X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র যাত্রা : যে রানওয়েতে নামলো

বিধান রিবেরু
১৩ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৪৩আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৪৪

তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র যাত্রা : যে রানওয়েতে নামলো বাংলাদেশী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে জহির রায়হান ও আলমগীর কবিরের পর বোধ করি তারেক মাসুদই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বেশী পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন এবং ধীরে ধীরে সাফল্যের দেখা পান। এই অর্জনে তাঁর সহধর্মিনী ক্যাথেরিন মাসুদের অবদানও কম নয়। মুক্তির গান, মাটির ময়না ও রানওয়ে তারেক মাসুদের উল্লেখযোগ্য, আলোচিত ও প্রশংসিত কাজ। মুক্তির গান ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একদল গায়কের ক্যাম্পে ক্যাম্পে অনুপ্রেরণা যোগানো ও তাদের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নিয়ে ডকুফিকশন। আর মাটির ময়না হলো মাসুদের অনেকদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন এবং নিজের প্রথম কাহিনীচিত্র। মাদ্রাসা ছাত্র অনুকে ঘিরেই তৈরী হয়েছে এই চলচ্চিত্রের বৃত্তচাপ। অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগে যে ছবি তিনি শেষ করেছেন এবং রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করেছেন, সেই রানওয়ে ছবিতেও রয়েছে মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা। তবে প্রথমটার প্রেক্ষাপট ১৯৬০ সালের দশক, সেখানে রয়েছে সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসকে নিয়ে সমালোচনা, রয়েছে ধর্ম ও ইজম নিয়ে নির্মাতার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। জীবনের শেষ কাহিনীচিত্রে রয়েছে শূন্য দশকের জঙ্গীবাদ ও সেখান থেকে ছবির প্রধান চরিত্র রুহুলের পরিত্রাণ পাওয়ার কাহিনী। উপকাহিনী হয়ে এসেছে গার্মেন্টসকর্মীদের কথা, এসেছে এনজিওর ঋণদান ও শোষণের কথা। উল্লিখিত তিনটি ছবির প্রথম দুটিকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে কিন্তু তৃতীয়টির বয়স এক বছরের কিছু বেশী হওয়ায়, তা নিয়ে এখনো ব্যাপক আকারে সাহিত্য তৈরী হয়নি। তাছাড়া নির্মাতা নিজেও ছবিটিকে বিশেষ প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেখাচ্ছিলেন। ফলে দর্শকদের বিশাল অংশই রানওয়ে ছবিটি দেখার সুযোগ পাননি। তারপরও বিভিন্ন জনপ্রিয় ও প্রচারশীর্ষ পত্র-পত্রিকায় রানওয়ে ছবি সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে, সেগুলো চলচ্চিত্রটিকে একভাবে পাঠের প্রতিক্রিয়া। মেধাবী নির্মাতা তারেক মাসুদের সর্বশেষ এই ছবিটি পড়ার সুযোগ হয়েছে এবং যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটি আগেরগুলোর চেয়ে কিঞ্চিত আলাদা বোধ করি। তাই সেটা তুলে ধরছি।

রানওয়ে ছবির শুরুতেই এক বিকট উড়োজাহাজের শব্দ শোনা যায়। মনে সবকিছু বুঝি ভেঙে পড়ছে। ভঙ্গুর সমাজের অবস্থা বুঝাতে শব্দের এমন মন্তাজ আমাদের আগ্রহী করে তোলে। তাছাড়া পশ্চিমাদের তৈরী উড়োজাহাজকে যে ক্যামেরা কোন থেকে দেখা যায় তাতে মনে হয় মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা রুহুল, রুহুলের মা, বোন ও দাদা সকলেই ঐ উড়ালযন্ত্রের আবিষ্কর্তাদের অধীন। কিন্তু মটিফের মতো করে আকাশযানের এই যাতায়াত ও শব্দ, পশ্চিমাদের অধীন সেটা না বুঝিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে রেলগাড়ি যে কাজটি করেছে সেটিও করতে পারে। অর্থ ঠিক করে নেয়ার দায়িত্ব কিছুটা তো দর্শকের উপর বর্তায়।

চলচ্চিত্রে আফগানিস্তান ও চেচনিয়াতে জঙ্গী প্রশিক্ষণের বিষয়টি এসেছে, আমরা জানি, এসব প্রশিক্ষণ-দৃশ্য প্রকাশ পায় নাইন ইলেভেনের পর, আর এতসব প্রস্তুতি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধেই। স্থানীয় পর্যায়ে দেখা যায়, এক অজানা চরে আফগানিস্তান ফেরত উর্দুভাইয়ের নেতৃত্বে রুহুল ও আরিফদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ, সিনেমা হলে হামলা চালানো প্রভৃতি। এগুলো দেখে বোঝা যায় নির্মাতার ইঙ্গিত কোন দিকে। এছাড়া, উর্দুভাইয়ের সঙ্গে বাস্তবের বাংলা ভাইয়ের কর্মকাণ্ডের মিলও আছে। তো এই উর্দুভাই আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এক নেতার সঙ্গে আতাত রেখে চলে। কাহিনীর মূল চরিত্র রুহুল উর্দুভাইয়ের পাল্লায় পড়ে আরিফের মাধ্যমে। আরিফের সঙ্গে রুহুলের পরিচয় হয় এক কম্পিউটারের দোকানে কাজ শিখতে গিয়ে। সেখানে আরিফকে আমরা দেখি পশ্চিমা বিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য দিতে। ছবির আরেক জায়গায় দেখা যায় বিশ্বস্ত ব্যাংক থেকে ফোন আসে ঋণের টাকা শোধের ব্যাপারে। তো সেই ফোন যিনি ধরেন, রুহুলের বৃদ্ধ দাদু, তিনি কানে ভুল শোনেন, বিশ্বস্ত ব্যাংকের জায়গায় তিনি শোনেন ‘বিশ্ব ব্যাংক’। ঋণদান ও আদায়ের সঙ্গে বিশ্ব বা বিশ্বস্ত, সবই যে এক, তারা যে দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য ও ভোগান্তি দুটোই বাড়ায় সেটা বোঝাতে চান তারেক মাসুদ। অতয়েব এসব ঘটনা ও সংলাপ থেকে এটাও ধরে নেয়া যায়, যন্ত্রপক্ষীরাজের বারংবার আসা যাওয়াকে নির্মাতা যুক্ত করতে চান বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে, বিশেষ করে জঙ্গী সমস্যার সঙ্গে। একটি দৃশ্যে বাচ্চা ছেলেকে দেখা যায় উড়োজাহাজকে লক্ষ্য করে গুলতি ছুড়ছে। অর্থাৎ সমস্যার বিনাশ চাই কিন্তু সেটার উপযুক্ত অস্ত্র আমাদের নেই। এখন এই উড়ালযান সমস্যার রূপকালঙ্কারই হোক অথবা পশ্চিমাদের খবরদারির ইঙ্গিত, এই ছবিতে যেভাবে রুহুল জঙ্গী দলে নাম লেখায়, প্রশিক্ষণ ও অভিযান চালায় এবং পরিশেষে সুবোধ বালকের মতো ঘরে ফিরে আসে, সেটা দেখে কিন্তু মনে হয় নির্মাতা নিজে পশ্চিমাদের দৃষ্টিতেই জঙ্গীবাদকে বিচার করেছেন।

হামলা চালিয়ে সাধারণ ও বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা অন্যায়, কিন্তু একই ঘটনা যদি ফিলিস্তিন কিংবা আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অথবা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাহলে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা টানা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বর্তমানে ঐরকম প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে না ঠিক, কিন্তু যে কারণে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গীবাদের উত্থান, বলা ভালো যাদের কারণে এদের জন্ম, (আফগানিস্তান থেকে রাশিয়াকে হঠাতে তালেবানদের হাতে আমেরিকানদের অস্ত্র তুলে দেয়ার কথা সকলেই জানেন অথবা সম্প্রতি গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে এনটিসি যোদ্ধাদের অস্ত্র যোগানো, যেসব অস্ত্র আবার চলে যাচ্ছে আল কায়েদার মতো সংগঠনগুলোর কাছে) তাদের ছেড়ে কথা বললে আখেরে তাদের সুরেই কথা বলা হয়। যেমনটা হয়েছে রানওয়ের বেলাতে।

জন্মসূত্রে খানিকটা আরব চিন্তাবিদ তালাল আসাদ বলেন, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইসলামি ভাবাদর্শের মিশেল ঘটিয়ে যে হামলা ও হত্যা হচ্ছে সেটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় আমেরিকা ও ইউরোপ। সেসব যুদ্ধেও সাধারণ মানুষ মরছে। কিন্তু সেগুলোকে তারা বলছেন ‘আনুষাঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি’। তার মানে এই দাঁড়ালো, ইসলামি জঙ্গী ও পশ্চিমাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যেটিকে তারা মনে করে ইসলামকে শুচি করার যুদ্ধ, দুটোতেই সাধারণ মানুষ মরছে বেসুমার। তাহলে কেন শুদ্ধ জিহাদিদের দিকে আঙুল? এর জবাবে তালাল আসাদকে সাক্ষী মেনে বাংলাদেশের চিন্তাবিদ সলিমুল্লাহ খান বলেন, “পাশ্চাত্য জগৎ যেহেতু পৃথিবীতে শান্তি ও ন্যায়ের রাজ্য কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর- অর্থাৎ যেহেতু তাঁহাদের উদ্দেশ্য ভালো- তাই তাঁহারা নির্বিচারে হত্যা করিলেও অন্যায় হইতেছে না। বড় ন্যায় ছোট্ট (ও মাঝারি) ন্যায়কে শুদ্ধ কাছেই টানে না, মাঝে মাঝে দূরেও ঠেলিয়া দেয়। সন্ত্রাসবাদীরা যেহেতু বড় ন্যায়ের নাগাল পায় নাই, সুতরাং তাহাদের নির্বিচার হত্যা- মায় আত্মহত্যা অবধি- অন্যায়। তালাল আসাদ দেখাইতেছেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই যুক্তি ধোপে টিকিবার যোগ্য নহে। টিকিলে পাশ্চাত্যের যুক্তি পর্যন্ত বর্ণের কলুষে বিবর্ণ হইবার আশঙ্কা থাকিয়া যায়।”

জঙ্গীবাদ নির্মূলে সদলবলে যেভাবে দেশ দখলের অভিযান চলছে তাতে নিতান্ত শিশুর কাছেও বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, পেছনে আরো বড় কারণ রয়েছে। অবাধ্য কয়েকটি সশস্ত্র দলকে শায়েস্তা করা উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য হলো তেল গ্যাসের মতো জাতীয় সম্পদ এবং আঞ্চলিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইরাক ও আফগানিস্তানের থেকে একেবারে ভিন্ন কৌশলে সম্প্রতি দখল হয়েছে লিবিয়া। মাটির তলার সম্পদ লুন্ঠণে যারা জঙ্গীবাদকে একটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, যাদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের কারণে পৃথিবীর বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে সভ্যতা, সেই পশ্চিমাদের ঢালকে নিজেদের সমস্যার উৎস্য বানালে, কিংবা বলা চলে, তাদের প্রতিদিনকার আওড়ানো বুলি নতুন করে আওড়ালে, জঙ্গী দমনের নামে একদিন এদেশের সম্পদ লুণ্ঠনেরও টিকিট পেয়ে যাবে পশ্চিমারা। তার মানে এই নয়, ইসলামের নামে পশ্চিমাদের বিরোধীতা করে যা হচ্ছে সেটাকে সমর্থন করছি। বরং বলতে চাইছি, জঙ্গীদের চেয়েও অনেক বড় বড় অপরাধ করে, একটা ভালো মানুষী মুখোশ পড়ে যারা আছে, তাদের চরিত্র উন্মোচনের মধ্য দিয়েই জঙ্গী সমস্যার সমাধান সম্ভব। সমস্যা ইসলাম ধর্মে নেই বরং ত্রাস ও সন্ত্রাস দিয়ে ইসলামকে ব্যাখ্যা করার মধ্যে নিহিত। তালাল আসাদ ওয়েলেক লাইব্রেরি বক্তৃতায় বলছেন, পশ্চিমা পণ্ডিতরা মনে করেন ইসলাম আধুনিকতা বিরোধী। এর বড় দৃষ্টান্ত ইসলামি সহিংসতা, মানে ইসলামি জঙ্গীরা যা করে, বাংলা ভাই বাংলাদেশে যা করেছে, তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র রানওয়েতে উর্দুভাই যা করেছে ইত্যাদি। তালাল আসাদ এও বলেন, পশ্চিমা পণ্ডিতদের একটা অংশ বিশ্বাস করেন ইসলাম জাহানকে যতদিন পর্যন্ত না আমূল সংস্কার করা হচ্ছে, ততদিন সন্ত্রাস বা তথাকথিত জিহাদী জোশ থেকেই যাবে। কিন্তু ঐ পণ্ডিতগণ এটা ভাবছেন না, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানেও মার্কিনীদের বোমায় মানুষ মরছে, গুয়েনতানামো বে কারাগার কিংবা আবু গারিব কারাগারে ‘সভ্য’ সৈনিকরা অসভ্য, মানবতাবিরোধী কাজ করছে প্রতিদিন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে সেই করুণ ইতিহাস অনুপস্থিত। মূল ধারায় হার্ট লকারের মতো হলিউডি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় এবং অস্কার জিতে নেয়। বাংলাদেশেও পশ্চিমা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভকেই গ্রহণ করা হচ্ছে দেদারসে। বঞ্চনা ও নিপীড়নের কথা উঠে আসছে গুটি কয়েক প্রামাণ্যচিত্রে। পশ্চিমা শক্তি ও জঙ্গীদের মানুষ মারার পাল্টাপাল্টি খেলা চলতেই থাকবে, যতদিন পর্যন্ত পশ্চিমারা তাদের আগ্রাসী চরিত্র বজায় রাখবে, ইসলামি জঙ্গী বলি কিংবা লিবিয়ার মতো ভূঁইফোড় এনটিসি যোদ্ধা, এরা জন্মাতেই থাকবে, ইতিহাসের নাটাই কার হাতে সেটা না বুঝলে শুদ্ধ ঘুড়িটাকেই দেখবো মুগ্ধ চোখে।

রানওয়ে ছবির শেষের দিকে দেখা যায় রুহুল জঙ্গী পথ থেকে ফিরে আসে, হঠাৎ করেই। তার জঙ্গী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া যেমন আকস্মিক তেমনি ছেড়ে আসাও রাতারাতি। রুহুলের মতো করে দর্শকও এক চমৎকার সকালে উঠে বসেন, এবং প্রত্যক্ষ করেন কোনো সমস্যা নেই, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে, সকল মুশকিল আসান হয়ে গেছে। আগের মতোই, মানে বোন বস্ত্রবালিকা রয়ে গেছে ও মা ঋণের অর্থ নিয়ে সংসার চালাচ্ছে, রুহুল কি করবে সেই ইঙ্গিত নেই, কিন্তু একটা বার্তা আছে, সেটা হলো ঘরের টানে জঙ্গী ভাই, তোমরা আগের জীবনে ফিরে এসো, হোক সেই জীবন ভৃত্যের। জঙ্গী কর্মকাণ্ডের পেছনে দেশীয় যে রাজনৈতিক নেতার হাল্কা উস্কানি দেখা যায় ছবিতে, তা যেমন কোনোভাবেই জঙ্গী সন্ত্রাসের মূলকে দোষারোপ করে না, তেমনি জঙ্গী উত্থানের পথকে বন্ধ করার নির্দেশও দেয় না। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশের আঁকা ছকে দরিদ্র দেশগুলোর ধর্ম বিশ্বাসী কিছু বেপথু মানুষকে যদি ফেলা হয়, তাহলে এই জঙ্গীবাদের প্রসার বাড়তেই থাকবে, কারণ এটাই তো দেশ দখল ও সম্পদ লুণ্ঠনের মূল চাবিকাঠি।

সোভিয়েত নন্দনতত্ত্ব বিশারদ এ্যাভনার জিস কার্ল মার্ক্সকে সাক্ষী মেনে বলেন, মার্ক্সবাদী নন্দনতত্ত্বের চর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারেন না ঐসব লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, যেসব লেখক মনে করেন, বিচ্ছিন্নতাবাদের কারণ বা এর উৎস্য (আমরা বলতে পারি সমস্যার মূল কারণ) উন্মোচন করতে ও সমাধানের পথ বাতলে দিতে শিল্পীরা বাধ্য নন। তাঁরা মনে করেন, সমস্যা আছে, ওটা বলে দেয়াই শিল্পীর জন্য যথেষ্ট। এ্যাভনার জিস মনে করেন, শিল্পীরা হলেন জীবন নামের পাঠাশালার ছাত্র, সমস্যা বিরাজ করে, এই কথা বলে দিলেই শিল্পীর দায়-দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের আলোচ্য চলচ্চিত্রের নির্মাতা মার্ক্সবাদী ছিলেন, সেটা বলা যায় না, অতএব মার্ক্সবাদী তত্ত্বের আলোকে তিনি এগুবেন সেটা প্রত্যাশা করছি না, কিন্তু তারপরও আশা করতে দোষ কি! মার্ক্সবাদীরা মনে করেন, সমস্যা দেখানোই শুদ্ধ নয়, সমস্যার উৎস্য ও সমাধান ইঙ্গিত করাও শিল্পীর কাজ। কিন্তু রানওয়ে ছবিতে বোধ করি সমস্যাটা বুঝতেই একটু গোলমাল বেধেছে, নয় তো জঙ্গী সমস্যার যে উৎস্য, মূল ও বড় যে সমস্যা সেটাই অনুপস্থিত এই ছবিতে। সমস্যা বাস্তবে উর্দুভাই, বাংলা ভাইদের মধ্যে নয়, সমস্যা আমরা যারা পশ্চিমা শক্তির সমালোচনা থেকে বিরত থাকছি। এই বুশ-ব্লেয়ার ভাইয়েরাই জঙ্গী সমস্যার উৎস্য, সুতরাং সমাধানও সেখানে। কিন্তু চলচ্চিত্রে যদি দেখানো হয়, আপনি এক সুন্দর ভোরে উঠলেন, সূর্যালোকিত দিন, পাখি ডাকছে, কোথাও কোনো ঝামেলা নেই, সবই আগের মতো ঝামেলাবিহীন, স্থিতিশীল তাহলে বাস্তবে গতকালের দুঃসময়টাকে মনে হবে স্রেফ দুঃস্বপ্ন। দর্শক যেহেতু রুহুলের সঙ্গে নিজেদের সেলাই করে নেন, তাই দর্শকরাও ভাবতে থাকবেন একদিন জঙ্গীসদস্যরা ঘরের টানে ঘরে ফিরে আসবে এবং সমস্যার শেষ হবে। আর অন্যদিকে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রুহুলের বাবার মতো বিদেশে শ্রম বিক্রি এবং রুহুলের বোনের মতো বিদেশীদের জন্যই কম মুজুরীতে কাপড় তৈরী, এ দুটোই যেন যথেষ্ট, যেন এতেই দেশের অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, এদেশ যেন কৃষিহীন, এদেশে যেন আর কোনো শিল্প গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ কথাগুলো আসতো না, যদি বিষয়গুলোর উল্লেখ না থাকতো চলচ্চিত্রে।

রানওয়ে যদি আল্পনা হয়, তাহলে এতে মোটিফের মতো করে যে উড়োযান ও যান্ত্রিক শব্দ এসেছে, পশ্চিমা শক্তি অথবা সমস্যার হুঙ্কার রূপে, সেই হুঙ্কারের জোরেই দেখি আল্পনা মূল সমস্যার দিকে নয় বরং রেখাপাত করেছে ভুলের দিকে। তারপরও বলতে দ্বিধা নেই, তারেক মাসুদ যে দৃঢ়তার সঙ্গে, জীবন যাপনের সঙ্গে ছবি নির্মাণকে একাত্ম করে এবং যে চলচ্চিত্রিক ও কারিগরি জ্ঞান নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন তা সমকালে বিরল বটে। তাঁর অকাল প্রয়াণে স্তম্ভিত হয়েছি, সঙ্গে যাঁরা সহযাত্রী হয়েছেন- মিশুক মুনীর, মোতালেব হোসেন, জামাল মিঞা ও মোহাম্মদ মোস্তাফিজ, তাঁদের প্রতিও রইলো আমাদের শ্রদ্ধা।


 

দোহাই

Talal Asad, On Suicide Bombing (2007), Seagull Books (2008), Kolkata
Avner Zis, Foundations of Marxist Aesthetics (1977), Progress Publishers, USSR
সলিমুল্লাহ খান, আদমবোমা (২০০৯), আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান সম্পাদিত ইতিহাস কারখানা ২, আগামী প্রকাশনী, এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ঢাকা

------

প্রথম প্রকাশ : উলুখাগড়া, ফেব্রুয়ারি ২০১২

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
লেবাননে এক হিজবুল্লাহ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
লেবাননে এক হিজবুল্লাহ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়