X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

চিররঞ্জন সরকারের রম্যরচনায় রম্যরস

মোস্তাফিজুর রহমান
১২ আগস্ট ২০১৬, ০৯:১৯আপডেট : ১২ আগস্ট ২০১৬, ০৯:৩১

‘আমাদের দেশে ভালো মানুষ, ভালো সংগঠন, ভালো উদ্যোগ, ভালো ভালো কথা কোনো কিছুরই অভাব নেই। তারপরও ভালো কিছু ঘটে না, ভালো কিছু বড় বেশি দেখা যায় না। সারাদেশে খারাপের এতো বেশি সমারোহ যে পত্রপত্রিকাগুলো পর্যন্ত ‘সুসংবাদ’ বড় বেশি খুঁজে পায় না। এ জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের অনেক গলদঘর্ম হতে হয়। ’ (আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক ও টক শো সমাচার)
‘এদেশে আসলে নীতিবাক্যটি হলো, চাচা আপন পরাণ বাঁচা। যে রাস্তায় গেলে আখেরে ভালো হবে, সেই রাস্তায় তোমার পূর্বপুরুষ তোমায় ঠেলে দিতে পারেন এবং তুমি যদি ঠিকমতো চলতে পারো তাহলেই তুমি সফল’
‘জীবনে কখনও কোনো প্যাঁচে পড়েননি, অথবা কখনও প্যাঁচ কষেননি এমন ব্যক্তি আমাদের সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দিন যত যাচ্ছে মানুষ যেন তত বেশি প্যাঁচালো হচ্ছে। …মানুষ সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে পারে না বা দেয় না। যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়, ‘নাস্তা করেছেন?’ উত্তর আসবে, ‘আমারে কী পাগলে কামরাইছে যে, নাস্তা না কইরা এত বেলা পর্যন্ত বইসা রইছি?’ (প্যাঁচের রাজনীতি, রাজনীতির প্যাঁচ)
জমিদারবাড়িতে সদানন্দ নামে এক ব্যক্তি চাকরের কাজ করতো, তাকে সংক্ষেপে সদা নামে ডাকা হত। সদা যেন কোনো কিছু নয়-ছয় করতে না পারে সে জন্য তার ওপর নির্দেশ জারি ছিল, ‘সদা, সত্য কথা বলবে’। জমিদারবাড়ির আর কারও জন্য সত্য বলার বাধ্যবাধকতা ছিল না। সেই থেকে ‘সদা’ তথা হতদরিদ্র নিম্নশ্রেণির জন্য সত্য কথা বলার ট্রাডিশন চলে আসছে। ধনী-টাকাওয়ালা-বড়কর্তাদের সত্য বলার প্রয়োজন নেই।’ (সদা সত্য কথা বলিবে)
‘পাগলে কী না বলে আর ছাগলে কী না খায়? ছাগলে ঘুষ খায় না আর পাগলে মিথ্যে বলে না!’ (ছাগলে কি না খায়? ঘুষ)

‘ব্যাচেলরের জীবনে কাজের বুয়াই হচ্ছে একমাত্র আশ্রয় এবং প্রশ্রয়। তিনিই প্রভু, তিনিই কাঙ্ক্ষিতা। একদিন যদি বুয়া না আসে তবে এলোমেলো ব্যাচেলর জীবনে ভীষণ ঝড়ের সর্বনাশ নেমে আসে। ঘরটা হয় গোয়ালঘর। আহার জোটে না। বাথরুমে বালতি ভরা হয়নি বলে হাতমুখও ধোয়া হয় না। এক করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়।’ (ব্যাচেলর বিড়ম্বনা)

‘এ যুগে পুলিস অফিসার হওয়া আর বাড়িওয়ালা হওয়া উভয়ই অত্যন্ত ভাগ্যের ব্যাপার। উভয়েরই রয়েছে দায়গ্রস্ত ব্যক্তিকে নাজেহাল করার অসীম ক্ষমতা। অন্যদিকে কুৎসিত মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা আর ব্যাচেলর ভাড়াটের জন্য বাসা খোঁজা উভয়ই অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা।’ (বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে সমাচার)

‘শুধু কথা দিয়ে, চিৎকার কিংবা বক্তৃতার মাধ্যমে যদি কোনো জাতি উন্নতি কিংবা শ্রেষ্ঠ হতে পারত তবে নিঃসন্দেহে আমাদের চেয়ে উন্নত, শ্রেষ্ঠ জাতি পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।’ (চিৎকার নির্ভর দেশ, আওয়াজ সর্বস্ব জাতি)

‘মুখে আমরা একে-অপরের জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছি; বাস্তবে কাঁচ-কলা। যে যার স্বার্থ ও সুবিধার পেছনে ছুটছি। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটলে সম্পর্কের বাঁধনটাই কেটে দিচ্ছি। ভেজাল আবেগ, ভেজাল মানবিক অনুভূতি ছন্দে ছন্দে বেজে উঠলেও জীবনের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত।’ (ভেজালিয়াতি)

‘অসুখ আমাদের জীবনে চরম সর্বনাশ ও আতঙ্কের নাম। একই সঙ্গে তা জুঁতসই অজুহাতও বটে। অসুখের দোহাই দিয়ে আমরা অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি। অসুখ ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক-উভয় রকমই হতে পারে। আমরা বর্তমানে জাতিগতভাবেই গভীর অসুখে আক্রান্ত।

আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও মাঝে মাঝে অসুখ চর্চা হয়। বিপদে পড়লে আমাদের কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় ‘স্বাস্থ্যগত’ কারণে পদত্যাগ করেন; নৈতিক বা আদর্শগত কারণে কেউ কখনো পদত্যাগ করেন না। অসুখ এক্ষেত্রে সম্মান বাঁচানোর হাতিয়ারও বটে!’ (অসুখ বিসুখ)

‘আমাদের পিতামহরা খড়ম ব্যবহার করতেন। এই খড়ম শুধু ‘পাদুকা’ হিসেবেই নয়; অশিষ্ট, দুর্বিনীত, উদ্ধতদের শায়েস্তা করতেও তা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের পিতামহরা বিদায় নিয়েছেন। তাদের ব্যবহৃত খড়মও আজ লুপ্ত। এই বেহায়া মতলববাজ গণশত্রুদের বেসামাল আচরণকে আজ কে নিয়ন্ত্রণ করবে?’ (ধর্ম, গুণ্ডাতন্ত্র ও পিতামহের খড়ম)

উল্লিখিত কথাগুলো বলেছেন আমাদের সময়ের সেরা স্যাটায়ার লেখক চিররঞ্জন সরকার। চিররঞ্জন সরকারকে চিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে। মুখে সদাই কথার খই ফোটে। এমন জমানো পাবলিক আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানো মানেই আমোদ, নির্ভেজাল আনন্দ। সরাক্ষণ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-কৌতুক-রস নিয়ে মেতে আছে। এমন মানুষের বন্ধুর অভাব হয় না। তারও হয়নি। আমরা যারা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি, তারা জানি ও কী রকম চিজ। অন্যকে হাসাবে, কিন্তু নিজে হাসবে না। অসম্ভব প্রাণশক্তি, অসম্ভব রস। যে কোনো কিছু নিয়ে রসিকতা করার দুর্লভ ক্ষমতা তার আছে। এমনকি নিজেকে নিয়েও নির্মম সব ফান করে! এটা খুবই বিরল। যাহোক, চিররঞ্জন যখন লেখালেখি শুরু করল, তখন আমরা আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম। দেখলাম, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে লেখারও মিল আছে!

তার কিছু কিছু লেখা তো অসাধারণ। চিররঞ্জনের লেখার স্টাইল প্রসঙ্গে মনে পড়ছে চার্লি চ্যাপলিনের গোল্ড রাশ চলচ্চিত্রটির কথা। এই চলচ্চিত্রটি একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। চ্যাপলিনের অনন্যসাধারণ মেধা, গভীর মননশীলতা, সুউচ্চ শিল্পের কাজ, প্রাণপাত পরিশ্রম, উত্তুঙ্গ উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ দক্ষতার ছাপ ছড়িয়ে রয়েছে পুরো ছবিটা জুড়েই। তবে, এই ছবিটির দুটি দৃশ্য ছাড়িয়ে গিয়েছে আর সব কিছুকেই। এরকম অদ্ভুত উদ্ভাবনী দক্ষতাময়, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন, প্রবল রসবোধসম্পন্ন এবং শিল্পের মাধুর্যময় কারুকার্যমণ্ডিত দৃশ্য খুব কম চলচ্চিত্রেই পাওয়া যায়।

এই দুটি দৃশ্যের একটি হচ্ছে জুতো খাবার দৃশ্য। ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিয়েও যে তীব্র রসাত্মক দৃশ্য তৈরি করা যায় তাঁর প্রমাণ হচ্ছেন চ্যাপলিন। তীব্র তুষারপাতের মধ্যে একটা কেবিনের মধ্যে আটকে পড়া দুজন ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার জন্য অন্য কিছু না পেয়ে একজনের পায়ের একপাটি জুতো সিদ্ধ করে খাচ্ছে। করুণ কোনো দৃশ্যকে হাস্যরসাত্মক এবং ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে চ্যাপলিনের জুড়ি ছিল না। তবে, এই দৃশ্যে তিনি নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। চ্যাপলিন মনে করতেন যে, অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে হাস্যরস করাটাও এক ধরনের বিদ্রোহই।

চিররঞ্জন সরকারের লেখা ‘রাজনীতির প্যাঁচ প্যাঁচের রাজনীতি’ পড়তে গিয়ে চ্যাপলিনের এই কথাটিই মনে হয়েছে। চিররঞ্জন বইটি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ভালো-মন্দ যাই হোক, বইটি নিয়ে কিছু লিখতে হবে। আমি লেখক নই, ফেসবুকে মাঝে মাঝে লিখি বটে। কিন্তু বন্ধুত্বের দায় আর ভালোলাগাবোধ থেকে তাঁর লেখা কিছু অংশ তুলে দিয়ে নিজের কর্তব্য পালন করলাম!

তবে এটুকু বলতে পারি যে, চলমান বিভিন্ন ঘটনা ও রাজনীতি নিয়ে তার আড়াআড়ি বা তির্যক সব মন্তব্য তুলনাহীন। তার প্রতিটি লেখার দ্যুতিময় মননশীলতার ছাপ পাওয়া যায়। ক্ষুরধার চিন্তার আঘাত পাঠককে জাগ্রত করে, আলোকিত করে এবং একটি নতুন দীপিত জগতে তুলে নেয়। আবার আমোদিতও করে। তিনি সেই দলের লেখক যাঁরা রম্যরচনার ছদ্মাবরণে উচ্চতর চেতনাসম্পদ উপহার দিয়ে চলেছেন। মুখের ভাষার মতো তাঁর গদ্যও বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষিপ্র, কাব্যময়, রঙিন ও ক্ষুরধার।

‘প্যাঁচের রাজনীতি রাজনীতির প্যাঁচ’ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ইমদাদুল খান সোহেল। চিররঞ্জন সরকারের এই বইটি প্রকাশ করে এবং ২০০ টাকা দাম রেখে ‘সমগ্র প্রকাশন’ নিঃসন্দেহে একটা ভালো কাজ করেছে।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া