X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৭ (প্রসঙ্গ জিন্নাহ)

ফিরোজ আহমেদ
২৮ আগস্ট ২০১৬, ১৭:০৪আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০১৬, ১৭:০৯

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৭ (প্রসঙ্গ জিন্নাহ) এভাবে জিন্নাহ যা আলোচনা করতে চাইছিলেন, তা হিন্দু ছাত্রদের সামনে আলোচনার যোগ্য ছিল না, তাই এভাবে (ভদ্রতা রেখে?) সকলকেই বিদায় করা হলো। কিংবা হিন্দু ছাত্রদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল। অথবা, রাষ্ট্রের ভবিষ্যত বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনাকে তিনি প্রযোজনীয় মনে করেননি। নীতিহীন ক্ষমতাধররা বিপদে আপদে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার কমবেশি করেই থাকেন

পূর্ব প্রকাশের পর

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসেন। সেদিনই তিনি রেসকোর্সে বক্তৃতায় বলেন, কিছু সংখ্যক কমিউনিস্ট এবং বিদেশিদের সাহায্যপ্রাপ্ত এজেন্ট পূর্ব বাংলাকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা ছাড়েনি এবং তারাই প্রচার করছে যে, পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে চায়।[১] শুধু এটুকুতে অবশ্য প্রমাণ হয় না যে জিন্নাহ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করছেন। কিন্তু ওই বক্তৃতারই আরেকটি অংশে ভাষা আন্দোলনকে মোকাবেলায় ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের সাক্ষ্যও মোটামুটি স্পষ্ট:
“প্রাদেশিকতার উস্কানি দানের মাধ্যমেই তাদের এই প্রচেষ্টাকে তারা অব্যাহত রেখেছে। যে পর্যন্ত না এই বিষয়কে আপনারা রাজনীতি থেকে বর্জন করেছেন, সে পর্যন্ত আপনারা নিজেদেরকে একটা সত্যিকার জাতি হিসেবে গঠন করতে সক্ষম হবেন না। আমরা বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, পাঠান ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। ইউনিট হিসাবে সেগুলির অবশ্য একটা অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করি, চৌদ্দশো বছর পূর্বে আমাদেরকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল আমরা কি তা ভুলে গেছি? আমার মতো আপনারা সকলেই এখানে বহিরাগত। বাঙলাদেশের আদি অধিবাসী কারা? যারা এখন এদেশে বাস করছে তারা নয়; কাজেই আমরা বাঙালি বা সিন্ধি বা পাঠান বা পাঞ্জাবি এ কথা বলার প্রয়োজন কি? না, আসলে আমরা সকলেই হলাম মুসলমান।
ওই বক্তৃতায় আরও বহু নিদর্শন পাওয়া যাবে, ভাষা আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক একটি প্রশ্নের মোকাবেলা করতে গিয়ে কতভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে আনা হয়েছে। মুসলমানরা সকলেই যে বহিরাগত এবং এখানকার আদি অধিবাসী নন, এই ঐতিহাসিক একদেশদর্শী তত্ত্বকে সামনে আনা হয়েছে উদ্ধৃতাংশটিতে। ইঙ্গিত দেয়া আছে যে, এই বিরূপ দেশীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বাইরে থেকে আসা মুসলমানদের সংহত বা একজোট থাকতে হবে। স্থানীয় বৈশিষ্ট্যকে বর্জন করার কথা বলা হয়েছে, কেননা সেটা ছাড়া এক জাতি গঠিত হবে না, এবং দাবি করা হয়েছে সেটা ‘চৌদ্দশো বছর আগে যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে’, তার সাথে সাংঘর্ষিক। বলা হয়েছে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ভাষার প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
একই বক্তৃতায় জিন্নাহ এমনকি সরকার ‘শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতক অথবা তাদের এজেন্টদের যে কোন চেষ্টাকে কঠিনভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করায় সন্তোষও প্রকাশ করেন। তিনি নিজেও ঘোষণা করেন, ‘এসব যদি বন্ধ না করা হয় তাহলে আমি নিশ্চিত যে আপনাদের সরকার এবং পাকিস্তান সরকার এই বিষাক্ত শক্তিকে নির্দয়ভাবে দমন করার জন্য কঠিনতম ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।”
সত্যি বলতে কি, ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নটি তখনও পূর্ব বাংলার রাজনীতির মাঠে অতটা বিস্তারিত হয়নি। ভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙার কোন কল্পনা, কোন ভাবনা পূর্ব বাংলার কারও মাথায় এসেছিল, তেমন নজির বিরল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া তাঁর অসহিষ্ণু মনোবৃত্তির প্রকাশ, অন্যদিকে একে মোকাবেলা করতে গিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে টেনে আনাটাও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদের পরিচয় কোনভাবেই দেয় না। অথবা, পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসেবে এ হয়তো তার দূরদর্শীতারই পরিচায়ক, তিনি ভালরকমই বুঝতে পেরেছিলেন ভাষার প্রশ্নটি বিপদজনক, এবং ভবিষ্যতের পাকিস্তানের মুসলিম উম্মাহর ধারণায় ফাটল শুরু হতে পারে ভাষার প্রশ্নটি থেকেই।
সত্যি বলতে কি, প্রাদেশিক ভাষা অনেকগুলো জাতিকে নিয়ে গঠিত বৃহৎ জাতিকে এক সময় বিপন্ন করে ফেলবে, এই আশঙ্কা ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেই ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছিল। নানান ঘটনাপরিক্রমায় পূর্ব বাংলায় ভাষা প্রশ্নে যে আলোড়ন উপস্থিত হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে ততটা ঘটেনি। বরং বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ, রাষ্ট্রনেতাদের সুবৃহৎ অংশ কেন্দ্রীয় স্বার্থের পক্ষেই অবস্থান নেন। সুনীতিকুমারের মতো বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান ভাষাতাত্ত্বিকও হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বলেছেন, বিভাগপূর্ব আমল থেকেই। তাঁর বয়ানে শোনা যাক :
“সংযুক্ত-রাষ্ট্র মূলত ভারতের ভাবী স্বাধীনতার যুগে এক একটী ভাষাকে আশ্রয় করিয়া যে-সকল স্বাধীন বা স্বতন্ত্র প্রান্তিক রাষ্ট্র স্থাপিত হইবে, সেগুলির অবস্থানের দ্বারা নানা নূতন কেন্দ্রাপসারী শক্তি কার্য্য করিবে, সেই-সব শক্তি প্রবল হইয়া নিখিল-ভারতীয় একতার পক্ষে হানিকর হইবে, এরূপ আশঙ্কা আছে; এরূপ কেন্দ্রাপসারী শক্তির অন্যতম প্রতিষেধক হিসাবে একটী নিখিল-ভারতীয় সর্বজন-বোধ্য রাষ্ট্র-ভাষার বিশেষ আবশ্যকতা সকলেই স্বীকার করিবেন। ভারতের ভৌগোলিক সংস্থান, ইহার প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক আবেষ্টনী, ইহার এক-সূত্রে-বদ্ধ সংস্কৃতি- এই সবের সংযোগে ভারতের যে একতা গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাকে বিখণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন করিয়া দিবার জন্য নানা দিক্ হইতে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে প্রয়াস দেখা দিবে। এইরূপ প্রয়াসকে প্রতিহত করিবার জন্য, ভারতে কতকগুলি কেন্দ্রীয় ও কেন্দ্রাভিমুখী শক্তি অত্যাবশ্যক হইবে এবং একটী নিখিল-ভারতীয় সর্বজন-বোধ্য রাষ্ট্রভাষা এইরূপ শক্তির মধ্যে অন্যতম রূপে যাহাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহার চেষ্টা করা উচিত।”[২]
তবে শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে জিন্নাহ ছিলেন অনেক বেশি কর্তৃত্বপরায়ন। নেহেরুর প্রতিস্পর্ধী আরও অনেক নেতা কংগ্রেসে ছিলেন, অচিরেই মোটামুটি শক্তিশালী বিরোধীদলও সেখানে সৃষ্টি হল। বিপরীতে জিন্নাহ কিন্তু ওই একই বক্তৃতায় বলেন:
“আপনারা যদি পাকিস্তানের খেদমত করতে চান, যদি আপনারা পাকিস্তানকে গঠন করতে চান, যদি আপনারা পাকিস্তানকে সংস্কার করতে চান তাহলে আমি বলবো যে প্রতিটি মুসলমানের সামনে একটি মাত্র সৎপথই খোলা আছে- তাহলো মুসলিম লীগে যোগদান করে নিজের সাধ্যমত পাকিস্তানের খেদমত করা। কোন রকম বিদ্বেষ অথবা শুভেচ্ছা অভাবের জন্য নয়, তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্যই ব্যাঙের ছাতার মত যে সমস্ত পার্টিগুলো গজিয়ে উঠছে সেগুলিকে সন্দেহের চোখে দেখা হবে।”
এই বাক্যরাশির মাঝে আমরা এক হৃদয়হীন, গণতন্ত্রের নূন্যতম চেতনাহীন ফ্যাসিস্টেরই সাক্ষাৎ পাই। পাই রাষ্ট্র বিষয়ে যে কোন বিরুদ্ধ মতের প্রতি নির্মূল করার নগ্ন হুমকি।
দুই.
ওই একই সফরে জিন্নাহ সাহেবের সাম্প্রদায়িক মনের আরও একটি পরিচয় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। সেবার ‘ঢাকা অবস্থানকালে প্রতিনিধিস্থানীয় ছাত্রদের সাথে সাক্ষাতের জন্যে জিন্নাহ ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সেই অনুসারে বিভিন্ন ছাত্রাবাসের প্রভোস্টদের মাধ্যমে ছাত্রাবাসগুলির সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদেরকে এই সাক্ষাৎকারের কথা বলা হয়। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের সহ-সভাপতিও এই সাক্ষাৎকারের জন্যে আমন্ত্রিত হন। ২০ মার্চ জিন্নাহর সাথে এই ছাত্র প্রতিনিধি দলটি চিফ সেক্রেটারির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।
পনেরো বিশ মিনিটকাল স্থায়ী এই সাক্ষাতকারে প্রত্যেকের সাথে পৃথক পৃথকভাবে পরিচিত হওয়ার জিন্নাহ ব্যক্তিগতভাবে সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করেন এবং অত্যন্ত মামুলী কিছু কথাবার্তার পর তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান।” অর্থৎ প্রতিনিধিদের বিদায় জানিয়ে দেন। এই সময় মোহাম্মদ তোয়াহা তাকে ভাষা সমস্যা বিষয়ে একটি লিখিত স্মারকলিপি দেন, জিন্নাহ সেটি হাতে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দেন, কোন মন্তব্য করেননি।[৩]
সাক্ষাতকারটি এত সংক্ষিপ্ত এবং কুশল-বিনিময় সর্বস্ব হওয়ার কারণটি জানা গেল অচিরেই। শিক্ষার্থীরা বিদায় নেয়ার সময় জিন্নাহর সামরিক সচিব হঠাৎ দৌড়ে এসে মোহাম্মদ তোয়াহা ও নজরুল ইসলামকে আবারও জিন্নাহর সাথে দেখা করবার জন্য বলেন। ‘তারা দুজন ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতে জিন্নাহ তাদের বলেন যে, সাক্ষাতকারের ব্যাপারে একটা ভুল হয়ে গেছে। তিনি শুধু মুসলমান ছাত্রদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন, হিন্দু ছাত্রদের সাথে নয়।
‘প্রত্যেক ছাত্রাবাসের সভাপতি এবং সম্পাদককে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাতের জন্যে আমন্ত্রণ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ছাত্রাবাসের দুইজন হিন্দু ছাত্র প্রতিনিধিও সেদিন অন্য ছাত্রদের সাথে গিয়েছিলেন। ছাত্রদের সাথে জিন্নাহ যে সব বিষয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, সেগুলি তিনি হিন্দু ছাত্রদের সামনে আলোচনার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না এবং তার জন্যে সাক্ষাতকারের সময় বিশেষ কোন আলোচনা না করে অল্পক্ষণ পরেই সাক্ষাৎকার তিনি শেষ করে দেন।
‘মোহাম্মদ তোয়াহা জিন্নাহর কথা শুনে তাকে বলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন ছাত্রাবাসে থাকে এবং বার্ষিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে হিন্দু ছাত্রদের জগন্নাথ ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।
‘জিন্নাহ তখন তোয়াহাকে বলেন যে, সেই জাতীয় কোন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে তিনি আলোচনা করতে চান নি। তিনি চান মুসলিম ছাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সাথে ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে কিছু আলাপ আলোচনা করতে।”[৪]
এভাবে জিন্নাহ যা আলোচনা করতে চাইছিলেন, তা হিন্দু ছাত্রদের সামনে আলোচনার যোগ্য ছিল না, তাই এভাবে (ভদ্রতা রেখে?) সকলকেই বিদায় করা হলো। কিংবা হিন্দু ছাত্রদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল। অথবা, রাষ্ট্রের ভবিষ্যত বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনাকে তিনি প্রযোজনীয় মনে করেননি। নীতিহীন ক্ষমতাধররা বিপদে আপদে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার কমবেশি করেই থাকেন। জর্জ বুশ যেমন ক্রুসেডের ডাক দেন, রাজীব গান্ধী রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছিলেন। কত কম বিপদে কত বেশি ধর্মের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, তাই দেখে রাষ্ট্রের শক্তিমত্ততাও টের পাওয়া যায়। সেই পরীক্ষায় ভারতের মতই পাকিস্তানও একদম শুরু থেকেই অকৃতকার্য হয়ে আসছে। জিন্নাহ খুব সম্ভবত তার ব্যতিক্রম নন।
প্রাসঙ্গিকভাবেই অন্য একটি বিষয় এখানে আলোচনা করা যায়। ভাষা আন্দোলনের পুরো সময়টি জুড়েই হিন্দু, কমুনিস্ট বা ভারতের ওপর আন্দোলনের দায় চাপানোর চেষ্টাটি পাকিস্তান রাষ্ট্র বা জিন্নাহ করছিলেন ভাষার এই গুরুতর সমস্যাটিকে আড়াল করার জন্যই। সঙ্কটের গণতান্ত্রিক মীমাংসার বদলে তাকে বল প্রয়োগে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা যে যে শুভ পরিণতি ডেকে আনে না, সে প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের এক সামরিক গভর্নর জাকির হোসেনের সাথে তার বৈঠকে যে প্রজ্ঞার পরিচয় রাজ্জাক সাহেব দিয়েছিলেন, সেটিকেই আমরা তৃতীয় বারের মত স্মরণ করছি।[৫]
‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামের যে গ্রন্থটি থেকে জিন্নাহ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণটুকু এখানে তুলে ধরা হলো, অধ্যাপক রাজ্জাক সেটির ভূয়সী প্রশংসাই করেছেন, বলেছেন “উমর যদি পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন এবং তৎকালীন রাজনীতি কেবল এই একটা বইই লিখতেন, তা অইলেই পস্টারিটি তার নাম স্মরণ করার জন্য যথেষ্ট। সে ত আরও অনেক কাম করছে। উমরের একটা ঋজু খাড়া চরিত্র আছে, বিশ্বাস অনুসারে চলার চেষ্টা করে। আমাগো সমাজে এই রকম মানুষ ক’জন আছে”[৬]। এটা খুবই সম্ভব যে, বদরুদ্দীন উমরের গ্রন্থটিতে উল্লেখিত প্রতিটি স্মৃতিচারণ তিনি যথাযথভাবে পাঠ করার সময় পাননি, অথবা স্মরণে রাখেননি। যদি ধরে নেয়া যায় যে, গ্রন্থটি তিনি খুঁটিয়ে পাঠ করেছেন, তাহলেও এটি সেই রকম একটা দৃষ্টান্ত হিসেবেই টিকে থাকবে, যখন ইতিমধ্যেই নির্মিত ধারণা বা বিশ্বাস নিয়েই আমরা কোন গ্রন্থ পাঠ করি, পরিচালিত হই এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণও করে ফেলি, তখন সাধারণত ওই গ্রন্থেই থাকা বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত আমাদের প্রত্যয়ে কোন পরিবর্তন ঘটায় না।
একই প্রসঙ্গে এই উদাহরণটি ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থটির লেখক স্বয়ং বদরুদ্দীন উমরসহ পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নেয়া উদার ও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার অধিকারী অংশটির জন্যও প্রযোজ্য। এরা সকলেই জিন্নাহর চরিত্রের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যে গুরুত্ব দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনকে মোকাবেলায় জিন্নাহর বাস্তবে আচরিত কৌশলের চেয়েও তারা গুরুত্ব দিয়েছেন সংবিধান সভার বৈঠকে জিন্নাহর আশ্বাসের ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রবলতম আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ বদরুদ্দীন উমর রচিত ‘সাম্প্রদায়িকতা’তেও জিন্নাহর এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় ঐক্যের মত আদতে গভীরতর বিভাজন সৃষ্টিকারী আহবান দিয়ে সাধারণত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা শাসকরা রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেন না। কিন্তু রাষ্ট্রে যদি শ্রেণিগত নিপীড়নের পাশাপাশি জাতিগত, বর্ণগত ও ধর্মীয় শ্রেষ্টত্বও প্রবল প্রতাপে থাকে, অসাম্প্রদায়িকতা তখন শাসকের বিলাসে পরিণত হয়। জিন্নাহ যতই অসাম্প্রাদিয়ক হবার বাসনা করুন, জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে বিভক্ত যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তিনি কায়েম করেছিলেন, সেটার পক্ষে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় পরিচয়ের দোহাইয়ের উর্ধে ওঠা খুবই কঠিন ছিল।
জিন্নাহ সম্পর্কে অধ্যাপক রাজ্জাকের মত দিয়েই অবশ্য ব্যক্তি আবদুর রাজ্জাককে, সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তার অবস্থানকে বিচার করা যথাযথ হবে না। এই প্রসঙ্গটি শেষ করা যাক আহমেদ ছফাকে উদ্ধৃত করেই: প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। তিনি কি কারণে পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন, তার একটা কৈফিয়ত তিনি দিয়েছেন। এটা গ্রহণযোগ্য কৈফিয়ত কি না বিচারের ভার অন্যদের... সেই পরিবেশ পরিস্থিতিতে তিনি মনে করেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেই বাংলার মুসলমান সমাজের উপকার হবে। বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ধারণাটিও রাজ্জাক সাহেবের মস্তক থেকে এসেছিল... এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন রূপান্তরের মধ্যে রাজ্জাক সাহেব যে অবস্থানটি গ্রহণ করেছিলেন, তা সঠিক কি বেঠিক ছিল সে বিতর্কেও আমি প্রবৃত্ত হবো না। আমি শুধু একটি কথাই জোর দিয়ে বলবো, রাজ্জাক সাহবে মনে প্রাণে খাঁটি সেকুল্যার মানুষ।”[৭](চলবে)

আরো পড়ুন-

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৬ (প্রসঙ্গ জিন্নাহ)

 

টীকা
১. পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ৯৪
২. ভারতের ভাষা ও ভাষাসমস্যা, প্রথম প্রকাশ পৌষ, ১৩৫১, রূপা এন্ড কোম্পানি মুদ্রিত ১৯৯২ সালের সংস্করণ থেকে বর্তমান উদ্ধৃতিটি নেয়া হয়েছে, পৃষ্ঠা ৪০।
৩. একই স্মারকলিপি তাকে আবারও দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে ২৪ মার্চ। পৃষ্ঠা ১০২, বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রথম খণ্ড।
৪. পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা ১০২। কাহিনীটির উৎস মোহাম্মদ তোয়াহা। সৈয়দ নজরুল ইসলামও বদরুদ্দীন উমরকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে শুধু এইটুকু স্মরণ করতে পারেন যে দ্বিতীয়বার তাঁদের দু’জনকে ভিতরে ডেকে নেওয়া হয়েছিল।
৫. সরদার ফজলুল করিম, পৃষ্ঠা ১১৮। বর্তমান রচনার টীকা ৪৪ দ্রষ্টব্য।
৬. আহমদ ছফা, যদ্যপি আমার গুরু, পৃষ্ঠা: ৮০
৭. আহমদ ছফা, যদ্যপি আমার গুরু, পৃষ্ঠা ১০৯

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া