X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজমুল হক নজীরকে মনে পড়ে

নাসির আহমেদ
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:২২আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:৫৮

নাজমুল হক নজীর (২৫.০৯.১৯৫৫-২৩.১১.২০১৫) মৃত্যু আমাদের জীবন থেকে ক্রমাগত স্বজনদের সুদূর করে দেয়, বিস্মরণের কুয়াশায় আড়াল করে দেয়- এ হচ্ছে অমোঘ নিয়তি। কিন্তু তারপরও কি মৃত্যু সবাইকে মুছে ফেলতে পারে! সবকিছু মুছে ফেলতে পারে? বোধ হয়, না। সম্ভবত সে কারণেই কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সংশয় প্রকাশ করেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে অতিক্রমণের কথাই সত্য মেনেছেন। তার সেই কবিতার স্মরণ নেয়া যেতে পারে। স্মৃতিবিভ্রাট না হলে পঙক্তিগুলো এরকম:
মৃত্যু কি সকলই নেয়? মৃত্যু কি সকলই নিতে পারে?
তা হলে কী নিয়ে বাঁচে নেয়নি যাদের যাদের মৃত্যু, তারা
অর্থাৎ যে যায় সে ও সমগ্রত যায় না ওধারে
চোখের আড়ালে গিয়ে বন্ধুদের হৃদয়ের কড়া ধরে নাড়ে
বারে বারে
দেখে যায় সব চেয়ে বেশি করে কে রেখেছে মনে
অর্থাৎ স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থেকে নিয়ত সে মৃত্যুকেই মারে।


মৃত্যু প্রসঙ্গ আসতেই কথাগুলো মনে এল। কবি নাজমুল হক নজীরের পুত্র স্নেহভাজন সাইফুল্লাহ নজীর মামুন তার পিতার ওপর একটি লেখা চেয়েছিলেন মাস দু’তিনেক আগে। সময় করে লিখব, তেমন সময় বের করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তবু পিতৃহারা সন্তান যখন আকুল আবেগে পিতার ঘনিষ্ঠজন বা সতীর্থ লোকের কাছে তাঁর সম্পর্কে একটি লেখা প্রত্যাশা করেন, তখন সে প্রত্যাশা পুরণ না করে উপায় থাকে না। লেখাটির জন্য তার নিরন্তর তাগিদ আর ধৈর্য্য মুগ্ধ হবার মত। মামুনের সেই দাবি মিটাতে গিয়েই মনে এল কবি নীরেদ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যু বিষয়ের উল্লিখিত পঙক্তিমালা।

আসলেই কি সৃজনশীল মানুষ একেবারে মুছে যান? আমার মনে হয়, না। তিনি এবং তাঁর কাজ যে কোনও মেয়াদেই হোক, স্মৃতির মধ্যে কিছুটা জায়গা করে নেয়। নাজমুল হক নজীরের বিষয়েও আমার সেই প্রত্যাশা। ব্যক্তি মানুষটি আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত স্মৃতিতে আজো বেঁচে আছেন। তাঁকে মনে পড়ে আমার। গত শতাব্দীর নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি সম্ভবত দৈনিক জনকণ্ঠেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যেহেতু শুক্রবারের সাময়িকীও আমি সম্পদনা করতাম, সঙ্গত কারণেই যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার একটা যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। প্রায় ১৫/১৬ বছর জনকণ্ঠে কাজ করার সুবাদে এই অভিজ্ঞতা: দেশের তৎকালীন সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় প্রায় সবাই লিখতে চাইতেন।

নামজাদা অনেকের লেখা পেয়েছি। সানন্দে প্রকাশ করেছি। তরুণদেরও জায়গা করে দিতে প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবারের সাময়িকীটি থাকতো তরুণদের জন্যই সংরক্ষিত। সেই সুবাদে ঢাকার বাইরে থেকে লিখছেন, ঢাকায় থেকেও লিখছেন- এমন লেখক, যাদের লেখা কোনও বড় দৈনিকে প্রকাশিত হয়নি, তাদের লেখা ছাপা হতো। যতদূর মনে পড়ে কবি নাজমুল হক নজীর জনকণ্ঠে তরুণদের পাতায় যেমন লিখেছেন, তেমনই মাসের অন্যান্য সাময়িকীতেও লিখেছেন।

তার কবিতার সরল প্রকাশভঙ্গি আর নিসর্গ-প্রকৃতির স্পর্শ আমার ভাল লেগেছিল। যখন দুর্ভেদ্য অথবা দুর্বোধ্য ভাষায় লেখার প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র, তখন নাজমুল হক নজীরের উচ্চারণের সরল অথচ ব্যঞ্জনাময় ছোট ছোট পঙক্তি আর বাক্য আমার কাছে আলাদা মনে হয়েছিল। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও যে কোনও কবি নিজস্বতা নিয়ে কবিতা লিখতে পারেন, সেটা তিনি মনে রেখেছিলেন।

মনে পড়ে তাঁর সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয়, তখন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রস্ততি চলছে। সেই পাণ্ডুলিপি থেকেও সম্ভবত আমাকে কবিতা দিয়েছিলেন ছাপার জন্য। বইমেলায় নতুন কাব্যগ্রন্থ “স্বৈরিণী স্বদেশ” আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। স্মৃতি বিভ্রাট না হলে এ-ও মনে হয় সত্য যে, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং মলাট ছাপা হয়েছিল জনকণ্ঠ সাময়িকীতে। তার কবিতা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিমুগ্ধ এবং কিছুটা অনুসারী এবং অভিসারীও। সেই প্রথম কাব্যগ্রন্থেই লিখেছিলেন-
..... সুলতা, সুদর্শন কি সত্যি চলে যাবে
খড়কুটো ভেসে যাবে বেদনার নীলে
সবুজ পাতা কি পুড়বে চৈত্রের খরতাপে
মিথ্যে কি তোমরা পলাশ ছুঁয়েছিলে?

এই উচ্চারণের মধ্যে কবির মৌলিকত্ব সত্ত্বেও জীবননন্দীয় বোধ দুর্লক্ষ নয়। একজন ভাল কবির অনেক গুণাবলী তার কবিতায় দেখেছি। “স্বৈরিণী স্বদেশ”, বলে জন্মভূমিকে কোন কালপরিসরে একজন দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত কবি ভর্ৎসনা করেন, আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না কবিতাগুলোর রচনাকাল এবং বইটির প্রকাশকাল দেখলে তা সচেতন পাঠক বুঝবেন।

নাজমুল হক নজীর এরপরও অন্তত আরও ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। নিরন্তর তিনি লিখেছেন। এমনকি অসুস্থ শয্যায়ও কবিতা সমগ্র’র ভূমিকা লেখার চেষ্টা করেছেন। শেষ করতে পারেননি, তার আগেই মৃত্যু যবনিকা টেনে দিয়েছে কবির আলোকিত দুই চোখে। কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘‘বড় হওয়ার” এবং একটি “সুবর্ণ গ্রাম”-এর। এ থেকে বোঝা যায় কী তীব্র আকুতি ছিল একজন কবি হিসেবে, মানুষ হিসেবে (আমি চাই বড় হতে/বড় সাধ একটি সুবর্ণ গ্রাম) আরও বড় হতে। কিন্তু মৃত্যু সেই সাধ পূর্ণ হবার আগেই জীবনের ওপর টেনে দিয়েছে বর্ণহীন অতল অন্ধকারের কালো পর্দা।

এই অপূর্ণ সাধ প্রসঙ্গে তাঁরই কবিতার উচ্চারণ মনে পড়বে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে স্বপ্নভঙ্গের এই বেদনা, তারপরও তাঁর অকালে চলে যাওয়া স্মরণ করে আমরা উল্লেখ করতে পারি “কথা ছিল” কবিতার ক’টি চরণ:
কথা ছিল রাত পোহালে ডাকবো
ঘুম ভাঙ্গল মানুষের কোলাহলে।

কথা ছিল গান গাইব
মিছিলের কথাগুলি
গান হয়ে ফিরে আসে।
কথা ছিল জোয়ার এলে ভাসাবো নাও
প্লাবণে ভেসে গেল ঘর
হাতের বৈঠা মুড়ো ঝাড়ন।

কবি নাজমুল হক নজীর অকালেই চলে গেছেন। কবিতা অন্তপ্রাণ এই মানুষটির দেবার আরও অনেক ছিল। কিন্তু সেই প্রাপ্তির স্বপ্ন কেড়ে নিল অনিবার্য মৃত্যু। এমন একজন স্বাপ্নিক মানুষ যিনি উচ্চারণ করেন:
আমাকে আর অবহেলা দিও না, গণ্ড ভেসেছে লোনাজলে
পিঠেতে চাবুকের দাগ ঘুম নেই অসহ্য কোলাহলে
অবাধ্য সময় দিতে চায় না আর কোনো প্রশ্রয়
আমি তবু স্বপ্ন বুনি প্রত্যহ কলংকিত জোছনায়।


সেই স্বাপ্নিকের পাণ্ডুলিপি এইভাবে অসমাপ্ত থাকতে পারে! এই বিস্ময় মিশ্রিত প্রশ্ন শুধু প্রশ্ন হয়েই থাকে। উত্তর মেলে না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যখন ক্রমাগত সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার থাবায় লুপ্ত-প্রায়, তখন নাজমুল হক নজীর “লজ্জ্বা” কবিতায় রচনা করেন ক্ষোভে-দুঃখে:

আমি কার জন্য বসে থাকি সুলতা...

উনিশশো একাত্তর সালকে মনে হয়
বসন্তকাল,
সুলতার আঁচলে বোনা ত্রিশলক্ষ ফুল তবু
ফুটে আছে খরতাপে
আসলে ভালোবাসার মতো শ্রেষ্ঠ কোনো অপরাধ
আজ নেই পৃথিবীতে।

একাত্তরে শহীদ বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা হারুনকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা “কালো জোছনার সেইদিন”। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে সেই ভয়াল দিনরাত্রি স্মরণ করিয়ে দেয় যে দিনরাত্রির বিবরণ তিনি দিয়েছেন ফরিদপুর অঞ্চলের বাস্তবতায়। একই চিত্র তো সারা বংলার গ্রামীণ জনপদের।

জীবন-মৃত্যুর সীমানা পেরিয়ে নাজমুল হক নজীর চলে গেছেন এমন এক অথই রহস্যলোকে, যেখানে যেতে হবে আমাদের সবাইকেই। যেহেতু মৃত্যু অনিবার্য এক বাস্তবতা। জীবনের উল্টোপিঠ মৃত্যু, অবিকল মুদ্রার মতো। কিন্তু সেই মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে চাই আমরা সবাই। নাজমুল হক নজীরও চেয়েছেন। তাইতো লিখতে পারেন:
...মৃত্যুর প্রচণ্ড পিপসা থাকে
জন্মের অভিমানী সকালে থাকে বন্ধন
তোমার জন্য
শুধু তোমার জন্য
স্বপ্নের কাছে আমি পাহাড় সমান।

এই রোমান্টিক, স্বাপ্নিক কবির চলে যাওয়া বেদনাবিদ্ধ করে। তার কথা আজ খুব মনে পড়ে। কতদিন কত দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কেটেছে তার ছোট ছোট সান্নিধ্যে। তার বিনম্র আচরণ, লাজুক হাসি, কৃতজ্ঞতাবোধ আমাকে এখনও স্মৃতির দিকে টানে। লেখা ছাপা হলে ভারি খুশি হতেন। সেই অভিব্যক্তি এই মুহূর্তে স্মৃতির ভেতর ভেসে উঠছে। বইমেলার ভিড়ে হঠাৎ পেছন থেকে তাঁর ডাকটি কানে বাজছে এখন। ওই আন্তরিক শ্রদ্ধা-মিশ্রিত “নাসির ভাই” ডাকটি আর শুনি না। জীবনের ক্ষণকালীনতায় মনটা ভারি হয়ে আসে। নাজমুল হক নজীর যেখানেই থাকুন আপনার অবিনশ্বর আত্মা আমাদের ছুঁয়ে আছে, ছুঁয়ে থাকুক যতদিন বাঁচি।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’