X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৬ (প্রসঙ্গ জিন্নাহ)

ফিরোজ আহমেদ
২১ আগস্ট ২০১৬, ১৩:১৭আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৬, ১৪:৫৩

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৬ (প্রসঙ্গ জিন্নাহ) অধ্যাপক রাজ্জাক এবং আরও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন; কিন্তু সেই রাষ্ট্রটা আবার ইহজাগতিক ও অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক রাষ্ট্র হোক, সেটাও চেয়েছিলেন। তাদের সেই স্বপ্নের পাকিস্তানে জিন্নাহর ভূমিকা কাণ্ডারীর। হুমায়ুন আজাদের সাথে এই কথোপকথনে যেমন, ছফা কিংবা সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতিচারণেও জিন্নাহর প্রতি তার এই মুগ্ধতা ও ভক্তি বারংবার অটুট দেখা যায়। কিন্তু জিন্নাহর এই ভাবমূর্তি কতখানি কায়েদে আজমের অসাম্প্রদায়িক ভক্তদের নিজস্ব নির্মাণ, কতটুকু সত্যি, তা নিয়ে সামান্য কিছু আলোকপাতের চেষ্টা করা যাক

পূর্ব প্রকাশের পর

অধ্যাপক রাজ্জাক ও জিন্নাহর মূল্যায়ন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে অধ্যাপক রাজ্জাক অনন্য। অধ্যাপক রওনক জাহানের– আবদুর রাজ্জাকের পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহে যিনি হার্ভার্ডে পড়তে গিয়েছিলেন– একটি ছোট্ট স্মৃতিচারণ থেকে এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে:
“এরপর স্যারের সাথে আমার দেখা হয় ১৯৬৮ সালে। আমি দেশে এসেছিলাম আমার পিএইচ.ডি থিসিসের জন্য ডেটা কালেক্ট করতে। আমি স্যারের কাছে সেই বিষয়ে ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম। তখন স্যার আমাকে একটা কথা বলেছিলেন যেটা আমার সবসময় মনে হয়। তখন তো সিক্স পয়েন্টস(ছয় দফা) নিয়ে কথা হচ্ছে সবখানে। তো আমি সিক্স পয়েন্টস নিয়ে স্যারের মতামত জানতে চাইলাম। স্যার বললেন,‘দেখেন, জাতি এখন অনেক আগায়ে গেছে। জাতি এখন আর সিক্স পয়েন্টস নিয়ে ভাবছে না, জাতি এখন স্বাধীনতার কথা ভাবছে।’ আমি কিন্তু সেই সময়ে অনেকের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু স্যার ছাড়া অন্য কেউ আমাকে জাতির এই যে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে বলেন নাই।”
তাঁর প্রজন্মের আরও অনেকেরই মতো অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তারুণ্যে ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের স্বপ্নে বিভোর। আবার, অধ্যাপক রওনক জাহানের স্মৃতিচারণ অনুযায়ী চল্লিশের কোঠায় বয়েসে অন্য বহু ব্যক্তির আগেই অধ্যাপক রাজ্জাকই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের পতনের আগাম অনুমাণ করেছিলেন। আগের একটি অংশে আমরা দেখিয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্বাংশের পার্থক্য বিষয়ে তার টনটনে সচেতনতা। কিন্তু অধ্যাপক রাজ্জাক বিষয়ে একটা খটকা বাধে এই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর চরিত্র বিচার নিয়েই।
১.
হুমায়ুন আজাদ অধ্যাপক রাজ্জাকের একটা সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাতকারটি মূল্যবান, তীক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। তারও চেয়ে বড় কথা, হুমায়ুন আজাদের স্পর্শগুণে গোটা সাক্ষাতকারটি একটি কবিতা-প্রায় হয়ে উঠেছে। এর মাঝেও ওই খটকা ঠিকঠাকই হাজির আছে। সাক্ষাতকারটি থেকে খানিকটা পাঠ করা যাক:
“হুমায়ুন আজাদ : পাকিস্তান বলতে এখন আমরা ইসলামি পাকিস্তান বুঝি। আপনারাও কি ইসলামি পাকিস্তান চেয়েছিলেন?
আবদুর রাজ্জাক : মোটেই না। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পরবর্তী ঘটনা। মুহম্মদ আলি জিন্নাহকে ধার্মিক লোক বলা যায় না, ইসলামের জন্য তাঁর বিশেষ মাথাব্যথা ছিলো না। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠানটি আর ১৫ই আগস্টে ভারতের স্বাধীনতা উৎসব অনুষ্ঠানটি তুলনা করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা উৎসবের প্রোগ্রামে ধর্মের কোনো নামগন্ধও ছিলো না। মওলানা আকরাম খাঁ, শাব্বির আহমদ ওসমানি, লিয়াকত আলিকে দিয়ে জিন্নাকে অনুরোধ জানান অনুষ্ঠানে কিছু ধর্মকর্ম রাখতে। অনুষ্ঠান শুরু হ’লে দেখা যায় জিন্না সরদার আওরঙ্গজেব খানকে ডাকেন কোরান থেকে কিছু আবৃত্তির জন্যে। আওরঙ্গজেব খান ধর্মের ধার ধারতেন না। তিনি মঞ্চে এসে দু-একটা সুরাকলমা প’ড়েই বিদায় নেন। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতা অনুষ্ঠান হয়েছিলো সম্পূর্ণরূপে হিন্দুবিধিমতে। পাকিস্তানে ধর্মের বাড়াবাড়ি পাকিস্তান হওয়ার পরের ঘটনা।”[১]
‘কেন আমি পাকিস্তান চেয়েছিলাম’ শীর্ষক একটা বক্তৃতাও আবদুর রাজ্জাক দিয়েছিলেন ইসলামিক একাডেমীতে। ক্ষুব্ধ ভক্ত আহমদ ছফা এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “বক্তৃতা একটা দিছিলাম, ত আপনে চটছেন ক্যান?
আপনি পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করবেন– চটব না তো কী?
আমি ত পাকিস্তান চাইছিলাম, হেই কথাডা বলতে দোষ কী?”[২]
‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থটিতে এই বক্তৃতাটির প্রেক্ষিত বলা নেই। পাঠক তাই সামান্য বিভ্রান্তির শিকারও হতে পারেন, কারণ এটি প্রধানত বক্তৃতার অনুষ্ঠান ছিল না। ছিল একটা বিতর্ক সভা, বলা যায় বাহাস। পাকিস্তান রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং বাস্তব দশা বিষয়ে একটি বিতর্ক সভায় তিনি দ্বৈরথে ডেকেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁকে, বিষয়বস্তু ছিল ‘কেন আমি পাকিস্তান চেয়েছিলাম।’ এই বিতর্কের আয়োজক ছিলেন আবুল হাসিম, যথাসময়ে অধ্যাপক রাজ্জাক উপস্থিত হলেও মোনায়েম খাঁ অসুস্থতার অজুহাতে বিতর্কে উপস্থিত হননি।[৩] এই বিষয়ে সরদার ফজলুল করিমের সাথে রাজ্জাক সাহেবের কথোপকথন থেকে:
“মোনায়েম খানের ব্যাপারটা বোধহয় ’৬৮ সালে। কিভাবে যেন কথাটা উঠেছিল যে, ইসলামিক একাডেমীর হলে মোনেম খান আর অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বাকযুদ্ধ হবে। বিষয়বস্তু : কেন আমরা পাকিস্তান চেয়েছিলাম। আবুল হাশিম সাহেব তখন ইসলামিক একাডেমীর পরিচালক। এককালের রাজনৈতিক নেতা। তাঁর উদ্যোগেই ব্যাপারটা সংঘটিত হতে যাচ্ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটলো না। কেন ঘটলো না তার কথাও অধ্যাপক রাজ্জাক বলেছিলেন। কিন্তু পরে।”[৪]
সেই পরের কাহিনিটা এমন:
“অধ্যাপক রাজ্জাক সহাস্যে বললেন : সে এক মজার ব্যাপার। এটা আবুল হাশিম সাহেবের কাণ্ড। তিনি ইসলামিক একাডেমীতে ‘হোয়াই আই ওয়ানটেড পাকিস্তান’ বলে বক্তৃতার একটা সিরিজ করেছিলেন। আমিই প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, এটা করুন। হাশিম সাহেব আমাকে বক্তৃতা দেবার দাবি করতে আমি বললাম, মোনেম খান একদিকের বক্তা হলে আমি আর একদিকের বক্তা হতে রাজি আছি। হাশিম সাহব বললেন : আমি অ্যারেঞ্জ করবো। কয়েকদিন পরে হাশিম সাহেব টেলিফোন করে বললেন, মোনেম খান রাজি হয়েছে। তারিখ দিয়ে বললেন : অমুক তারিখ ৫টার সময়ে ইসলামিক একাডেমীর হলে বক্তৃতা হবে।
আমরা বললাম, অধ্যাপক রাজ্জাককে : হ্যাঁ, আমরা কাগজে একটা এর ঘোষণা দেখেছিলাম এবং ব্যাপারটাতে বেশ কৌতুকবোধ করেছিলাম।
অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন : হ্যাঁ, কিন্তু তারিখে দিন দু’টার দিকে হাশিম সাহেব বললেন : ভাই এ তো এক বিপদে পড়লাম। আমি আপনার বক্তৃতা ঘোষণা করেছি, এদিকে মোনেম খান বলেছেন, তাঁর অসুখ হয়েছে, তিনি মিটিং-এ আসবেন না।...
আমরা অধ্যাপক রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করলাম : তবু কি আপনি সেদিন বক্তৃতা করেছিলেন?
: হ্যাঁ, আবুল হাশিমকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আমার বক্তৃতা করতে হয়েছিল। সে বক্তৃতার বোধহয় টেপ করা আছে ইসলামিক একাডেমীতে।
অধ্যাপক রাজ্জাক এ ব্যাপারে আরো বললেন : কিন্তু মজার ব্যাপার সেদিন রাতেই আমি রাজশাহী যাবার জন্য রাত এগারোটার ট্রেনে উঠেছি। কিন্তু কি ব্যাপার? গাড়ি আর ছাড়ে না। কেন গাড়ি ছাড়ে না? কারণ গভর্নর মোনেম খান যাবেন ময়মনসিংহ। তিনি আসবেন, তবে গাড়ি ছাড়বে। আমি মনে মনে বললাম : মজার ব্যাপার তো! এই না দুপুরে মোনেম খান খবর পাঠিয়েছে যে তার অসুখ। মিটিং-এ বক্তৃতা দিতে পারবে না। কিন্তু এখন তো বেশ সুস্থতার আলামত দেখা যাচ্ছে।”[৫]

২.
এই যে বাহাস আয়োজনের উদ্যোগ, এর দুই পক্ষের বিতর্কের বিষয় থেকেই বোঝা যায়, একক কোন আকাঙ্ক্ষা থেকে সকলে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হননি। মোনায়েম খান আর অধ্যাপক রাজ্জাক হয়তো একই বৈষম্য, পশ্চাৎপদতা আর স্বাতন্ত্রের অনুভূতি থেকে পৃথক রাষ্ট্র চেয়েছিলেন মুসলমানদের জন্য। যেমন আর সকল কিছুর পাশাপাশি অধ্যাপক রাজ্জাক অনেকগুলো সাক্ষাতকারে বারংবার উল্লেখ করেছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অনুপস্থিতির কথা। অধ্যাপক রাজ্জাক এবং আরও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন; কিন্তু সেই রাষ্ট্রটা আবার ইহজাগতিক ও অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক রাষ্ট্র হোক, সেটাও চেয়েছিলেন। তাদের সেই স্বপ্নের পাকিস্তানে জিন্নাহর ভূমিকা কাণ্ডারীর। হুমায়ুন আজাদের সাথে এই কথোপকথনে যেমন, ছফা কিংবা সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতিচারণেও জিন্নাহর প্রতি তার এই মুগ্ধতা ও ভক্তি বারংবার অটুট দেখা যায়। কিন্তু জিন্নাহর এই ভাবমূর্তি কতখানি কায়েদে আজমের অসাম্প্রদায়িক ভক্তদের নিজস্ব নির্মাণ, কতটুকু সত্যি, তা নিয়ে সামান্য কিছু আলোকপাতের চেষ্টা করা যাক।
৩.
এটা খুবই ঠিক যে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মীদের অনেকেরই মাঝে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তোলার আকুতি ছিল। পাকিস্তান বা ভারত কেউই ধর্মরাষ্ট্র ছিল না, দুটো দুইভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছিল প্রয়োজন মাফিক। সত্যি বলতে কি, ধর্মরাষ্ট্র প্রত্যয়টিও অলীক ধারণামাত্র। রাষ্ট্রের মাঝেই কোন শ্রেণি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বা আধিপত্য বাকিদের ওপরে চাপিয়ে দেয়ার দরকার হলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মের ব্যবহারের প্রয়োজনটিও দেখা দেয়। বহু আধুনিক রাষ্ট্রেই তাই এই স্ববিরোধটি দেখা যায়, রাষ্ট্রের পরিচালকরা আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেন এক কথা, কাজের বেলায় দিব্যি বিপরীতটিই চালিয়ে যান।
ফলে অলঙ্কারিক অসাম্প্রদায়িকতার ঘোষণাতে নয়, কাজের বেলাতেই প্রমাণ দিতে হয় রাষ্ট্রের চরিত্র সাম্প্রদায়িক কি না সেটার। রাষ্ট্র যখন কোন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়, তখনই নেতৃত্ব সাম্প্রদায়িক কি না, ধর্মকে রাজনৈতিক ব্যবহারে আগ্রহী কি না, তার প্রকৃত ও যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হয়। ফলে অধ্যাপক রাজ্জাক যে দুটি গল্প দিয়ে নেহেরু ও জিন্নাহর পার্থক্য তৈরি করার চেষ্টা করলেন, সেটা দ্বারা চালিত হওয়া ইতিহাসের শিক্ষার্থীর জন্য বিপদজনক হতে পারে।
মূল আলোচনায় যাবার আগে পাকিস্তানেরই অভিজ্ঞতায় পরবর্তীকালের আরেক শাসকের কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। শুরুতে মধ্যবিত্ত অংশের মাঝে আধুনিক সব সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া আইয়ুব খান পাকিস্তানের ৬২ সালের সংবিধানে আগেকার ৫৬ সালের সংবিধানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রত্যয়টি প্রথমে বাদ দিয়ে পরে আবার সেটি ফেরত আনেন কয়েক মাস পর। আইয়ুব খান ১৪ মার্চ, ১৯৬৩ শর্ষিণার পীরের উরসেও বক্তৃতা দেন।[৬] আইয়ুব খান কি পাকিস্তানকে ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত ছিলেন? ওপরের উদাহরণ দুটি থেকে তাই মনে হতে পারে। বস্তুত আইয়ুব খান মুসলিম পারিবারিক আইনের কিছু গুরুতর সংশোধনী করে এর আগেই মৌলবাদীদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন, কাফের আখ্যাও পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবার ফাতেমা জিন্নাহর সাথে নির্বাচনী দ্বৈরথে পার হবার তাড়নায় ধর্মীয় নেতৃত্বকে ব্যবহার করে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ এই জিগির তুলিয়েছিলেন নিজেই। ফলে সংবিধানে ধর্মরাষ্ট্র ফেলে দিয়ে আবার ফেরত আনা কিংবা নির্বাচনে জেতার জন্য মোল্লা সম্প্রদায়কে ব্যবহার দিয়ে আইয়ূব খানকে ধর্মান্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা যথাযথ হবে না। বরং এটা স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৪.
আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরবর্তীকালেরই গল্প, যে পরবর্তীকালের বাড়াবাড়ির কথা হুমায়ুন আজাদকে বলছিলেন আবদুর রাজ্জাক। পাকিস্তান রাষ্ট্রে পরবর্তীকালের এই ধর্মের বাড়াবাড়ির সাথে জিন্নাহর কি কোন সম্পর্ক আছে? তিনি তো এমনকি ১৯৪৭ সালের ১১ অগাস্টে পাকিস্তানের সংবিধান সভায় তার বিখ্যাত বক্তৃতায় ঘোষণায় এই নিশ্চয়তাই দিয়েছিলেন:[৬]
আপনারা বাধাহীন; বাধাহীনভাবে আপনারা নিজ নিজ মন্দিরে যাবেন, এই পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাধাহীনভাবে আপনারা নিজ নিজ মসজিদ বা অন্য যে কোন প্রার্থনার স্থলে যাবেন। আপনি যে কোন ধর্মের অথবা বর্ণের অথবা বিশ্বাসের অনুসারী হতে পারেন– রাষ্ট্রের পরিচালনায় এর সাথে কোন সম্পর্ক নাই। আপনারা জানেন, ইতিহাস বলে যে ইংল্যান্ডে কিছুকাল আগে পরিস্থিতি ভারতের বর্তমান দশার চেয়েও অনেক খারাপ ছিল... ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমাদের সূচনা সেইসব দিনে হচ্ছে না। আমরা এমন সময়ে শুরু করছি যখন কোন বৈষম্য নাই, একটা সম্প্রদায়ের সাথে আরেকটটা সম্প্রদায়ের কোন পার্থক্য নেই, একটা বর্ণ বা বিশ্বাসের অনুসারীর সাথে আরেকজনের কোন বৈষম্য নেই। আমরা শুরু করছি এই প্রাথমিক মূলনীতি থেকে : একটি রাষ্ট্রের আমরা সকলেই নাগরিক, সমান নাগরিক... আমি মনে করি আমাদের উচিত হবে এটিকে আমাদের সামনে আমাদের আদর্শ হিসেবে রাখা, এবং আপনারা দেখবেন সময়ের আবর্তনে হিন্দুরা আর হিন্দু থাকবে না, মুসলিমরা আর মুসলমান থাকবে না, ধর্মীয় অর্থে নয়, কেননা সেটা প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাস, বরং রাজনৈতিক অর্থে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এটা ঘটবে।[৭]
তার এই অতি চমৎকার ঘোষণার প্রতি পরবর্তীকালের পাকিস্তানে জিন্নাহ নিজেই কতটা সৎ থাকতে পারতেন, তার পরীক্ষা নেয়াটা যথেষ্ট কঠিন। কেননা মাত্র এক বছর পর ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে তার মৃত্যু হয়। এর মাঝেই জিন্নাহ একবার ঢাকা এসেছিলেন। সেই সফরে পূর্ব বাংলার রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারিত হয়েছিল অনেকটাই। এই সফরের সংক্ষিপ্ত সময়টুকুতে জিন্নাহর কয়েকটি কাজে এই অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীনতার নীতি তিনি কতখানি পালন করতে পারছিলেন, তার সামান্য যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা হয়তো অধ্যাপক রাজ্জাকের কাহিনিটিকে খারিজ করে দেবে।
সেই কাহিনি আমরা শুনবো বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামের সুবিখ্যাত গ্রন্থটিতে ঠাঁই পাওয়া মোহাম্মদ তোয়াহার স্মৃতিচারণে। (চলবে)

আগের পর্বে যেতে-

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৫

 

টিকা

১. আবদুর রাজ্জাক, এই সময়ের জ্ঞানতাপস : হুমায়ুন আজাদের সাথে সাক্ষাতকার


২. যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা।

৩. সরদার ফজলুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ।
৪. ১১৬ পৃষ্ঠা, সরদার ফজলুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ। মোনেম খান যে রাজ্জাক সাহেবের বিষয়ে অস্বস্তিতে ভূগতেন, তার দৃষ্টান্তস্থানীয় একটি গল্প বলেন। রাজ্জাক সাহেবের বন্ধুস্থানীয় আখতার হামিদ খান একবার ফোন করে তাকে কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে যেয়ে কাজ করার নিমন্ত্রণ জানান। দুই বৃদ্ধ কেউ কারও মত বদলাতে পারবেন না, অতএব ছ’মাসেই তাদের বিচ্ছেদ হবে এই বলে রাজ্জাক সাহেব তাকে নিরস্ত করতে চাইলে আখতার হামিদ খান তাকে জানান যে, এবার তাকে যেতেই হবে, কারণ এই প্রস্তাব খোদ লাট সাহেবের : হঠাৎ সেদিন গভর্নর মোনেম নিজে আমাকে ফোন করেছেন। আমি তো ফোন পেয়েই আশ্চর্য। ভাবলাম, আমি আবার কি অপরাধ করলাম। কিন্তু তিনি ফোন ধরেই জিগ্যেস করলেন আমাকে : ‘আপনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির আবদুর রাজ্জাককে চিনেন?’ আমি বললাম, হ্যাঁ, চিনি। গভর্নর বললেন : আপনি তাকে আপনার একাডেমীতে নিয়ে নেন। আমি চাই না সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে থাকে... এই কাহিনী স্মরণ করে অধ্যাপক রাজ্জাক হাসতে হাসতে বললেন : এমনি মজার লোক ছিলেন মোনেম খান।
৫. (আবদুল হক : লেখকের রোজনামচা, চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ১৯৫৩-৯৩, পৃষ্ঠা ৭৮, ১৫ মার্চের ভুক্তিটিতে এ সম্পর্কিত বিশ্লেষণ দ্রষ্টব্য) তিনি নিজেও আইয়ুব খানের ‘প্রগতিশীলতা’র প্রতি মোহভঙ্গ হওয়া একজন মানুষ।

৬. বক্তৃতাটির খণ্ডাংশের বর্তমান লেখককৃত অনুবাদ।


৭. পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ৯৪।
 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ