X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

চরাচরের কবি’র সঙ্গে কিছুক্ষণ

.
১৭ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৩৯আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০১৬, ১৯:৩২

আলাপচারিতায় শবনম ফেরদৌসী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মজুমদার, আবু সায়ীদ (একাত্তর টিভি থেকে ছবিটি নেওয়া) বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একজন কবি। পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতিতে, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তিনি নিজের আরও একটি পরিচয় দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা। কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতার ছন্দ যেন চলচ্চিত্রের পর্দায়ও এক ভিন্ন ইমেজ তৈরি করে ফেলে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত জীবনের শুরুতে ছিলেন সত্যজিৎ রায় দ্বারা অনুপ্রাণিত। বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ দিয়ে শুরু করলেও এখন তিনি ভিন্ন ধারার একজন নির্মাতা। তার নির্মিত চলচ্চিত্র- সময়ের কাছে (১৯৬৮), দূরত্ব (১৯৭৮), অন্ধ গলি (১৯৮৪), তাহাদের কথা (১৯৯২), উত্তরা (২০০০), মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২), কালপুরুষ (২০০৮), জানালা (২০০৯) ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হয়েছে।

তারই মুখোমুখি হয়েছেন নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী। এমন ভিন্ন একটি আলোচনায় আরও ছিলেন ভারতের ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিস-এর সাধারণ সম্পাদক প্রেমেন্দ্র মজুমদার এবং বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নির্মাতা আবু সায়ীদ।

শবনম ফেরদৌসী: দাদা, কেমন লাগছে বাংলাদেশে এসে, এবার তো আর নতুন নয়।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: বাংলাদেশে যখনই আসি আমার খুব ভালো লাগে। যখনই প্লেনটা ল্যান্ড করতে শুরু করে, জানলা দিয়ে আমি বাংলাদেশের জমি দেখতে পাই, চোখটা কেমন ভিজে যায়। কথা বলতে অসুবিধা হয়। খুব ছোট্টবেলায় আমি ঢাকা শহরে কাটিয়েছি। ১৯৫০-এর শেষ চলে যাওয়া। শিকড়সুদ্ধ উপড়ে আমাদের পরিবার চলে যায় ওখানে। শহরটা কলকাতা কিন্তু তার মধ্যে বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ বেঁচে আছে।
শবনম ফেরদৌসী: সেই অতীত ও বর্তমানের একটা মাঝামাঝি সময়ে অবস্থান করতে থাকেন হয়তো... আমি আরেকটু পরিচয় করিয়ে দিতে চাই আমাদের সঙ্গে যে আরও অতিথিরা আছেন। আমাদের সঙ্গে আছেন, প্রেমেন্দ্র মজুমদার, তিনি হচ্ছেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিস অব ইন্ডিয়ার সেক্রেটারি জেনারেল। পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র সংগঠক, সমালোচক। সঙ্গে আরও আছেন আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতা আবু সায়ীদ। প্রেমেন্দ্র মজুমদার আপনার কাছে আসতে চাচ্ছি কারণ আপনার সঙ্গে দাদার ( বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত) অনেকদিনের একটা বোঝাপড়া। তো সেই জায়গা থেকে যদি বলতেন যে, এই যে দীর্ঘ সময় পথ চলা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর, সেই জায়গাটাকে কোথায় দাঁড় করাবেন?

প্রেমেন্দ্র মজুমদার: বুদ্ধ’দার সঙ্গে আমার পরিচয়সূত্র অবশ্যই ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট। তখন ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে। দূরত্ব, নিমঅন্নপূর্ণা, শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি —এই সমস্ত ছবি তখন তৈরি হচ্ছে। আমরা তো বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটিতে নিয়ে গিয়ে সবার ছবি ইন্ট্রোডিউস করতাম, দেখাতাম। বুদ্ধ’দারও ‘দূরত্ব’ দেখিয়েছি আমরা, ‘নিমঅন্নপূর্ণা’ দেখিয়েছি। অনেককাল আগের কথা, সে আজকের কথা নয়। সেই সময় ‘শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি’ নিয়ে আমার ছোট একটা লেখা বেরিয়েছিল, বাংলায়। একটাই মাত্র শো হয়েছিল। অসম্ভব ভালো একটা ছবি। সম্প্রতি আমি একটা বইও সম্পাদনা করি, ‘দ্য পোয়েট অব সেলুলয়েড’ বলে। বুদ্ধদার সমস্ত কাজ নিয়ে।

শবনম ফেরদৌসী: আসলে ভারতীয় চলচ্চিত্র যে আন্দোলন, নির্মাতাদের আন্দোলন বলি যেই জায়গা থেকেই, সেই জায়গায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের...

প্রেমেন্দ্র মজুমদার: ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কোনও আন্দোলন নেই। ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট আছে। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন অবশ্যই আছে। এবং ভারতীয় সিনেমাতে বিভিন্ন ভাষাতে অন্য ধারার ছবি তৈরি করার একটা... আন্দোলন অর্থে না, অন্য ধারার অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাই আসছেন। সত্যজিৎ, ঋত্মিক, মৃণাল সেন—তিনজন গ্রেট মাস্টার কলকাতা শহর থেকেই আসছেন। কেরালায় আদুর গোপাল কৃষ্ণান আসছেন। বোম্বেতে শ্যাম বেনেগাল আসছেন। ব্যাঙ্গালোরে গিরিশ কাসারাভালি আসছেন। তারা সবাই সত্যি সত্যি গ্রেট মাস্টার। তার মধ্যে বুদ্ধদা সবারই শ্রদ্ধেয়। যেহেতু তাদের সবার চেয়ে সিনিয়র, প্রায় সমসাময়িক বা তারপরও...

 

সিনেমায় আমি যা বলব, তার একটা অংশ তো আমি নিজেই। আত্মকথন নয় কিন্তু তার পরও কোথাও নিজেকে তো ছড়িয়ে দিতেই হয়।- বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

 

শবনম ফেরদৌসী: আসলে নির্মাতা তো তার কাজটি দিয়েই আন্দোলনটা চালিয়ে যান, মানে যদি আমি বলতে চাই যে, সমাজ বদলের কথাই বলি, কী তার  চিন্তা, সেটার যে রিফ্লেকশন হবে, সেটাও তো একধরনের...

প্রেমেন্দ্র মজুমদার: সেটা হবেই, কারণ ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিষয়টা আরও জটিল হয়ে যায় এই কারণেই, কারণ ভারতবর্ষ তো প্রায় দেড় হাজার ছবি তৈরি করে বছরে বাইশটা-ছাব্বিশটা বিভিন্ন ভাষাতে। অসংখ্য ছবি হচ্ছে, তার একটা বিশাল মার্কেট, পৃথিবী জোড়া বাজার। সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে তারা যেসব ছবি তৈরি করছে। অন্যরকম ছবি, যেগুলোকে সত্যি সত্যি ভারতীয় ছবি বলে চিহ্নিত করে লোকে। যেগুলো শ্রদ্ধা ভক্তি করে, অন্য ছবির তো একটা বড় বাজার আছেই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা নমস্য।

শবনম ফেরদৌসী: আবু সায়ীদ আপনি যদি বলতেন, এই যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি দেখে তো আমাদের বেড়ে ওঠা, সেইখানে নির্মাতা হিসেবে আপনি কোন জায়গাটায় এফিলেইটেড বোধ করেন?

আবু সায়ীদ: সেটা ধরেন শুধু আপনাদের না আমাদের সময় থেকেও, তখনও কিন্তু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অনেক বড় একজন নির্মাতা। আমি যখন ছবি নির্মাণ শুরু করি, তখন খুব যে ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল তা কিন্তু নয়, যেহেতু আমি মফস্বলে থাকতাম। ভিএইচএস ক্যাসেটের মাধ্যমেই যে দু-চারটে ছবি দেখা। কিন্তু ওনাকে নিয়ে লেখা, ওনার ছবির বক্তব্য, ওনার ছবির ল্যাঙ্গুয়েজ সেই বিষয়টা কিন্তু আমি অনেক আগে থেকেই পরিচিত। এছাড়া ওনার ছবির চিত্রনাট্যটা তখন পাওয়া যেত। এটা একটা বড় ব্যাপার ছিল যেটা অনেকের ক্ষেত্রেই সেটা ছিল না। তখন প্রথম আমি দেখি, আমার যতদূর মনে পড়ে ‘গৃহযুদ্ধ’ এবং গৃহযুদ্ধের চিত্রনাট্যটাও পড়তে পারি এবং তাতে সুবিধা হয় যে চিত্রনাট্য এবং একটা ফিল্মের যে নির্মাণের যে একটা ব্যাপার সেটা কিন্তু বোঝা যায়। পরবর্তী পর্যায়ে আমি তো তার অনেকগুলো ছবিই দেখেছি। শুধু মুগ্ধই হয়েছি। বিশেষ করে আমাদের এখানে সবচাইতে বেশি হয়তো প্রভাব বিস্তার করেছেন সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্মিক। কিন্তু তাদের ভাষাগত দিক থেকে যদি চিন্তা করি, ছবির ইমেজগত দিকে থেকে চিন্তা করি, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একেবারেই আলাদা। যেটা পরবর্তী পর্যায়ে অনেকেই এসেছেন। কিন্তু তার মধ্য থেকে উনি যে একবারেই আলাদা এবং সেটাই কিন্তু আজকের যে অবস্থান এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করে উনি যে এখনও চলচ্চিত্র তৈরি করে যাচ্ছেন এবং মানুষের চলচ্চিত্রের ভাষাকে নতুন মাত্রা দিতে পারছেন এটা কিন্তু ওনার নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করার ব্যাপার।

শবনম ফেরদৌসী: আমি এই সূত্র ধরেই দাদা আপনার কাছে আসতে চাচ্ছি, একটা বিষয় ঘুরে ফিরে পাওয়া যায় আপনার ছবিতে সেটা হচ্ছে, আপনি খুব একা মানুষের কথা বলেন। এই যে ভিন্ন একটা জায়গা, একটা বিচ্ছিন্ন সত্তা, কিন্তু তার সমস্ত হিউম্যান কোয়ালিটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, এটা কি আপনারই রিফ্লেকশন কিনা? 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: কিছুটা তো বটেই। সিনেমায় আমি যা বলব, তার একটা অংশ তো আমি নিজেই। আত্মকথন নয় কিন্তু তার পরও কোথাও নিজেকে তো ছড়িয়ে দিতেই হয়। সেখানে নিজের যে বোধগুলো ভাবনাগুলো বেঁচে থাকার রসদগুলো ভালোবাসাগুলো রাগগুলো অভিমানগুলো সবইতো জড়ো হয়। দুটো শব্দ আছে ইংরেজিতে– লোননি আর অ্যালোন। আমি লোনলি নই, অ্যালোন। কিন্তু একা থাকতে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি এ কারণে, যেকোনও সৃষ্টিশীল মানুষ একা থাকতে ভালোবাসেন কিছুটা সময়।

শবনম ফেরদৌসী: নাকি সে জন্মায়ই একাকি হয়ে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হয়তো তাই। কিন্তু সে তো বুঝতে পারে না! ওই বোধগুলো সে বুঝতে পারে অনেক পরে। যখন সে কোনও কাজের মধ্যে ঢুকে যায়। কবিতা লিখতে এসে, ফিল্ম করতে এসে আমি নিজেকে খুঁজতে শুরু করলাম, একটা সময় বুঝতে পারলাম যে আমি একা। এবং এটাই আমার কবিতায়, আমার সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে এসেছে এবং একাকিত্বতা আমাকে তৈরি করতে হয়নি। অনেকসময় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে আমি থাকি। আসলে কিন্তু আমি ওখানে থাকি না।

শবনম ফেরদৌসী: এবং তার রিফ্লেকশনও আপনার ছবিতে দেখি যে, একা... ওই যে ‘কালপুরুষ’-এর কথা যদি বলি, কথা বলছে বাবার সঙ্গে, রাস্তার মানুষ যাচ্ছে চারপাশ দিয়ে। এ ব্যাপারটা খুব আসে যে রাস্তার মধ্যে আপনার শ্যুটিংটা খুব দেখতে পাই, শহরের রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে একা একটা মানুষ!

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এটা কিন্তু আপনারও হয়, ওরও হয়... সবারই হয়। যতই ভিড়ের মধ্যে থাকুন না কেন, আপনি কোথাও একদম একা!
শবনম ফেরদৌসী: প্রেমেন্দ্র মজুমদার আপনার কাছে আসতে চাই যে, শেষ পর্যন্ত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের যে সত্তা, একাকী সত্তা, নিঃসঙ্গ নয়, সেটা কি সব মানুষের কথাই বলে, আমাদের প্রত্যেকের। সেটা কি একই সাথে এই সময়ে মানুষ যে ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া সেটাকেও কি রিফ্লেক্ট করে না?
প্রেমেন্দ্র মজুমদার: করে তো বটেই। সেটাই সব না। আসলে বুদ্ধ’দার ছবির যে বিষয়টা রয়েছে, যেমন আমরা বলি পোয়েট অব সেলুলয়েড, একটা কাব্যিক ব্যাপার থাকে, চিত্রায়ন, চিত্রকল্পগুলো নির্মাণ করা, শব্দ নির্মাণ করা এবং ডায়ালগ সবকিছুর ভেতরে একটা কাব্যিক ব্যাপার রয়েছে। এখন দেখুন, এই ধরনের কবিতা তো কবি একা একাই লেখেন, নিজের জন্যই মূলত লেখেন, দু-চারটে লোক না পড়লেও খুব একটা বিশেষ কিছু এসে যায় না। বুদ্ধদার ছবি হচ্ছে মূলত অথর ফিল্ম।
অথর ফিল্ম যখনই হবে তখনই তো একটা সিগনেচার থাকবে। তবেই তো সে অথর হবে। বুদ্ধদার ফেমাস সিগনেচার হচ্ছে বুদ্ধদার এই যে একাকীত্ববোধটা। অনেকের সাথে থেকেও উনি একা থাকতে পারেন।
শবনম ফেরদৌসী: এমনি ফিল্ম সোসাইটিজ করার কারণে তো বিভিন্ন জায়গায় তো আপনি ছবি দেখিয়েছেন। তখন যে মানুষের যে রিঅ্যাকশন, সেটা কি আমাদের একটু জানাতে পারেন কিনা?
প্রেমেন্দ্র মজুমদার: বুদ্ধ’দার ছবি বিদেশে তো অবশ্যই দেখানো হয়, সেখানে তো আর আমরা দেখাইনি, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালসে দেখিয়েছে, সেখানকার রিঅ্যাকশন যারা দেখেছে যারা ফেস্টিভ্যাল এটেন্ড করে তারা বলতে পারবে, সে তো অবশ্যই, তারা তো একটা বোদ্ধা দর্শক। বুদ্ধদার ছবির একটা নির্দিষ্ট দর্শক আছেন। অবশ্যই, তারা একটু প্রশিক্ষিত দর্শক। কারণ দেখুন এরকম ছবি বুঝতে গেলে তো একটা অন্তত কাব্যের ভাষাটা বুঝতে হয়! চলচ্চিত্রের ভাষা অত্যন্ত কঠিন বলে না হয় বুঝলেনই না। সেটা আলাদা কথা। তো সেই বোধ যাদের আছে তাদের কাছে তো উনি অসম্ভব জনপ্রিয় পরিচালক বটেই!

শবনম ফেরদৌসী: আবু সায়ীদ যদি কিছু বলেন...

আবু সায়ীদ: বাংলাদেশেও আমি বলতে পারি যে, একটা সুনির্দিষ্ট একটা দর্শক আছে। কালকেও যে আমাদের একটা আড্ডা হচ্ছিল সেখানে যারা ছিলেন, তার ছবির শট ধরে ধরে বলছিলেন। এবং তার যে এই যে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা তার শট যেভাবে কথা বলে... একটা সৌন্দর্য তো থাকেই এবং লম্বা টেক নেওয়ার একটা প্রবণতা, অনেক ট্রলি করে করে... মিজো সিনটা তার একটু ডিফরেন্ট। অনেক পরিকল্পিত সেটা খুবই বোঝা যায়। কিন্তু সেটা কিন্তু শুধু মাত্র ওই যে সৌন্দর্যের মধ্যেই থাকে না। ওর মধ্য দিয়ে আরেকটা মাত্রা দিতে পারে। সেটাই হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘তাহাদের কথা’ই বলুন! উনি ওনার ভিজ্যুয়াল দিয়ে ওনার ভেতরের শক্তি দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

শবনম ফেরদৌসী: হ্যাঁ নিজের ভাষা অন্যকে বুঝানো।

আবু সায়ীদ: বুঝানো।

শবনম ফেরদৌসী: এর চেয়ে কঠিন কাজ চলচ্চিত্রে আর হয় না।

আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, সেটাই আর কী।

শবনম ফেরদৌসী: দাদা, আসলে ফটোগ্রাফি বলি, ভিজ্যুয়াল বলি, কতখানি গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ক্যামেরা তো আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ক্যামেরা বাদ দিয়ে তো আমি ছবিটা করতে পারবো না। কিন্তু ক্যামেরা নিজের গুণেই ছবি তোলে। তাই না? ক্যামেরা আপনি চালিয়ে দিয়ে চলে যান এক ঘণ্টা ঘুরে আসুন দেখবেন অনেক কিছু উঠে গেছে। কিন্তু আপনি যদি ক্যামেরাটাকে ব্যবহার করতে চান, আপনার মতন করে, দৃশ্যগুলোকে গাঁথতে চান আপনার ভাবনার মতন করে, তাহলে কিন্তু ক্যামেরাটাকে আপনার বশ্যতা স্বীকার করতেই হবে। লেন্স, আলো ভীষণ প্রয়োজন। বিশেষ করে যে ইমেজ, যে ধরনের ইমেজ আমি তৈরি করতে চাই, যেগুলো একদম আমার নিজের ইমেজ, যেগুলো কোনও অংশেই ম্যানিপুলেটেড নয়, সে ইমেজটা তৈরি করতে গেলে কিন্তু আামাকে ভীষণভাবে বুঝতে হবে ওই ইমেজটা আমি কিভাবে তৈরি করবো। ক্যামেরা আমি কোথায় বসাবো, কখন বসাবো, কোন লেন্সে বসাবো, কী মুভমেন্টস নেব। যেমন এবারকার ছবিতেও আছে সাত মিনিটের একটা শট। ক্যামেরা কোথাও নড়ছে না কিন্তু আমাকে ভেবে নিতে হয়েছে যে ওই একটা টেক আমি করবো, ইমেজটা যেটা তৈরি হবে সে ইমেজটা কিন্তু প্রতি মুহূর্তে নতুন হয়ে যাচ্ছে। শেষ করলাম যেটা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’। শেষের দিনের শ্যুটিং এর সময় আমার অ্যাসিসটেন্ট বললেন যে, দাদা ক্যামেরাটা ওই দিকে নিয়ে যাবো তো? আমি বললাম না! কে বলেছে তোমাকে? ওখান থেকে নেবেন না? আমি বললাম, নাহ, আমি নেব না, আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই। মানে আমার মনে হয় যে আমরা অনেক সময় সিনেমা করতে গিয়ে অতিকথনের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ি। কোনও নারীকে আমার কেন বার বার বলতে হবে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’? বলারও প্রয়োজন নাই। আর বারবার বলা তো চড় খাওয়া ব্যাপার হবে, তাই না? অনেক কথা কিন্তু বলতে হয় না, অনেক শব্দ উচ্চারণই করতে হয় না। তেমন ক্যামেরাতেও অনেক কিছু গ্রহণই করতে হয় না। কবিতাতে অনেক শব্দ দিয়ে গাঁথতেও হয় না। অনেক না বলা শব্দ থাকে, না নেওয়া ট্রিকস থাকে, সেগুলো কিন্তু দর্শক ঠিক খুঁজে বের করে নেয়।

শবনম ফেরদৌসী: ওই টাইমিংটা আপনি কিভাবে বুঝে যান? কতটুকু থাকবে? মানে ঠিক যেখানটায় শেষ হওয়ার কথা, যেখানটায় শুরু হওয়ার কথা, এই জায়গাটা কিভাবে আপনার কাছে আসে, ধরা দেয় কিভাবে আপনার কাছে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: অনেককাল আগে, প্রথম ছবি করছি, বুঝতে পেরেছেন? কনটেন্ট অব লাভ বলে একটা ছবি। বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মিনাক্ষী সেই ছবিতে প্রথম কাজ করেছিলেন। ঘুরে বেড়াচ্ছি আমার এডিটরকে ধরবো বলে। পয়সা দিতে পারবো না আমি সে শুনে এড়িয়ে যাচ্ছে। একটা জায়গায় ঢুকে পড়েছি, একটা ঘরে এডিট হচ্ছে। তো ভদ্রলোক বললেন, ‘কী চাই?’ আমি বললাম, ‘ওকে চাই’ ‘ও তো নেই, কী দরকার?’ আমি বললাম, কী জন্য এসেছি। উনি আমাকে বললেন, মানে অদ্ভুত শিক্ষা আমাকে দিলেন, মানে অসম্ভব বড় শিক্ষা! বললেন যে, ‘আপনি তাল বুঝেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ তা তো একটু বুঝি!’ ‘কী করে বুঝেন?’ ‘বাড়িতে মা গান করতেন, গান থেকে তাল বুঝি’ ‘তা সব গানের সাথে সব তাল যায়?’ ‘তা কেন যাবে!’ ‘হ্যাঁ, এটা মনে রাখবেন। এডিটিংটা তালের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। বেতালা হলে না, আপনার মন ঠিক বলে দিবে বেতালা।’ কথাটা কিন্তু আমার ভীষণ লেগে গিয়েছিল। আমার মনে হয় যে কোথায় থামতে হবে, আমি বুঝে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে বিশ্বাস করা উচিত নিজের মনকে আর চোখকে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং আবু সায়ীদ (একাত্তর টিভি থেকে নেওয়া)
আবু সায়ীদ:
আমি বলছিলাম, চিত্রনাট্য, শ্যুটিং এগুলো...
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ সেটা খুব বড় কথা। সেটা হচ্ছে যে, আমি কিন্তু মূলত ভীষণভাবে নির্ভরশীল ইমেজের প্রতি। গল্প আগে ভাবি না ইমেজ আগে ভাবি আমি নিজেও জানি না। বোধ হয় ইমেজ আগে ভাবি। ‘টোপ’ গল্প নিয়ে আমি পনেরো-কুড়ি বছর ধরে ভেবে যাচ্ছি, করতে পারছি না। যতগুলো ইমেজ আমি ভেবেছি মনে হয়েছে সময় হয়নি। ধরতেই পারছি না। কেন, যে এক্সটেনডেট রিয়েলিটির কথা আমি বলি, সেখানে ‘টোপকে’ ঢুকাতে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছিলো। অসুবিধাটা এত বেশি হচ্ছিলো যে পনেরো কুড়ি বছর পর শেষের দিকে আমি বুঝতে পারলাম উত্তরটা কী! কিভাবে ওই ম্যাজিক্যাল রিয়েলিটির মধ্যে ওই এক্সটেনডেন্ট রিয়েলিটির মধ্যে ‘টোপে’র মতো একটা, মানে অসম্ভব রিয়েলিস্টিক একটা গল্পকে ঢুকাবো। কেন না আমি শুধু সেই বাস্তবতার কথাই শুধু বলতে চাই না, আমার মনে হয় বাস্তবতার বাইরে আরও একটা বিশাল বড় বাস্তব আছে। যেটা এক্সটেনডেন্ট। যেটা এই রিয়েলিটির এক্সটেনডেন্ট। এবং সেটা খুব ইমপর্টেন্ট আমার কাছে, যার জন্য ‘টোপ’ আমি শেষ পড়েছিলাম তিরিশ বছর আগে। এরপর একবারও আমি পড়িনি। আমি স্ক্রিপ্ট লিখলাম। লিখলাম খুব অল্প। এবার যেটা হলো আমি ওখানে গিয়ে (শ্যুটিং এ গিয়ে) চেঞ্জ করতে শুরু করলাম।
শবনম ফেরদৌসী: মানে এটা সাধারণত আপনি করেন না?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: সবসময় করি। আবার যখন এডিটিং টেবিলে গিয়ে, আবার চেঞ্জ করতে শুরু করলাম। আরেকটা জিনিস কখনও করি না, কিছু ভেবে যাই না। আমি ভেবে যাই না। কেননা আমি জানি, আমি যদি ভেবে যাই, বিপদ! ভয়ংকর বিপদ! তাহলে আমি আটকে গেলাম, মানে আননোউন, এলিমেন্টস অব আননোউন বলে একটা কথা আছে। ওটা আমার কাছে ভীষণ ইমপর্টেন্ট।

শবনম ফেরদৌসী: এবং আপনার ছবিতে এটা ঘটেও! ঠিক ঠিক শট নেওয়ার সময় একটা চরিত্র এলো, একটা পাখি উড়ে গেলো। আপনি তো ওকে উড়তে বলেননি।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: না। বুঝতেও পারিনা কিভাবে হয়, যেমন- একটা ছবির শ্যুটিং করছিলাম, শটটা বলে দিয়ে চেয়ার নিয়ে পেছনে বসেছিলাম, তখন আমি সিগারেট খেতাম। একটা গাছ আমার সামনে, গাছের মধ্যে উই পোকায় ভরা। আর দেখলাম উই পোকারা ভীষণ ব্যস্ত! প্রচুর তাদের কথা বলছে, ঝড় সংক্রান্ত তাদের আলাপ, ভীষণ ব্যস্ত। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তারপর আমি বললাম যে, লাঞ্চ ব্রেক দিলাম। পুরো একটা সিকোয়েন্স লিখলাম। ওই উই পোকাদের নিয়ে।

আবু সায়ীদ: এটা ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ এর..

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: আমি এটাই বলতে চাই সবাইকে যে, মনটা খুলে রাখা উচিত। স্ক্রিপ্টটাই শেষ কথা নয়।

আবু সায়ীদ: আপনি যখন চিত্রনাট্যটি করেন, তখন শ্যুটং পিরিয়ড এবং এডিটিং এই তিনটার মধ্যে মানে কতটুকু একদম কনফার্ম যোগসূত্র ধরেই হয় আর কতটুকু একটু চেঞ্জ হয়ে যায়?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: সম্প্রতি আমার স্ক্রিপ্ট কালেকশন নিয়ে দ্বেজ থেকে কালেকশন বেরিয়েছে তো, বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে। একজন বলছিল যে আপনার স্ক্রিপ্টগুলো পড়তে পড়তে আমি ভাবছিলাম যে আপনার ছবির কথা। মিল আছে কিন্তু অমিলটা বেশি। স্ক্রিপ্টে অনেককিছুই আছে যা সিনেমায় নাই। আবার সিনেমায় অনেককিছু আছে যা স্ক্রিপ্টে নাই। তো আমি কখনোই মনে করি না স্ক্রিপ্টটাই শেষ কথা। স্ক্রিপ্ট একটা থাকা দরকার।

শবনম ফেরদৌসী: ‘চরাচরে’র ক্ষেত্রে কি পাখিদেরকে আপনি এরকম জাস্ট ফলো করে গেছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: চরাচরের শেষে ছিল যেটা, লখা যে বাড়িটায় থাকে দরজাটা খুললে আমরা দেখতে পাই দরজার ওপারে কী আছে। শেষবার যখন লখা দরজা খোলে, দরজার ওপারে দেখা যায় সমুদ্র। তো সমুদ্র তো ছিল না! আজকে যখন দরজা খুললো সমুদ্রটা একদম দরজার পাশে এসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। এ সমুদ্রের কাছে ও দেখতে পায় অনেক পাখি! ভাবনাটা হচ্ছে পাখিদের সঙ্গে ও-ও উড়ছে! একটা চর আছে। সেই চরে জোয়ারে যেতে হবে আবার জোয়ারেই ফিরে আসতে হবে। গিয়ে দেখি সামনে প্রায় হাজার খানেক পাখি বসে আছে! তারা কিন্তু বসেই আছে! আমি প্রতিটা মুহূর্তে আতংকে বসে আছি এই বুঝি উড়ে গেল, এই বুঝি উড়ে গেল। তাহলে গেলাম। আমি বললাম যে সবাইকে একটা শব্দ করতে। ঠিক সবার ঘড়ি মিলিয়ে নিলাম। ওই সময়টা যখন আসবে তখন এমন একটা শব্দ করতে হবে যেন পাখিগুলো উড়বে। হ্যাঁ! তো শট শুরু হলো, দৌড় শুরু হলো, আমরাও ওর পেছনে, বিশাল বড়  ট্রলি! সমুদ্রের কাছাকাছি, পাখিগুলো উড়তে শুরু করলো। অসামান্য সে দৃশ্য! তো এটাকে আমি কী বলবো! যে পাখি মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়, ওই পাখিগুলো বসে ছিল কিন্তু!

শবনম ফেরদৌসী: রজিত কাপুরের কতদিন লেগেছিল স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে? এ ছবি করবার পর?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এটা খুব বড় প্রশ্ন। এটা ছিল রজিতের দ্বিতীয় ছবি। মানে একটা মানুষ পাখি ধরবে এবং পাখি ছেড়ে দেবে, তার আঙুলগুলো কিন্তু ভীষণ অন্যরকম হতে হবে... তার আঙুল ধ্যাবরা হলে তো হবে না! আমার কারও আঙুল পছন্দ হয় না! আর মুখের মধ্যে সেই ভালোবাসা নেই!

শবনম ফেরদৌসী: হ্যাঁ, সে স্বপ্ন চোখে...

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, পাখি ভালোবাসা, পাখি ধরার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মুখের মধ্যে...

শবনম ফেরদৌসী: মমত্ব

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটবে।

শবনম ফেরদৌসী: ম্যাজিক...

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ম্যাজিক আসবে! আমি ওর আঙুল দেখছিলাম। ওর মুখ দেখছিলাম, ওর চোখ দেখছিলাম! অভিনয়টা আমি দেখতে চাইনি। ওগুলোতো অনেকটা আমাকে কাজ করিয়ে দেবে। বাকিটা আমি করে নেবো। শ্যুটিং শেষের পর রজিত একদিন ফোন করেছে আমাকে। বলছে, ‘দাদা, আমি দু’মাস ঘর থেকে বেরুতে পারছি না! কাজই করতে পারছি না!’

আবু সায়ীদ: আচ্ছা দাদা আমি আরেকটা বিষয় বলি যেহেতু ওয়ার্কশপ শব্দটা আপনি ইউজ করলেন। নরমালি ওইখানকার... আপনার ছবি এছাড়া যে ছবিগুলো হচ্ছে, তো ওয়ার্কশপের ধরনটা কী রকম হয়?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: যে ওয়াকর্শপের কোনও ধরন হয় না। মানে মুশকিল হচ্ছে যে প্রতিটা ছবি নতুন, প্রত্যেকটা ছবির চরিত্ররা তোমার কাছে অন্তত নতুন অনেকটাই আর তাদের (অভিনেতা) কাছেও চরিত্রটা নতুন! ফলে ওয়ার্কশপগুলো পুরো পাল্টে যায় কিন্তু। আগের ছবির যে ওয়ার্কশপ তুমি করেছো, এ ছবিতে তা করছো না! করতে পারোও না, করলে কাজ করবেও না! যেমন এই ছবির জন্য ভেবে নেবে কী করছো, এই ছবির চরিত্রগুলোর জন্য। ওই মানুষটা একরকম আর এই মানুষটা একরকম। তুমি দেখবে যে কিছু কিছু অভিনেতা আছেন, যারা তোমাকে ইন্সপায়ার করে। তুমি ভাবোওনি কিছু! কিন্তু ওকে দেখে তুমি বুঝে যাচ্ছো এটা হলে হয়, ওটা হলে হয়! মানে ডিরেক্টারস অ্যাকটর বলে একটা কথা আছে। এটা কিন্তু ভীষণ ইমপর্টেন্ট! আমি সবসময় জিজ্ঞাসা করি কোনও অ্যাকটরকে, আচ্ছা আপনি অ্যাকটিং তো করেন, আর কী করেন? আসলে আমি চাই ইনফরমেশন। আমার কিছু ইনফরমেশন দরকার হয়।

শবনম ফেরদৌসী: ওকে জানার জন্য?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, শুধু জানার জন্য নয়। যদিও স্ক্রিপ্ট সিন টু সিন নয়! অনেক কিছু তখনো বদলাতে পারো। তুমি হয়তো দেখলে তোমার কোনও অ্যাকটর ম্যাজিক করতে পারে, অভিনয় পারে কিন্তু ছেলেকে ম্যাজিক দেখায়। এইবার তুমি দেখলে এটা কিন্তু অদ্ভুত একটা এলিমেন্ট, এটাকে কাজে লাগানো যায়।

শবনম ফেরদৌসী: একটা ছোট প্রশ্ন ফাঁকে করে নেই। তখন যে মিরাকেলের কথা বললেন, শ্যুটিং এর সময়, এডিটিং-এ তো হয়ই, ছবি দেখে নিজের ছবি দেখে কখনও কেঁদেছেন?

ক্যামেরা আপনি চালিয়ে দিয়ে চলে যান এক ঘণ্টা ঘুরে আসুন দেখবেন অনেক কিছু উঠে গেছে। কিন্তু আপনি যদি ক্যামেরাটাকে ব্যবহার করতে চান, আপনার মতন করে, দৃশ্যগুলোকে গাঁথতে চান আপনার ভাবনার মতন করে, তাহলে কিন্তু ক্যামেরাটাকে আপনার বশ্যতা স্বীকার করতেই হবে। - বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: না, নিজের ছবি দেখে কাঁদিনি। একবার একটা দৃশ্য উত্তরার একটি দৃশ্য... একবারই আমার চোখে জল চলে এসেছিল, উত্তরাতে একটি দৃশ্য আছে। সেটা নিয়ে রিহার্স করার দরকার ছিল। একটা বিশেষ গাছের দরকার ছিল। গাছটাকে খুঁজে পেলাম। এবার রিহার্স করতে শুরু করলাম। যখন রিহার্স করছি, ঠিক পরদিন বিকেলে ঠিক ওই সময় শেষ বিকেলে শটটা হবে। ফলে আমি সবটাই বুঝে নিচ্ছি আলোটা কী হবে, সব কিছুই, তখন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। এই একবারই জীবনে বোধহয় আমি কেঁদেছি। আর অন্যের ছবি দেখে কেঁদেছি।

আবু সায়ীদ: তার মধ্যে কোন কোন ছবি হতে পারে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: একদম ব্যক্তিগত কারণ, একটা কারণ বলছি সেটা হচ্ছে যেহেতু আমরা এখানকার মানুষ, ছিলাম! এই মানে শেকড় ওপড়ানোর। মর্মান্তিক দুঃখ... এটা আমাদের বাংলাদেশের একজন পরিচালকের ছবি আমি দেখছিলাম, দেখতে দেখতে আমি মানে ইমোশনালি এত বায়াসড করে গিয়েছিলাম যে ছবির শেষে আমি কারও সঙ্গে আর কথা বলিনি।

আবু সায়ীদ: ছবির নামটা মনে আছে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: চিত্রা নদীর পাড়ে।

শবনম ফেরদৌসী: আচ্ছা উত্তরার সুতো ধরে আসি যে, কুস্তি, আপনার ছবিতে আসে। ফেরাতেও এসছে। এটা কি অবদমিত যে মানুষের ক্রোধ, কাম তারই রিফ্লেকশন হয়ে আসে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: আমি একটা মজার ঘটনা বলি আপনাদের। ছবি শেষ হওয়ার আগেই আমি বাইরে থেকে প্রিসেল করলাম। দুটো সেক্টরে। প্রিসেল করে যে টাকাটা পেলাম, আমার সব হয়ে গেলো। তারপর ছবিটি ভেনিসে গেল, ভেনিসে বেস্ট ডিরেক্টর এ্যাওয়ার্ড পেলো। এই ছবিটা পাগলের মতো বিক্রি হয়ে গেল। এবং যিনি কিনলেন ইউরোপের, একদিন উনি ফোন করে বললেন, এই ছবিটা ওইখানেও বেস্ট ফিল্ম পেয়েছে জানো! আমি বললাম, তাই নাকি? কী ফেস্টিভ্যাল? আমি তো জানি না! বললো, ফেস্টিভ্যালটা হচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল গে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। তো আমি তো অবাক! উত্তরা গে ফিল্ম কী করে হয়? ওরা তারপর এ্যাওয়ার্ডটা পাঠিয়েছে, সার্টিফিকেট একটা পাঠিয়েছে যে, এত শান্ত গে ফিল্ম ওরা আর দেখে নাই! তো তখনই বুঝতে পারলাম যে... আমার তো মাথায় নেই ওসব জিনিস!

শবনম ফেরদৌসী: কিন্তু বোধটা দেয় কিন্তু!

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হ্যাঁ সেটা পরে শুনেছি। অনেকেই পরে বলছিল। না আমার মাথায় সেটা ছিল না। পরে বুঝতে পারলাম এর মধ্যে নিশ্চয়ই অবদমিত কাম, অবদমিত ক্রোধ, দ্বেষ সবগুলোই মিশে থাকে।

আবু সায়ীদ: এই সময়, বিশেষ করে এখন তো চলচ্চিত্রে অনেক রকম পরিবর্তন। মানে টেকনোলজিরও পরিবর্তন হচ্ছে ভাবনা চিন্তার দিক থেকেও বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তো আপনার দৃষ্টিতে কলকাতার, আপনার উত্তরকালীন, আমি শুধু কলকাতার মানে বর্তমান না, যে এটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন?

আলোচনায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মজুমদার এবং আবু সায়ীদ

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: বাণিজ্য সত্তাও যদি ধরে নেই, প্রেমেন যেটা বললো এতো সত্যি কথা, যে বাণিজ্যসত্তার দিক থেকেও কিন্তু ছবিগুলো ব্যর্থ! ইনফ্যাক্ট ছবিগুলো বাণিজ্যও করতে পারছে না। একটা জিনিস মনে করবে, মনে রাখাটা উচিত, যে একটা খুব বড় বাজার কিন্তু বাইরে আছে। সেগুলো কিন্তু বাংলা ছবির বাজার না, ভালো ছবির বাজার। সে ভালো ছবির বাজারটা কিন্তু, খুব উৎসাহজনক কারণ পৃথিবী জুড়ে স্ক্রিন বাড়ছে! এ মুহূর্তে হয়তো ঢাকা শহরে স্ক্রিন কম, কিন্তু পৃথিবীর প্রত্যেকটা বড় শহরে মাঝারি শহরে স্ক্রিনিং বাড়ছে, ছবির ডিমান্ডও তাই বাড়ছে। এ ছবিগুলো (কলকাতার) কিন্তু সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ। আরেকটা জিনিস আমার মনে হয় যে, মানে, মিডিওক্রিটি, গেইন করতেই পারে কোনও একটা সময়ে, কিন্তু সেটা কখনও দৃষ্টান্ত হতে পারে না। মানে মিডিওক্রিটি কিন্তু একটা ডেনজারাস গেম যেটা এ মুহূর্তে কলকাতার পরিচালকরা চর্চা করছে। তার দু’টো কারণ। একটা হচ্ছে যে, ভালোবাসা... কোথাও কোনও ভালোবাসা নাই! সিনেমার প্রতি এত ভালোবাসাহীন মানুষজন আমি দেখতে পাই এখন কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে যারা ছবি করছেন, যা আগে কখনও দেখিনি। তুমি যে মুহূর্তে ভালোবাসা থেকে সরে আসবে, বা ভালোবাসতে ব্যর্থ হবে, তুমি তঞ্চকতার আশ্রয় নিবেই! নিতেই হবে। তোমার (আবু সায়ীদ) মতো এখন পরিচালকরা, ভাবো যে এত সুন্দর ছবি উপহার দিয়েছে, তার কিন্তু কোনও চিন্তার কারণ নাই।

শবনম ফেরদৌসী: কিন্তু দাদা, আগে ছিল! আগেও হিন্দি ছবি হতো, হলিউডের ছবি আসতো কিন্তু পাশাপাশি আপনাদের ছবিগুলো খুব প্যারালালি যেতো। কিন্তু হঠাৎ করে যেন সেটা হারিয়ে গেলো।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হারিয়ে যায়নি! চর্চাটা হারিয়ে যায়নি, দেখো নানানভাবে চর্চা হয়। এবং ওই চর্চাটা অন্য চর্চার চেয়ে কম জরুরি এমন ভাবার কারণ নেই কিন্তু! তোমাকে একটা ঘটনা বলি। একটি ছেলে ফোন করে যাচ্ছেন ওকে (প্রেমেন্দ্র মজুমদার), কয়েকদিন ধরে আামার সঙ্গে কথা বলবেন বলে। ঢাকায় এসে শেষ পর্যন্ত ধরেছে। তো ওর সঙ্গে বসে যখন কথা বলছিলো, ও বলছিলো, আমি নয় এরকম প্রচুর লোক আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আছে, তাদের নাম খবরের কাগজে বেরুচ্ছে না। তাদের এই খোঁজটা খবর হচ্ছে না। কিন্তু এ খোঁজটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে এবং এই খোঁজটাই আসল! ফলে কাগজে অনেক কিছুই বেরোয়, অনেক কিছুই তো বেরোয় না।

শবনম ফেরদৌসী: তাতে কী যায় আসে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। যেটা ঘটনার ঘটতে থাকেই। আমি এবার বাংলাদেশে এসে, ঢাকায়-রাজশাহীতে ঘুরে আবার বুঝতে পারলাম যে, ভালো জিনিসকে বাঁচিয়ে রাখার, প্রাণ, এখানে ভীষণভাবে এগজিস্ট করে। এ যে জিনিসগুলো আমি দেখে গেলাম এবার এসে, এরা যেখানেই থাকুন না কিন্তু, আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে সিগনাল পাঠাচ্ছেন। ওর সিগনালটা আমি পাচ্ছি। পাচ্ছি বলেই আমি আরো ইয়াং হয়ে যাচ্ছি। কিসে ইয়াং? কাজে। আমাদের একটা চেষ্টা থাকে সময়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার। তাই না? বা আমি যেন সেসময়কে প্রতিফলিত করতে পারি আমার ছবিতে। কিন্তু একটা জিনিস আমরা ভুলে যাই, যে সময়টা তো থেমে থাকছে না।

সময়টাতো এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। আজকে থেকে পঞ্চাশ বছর পর কী হবে? এগুলোকে কি সে ফেলে দিয়ে যাবে? সময় কিন্তু নাইনটি নাইন পয়েন্ট নাইন নাইন পারসেন্টকে ফেলে দিয়ে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় না। পয়েন্ট ওয়ান পারসেন্ট সঙ্গে নিয়ে যায়। এমন কোনও কবিতা লিখতে চাই না, এমন কোনও সিনেমাও করতে চাই না, যেটা শুধুমাত্র সেই সময়ের। তাহলে খুব মুশকিল। চরাচরের যে লখা ও কী! আমরা তো কেউই একদিন থাকবো না, কিন্তু লখা আরেকটা জায়গায় বেঁচে থাকবে। লখা হয়তো আরেক নামে, আরেক জায়গায় রিলেট করবে কোনও একটা মানুষকে। এবং সেটাই কিন্তু আসল কাজ।

শবনম ফেরদৌসী: আমার একটা ছোট ব্যক্তিগত প্রশ্ন আছে, এটা খুব প্রচলিত যে শিল্পীরা স্বার্থপর হয়। এবং সে তার কাজের স্বার্থে অনেক অন্যায়ও করে অনেক সময়। এবং সে অন্যায়টা কালের বিবর্তনে হারিয়েও যায়। আসলেই কি শিল্পীকে স্বার্থপর হওয়াটা জরুরি?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: স্বার্থ অনেক ধরনের হয়, হ্যাঁ? কিন্তু আমার কাছে কোনটা সত্যি? আমি এমন কোনও কাজ করতে চাই না, করি না, যেগুলো অন্যের চোখের জলের কারণ হয়। কাউকে আঘাত যদি আমি দিয়েও ফেলি, আমার ক্ষমা চাইতে এক মুহূর্ত দেরী হয় না। তবে আমি মনে করি যথার্থ কোনও মানুষ, কোনও সৃষ্টিশীল মানুষ কখনোই সেটা হন না। কখনোই তিনি খারাপ মানুষ হতে পারেন না। যদি হন, তাহলে বলতে হবে শুধু গোড়ায় গলদ নয়, তার কাজেও গলদ। কাজটা কিছু হয়নি। অন্যের দুঃখ দেখে যদি আপনার চোখ ছলছল না করে, যদি আপনার মন খারাপ না হয়, তাহলে তো আপনার কবিতা লেখাই উচিৎ না, আপনার গান গাওয়া উচিৎ না, সিনেমা করা উচিৎ না, কিচ্ছু করা উচিৎ না।

আমি কখনো কোনও টার্মস-এ কাজ করি না। কারও কাজ করি না। আমি আজ পর্যন্ত নিজের টার্মস এ ছবি করি। সেটাই করি যেটা চাই। সেটা যখন পারবো না, যদি পরিস্থিতি এমন হয়, যে আমি করতে পারছি না, সিনেমাই করবো না।

শবনম ফেরদৌসী: প্রেমেন্দ্র’দা আপনার কাছে আসতে চাচ্ছি। সেটা হচ্ছে যে, দাদা (বুদ্ধ) একাধারে কবি, সুরকার, নিজের ছবিতেও সুর করেছেন। আসলে তো তিনটার মধ্যে একটা মেলবন্ধন আছে। একটা হারমোনি আছে। সেটা কি তাকে আরও ঋদ্ধ করেছে কিনা?

প্রেমেন্দ্র মজুমদার: সেরকম যদি বলেন উনি ভালো চিত্রকর, ভালো সঙ্গীতকার, ভালো শব্দযন্ত্রী, ভালো ম্যানেজম্যান্ট বোঝেন, ভালো এমবিএ-ও হতে পারেন! সিনেমা তো সবকিছু নিয়েই! টোটাল আর্ট একদম। যারা সবগুলো ধারাতেই ভীষণ পারদর্শী যদি নিজে হতেও পারেন বা অন্যের পারদর্শীতাকে সুপারভাইজ করার মতো ক্যাপাসিটি থাকবে যখন তখনই তো ভালো ফিল্ম তো স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হবে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: কোনোটাই হয় না ফাইনালি জানেন! কবি হওয়াতেও কিছু সুবিধা হয় না, সুর জানলেও কিছু সুবিধা হয় না। সুবিধা একটাতেই হয় যে আরেকজনের বেঁচে থাকাটাও আপনাকে স্পর্শ করছে। এটা যদি আপনার না হয়, তাহলে যতই গান গান, যতই কবিতা লিখুন, যতই ছবি আঁকুন, কিচ্ছু হবে না।

অনুলিখনঃ তাসমিয়াহ আফরিন মৌ

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা