X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব- ৯ (সামন্তবাদ বিচার : শেষ অংশ)

ফিরোজ আহমেদ
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:২৯আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:১৯

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক
পূর্ব প্রকাশের পর

সামন্তবাদের উপস্থিতি বিষয়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়টিকে আমরা দুটি দিক দিয়ে বিচার করতে পারি:
ক. সামন্ত সমাজে বণিকবৃত্তি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত কি না
খ. চাঁদ সওদাগরের কাহিনি বাংলায় প্রচলনের সময়ে বাংলায় বাণিজ্যবৃত্তির পরিস্থিতি কেমন ছিল
প্রথম প্রশ্নটি বিষয়ে বলা যেতে পারে, সামন্তবাদ পরিভাষাটিকে অধ্যাপক রাজ্জাকের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘কঠোরতম অর্থে’ ব্যবহার করা হলেও কিন্তু সেখানে বাণিজ্য অনুপস্থিত থাকবেই, এমন কোনো শর্ত কোথাও নেই। বরং বাণিজ্য থাকাটাই স্বাভাবিক এবং সকল সামন্ত সমাজেই কমবেশি বাণিজ্য ছিল। লোহা, লবণসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সবখানে পাওয়া যায় না। সামন্ত প্রভূদের বিলাসোপকরণের একটা বড় অংশও বাইরে থেকেই আসতে হতো। বাইরে থেকে আসতে হতো বহু যুদ্ধোপকরণও। এগুলো বণিকরাই সরবরাহ করতো। ফলে যে খাঁটি ফিউডালিজম বা সামন্তবাদ ইউরোপে মধ্যযুগের শুরুতে আবির্ভূত হয়েছিল, সেখানেও আমরা প্রতিটি রাষ্ট্রে ও সমাজে একটি বর্গ হিসেবেই বণিকের উপস্থিতি দেখতে পাবো। এবং সামন্তবাদের সময়টা জুড়েই বণিকদের সংঘ, গোষ্ঠী বা গিল্ড ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছিল সামন্তবাদী একটা ব্যবস্থার অনড়-অচলতার পরিপূরক হিসেবেই। এমনকি মধ্যযুগে জার্মান বণিকদের বিখ্যাত হ্যানসিয়াটিক গিল্ড গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে ছিল, বিশাল এই বণিক সংঘের হাতে অজস্র ধরনের পণ্যের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার ছিল তো বটেই, সদাপ্রস্তুত নিয়মিত সেনাবাহিনিও তারা ব্যবহার করতো, স্বাধীন রাজাদের সাথেও তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছে। তাদের স্বশাসিত বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল সামন্তশাসিত ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়াসহ গোটা ইউরোপে; তারা টিকে ছিল আধুনিক আমলের সূচনাকাল পর্যন্ত। এরা ছাড়াও ছিল মধ্যযুগে ছিল জেনোয়া, ভেনিসসহ বেশ কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্রিক সামুদ্রিক পরাশক্তি, ভরভরন্ত সামন্তযুগে যারা ইউরোপে বাণিজ্যের একটা বড় অংশ পরিচালনা করতো।
ফলে বণিকের অনুপস্থিতি সামন্তবাদের শর্ত হবার কথা না, যেটি ছফার বয়ানে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক দাবি করছেন। রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণমূলক শক্তির অবসান পরবর্তীতে অনেকগুলো ক্ষুদ্র আঞ্চলিক রাজশক্তি এবং পুরো স্বাধীন, আধা স্বাধীন কিংবা কোনো কোনো ধরনের শিথিল আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ সামন্ত যুদ্ধবাজ নেতাদের উদ্ভব, তার পারিবারিক উত্তরাধিকার সৃষ্টি এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরন্তর কলহ দীর্ঘস্থায়ী ইউরোপীয় সামন্তবাদের সূচনা করেছিল। প্রজাদের বৃহদাংশকে কৃষক ও কারিগর হিসেবে ভূমিতে যথাসম্ভব আটক রাখার আইনী, ধর্মীয় ও নৈতিক যৌক্তিকতা সামন্তবাদের টিকে থাকা ও বিকাশের পরিপূরক ছিল। সামন্ত প্রভূরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজার অধীনস্ত ছিলেন বটে, নিজের গণ্ডীর মাঝে তার হুকুমই ছিল চূড়ান্ত। এবং প্রায়ই সেই গণ্ডী বাড়িয়ে নিতে তারা চেষ্টা করতেন। এরা প্রত্যেকেই নিজস্ব সামরিক শক্তির অধিকারী ছিলেন, রাজা ও সম্রাটকে সামরিক সেবা দেয়াই ছিল তাদের একমাত্র বাধ্যবাধকতা। বহুক্ষেত্রেই তারা নিজেদের রাজার বিরুদ্ধাচারণও করতো, এমনকি বিদেশী রাজাদের সাথেও আঁতাতের অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে।
কিন্তু এহেন সামন্তসমাজও বাণিজ্য ছাড়া টিকতে সক্ষম ছিল না। শুরু থেকেই সেখানেও বাণিজ্য ছিল, থাকতেই হতো। তবে আগেকার দাসযুগের মতো বাণিজ্য অত বেশি প্রবল ছিল না। বড়জোড় এটা বলা যায় যে, কেন্দ্রিয় রোমক সাম্রাজ্যশক্তির পতনের ফলে নগরগুলোর ক্ষয় ও নাগরিকতার হ্রাসের কারণে বাণিজ্যের চাহিদা, পরিমাণ ও গূরুত্ব বিপুল হারে হ্রাস পেয়েছিল। বিশেষ করে সামন্তযুগের শুরুর আগে আগে জার্মান ‘বর্বর’দের আক্রমণের কালটাতে ইউরোপে নগরসভ্যতা বহুলাংশে প্রায় বিধ্বস্ত হয়েছিল। হস্তশিল্প ও কৃষির রফতানি বাণিজ্য ও বিলাসপণ্যের বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে উধাও হয়েছিল। হাজার হাজার কারিগর ও দাস এইসব উৎপাদনে যুক্ত ছিল। রোমসহ বিশালকার নগরগুলো ছিল এর ক্রেতা। এই নগরগুলো ধ্বংস ও শাসনপ্রণালী বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে অধিকাংশ মানুষ নিজস্ব চাহিদা মেটাবার কৃষিকাজে ফেরত গিয়েছিল। আক্রমণকারী জাতিগুলোর যাযাবর ও পশ্চাৎপদ জীবন যাত্রার কারণে নগর ও নগর সভ্যতার চাহিদা কিংবা একে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন তেমন ছিল না। পরস্পরের সাথে যুদ্ধের কারণে সেটা তৈরি হতেও বেশ কয়েকটা প্রজন্ম সময়ও নিয়েছে। ফলে এমনকি শুরুতে শিক্ষাব্যবস্থাও ধ্বংস হয়েছিল। কেবল গির্জা প্রশাসনই সনাতনী শিক্ষার চর্চাকে খানিকটা আগলে রেখেছিল, রক্ষণশীল কায়দায়। ফলে বণিকরাও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তখনও সামন্তবাদেরও ঠিকমতো সূচনা হয়নি। দাসযুগ পরবর্তী এটা একটা মধ্যবর্তী সময়, যাকে ইউরোপের ইতিহাসে বর্বর আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় বলে চিহ্নিত করা হয়।
কিন্তু সামন্তবাদ ও সামন্তশক্তিগুলো দানা বাধতে থাকলে, যাযাবর আক্রমণকারীরা ধীরে ধীরে নিজেদের হুন, গথ, ভ্যান্ডাল, ফ্যাঙ্ক, লম্বার্ড সহ অজস্র রাজবংশ ও সামন্ত পারিবারিক শাসনে অভ্যস্ত হলে ধীরে ধীরে বণিকরা আবারও ফেরত আসতে থাকেন। তবে তারা কখনোই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি। সামন্তবদের দীর্ঘকালটি জুড়ে তারা বিকশিত হয়েছেন। নিজেদের আয় বৃদ্ধির জন্য সামন্ত প্রভূরা মেলার আয়োজনও করতেন, বণিকদের উৎসাহিত করতেন। কোনো কোনো সামন্তপ্রভূর আয়ের উৎস ছিল বণিকদের লুণ্ঠনও। এবং  মধ্যযুগের শেষভাগে আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর উদ্ভবের সাথে সাথে সামন্তদের প্রভাব গুরুত্ব কমাবার পেছনে বণিকদের অদৃষ্টপূর্ব বিকাশের একটা সম্পর্কও আছে। রাজাদের কতৃত্ব বৃদ্ধি করে সামন্তবাদের উচ্ছেদ বণিকদের একটা অন্যতম চাওয়া হয়ে দাঁড়ায় মধ্যযুগের শেষপর্বে। সামন্তদের শায়েস্তা করে, তাদের আঞ্চলিক ক্ষমতা খর্ব করে কেন্দ্রিয় শাসন প্রতিষ্ঠা রাজাদেরও স্বার্থ ছিল বটে। এর আগ পর্যন্ত সামন্তযুগে বণিকরা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধই হয়েছে।
সংক্ষেপে, সামন্ত যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য এটা না যে সেখানে বাণিজ্য থাকতে পারবে না। বরং সামন্তবাদের একটা অন্যতম শর্ত হিসেবে দেখানো হয় উৎপাদনের বৃহদাংশ কৃষকরা নিজেদের ভোগের জন্যই উৎপাদন করেন, একটা অংশ কর হিসেবে সামন্ত প্রভূর কাছে যায়। শিল্প-বাণিজ্যের চাইতে ভূমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ও ভূমির খাজনাই রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের উৎস। শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী জার্মানি রাশিয়া ফ্রান্স ইংল্যান্ডসহ অধিকাংশ ইউরোপীয় রাষ্ট্রে জমির রাজস্বই ছিল রাজাদের প্রধান আয়, সামন্তপ্রভূদের তো বটেই। স্পেন একটা ব্যতিক্রম ছিল, কেননা তার ছিল আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে উপনিবেশ থেকে আসা সোনা ও রূপোর একচেটিয়া কারবার। কিন্তু সেখানেও অধিকাংশ প্রজা ভূমিদাস হিসেবেই বাস করতো। সামন্তব ব্যবস্থারই অনুষঙ্গ হিসেবে সামন্ত প্রভূরা কৃষক প্রজাদের জমির সাথে বেঁধে ফেলেন, তাদের ভূমিদাসে পরিণত করে আইন জারি করেন এবং তা বংশানুক্রমিক দায়ে পরিণত হয়। ফলে ভূমিকে কেন্দ্র করেই অধিকাংশ মানুষের সংস্কৃতি ও জীবন নির্ধারিত হয়। কিন্তু তথনও মুক্ত কৃষক যেমন ছিলেন, সংখ্যায় কম হলেও, তেমনি ছিলেন বণিক শ্রেণিও। সামন্ত যুগের পূর্ববর্তী দাস যুগে উৎপাদন পদ্ধতিটি আবর্তিত হতো দাসদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে। মোটাদাগে গ্রিক ও রোমান পর্বটিকে দাসযুগ ধরা হয়, রোমান সাম্রাজ্যের পতন পরবর্তী সময়টুকু মধ্যযুগে সামন্ত প্রথার বিকাশ ও বিস্তার। প্রায় স্বনির্ভর গ্রাম সমাজে প্রধানত নিজেদের ভোগের জন্যই এখানে কৃষকরা উৎপাদন করতেন। মেলা, বাজার ও বন্দরগুলোকে কেন্দ্র করে বণিকরা স্থল ও জলপথে নানান ধরনের বাহনে তাদের পণ্যরাশি নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে এই পণ্যগুলো ছিল প্রধানত লোহা ইত্যাদির মতো বিরল অথচ প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, লবণের মতো অত্যাবশ্যক পণ্য, পশমী ও হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি এবং সামন্ত প্রভূদের বিলাসসামগ্রী।
ফলে, অধ্যাপক রাজ্জাককে আমরা যখন আহমদ ছফার মুখ দিয়ে বলতে শুনি : “পুরনো বাংলাপুঁথিতে দেখা যায় বাংলার বাণিজ্যবহর জাভা, সুমাত্রা এই সকল অঞ্চলে যাওয়া আসা করছে। যেখানে বাণিজ্য এইরকম সচল থাকে সেই সমাজটারে অন্য যা ইচ্ছা কইবার চান কন, কিন্তু ফিউডালিজম বলবার পারবেন না... তা অইলে চাঁদ সওদাগরের কাহিনি আপনের জানা। বেবাক বাংলা সাহিত্যে এই রকম শিড়দাঁড়ার মানুষ একটাও দেখছেন?... চাঁদ সওদাগর চরিত্রের এই যে ঋজুতা এইডা অইল সমুদ্র বাণিজ্য শক্তির প্রতীক।” তখন আমাদের স্মরণ না হয়ে পারে না যে, ইউরোপের সামন্তযুগের প্রায় পুরোটা জুড়েই দুঃসাহসী দূরগামী বণিকরা ছিলেন, সমুদ্রে তারা আধিপত্য করতেন, ছোট ছোট নৌকা করে দূর গ্রাম পর্যন্ত তারা মেলায় যেতেন, দলবেধে স্থলপথেও জার্মান বণিকদের দীর্ঘ সারি ইউরোপের প্রান্তিক নগরগুলো পর্যন্ত যেতেন, এবং তাদের হাত ধরেই ইউরোপে খৃস্টানধর্ম ও জার্মান সংস্কৃতির একটা বিকাশ ঘটেছিল। কেননা বণিকদের ছাড়া সামন্তযুগে যেটুকু বাণিজ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল, তা মেটানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু সামন্তযুগের একটা দীর্ঘকাল ধরে তাদের আইনী অধিকার, সামাজিক মর্যাদা ও রাজননৈতিক ক্ষমতা ছিল তুলনামূলকভাবে খুবই কম।
৩.
ভারতে সামন্ত সমাজ আদৌ ছিল কি না, থাকলেও ভারতের সামন্তবাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো কি, না থাকলে তার বদলে যা ছিল, তাকে কোন নামে ডাকা যাবে- সেটা একদমই ভিন্ন প্রশ্ন। আমরা এখানে সেই অনুসন্ধানে আদৌ যাচ্ছি না। আমাদের একমাত্র আগ্রহের বিষয় সামন্তবাদ নামক উৎপাদন ব্যবস্থায় বণিকের উপস্থিতি এবং তৎপরতা সম্ভব কি না সেটা। এবং সে দিক দিয়ে বলা যায়, যে ইউরোপে আমাদের চেনা ধ্রুপদী সামন্তবাদের উদ্ভব বিকাশ ও লয় ঘটেছিল, সেই মধ্যযুগের ইউরোপেও বণিকরা সর্বদাই ছিলেন। ফলে, ভারতবর্ষে  অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক কথিত চাঁদ সওদাগর নামের বণিকের উপস্থিতি সামন্তবাদের সম্ভাবনাকে খারিজ করার জন্য যথেষ্ট না।
এবার আমরা আসি দ্বিতীয়ত প্রশ্নটাতে : বাংলার বণিক ও চাঁদ সওদাগরের কাহিনিটি কখন লেখা হচ্ছে। চাঁদ সওদাগরের কাহিনিটি এসেছে দেবী মনসার প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে। মনসামঙ্গল কাব্যের সবচে বড় লেখকগণ বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার পরেকার যুগের[১]। বাংলার বাণিজ্য ইতিহাসের বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একটা দিক হলো এই যে, মুসলমান শাসনের অব্যবহিত পূর্বের পাল ও সেন এই দুই আমলের আগেই ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষভাবে লয় পেয়েছিল। বঙ্গে গুপ্তযুগে (৩০০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) সাধারণ গৃহস্থরাও স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার করতেন।[২]  “এই যুগের প্রায় প্রত্যেকটি লিপিতেই দেখিতেছি, স্থানীয় রাষ্ট্রাধিকরণ যে পাঁচটি লোক লইয়া গঠিত তাহার মধ্যে দুইজন বোধ হয় রাজপুরুষ, বাকি তিনজনই শিল্পী,বণিক ও ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধি- নগরশ্রেষ্ঠী, প্রথম সার্থবাহ এবং প্রথম কুলিন। ব্যবসা বাণিজ্যের সমৃদ্ধি ছিল বলিয়াই এই সমৃদ্ধির পশ্চাতে রাষ্ট্রের সজ্ঞান একটা চেষ্টা ছিল।” শশাঙ্কের আমল থেকে এই পরিস্থিতির অবনতি দৃশ্যমান, রাষ্ট্র আমলাতন্ত্র নির্ভর এবং নকল স্বর্ণমুদ্রা দেখা দিয়েছে। রৌপ্যমুদ্রা বিলুপ্ত।[৩] দেখা যায়  কি নীহাররঞ্জন থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দেয়া যাক:
“শশাঙ্ক-জয়নাগের কালে রৌপ্যমুদ্রা ছিল না, কিন্তু যত অপকৃষট বা নকলই হউক না কেনো, সুবর্ণমুদ্রা তো ছিল। বাঙলাদেশের মুদ্রাজগৎ হইতে সুবর্ণমুদ্রা এই যে অন্তর্হিত হইলো মুসলমান আমলের আগে তাহা ফিরিয়া আসে নাই। আর একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাইতেছি, তাম্রলিপ্তির ইতিহাসের মধ্যে। সপ্তম শতকের শেষ পাদেও ইৎ-সিঙ তাম্রলিপ্ত বন্দরের উল্লেখ করিতেছেন, অষ্টম শতকেও সাক্ষ্যেও, যেমন দুধপানি পাহারের লিপিতে, ২/১বার তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাইতেছি কিন্তু এই সব উল্লেখ হয় প্রাচীনতর স্মৃতিবহ অথবা শুধু উল্লেখই মাত্র। তাম্রলিপ্তির সেই সম্পদ-সমৃদ্ধির কথা আর কেউ বলিতেছেন না। অষ্টম শতকের শেষার্ধ হইতে এ উল্লেখও আর পাওয়া যাইতেছে না এবং চতুর্দশ শতকের আগে সমগ্র বাঙলাদেশে আর কোথাও বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের আর কোনো বন্দরই গড়িয়ে উঠিল না!”[৪]
এই বাণিজ্যের পতনের সাথে বৈশ্বিক ঘটনাবলীরও একটা সম্পর্ক আছে। বিশেষভাবে সম্পর্ক আছে ইউরোপের কেন্দ্রিয় রোমান সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ও সামন্তবাদের উদ্ভবের সূচনারই সাথে। জার্মান ‘বর্বর’ জাতিগুলোর আক্রমণে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, শেষ রোমান সম্রাট নিহত হন বিপর্যস্ত ৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে। ফলে সারা দুনিয়ার সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারপরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে রাষ্ট্রগুলো রোম সাম্রাজ্য থেকে জন্ম নেয়, তার চাহিদার কারণেও এই সমুদ্র বাণিজ্য আরও কিছুকাল দুর্বল আকারে টিকে থাকে। আরও কয়েক শতাব্দীর জন্য টিকে থাকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যও। ইউরোপের সামন্তযুগের উদ্ভবের আদি কারণ এটাই। ধীরে ধীরে কয়েক শতক ধরে এরপর সামন্তবাদ শক্তিশালী ও দানা বাধতে থাকে। এর একটা প্রত্যক্ষ ফল ছিল সমুদ্র বাণিজ্য খুব বিরাট আকারে হ্রাস পাওয়া, যার ফলে সমুদ্রবাণিজ্য নির্ভর এডেন বন্দরের অধীশ্বর ইয়েমেনের বাদশা আবরাহার বাণিজ্য বিপর্যয় ঘটে, তার মন্দিরে তীর্থযাত্রীর সংখ্যাও হ্রাস পায়। খেয়াল করুন, এই সময়েই উটের কাফেলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। স্থলপথে নতুন বাণিজ্যপথ জমজমাট হয়, চলার পথে একটা উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল মক্কা। সে অন্য আলোচনা।
নীহাররঞ্জনকে দিয়েই আলোচ্য সময়ের বাংলার অবস্থা বোঝাবার চেষ্টা করা যাক:
“এই সব কারণে সমাজে কৃষি-নির্ভরতা বাড়িয়া যাওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং অষ্টম শতক হইতে দেখা যাইবে গাঙ্গেয় ভারতে, বিশেষত বাঙলাদেশে ঐকান্তিক কৃষিনির্ভরতা ক্রমবর্ধমান এবং আদিপর্বের শেষ অধ্যায়ে, অর্থাৎ অষ্টম হইতে ত্রয়োদশ শতকের বাঙলাদেশ একান্তই কৃষিনির্ভর, অর্থাৎ কৃষিই ধনোৎপাদনের প্রথম ও প্রধান উপায়, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যতম উপায় হইলেও তেমন লাভবান নয়, অর্থাৎ বাণিজ্য-সমতা দেশের স্বপক্ষে আর নাই; পূর্ব-দক্ষিণ দ্বীপ ও দেশগুলির সঙ্গে কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য থাকা সত্ত্বেও নাই।”

এই অধ্যাপক রাজ্জাক কথিত এই ‘ঋজু’ চাঁদ সওদাগরের ব্যক্তিত্বটি যখন নির্মিত হচ্ছে, তখন বাংলায় বাণিজ্য সংস্কৃতির রীতিমত ধস নেমেছে, কৃষি হয়েছে সম্পদের উৎস, বিদেশী পর্যটকেরা এই কৃষিরই প্রশংসা করছেন, বণিকদের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে, বণিকবৃত্তি নামমে নামতে শেষ পর্যন্ত বর্ণবিচারে তাদের অবনমন ঘটিয়েছেন সেন রাজারা

এটা অদ্ভুদ যে চাঁদ সওদাগরের কাহিনিটা যখন বাঙলা ভাষায় লেখা হচ্ছে, তার কয়েকশ বছর আগেই সওদাগরি বস্তুটাই, তার বিনিময় মাধ্যম আস্ত মুদ্রাসহ উধাও হয়ে গেছে বাংলা থেকে। মুদ্রার বদলে কড়ির প্রচলন ঘটেছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে। পাল এবং সেন, বাংলার এই দু’দুটো বিখ্যাত রাজবংশের আমলেই বণিক শ্রেণি বিপর্যস্ত হয়েছে। এটা কেবল শাসকের ব্যবসাবিদ্বেষী মনোভাবের জন্য না, বরং রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস পরবর্তী আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতটা মাথায় রাখলে এটাকে অবসম্ভাবী বলেই মনে হবে। ভূমিকেন্দ্রিক এই কালের অবশিষ্ট বণিকরা সামাজিকভাবেও আর সম্মানিত ছিলেন না। “বল্লাল চরিতের সাক্ষ্য প্রামাণিক হইলে স্বীকার করিতে হয়, বণিক ও বিশেষভাবে সুবর্ণবণিকদের তিনি সমাজে পতিত করিয়া দিয়াছিলেন।”[৫] লক্ষণ সেনের অন্যতম সভাপতি গোবর্ধন আচার্যের কবিতা উদ্ধৃত করে নীহাররঞ্জন আরও দেখিয়েছেন, যে শ্রেষ্ঠীরা একদা শত্রুধ্বজোত্থান পুজা করতেন, দ্বাদশ শতকেও সেই পুজা অব্যাহত থাকলেও শ্রেষ্ঠীরাই আর নেই, শত্রুধ্বজ নিয়ে তাই তার কবিতা“হে শত্রুধ্বজ! যে শ্রেষ্ঠীরা তোমাকে উন্নত করিয়া গিয়াছিলেন, সেই শ্রেষ্ঠীরা কোথায়! ইদানীংকালের লোকেরা তোমাকে লাঙলের ঈষ অথবা গরু বাঁধিবার মেঢ়ি করিতে চাহিতেছে।”এই একটি শ্লোকে ব্যবসা বাণিজ্যের অবনতিতে এবং একান্ত কৃষিনির্ভরতায় বাঙালী সমাজের আক্ষেপ গোবর্ধন আচার্যের কণ্ঠে যেন বাণীমূর্তি লাভ করিয়াছে। একটু প্রচ্ছন্ন শ্লেষও কি নাই!”
ফলে এই অধ্যাপক রাজ্জাক কথিত এই ‘ঋজু’ চাঁদ সওদাগরের ব্যক্তিত্বটি যখন নির্মিত হচ্ছে, তখন বাংলায় বাণিজ্য সংস্কৃতির রীতিমত ধস নেমেছে, কৃষি হয়েছে সম্পদের উৎস, বিদেশী পর্যটকেরা এই কৃষিরই প্রশংসা করছেন, বণিকদের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে, বণিকবৃত্তি নামমে নামতে শেষ পর্যন্ত বর্ণবিচারে তাদের অবনমন ঘটিয়েছেন সেন রাজারা। অবশেষে সমুদ্রপথে আরব নাবিকদের কর্তৃত্ব সমুদ্রপথকে আবারও কিছুটা নিরাপদ করে, বাংলায় মুদ্রা সংস্কৃতি ফেরত আসে মুসলমান দখলের পর।
খুবই সম্ভাবনা আছে যে, অধ্যাপক রাজ্জাক সামন্তবাদ নিয়ে যা বলেছিলেন, আহমদ ছফার বর্ণনায় তার অংশবিশেষই এসেছে। তবে বণিকদের এই ভাবপ্রবণ ইতিহাস নির্মাণ একদা চল ছিল বটেই। তবে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, বাংলায় কিংবা ভারতে সামন্তবাদের অনুপস্থিতি আবিষ্কার এই রচনার লক্ষ নয়, বরং বণিকের উপস্থিতি যে সামন্তবাদের সাথে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এবং উপরন্তু কোনো এক অদ্ভুদ সামাজিক কারণে বাংলার প্রধানতম বণিকের চরিত্র চাঁদ সওদাগর এমন একটা সময়ে নির্মিত হলো যখন বাংলা থেকে বাণিজ্যের প্রধানাংশে অবলোপন ঘটে কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রাধাণ্যে এসেছে। (চলবে)
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-

অধ্যাপক রাজ্জাক : কয়েকটি খটকা || পর্ব-৮ (প্রসঙ্গ সামন্তবাদ)

 

টীকা
১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় অধ্যায়, মনসামঙ্গল কাব্য দ্রষ্টব্য
২.বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা ৩৬১
৩.বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা ৩৭৩
৪.বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা ৩৮১
৫.নীহাররঞ্জন, ২৭৫ পৃষ্ঠা

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা