X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জ্যেষ্ঠের প্রতি

হাসান আজিজুল হক
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২৩:২৫আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২৩:৩৬

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হকের রচনার বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যে আমি বহুদিন ধরে মুগ্ধ। এখন তাকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান লেখক বলাটাও বাহুল্য হয়ে যায়। তিনি হচ্ছেন ‘দি রাইটার’। তাকে আমরা সব্যসাচী লেখক বলে ডাকি।
মহাভারতের শ্বেতবাহক অর্জুন দুই হাত দিয়ে সমানে জ্যা আকর্ষণ করতে পারতেন। লেখকরা তো বাঁ হাত দিয়ে লেখেন আবার ডান হাত দিয়েও লেখেন। এখন ডান হাত, বাম হাত- দুই হাতের কলমই বাতিল হয়ে গেছে। যতদূর জানি, সৈয়দ অনেকদিন থেকে লেখার জন্য কলম ব্যবহার করেন না। আধুনিকতম প্রযুক্তির সাহায্যে সরাসরি লেখা কম্পিউটারে কম্পোজ করে থাকেন। কাটাকাটি যা করার সেটা সেখানেই করেন। তৈরি হয়ে যায় একেকটি সম্পূর্ণ নির্ভুল রচনা।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে- সব্যসাচী কথাটার একটা ভিন্ন অর্থ আমাদের করে নিতে হবে। সেটা কি লেখার দক্ষতা, সেটা কি লেখার নৈপুণ্য, সেটা কি রচনার প্রাচুর্য নাকি সাহিত্যের অনেক শাখাতে স্বাচ্ছন্দে বিচরণ? এই শেষ কথাটা ধরলে বলতেই হবে, সৈয়দ হক একজন সব্যসাচী লেখক।
কবিতা লিখেছেন সাহিত্যজীবনের শুরু থেকে। এখন তিনি বাংলাদেশের জীবিত সর্বাগ্রগণ্য কবিদের একজন। প্রধানতম বলতেও আমার দ্বিধা নেই। পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্প। প্রাচুর্যে ভরা তার এই সম্পদ। লিখেছেন উপন্যাস এবং আমাদের কথাসাহিত্যের ধারায় এখানেও তিনি অগ্রগণ্যদের একজন। তিনি লিখেছেন কাব্যনাটক, মঞ্চনাটক এবং এই শাখায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একমাত্রই। আমার মতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরুলদীনের সারাজীবন এবং এ রকম আরো কিছু কাব্যনাটক আমাদের গোটা বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। এখন আশ্চর্য হয়ে দেখতে পাচ্ছি, শিল্প-সাহিত্যের এত অসংখ্য ধারায় আমাদের এ কালের লেখকদের মধ্যে আর সম্ভবত কেউ-ই নেই। তিনি এখানে একা। চলচ্চিত্রের সংলাপ লিখেছেন। ছবি এঁকেছেন। আর সব জায়গাতেই তার নিজস্ব পাঞ্জা।
তার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ দু’একজন কবি-সাহিত্যিক বাংলাদেশে আছেন বটে কিন্তু সামনে সক্রিয় আছেন একমাত্র তিনি। তার লেখা কখনোই থমকে যায় না। জায়গায় জায়গায় পচনের চিহ্ন রাখেন না। এখনো তিনি তার লেখায় সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারেন।
সৃষ্টির জায়গা থেকে ছোট-বড় কোনো কথা নেই। কার চেয়ে বড়, কে কার চেয়ে ছোট এসব হিসেব যদি সাহিত্যের প্রধান কথা হতো, তাহলে সৃষ্টি কথাটা থাকত না। সে জন্যই লেখক এবং শিল্পী মাত্রই একদম একা, স্বতন্ত্র। পরস্পরের তুলনা একদম অবান্তর বলে মনে করি। একজন লেখক একটা নিজস্ব বৃত্ত তৈরি করেন। বড় বা ছোট লেখক অনুযায়ী যার যার নিজস্ব বৃত্ত তৈরি হয়। বিচার করতে হয় সেই নিজস্ব বৃত্তের মধ্যে সেই বিশেষ শিল্পীকে।
সৃষ্টি কথাটার অর্থ হচ্ছে- যা কোথাও ছিল না, এইমাত্র তা নতুন আবির্ভূত হলো। সেটাকে যে আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হিসেবে দেখেও সমগ্রভাবে মানবিক কাজের অংশ বলে মনে করতে পারি। তার কারণ বিশেষ এবং সমগ্র পাশাপাশিই থাকে। সে জন্যই নতুন সৃষ্টি বিশেষ এবং নির্বিশেষ। আমি সাহিত্যের কাছে প্রধানত পেতে চাই। বাতিল করতে চাই না। বাতিল যা হওয়ার এমনিতেই হয়ে যায়। কারণ, নিখুঁত কখনোই মানব সৃষ্টির সঙ্গে যায় না। তা নিয়ে আক্ষেপ করা বৃথা। আর তাই বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যে নজর থাকা উচিত। এই জায়গা থেকে বলতে গেলে সৈয়দ শামসুল হকের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি।
পারফেকশন কথাটি সোনার পাথর বাটির মতো। চাওয়াটাই বোকামি। সৈয়দ শামসুল হকের কাছ থেকে কিছু পেয়েছি, তা আমি যেমন বলতে পারি, তেমনি কোনো আক্ষেপ না করে কী পাওয়া যায়নি তা বলতে হবে। সেখানে বলতে হবে, সৈয়দের সাহিত্য জগৎটা খানিকটা ভাষা নির্মিত, যৌক্তিক কাঠামোয় আবদ্ধ। এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? জ্যামিতিক ছকের মতো? প্রতিজ্ঞা থেকে উৎপন্ন সিদ্ধান্তের মতো? কিংবা নানা ধরনের পঙ্গুতা, অপূর্ণতা, ধস, পরিপূর্ণ জীবনের জায়গায় কিছুটা যেন অবয়বিক। নির্মাণ এবং ভাষাকে তিনি তার সাহিত্যে একটু বেশি জায়গা দিয়েছেন।
সৈয়দকে আমি আজকাল জ্যেষ্ঠ বলে ডাকি। ভালোবাসি অনেকটা যতদূর ধারণা করি, তিনিও আমাকে একটু ভালোবাসেন। তার ভালোবাসায় কোথায় একটা নিভন্ত ভাব থাকে। আমি অন্তত তার গগনে জ্বলন্ত ভালোবাসার তেমন একটা উদাহরণ দেখিনি। কিন্তু অনুভব করতে পারি মানুষটির মধ্যে প্রচুর ভালোবাসা এবং আবেগ চাপা পড়ে আছে। সেটা প্রায় স্নেহ ও যত্নের পর্যায়ে চলে যায়। এতকাল ধরে তাকে দেখছি, এর মধ্যে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যে বিশেষ তারে বাঁধা ছিল এখনো তেমনি রয়েছে। দেখা হলে- ‘এই যে হাসান’ বলে একটি স্মিত সম্ভাষণ এবং সেই সঙ্গে সামান্য একটু ঠাট্টার ছোঁয়া এবং তারপরই একটু ঠেঁস দিয়ে দু-একটি কথা। যেমন- ‘উত্তরবঙ্গ শূন্য করে দিয়ে এখানে এসেছেন’ কিংবা ‘আপনার রাজত্বে গিয়েছিলাম’।
সৈয়দ শামসুল হক দু’একবার লিখেছিলেন আমার লেখা সম্বন্ধে কিংবা আমার আচরণ সম্বন্ধে দু-একটি কথা, সে সবই প্রায় অননুমোদনের বিচার। এসব হওয়ার পরেও আমাদের সম্পর্কটা বড্ড তাজা আছে। তাকে জ্যেষ্ঠ বলে ডাকি, আমি অনুজ থাকতেই ভালোবাসি।
সৈয়দ শামসুল হক একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘লেখক হওয়া মানেই হলো কাঁধে লাঙল নিয়ে জন্মগ্রহণ করা (লাঙল মানে হলো কলম)। আমি মৃত্যুর সময়ও যেন কাঁধে লাঙল নিয়ে মরতে পারি।’ আমি তার কর্মময় চলন্ত জীবন কামনা করি।
পুনর্মুদ্রণ

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে