X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেহুলার ভাসান দেখতে গিয়ে

জাহিদ সোহাগ
২০ আগস্ট ২০১৬, ১২:২১আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৬, ১২:৪৬

লখিন্দর ও বেহুলা নাচছে এর পরে তিনি বেহুলাকে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করতে বলেন। এই দৃশ্যে আমরা দর্শকরাই গ্রামবাসী হয়ে গেলাম। সাদা একটা চাদর সবার সামনে ধরা হলো সবাই যে যার খুশি মতো ভিক্ষা দিল। বয়স্ক নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে সবাই সাদা চাদরে টাকা-পয়সা দিলো। আমি তাদের মুখে দেখলাম বিষাদের ছায়া

১৭ আগস্ট সকালে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা বাজারে নেমেই নাকে পেঁয়াজ-মরিচের ঝাঁঝ ঢুকলো। আজ হাটবার নাকি? সঙ্গী নওশাদ প্রশ্ন করলে উত্তরে বলি, ‘এখন গ্রামে প্রত্যেক দিনই হাট।’ হবে হয়ত। ঝকমারি এই দুনিয়াদারি। রাজিবকে বলি, ‘আলু কিনে দেই? কাওরান বাজারে বিক্রি করে ব্যবসা করবেন’- মানে শহীদুল জহিরের গল্প মাথায় ঢুকছে। কিন্তু এখানে জহির নয়, এসেছি কানাহরি দত্তের মেটাফর খুঁজতে, তিনি এই অঞ্চলেরই (নান্দাইল) লোক। সে যাক, রাজিব লা জবাব। কিছুদূর যেতেই কবি কায়সার হককে দেখতে পেলাম ট্রলারে বসে আছেন, মাথায় নেরুদার টুপি, হাত তুললাম দু’জনেই; যাত্রা শুরু হলো তবে। তিনি জানালেন সবগুলো ট্রলার আগেই ছেড়ে গেছে। তবু আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক আসবেন বলে। এখানে একটা কথা বলে নেই, কায়সার হক ‘মনসামঙ্গল কাব্য’র গদ্যরূপ দিয়েছেন ৩৬০-এরও অধিক পৃষ্ঠা জুড়ে। গত বছর লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি।
ট্রলার চলতে শুরু করলো। নদীর নাম জহরনঙ্গা। এটা যমুনার শাখা। নদী ভর-ভারান্ত। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা চলার পর আকুয়া। পথে পথে দেখলাম, বিভিন্ন স্থানে মানুষজন জটলা পাকিয়ে আছে। সম্ভত এসব স্থানে মনসার ঘট স্থাপন করা হয়েছে। বেহুলার ভাসান দেখবে তারা। কায়সার হক সাতটি ঘাটের কথা বললেন, নদীর বাঁকে বাঁকে। এ নদীও তেমন নদী।

আকুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সামিয়ানা টাঙানো। চেয়ার টেবিল পাতা। অবশ্য দূর থেকেই কানে আসছিল ঢাকের আওয়াজ। মাঠে যাত্রার পোশাক পরা একদল মানুষ যাদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে গ্রামবাসী। আমি প্রথমেই হাত মেলালাম যার সাথে তিনি দেখতে লম্বা গড়নের, কোকড়ানো চুল, পাতলা গোঁফ।
-আপনি লখিন্দর?
-না, চাঁন।
-চাঁদ সওদাগর?
-হু।
বেহুলা কই জিজ্ঞেস করতেই তিনি একজনের কাছে নিয়ে গেলেন। রঙিন শাড়ি পরা। আমি হাত মেলাতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এভাবে একে এক লখিন্দর, পদ্ম-সহ অনেকের সাথেই পরিচয় হলো। ছবি তুললাম। এদের বাস্তব জীবনের নাম- লখিন্দর সেজেছেন মনির, যিনি এই গ্রুপের প্রধান; বেহুলা সেজেছেন এসরাফিল; চাঁদ হলেন, আবুল কালাম আজাদ। এদের মধ্যে কেউ কেউ বৃহন্নলাও থাকতে পারেন। আয়োজক যাত্রিক এর কর্ণধার সাদাফ সায্ বললেন, ‘এরা প্রত্যেকেই নানান পেশায় যুক্ত। কেউ রিক্সা-ভ্যান চালায়, কেউ অটো, কেউবা কৃষি শ্রমিক। বছরের এই সময়টাতে তারা মনসামঙ্গলের পালা করে। গ্রামবাসীর কাছে মূল আকর্ষণ হলো বেহুলার ভাসান।’যাত্রিক  তিন বছর ধরে এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। আর দশ বছর ধরে সাধনা।  

বেহুলা, লখিন্দর এবং চাঁদ তিনজনকেই আমি জিজ্ঞেস করেছি কত বছর ধরে তারা এই পালা করে। তারা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারলেন না। বেহুলা বললেন তার বাবা নাকি তাকে শিখিয়েছেন। তার বাবাও পালা করতেন। তখন কেউ কেউ এগিয়ে এসে একই বললেন। শুনেছি টাঙ্গাইলে নাকি ২শ’র বেশি দল ছিল, এখন মাত্র টিকে আছে পনেরো ষোলটি। হয়ত ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হতে দেবে না যাত্রিকসাধনা । তারা বাঙালির শেকড়ের কাছে এসে তাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দিতে চান। মনে হয় তারা অনেকটা সফলও হয়েছেন। বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী অনুষ্ঠান শেষে বললেন তিনি বেহুলার ভাসান তাদের ইভেন্টের ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভূক্ত করবেন। যাক সে অন্য প্রসঙ্গ। আসল কথায় আসি।
এই দলের সদস্যরা গ্রামে এক সপ্তাহ ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করেছে। সেখান থেকে অর্জিত চাল-ডাল বা নগদ টাকা দিয়ে নদীর সাতটি ঘাটে মনসার ঘট স্থাপন করেছেন, সেখানে গিয়ে ভোগ দিবেন। সাতটি ঘাটের নামও চমৎকার। আমি যখন জানতে চাইলাম তখন একে একে ঘাটের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। কেউ বললো ১১ টা ঘাট। কেউ বা বললো ১৪ টা। তখন লিখতে শুরু করলাম। তারা শুরু ও শেষটায় সবাই একমত। তবে চৌদ্দটি ঘাটের নাম কেউ বলতে পারলেন না। বললেন ১২ টি ঘাটের নাম। ঘাটগুলোর নাম- শুরু হয়েছে চাঁদের ঘাট থেকে- অনুমান করা যায় এটা চাঁদ সওদাগরের বাড়ির ঘাটই। তারপর পদ্মার ঘাট, শিবের ঘাট, পাখির ঘাট, কাকের ঘাট, ধোপার ঘাট, গোদার ঘাট, শিয়াল ঘাট, নেতু ধোপিনির ঘাট এবং সর্বশেষ দেবপুর ঘাট। এছাড়াও কেউ কাউে সংশয় নিয়ে বাঘের ঘাট ও কালিদাসের ঘাটের কথা বলেছেন। তবে তারা সাতটি ঘাটেই ভোগ দেন।
তাদের ভোগ দেওয়াটা জাকজমকপূর্ণ, গানের সঙ্গে সমানতালে ঢাক মন্দিরা বাঁশি হারমোনিয়াম বাজছে তো বাজছেই। শ্রাবণের শেষ দিনে মনসা পূজা হয়, বেহুলার ভাসানও সেই দিনে। বেহুলার ভাসানের মধ্য দিয়েই তো মনসা দেবী তার অভীপ্সা পূরণের দিকে অগ্রসর হয়েছেন।
প্যান্ডেলের সামনে ছোট পরিসরে তারা আমাদের মনসামঙ্গলের কাহিনি অভিনয় করে দেখালেন। শুরু হলো গান দিয়ে- তাদের নাচ-গান প্রায় সবই সমবেত এবং বাদ্যযন্ত্রের উচ্চ শব্দের সঙ্গে- অবশ্য এতে আমার বা কারোরই অসুবিধা হয়নি, আমরা সবাই মনসামঙ্গলের বেহুলা-লখিন্দরকেই দেখছিলাম। গানের কথাটা অস্পষ্ট মনে আছে ‘আমারে মজাইলি কালা চাঁদ...’ গেয়ে গেয়ে সবাই নাচে; এটা আনন্দের গান। এসময় বেহুল-লখিন্দর একে অপরকে ধরে ঘূর্ণির মতো নাচে। তারপর একটা দুঃখের গান। গানের কথা বুঝে উঠতে পারিনি। তবে সবার মুখ দেখে বুঝতে পেরেছি। বেহুলার অভিব্যক্তিও পরিবর্তন হয়ে গেল। দুপুররোদে সে লখিন্দরকে ধরে নাচছে আর গাইছে। তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ঘাম বুঝি। লক্ষ্য করে দেখলাম তার উৎপত্তিস্থল চোখ থেকেই।
এরপর বাসর ঘরে প্রবেশ। বাসর ঘর বানানো হয়েছে মাটিতে কার্পেট ও শীতল পাটি বিছিয়ে। ঢুকে লখিন্দর বেহুলাকে বলে সে নাকি স্বপ্ন দেখেছে তাকেও সাপে দংশন করবে। তার আগের ছয় ভাইয়ের মতো তারও একই পরিণতি হবে।
লখিন্দর বাসর ঘরে নিথর পরে থাকে। বেহুলা বিলাপ করে করে গান ধরে, ‘তুমি জাগো, তুমি জাগো’, কিন্তু সে লখিন্দরকে বিছানা থেকে তুলতে পারে না। তখন সে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে দু’হাত তুলে বলে সে কী পাপ করেছে যেজন্য তার হাতের শাখা খুলে নিল- লোহার বাসরে সাপ ঢুকলো ইত্যাদি। পুরো ব্যাপারটা বেহুলা চাঁদকে বলেন, চাঁদ লখিন্দরকে নিরীক্ষা করে দেখেন তার পায়ের বৃদ্ধ আঙুলে কালসাপ কেটেছে। এর পরে তিনি বেহুলাকে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করতে বলেন। এই দৃশ্যে আমরা দর্শকরাই গ্রামবাসী হয়ে গেলাম। সাদা একটা চাদর সবার সামনে ধরা হলো সবাই যে যার খুশি মতো ভিক্ষা দিল। বয়স্ক নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে সবাই সাদা চাদরে টাকা-পয়সা দিলো। আমি তাদের মুখে দেখলাম বিষাদের ছায়া।
এবার লখিন্দরকে ঘিরে পুরো দলটি গেয়ে গেয়ে নাচলো। কেউ একজন লখিন্দরকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করালো, তিনি ঢুলু ঢুলু চোখে বেহুলাকে ধরে নাচের সঙ্গে তাল রক্ষা করলো। মনে হলো ইন্দ্রসভায় নেচে দেবতাদের তুষ্ট করা শেষে জীবিত লখিন্দরকে ফিরে পেলো বেহুলা।
পুনশ্চ
আমরা যারা দেরি করে এসেছি তারা নদীতে বেহুলার ভাসান ও সাত ঘাটে মনসার ভোগ দেওয়া দেখতে পারিনি। ওইদিন মেঘলা আকাশ, মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাট, আবার রৌদ্র- আমাদের মনে সত্যিই জেগেছিল অতীতের জানা ছবি, যা বাস্তবের কশাঘাতে মুছে যায়নি।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা