকরণই আধুনিকতা নয়। নিজের যা কিছু আছে তাকে বর্জন করে বাইরে থেকে গ্রহণ করলেই হলো না। সেই গ্রহণ যদি নিজের ঐতিহ্যের সমৃদ্ধির কাজে না লাগে তবে তা অপ্রয়োজনীয়। তাই ক্রমাগত অনুশীলনে তিনি তাঁর নিজস্ব শৈলী খুঁজে পেয়েছিলেন যার মাধ্যমে পরবর্তীকালে তিনি সাফল্যের সাথে তাঁর নিজস্ব দর্শন, আদর্শিক চিন্তাকে প্রকাশ করতে পেরেছেন।
আর্টস্কুল ছেড়ে সুলতান চষে বেড়ালেন সারা ভারত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ পর্যায়ে। জীবন চালাতে তিনি তখন প্রচুর ফরমায়েশি ছবি এঁকেছেন যার ক্রেতা ছিল মূলত ইংরেজ সেনাবাহিনীর লোক। জানা যায়, এইসময় তিনি মোঘল চিত্রকলার  ভ্রান্ত নকল তৈরি করতেন, কারণ ঐ সময়টাতে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্টের শিল্পকর্ম হিসাবে ওগুলোর বাজারদর ছিল চড়া। কিন্তু অচিরেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এভাবে বেশিদিন চলবে না। তাঁর নিজের মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ‘স্টাইল’ তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তখনই তিনি অন্যপথে এগোলেন, বেছে নিলেন জীবন-ঘনিষ্ঠ বিষয়। সেই সময় শুরু হলো কাশ্মির ও বাংলার নিসর্গদৃশ্যের চিত্রায়ন। তবে কাশ্মিরের নিসর্গদৃশ্যগুলো প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এঁকেছিলেন, কারণ দেশে ফেরার পর তাঁকে আর ঐ ধরনের নিসর্গদৃশ্য আঁকতে দেখা যায়নি। মূলত ১৯৫০-এর পর থেকে তাঁর ক্যানভাস জুড়ে শুধুই বাংলাদেশ─ বাংলার কৃষক সমাজ, উৎপাদনের সাথে যারা সম্পৃক্ত, জল ও মাটির সাথে যাদের সম্পর্ক নিবিড়। তাঁর বিশাল বিশাল ক্যানভাসগুলো ধারণ করে আছে গ্রামের বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের মাঠ, জমিতে মই দেওয়া, লাঙ্গল-গরুতে গাঁতায় চাষ, ধান তোলা, ধান মাড়াই, ধান ঝাড়া, ধান ভানা, গোলায় ধান ওঠানো, পাট কাটা, পাট বাছা, পাট ধোয়ার কাজে ব্যস্ত কিষাণ-কিষাণী; নদীর ঘাটে স্নানরতা, জল ভরা, কাপড় ধোয়া, শাপলা তোলা, দুধ দোহানো, মাছকোটার কাজে নিয়োজিত কৃষক রমণী; খাল-বিল-নদীতে মাছ শিকারে ব্যস্ত জেলে-সম্প্রদায়; ঢাল-সড়কি-লাঠি নিয়ে চরদখলে উদ্যত মারমুখি কৃষক; আছে ঋতুভিত্তিক গ্রামীণ পরিবেশ। একই শিরোনামের একাধিক ছবি রয়েছে। এই সকল বিষয়ের পৌনঃপুনিক চিত্রায়নে তাঁর ক্যানভাস ঠাসা। ব্যতিক্রমী বিষয়ের চিত্রায়ন হিসেবে দেখতে পাই বস্তিবাসী জীবন, জলোচ্ছ্বাসের পর, বেদেনীদের ঘরে ফেরা’র মতো কয়েকটি ছবি আর সেইসাথে গণহত্যার মতো এক-আধটা নিরীক্ষাধর্মী বিমূর্ত চিত্রকলা। মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছেন তেল ও জল রং এবং মূলত এই মাধ্যমেই তিনি কাজ করতেন তবে পেন্সিল ও কালিতে কিছু স্কেচও করেছেন। তাঁর সব ধরনের ছবিই লিটারারি ইন্টারেস্টে ঠাসা। শিল্পের ক্ষেত্রে হিউম্যান ও প্লাস্টিক মূল্য উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে ফিগারেটিভ শিল্পীদের কাজের হিউম্যান ভ্যালু নিয়ে বেশি কথা হয়। সুলতানের কৃষককূল এতো দানবীয় অঙ্গসৌষ্ঠবের কেন─ এই একটি প্রশ্নই বারংবার জিজ্ঞাসিত হয় যার উত্তরে বলা যেতে পারে বাংলার কৃষক নিয়ে তার একধরনের রম্যবাদী আদর্শায়ন (Romantic Idealization) রয়েছে। বাস্তববাদী অন্তর্দৃষ্টি (Realistic Vision) থেকে শুরু হলেও ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবতাকে দূরে ঠেলে নতুন কোনো স্বপ্ন বা কল্পিত বাস্তবতার ইঙ্গিতই আদর্শায়ন। সুলতানের অতিকায় কৃষককুল বাস্তবের প্রতিভূ নয় মোটেও। আর সেইজন্য ব্যকরণগত অর্থে তিনি বাস্তববাদী চিত্রী (Realistic Painter) নন।  সুলতানের ছবি ব্যাখ্যা দাবি করে; দারিদ্র্য-পীড়িত দেশের কৃষকদের এমন দানবীয় হওয়ার ব্যাখ্যা। তাঁর ফিগরগুলো ভারতীয় চিত্রকলায় যে আদর্শে নারী-পুরুষ চিত্রিত হয়েছে সে রকমতো নয়ই বরং সাদাচোখে আমরা যেমনটি দেখতে পাই তেমনও নয়। কেননা একে তারা মানুষ, তায় আবার কৃষক। সুতরাং দেবতাকুলের রূপের অনুকরণ-অনুসরণ ঘটতে পারে না। কিন্তু অনার্য নায়িকার যে রূপ বর্ণনা ভারতীয় চিত্রশাস্ত্রে পাওয়া যায় তার সাথেও তাঁর কৃষকবধূদের উল্লেখযোগ্য কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়না। নাসিকা চিত্রণে ভারতীয় চিত্রশিল্পী যেখানে তিলফুল, শুকচঞ্চু ও বাঁশিকে আদর্শ ধরেছেন সেখানে সুলতানের নারীদের একটু ছিন্ননাসাই মনে হয়। নয়ন চিত্রণে যেখানে পদ্মপাপড়ি, কমল, মৃগ ও খঞ্জনের নয়নকে আদর্শ ধরা হয়েছে তার সাথে তার নারীদের চোখের কখনো কখনো মিল লক্ষ্য করা যায় তবে তা কাকতালীয়ই মনে হয়। কুচযুগল চিত্রায়নের ক্ষেত্রে শাস্ত্রকাররা ঘট ও দাড়িম্ব ফলকে আদর্শ ধরলেও সুলতানের চিত্রে উভয় অনুকৃতিই অনুপস্থিত। তার নারীর কুচযুগল আরো স্ফীত, আরো মেদবহুল। তবে ভারতীয় চিত্রশিল্পে হস্তীর মস্তকের উঁচু মাংসপিণ্ডের সাথে রমণীদের নিতম্বদেশের যে উপমা পাওয়া যায় তার সাথে সুলতানের নারীদের নিতম্বের মিল রয়েছে যথেষ্ট। হস্তীর গুরুমস্তকের মতোই তার নারীরা গুরুনিতম্বিনী। আবার বাহুর বর্ণনায় যখন শাস্ত্রকাররা বলেন, ‘কিবা মনোহর কর─ মৃণালের গর্বহর, অঙ্গুলি চম্পক চারুদল’ তখন চরম বৈশাদৃশ্যই ধরা পড়ে। মুলত রেনেসাঁ মাস্টারদের অনুকরণে সুলতান তাঁর কৃষকদের ফিগর এঁকেছেন কারণ এই প্রসঙ্গে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক-নৃতাত্ত্বিক চেতনা রয়েছে। এক সময়ের সচ্ছল স্বাস্থ্যবান কৃষক সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ভেতরে থেকে যেমন শোষিত হলো তেমনি শোষিত হলো বুর্জোয়া সমাজ কাঠামোর ভিতরেও। আর এই নিরন্তর শোষণে তারা কৃষকায় হলো। একজন ‘ভিশনারি’ হিসেবে সুলতান ওদের হারানো স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার চান। এই ধরনের রোমান্টিক ভাবালুতাকে অনেকেই বাস্তব থেকে পলায়ন বলে মনে করেন। কেননা বাস্তবের সাথে সঙ্গতিহীন কোনো কিছুর চিত্রায়ন বিভ্রান্তিকর ও পলায়নপরতা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু বাংলার কৃষককে অতিকায় দেখার প্রচেষ্টাকে যতই পলায়নপরতা বলা হোক না কেন আদতে তা এক স্বপ্নের নির্মাণ। আর স্বপ্ন নির্মাণে সবসময় পলায়নপরতা নেই, আছে আশাবাদ, আছে সংগ্রামের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত।
তাহলে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে সুলতানের ছবির এ্যানাটমিতে যে অতিরঞ্জন তার উদ্দেশ্য 'adding strangeness to beauty’ নয় মোটেও, distortion তো নয়ই। আর যদি distortion বলে ধরে নিই তাতেই বা কি ? যদি কোনো আদর্শের স্বার্থে তিনি তার ফিগরের এ্যানাটমি বিকৃত করেই থাকেন তাতে তার ছবির আদর্শিক মূল্য কমে যায়না, তার Representational motive নষ্ট হয়ে না। শুধু জ্যামিতিক প্যাটার্নে বাস্তবানুগ ছবি আঁকলেই ভালো ছবি এমন ধারণা নেহায়েত সাধারণ দর্শকের মূল্যায়ন হতে পারে। আর ‘সুলতান এ্যানাটমি জানেন না’ বলে যারা মুখ বাঁকা করে হাসেন তারা শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আর্টিস্টিক এ্যানাটমি’র কথা ভুলে যান। মেডিকেল এ্যানাটমির উপস্থাপনা ছবি আঁকার উদ্দেশ্য হতে পারে না। শিল্পীকে তার নিজস্ব এ্যানাটমি তৈরি করতে হয়।
বস্তুত সুলতান তার ছবির মানুষদের ফিগর সম্পর্কে যতই ঐতিহাসিক-নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন না কেন তা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না, কেননা তিনি এক কল্পরাজ্য গড়তে চান, একটি প্রতিবাদী বারতা পৌঁছাতে চান যার জন্য তাঁর নিজস্ব এ্যানাটমি প্রয়োজন, যা মেডিকেল এ্যানাটমি নয়, আর্টিস্টিক এ্যানাটমি।
আর তাছাড়া রূপরীতির ক্ষেত্রে সুলতান শুধুমাত্র ইম্প্রেশনিস্টিক ধারার নন, প্রকাশবাদী ধারারও বটে। এই ধারার শিল্পীরা একটু বেশি আবেগপ্রবণ হন। যে কোনোভাবেই সেই আবেগকে প্রকাশ করেন। তার জন্য সর্বদা পরিপার্শ্বের চেনা জগতের অতিরঞ্জন ও বিকৃতিকে প্রশ্রয় দিতে ছাড়েন না। এমনকি মাঝে মাঝে তা উদ্ভট কিছুও হয়ে দাঁড়ায়। হার্বাট রীড এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
It expresses the emotions of the artist at any cost – the cost being usually an exaggeration or distortion of natural appearances which borders on grotesque.

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে গ্রীক ভাস্কর্যও বিকৃতিকে প্রশ্রয় দিয়ে সৃষ্টি। বাস্তবে চোখের ভ্রু, নাক কখনোই এতো সোজা, মুখ এতোটা ডিম্বাকৃতি, বক্ষযুগল এতোটা গোলাকার হয় না, যা আমরা মিলোসের আফ্রোদিতিকে দেখে থাকি। কিন্তু সৌন্দর্যকে বাস্তব ছাপিয়ে নিয়ে মনের মাধুরী-কল্পনা-রং মিশিয়ে আরো সুন্দর করলে ‘বাস্তবের সাথে মিল নেই’ এই দোহাই দিয়ে তার শিল্পমূল্য খারিজ করে দেওয়া যায় না।
আগেই বলেছি বাংলার কৃষক নিয়ে তার এক ধরনের ‘রম্যবাদী আদর্শায়ন’ আছে। প্রাচীন কৃষক সমাজ, তাদের জীবন যাপনের ধরণ, চাষাবাদের পদ্ধতি─ বিশেষ করে গাঁতায় বা দলবদ্ধভাবে চাষ ও সমবায় পদ্ধতি তার খুব পছন্দ ছিল। সেইজন্য তাঁর ছবিতে অনেক ফিগর একসাথে দেখা যায়। সুলতান সবচেয়ে অপছন্দ করতেন কৃষির আধুনিকায়ন। ট্রাক্টর, ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র, ছাটাইকলের ব্যবহার তিনি পছন্দ করতেন না। এক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীলতা তার শিল্পীসত্তার সাথে সম্পৃক্ত। তিনি শহরায়ন চান না। সনাতন যে কৃষক সমাজ সেই সমাজই তাঁর আরাধ্য। সেখানে আধুনিকায়নকে তিনি অবাঞ্চিত অনুপ্রবেশ বলে মনে করতেন। তাই তার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর অতিকায় কৃষককুল এক শৈল্পিক প্রতিবাদ। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যখন বলেন, ‘সুলতান হারানো একটি গ্রামীণ পৃথিবীর ইমেজ তুলে ধরেছেন’ তখন ধন্ধে পড়ে যাই। সত্যিই কি কখনো কোনো গ্রামীণ সমাজ ছিল যেখানে কৃষকরা এমন স্বাস্থ্যবান, নারীরা এমন লাবণ্যময় পুরুষ্ট দেহের অধিকারী ছিল? বেশি পিছনে না গিয়েও বলা যায়, দুইশত বৎসরের ঔপনিবেশিক শোষণ ও পঁচিশ বছরের পাকিস্তানি শোষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাংলার কৃষক সমাজ। এই সময়ে শিল্পায়নে পুঁজির যোগানদারও তারা, কিন্তু তারাতো কিছু পায়নি। তাদের ভাগ্যোন্নয়ন হয়নি; সবাই তাদের ঠকিয়েছে। আসলে সুলতান বলতে চেয়েছেন শোষণের কথা, করতে চেয়েছেন প্রতিবাদ। ওদের অতিকায়তা তার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা-প্রতিবাদের চিত্ররূপ।
আর তাই তার জগৎ আমাদের কাছে চেনা হয়েও অচেনা মনে হয় কারণ একটি ‘ভিশন’কে ধারণ করে আছে তাঁর ছবি। সেই ভিশনের কারণেই বস্তুর দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ বাদ দিয়ে আপন অনুভূতির কাল্পনিক রূপ তুলে ধরেন তিনি। এভাবেই নিজ দর্শনের চিত্ররূপ দিতে গিয়ে তৈরি হয়ে যায় শিল্পীর নিজস্ব ফর্ম যা দেখে সহজে চেনা যায় তার কাজ। পটচিত্রের ফর্মের সাথে কিউবিক ফর্ম মিশিয়ে যেমন যামিনী রায় তার নিজস্ব ফর্ম তৈরি করেছিলেন যা কামরুল হাসানেও দুর্লক্ষ্য নয় তেমনি সুলতানও ইয়োরোপীয় রীতির সাথে বাংলার লোকজ ধারার সংমিশ্রণে তাঁর নিজস্ব ফর্ম তৈরি করেন। আর ফর্ম, ক্যান্ডিনেস্কির মতে শিল্পীর আন্তরিক চাহিদার বাহ্যিক প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন : Form is nothing but the outward expression of the artist’s inner needs. এবং সুলতান তার ফর্ম তৈরি করেছেন সেই আন্তরিক চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে এনাটমি গ্রাহ্য না করে, কারণ তার প্রয়োজন ছিল। এই প্রসঙ্গে ক্যান্ডিনেস্কিই অন্যত্র বলেছেন, In principle there is no problem in form. The artist who expresses his ‘soul vibration’ can use any form he wants.        
হ্যাঁ, ‘soul vibration’। সুলতানের হৃদস্পন্দন হলো সনাতন কৃষক-সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। প্রতারণা-পুঁজিতন্ত্রের আগ্রাসন ও আধুনিকায়নের ফলে প্রচলিত যে কৃষি-ব্যবস্থা ভেঙে যেতে বসেছে, সুলতান তাকে বাঁচাতে চান। তাঁর কল্পনায় ধরা পড়ে এমন এক কল্পরাজ্য যেখানে কৃষকরা লাঙল-গরুতে জমি চাষ করে, কাস্তে হাতে নিড়ানি দেয়, গরুর মলনে ধান মাড়াই ও ঢেঁকিতে ধান ছাটাই করে, আর নারীরা ঘর-গৃহস্থালী সামলায়। সেই কৃষক সমাজের চিত্রায়নে তিনি যে ফিগর আঁকেন তা অতিকায়। আর এর মাঝেই আছে প্রতিবাদী বার্তা, কৃষকদের রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্র। তাদের রাজ্যে কৃষকরাই সুলতানী করবে─ এমন এক ইউটোপিয়ার সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন তিনি আজীবন।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা