X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিথ-পুরাণের করণসূত্র : প্রজ্ঞা ও প্রকাশ || পর্ব-২

শিমুল মাহমুদ
০৩ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৪৫আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৫৯

মিথ-পুরাণের করণসূত্র : প্রজ্ঞা ও প্রকাশ || পর্ব-২ পূর্ব প্রকাশের পর

আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ক্লদ গুস্তাভ লেভি-স্ত্রাউস মিথ বিষয়টির তাৎপর্য উপলব্ধি করে তাঁর ‘দ্য মিটিং অব মিথ অ্যান্ড সাইন্স’ রচনাতে মিথের গুরুত্বকে বিজ্ঞানের সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি বিষয়কে জরুরি বলে মনে করেন, তা হলো এই যে মিথের গল্পসমূহ যাকে মনে করা হয় অর্থহীন অবাস্তব আর শৃঙ্খলাহীন, তবু মানুষের সভ্যতায় এগুলোর পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ মিথের সৃষ্টিশীলতার পেছনে কোনো প্রণালি বা শৃঙ্খলা কাজ করে কিনা তা খুঁজে বের করা। তিনি মনে করেন সতেরো-আঠারো শতকের বিজ্ঞান তার প্রয়োজনেই মিথকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে। অথচ এই সময়ের বিজ্ঞান মিথের সাথে নিজেকে সমন্বয় করার চেষ্টা করে চলেছে। দৃশ্যমান পৃথিবী, বর্ণগন্ধময় এই পৃথিবী, অঙ্কের নিয়মে চলছে যে পৃথিবী, এই পৃথিবীরও অতিরিক্ত উপলব্ধিসমূহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বিজ্ঞান। ফলে পুরাণ বিশ্বাসকে বিতাড়িত করে তার জায়গা দখল করতে শুরু করেছে বিজ্ঞান। দৃশ্যমান এবং দৃশ্যাতীত অর্থাৎ বোধ এবং বোধাতীত বোধ নিয়ে এখনকার বিজ্ঞান তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছে; এবং তার ভেতর থেকে প্রকৃত সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করছে।

ফলে ইতিপূর্বে যা ছিলো অলীক এখন আর তা অলীক নয়; কারণ বিজ্ঞান তা ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছে; ফলে সংগত কারণেই মিথের প্রেক্ষাপটকেও বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে যাচাই বাছাই করার সময় এসেছে। এ প্রসঙ্গে মির্চা এলিয়েড মনে করেন, আধুনিক জীবনেও আমাদের পক্ষে মিথ-মুক্ত মননের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয় বরং আমরা এখন বিবিধ সামাজিক ক্রিয়াদি এমনকী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মিথকে সচল রেখেছি। ফলে আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট জীবনের নিয়ন্ত্রণে থেকেও মিথের রয়েছে নানাবিধ প্রায়োগিক দিক। এ প্রসঙ্গে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখাইম মনে করেন, সমাজগোষ্ঠীর জীবনচর্চাকে একটি সুনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত করাই মিথ বা পুরাণের কার্যকারিতা।

মিথতত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ এজন্যই প্রাসঙ্গিক যে, মানব মেধার সামগ্রিক যোগফল এবং মানব প্রজাতির অভিজ্ঞতালব্ধ ক্রমপরিবর্তন তথা ক্রমবিকাশের অন্তর্ধারায় মিথ প্রসঙ্গ প্রোথিত। বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে উন্মোচিত হতে পারে একটি জাতির উৎসগত পরিচয় তথা আত্মপ্রত্যয়। সেই সাথে ঐতিহ্যগত সামষ্টিক চেতনা। ফলে মিথ প্রসঙ্গের সাথে সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও শিল্প-সাহিত্যের বিষয়গুলোও জড়িত। জড়িত এই কারণে যে মিথ বা পুরাণ বা পুরাবৃত্ত হলো মানবজাতির যৌথ নির্জ্ঞান বা বলা সম্ভব যৌথ স্বপ্ন। এই যূথবদ্ধ যৌথের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ; এই সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শনির্ভর অবকাঠামো পৃথিবীর সব জাতি ও গোষ্ঠীর ভেতর দৃশ্যমান।

সার্বিক অর্থে বলা সম্ভব, সভ্যতার শৈশব থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ধর্ম ও লোকবিশ্বাসজাত রূপকের আড়ালে যে সমস্ত সত্য মানব পরিবারকে জীবনযাপনে সাহায্য করেছে সে সব ইঙ্গিতপূর্ণ সত্যের রূপভাষ্যই পুরাণ বা মিথ। আবার এ-ও বলা সম্ভব, মানব পরিবারের কল্পনা ও মননকে সমৃদ্ধ তথা প্রসারিত করে আসছে যে ইঙ্গিতময় প্রতিভাষ্য তাকে সার্বিক অর্থে পুরাণ হিসেবে চিহ্নিত করতে না-পারলেও তা অবশ্যই পুরাণের বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। একইভাবে মানব-পরিবারকে জীবনের নানা রহস্য উদ্ঘাটনে অথবা সেসব রহস্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে যে ইঙ্গিত-প্লাবিত প্রতিভাষ্য তা অবশ্যই পুরাণের আরও একটি বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে জোসেফ ক্যাম্পবেলের ধারণাটি প্রাসঙ্গিক। তিনি মনে করেন, পুরাণ বা মিথ আমাদের মূল্যবোধের ভিত্তিভূমি তৈরি করতে সাহায্য করে। যেহেতু আমরা মানুষেরা পরিবর্তনশীল জৈবিক জীব সেহেতু অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাপ্ত জীবনের এসব পৌরাণিক কাহিনি আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে।

মানব-পরিবার যখন তার হাজার বছরের প্রজ্ঞাকে ধারণ করতে গিয়ে রূপকের আশ্রয় নেয় তখন জন্ম হয় মিথের। মানবসভ্যতায় যখন কৃষিজীবন বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে তখন মা-মাটি-মেয়ে সমার্থক রূপকের আশ্রয়ে উর্বরতার প্রতীক হিসেবে গোষ্ঠীগত অভিজ্ঞতার শেকড়ে প্রতিষ্ঠিত হলো; আমরা রামায়ণে দেখতে পাই সীতার জন্ম হচ্ছে মাটি থেকে এবং লাঙ্গলের ফলা থেকে; অর্থাৎ কৃষিসভ্যতার অভিজ্ঞতা পুরাণকথার আশ্রয়ে উঠে এসেছে ধর্মকথা হিসেবে। জনক বিশ্বামিত্রকে বলছেন, ‘অনন্তর একদিন ক্ষেত্রকর্ষণ করতে করতে লাঙ্গলের রেখা থেকে একটি কন্যাকে পাই। ক্ষেত্রশোধনকালে হলরেখা থেকে উত্থিত এজন্য লোকে তাকে সীতা বলে। ভূতল থেকে উঠে সে আমার আত্মজা রূপে বড় হয়েছে।’ [বাল্মীকি রামায়ণ, অনু., রাজশেখর বসু]

‘ক্ষেত্রকর্ষণ’ অর্থ বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। বিকশিত হওয়ার অর্থ বেঁচে থাকা; আর বেঁচে থাকার মন্ত্রই হলো ধর্ম। এই ধর্মের উদ্ভব কোনো অলীক স্বপ্ন থেকে নয় বরং বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতার ফসলই ধর্ম। ‘ধর্ম’ অর্থ বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব; আর মানব প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম হলো ক্রমঅভিজ্ঞতার আলোকে লড়াই করে টিকে থাকা। এই টিকে থাকার পদ্ধতিসমূহ মানব প্রজন্ম নিজেকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ক্রমাগত মজ্জাগত করে নেয়; ফলে তা তাদের স্বভাবে রূপ নেয়; প্রকৃত প্রস্তাবে এই স্বভাবকেই আমরা ধর্ম বলি। স্বভাব বিষয়টি আবার বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত; ফলে ধর্মের সাথে স্বভাব ও বিশ্বাসের যোগসূত্র থাকাই স্বাভাবিক। 

বাস্তব জীবনের চিরায়ত অভিজ্ঞতার যোগফলে ধর্মের উৎপত্তি। আমরা মহাভারতে দেখতে পাই জন্ম ও মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। এই মানব দেহের রয়েছে জন্ম, রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু। অথচ এই সত্যের ভেতর বসবাস করেও আমাদের রয়েছে মৃত্যুকে অতিক্রমণের আকাঙ্ক্ষা; আমরা চাই নিত্য সুখ; অথচ দেহ নিত্য রিপু দ্বারা আক্রান্ত এবং জরাগ্রস্ত। এই রিপুতাড়িত দেহের আশ্রয়ে কীভাবে মানবজীবনকে সফল করে তোলা সম্ভব? ব্যাস কুন্তীকে বলছেন, পক্ষান্তরে তিনি মানবকুলের উদ্দেশ্যেই বলছেন, ‘দেবতারা ঐশ্বর্যবান, তাঁরা সংকল্প বাক্য দৃষ্টি স্পর্শ বা সংগম- এই পাঁচ প্রকারে পুত্র উৎপাদন করতে পারেন।... দেবগণই মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে এসে নিজ নিজ কার্যসম্পন্ন করে স্বর্গে ফিরে গেছেন।’ [কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, মহাভারত, অনু., রাজশেখর বসু]

প্রকৃত প্রস্তাবে এখানে মানববৈশিষ্ট্যের কথাই বলা হয়েছে। মানব দেহ সংকল্প, বাক্য, দৃষ্টি ও স্পর্শ দ্বারা তার অভিপ্রায় প্রতিষ্ঠিত করে তার কর্মের প্রতিফলন ঘটায়। এখানে ‘পুত্র’ প্রতীকের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে মানব সভ্যতার যাবতীয় কর্মাদির প্রকাশ; এই কর্মাদির তালিকা প্রকাশ করলে পাওয়া যাবে তার চাঁদে অভিযান থেকে শুরু করে একটি স্বর্গতুল্য আধুনিক বিশ্ব অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে অতিক্রম করে মহাপ্রভুর শক্তি নিয়ে প্রকৃতির বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা অথবা প্রকৃতি সংলগ্ন হওয়া। ফলে আমরা সংগত কারণেই পুরাণে দেখতে পাই, ‘দেবতা’ অর্থ ‘মানুষ’ অথবা ‘মানুষ’ অর্থ ‘সূর্য’ অথবা ‘চন্দ্র’। ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন বলছেন, ‘মানুষের কর্ম থেকেই শরীর উৎপন্ন হয়। শরীরের উপাদান মহাভূতসমূহ, ভূতাধিপতি মহেশ্বরের অধিষ্ঠানের ফলে দেহ নষ্ট হলেও মহাভূত নষ্ট হয় না, জীবাত্মা মহাভূতকে ত্যাগ করেন না, মহাভূত আশ্রয় করে তিনি পূর্বরূপে প্রকাশিত হতে পারেন।’ [কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, মহাভারত, অনু., রাজশেখর বসু]

মানব প্রজন্মের জাতিগত অভিজ্ঞতার পুঞ্জীভূত সাংকেতিক প্রকাশই মিথ বা পুরাণ। সুতরাং ইতিহাস ও ঐতিহ্য; এবং এই ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে যেভাবে মানব-পরিবারের আধ্যাত্মিকচেতনার বিকাশগত স্তরসমূহ জড়িয়ে থাকে সেই স্তরসমূহের ব্যাখ্যা বা পাঠ উদ্ধার সম্ভব মিথ বা পুরাণের আলোকে। সুতরাং আমরা আজ আধুনিক বিশ্বে বাস করলেও আমাদের ফিরতে হচ্ছে মিথের কাছে; ধর্মের কাছে। ধর্ম মানবগোষ্ঠীকে যেভাবে পথ নির্দেশনা দিয়ে থাকে আধুনিক মানবসভ্যতা আজও সেই হাজার জীবনের পরীক্ষিত বিধিবিধানের ওপর নির্ভর করে আসছে; আবার এ কথাও ঠিক মানব প্রজন্ম তার প্রয়োজনেই চিরায়ত বিশ্বাসের সাথে যোগ করে নেয় সময়োপযোগী দৈনন্দিন সত্য; ফলে সংগত কারণেই মিথ মানবজীবনের প্রয়োজনের সাথে সংগতি রক্ষা করে বিবর্তিত হয়।

মানব-পরিবার তাদের হাজার বছরের জীবন-প্রবাহের প্রতিটি লড়াই অথবা দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার প্রচেষ্টাকে চেতনায় ধারণ করে তা অভিজ্ঞতায় ও প্রজ্ঞায় রূপান্তরিত করে সেই লব্ধ অভিজ্ঞতা পরবর্তী জেনারেশনের কাছে পৌঁছে দেবার অনিবার্য আকাঙ্ক্ষায় বংশপরম্পরায় তাকে বাঁচিয়ে রাখে। এই যে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের জগৎকে বাঁচিয়ে রাখার বহমান কৌশল, এই কৌশল প্রধানত ভাষাকেন্দ্রিক; এই ভাষা হাজার বছরের মানব অভিজ্ঞতাকে ধারণ করতে গিয়ে হয়ে ওঠে কখনও-বা রূপক গল্প, কখনও-বা স্বর্গীয় বাণী। আসলে এই রূপকগল্পগুলো মানবজীবনকে পথ দেখাবার জন্য এতই মূল্যবান ভূমিকা পালন করে আসছে যে শেষ পর্যন্ত তা ধর্মীয় গ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে যায়; ফলে মানব-পরিবারে ক্ল্যাসিক লিটরেচর মাত্রই ধর্মীয় গ্রন্থ; কেননা ক্ল্যাসিক লিটরেচরগুলো শুধু একজন মানুষের প্রজ্ঞা, অনুভূতি ও জ্ঞানকেই ধারণ করে না, বরং তা ধারণ করে হাজারো মানুষের গোষ্ঠীগত চেতনার প্রজ্ঞালব্ধ জ্ঞানের জগৎ, যা তারা বংশপরম্পরায় বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছে। সে তার অভিজ্ঞতায় জেনেছে ‘ঈশ্বর’ শুভ শক্তির রূপক; তিনি ত্রাতা। ‘শয়তান’ অশুভ শক্তির প্রতীক; তিনি বিপথের জাদুকর। এই যে শুভ অশুভের দ্বন্দ্ব; এই যে চিরন্তন দ্বন্দ্বের গতিময় জীবন; এই দ্বন্দ্বমুখর গতিময় জীবনের কারণেই শেষ পর্যন্ত পশু ও শিশুর সহবস্থানে মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে প্রাকৃত মানুষ নয় বরং বলা চলে সভ্য মানুষ। এভাবে মানবজীবনকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলে পুরাণ; পুরাণের রূপকল্প পক্ষান্তরে প্রতিটি মানুষের আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার প্রতিরূপ।

হোমারের ইলিয়ডে দেখা যায়, প্রকৃতিশ্রেষ্ঠ একিলিসকে যখন কিছুতেই দমন করা যাচ্ছে না, এমনকী ভয়ানক ক্রুদ্ধ নদী স্কামান্দার তার বিশাল জলরাশির সাহায্যে যখন বীর একিলিসকে প্রতিহত করতে পারছে না তখন স্কামান্দারকে একিলিসের বিরুদ্ধে বলতে শোনা যায়, ‘তাকে আমি ভাসিয়ে নিয়ে যাব বালুকারাশির ভেতরে এবং তার উপর স্তূপাকৃত করব ভাঙা কাষ্ঠখণ্ড। এত গভীর বালুকারাশির ভেতরে আমি তাকে পুঁতে ফেলব যে, একিয়ানরা কখনও জানতেও পারবে না, কোথায় তার দেহ রক্ষিত হয়েছে।’ [হোমার, ইলিয়ড, অনু., আবুল কালাম শামসুদ্দীন] তারপরও একিলিসকে কেউ দমন করতে পারেনি। দেবতারা পর্যন্ত যখন একিলিসের বিপরীতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এমনকী একিলিস তার মাতা দেবী এথিনীর কাছে জানতে পেরেছে ট্রয়ের দেয়ালের পাশে তিরন্দাজ দেবতা এপোলোর তিরের আঘাতে তার মৃত্যু হবে; এই নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জানতে পারলেও কোনো লৌকিক অথবা অলৌকিক অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত কোনো অতি দানবীয় শক্তি তাকে দমন করতে পারেনি।

যদিও এই কাহিনি বীর যুগের; তারপরও আধুনিক যুগে এসে আমরা একই বিষয় লক্ষ করি; হতে পারে তা হিরোশিমার ঘটনা অথবা টুইন-টাওয়ারের ঘটনা অথবা ইরাক, আফগানিস্তান অথবা কোনো সুইসাইড-স্কোয়াডের উদাহরণ। লক্ষযোগ্য আমরা নশ্বর মানবকুল পরিষ্কার জানি আমাদের মৃত্যু অবধারিত; তারপরও আমরা বীরদর্পে এগিয়ে যাই টিকে থাকার যুদ্ধে, মৃত্যুর বিনিময়ে ভবিষ্যৎ পুরুষের জন্য নিশ্চিত করে দিয়ে যাই যুদ্ধজয়ের অহংকার। প্রকৃত প্রস্তাবে মানব প্রজাতির এই অহংকার মূলত পৌরাণিক অহংকার; এই পৌরাণিক যুদ্ধ এমন এক ‘রূপক’ আমাদের সামনে উপস্থিত করে যা মানব প্রজাতির সেই সূচনালগ্ন থেকে এযাবৎ যাবতীয় প্রচেষ্টা, প্রেরণা ও সাধনার কথা উপস্থাপন করে। মানব প্রজাতি একিলিসের মতো প্রকৃতির বিপরীতে, নিয়তির বিপরীতে তার মেধা এবং সাহস দিয়ে যুদ্ধ করে পৃথিবীর ওপর, দেবতাদের ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করেছে। পুরাণ আমাদের মানবজাতির প্রভুত্ব স্থাপনের এই সামষ্টিক ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি ফেরাতে সাহায্য করে। যদিও আমাদের স্বীকার করতে হবে ‘পুরাণ’ অবশ্যই ইতিহাস নয় কিংবা শুধু নিছক রূপকথা নয় বরং পুরাণকথার আশ্রয়ে আমরা পেয়ে থাকি মানবজাতির সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছায়া যা বিবিধ রূপকের ছদ্মবেশে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়।

মিথ জন্ম নেয় মানব অভিজ্ঞতার প্রজাতিলব্ধ প্রত্মস্মৃতিভাণ্ডার থেকে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত স্মৃতিই আমাদের সবচেয়ে বড়ো পুঁজি; সবচেয়ে বড়ো পাথেয়। মিথ হলো মানব জন্মের প্রত্মঅভিজ্ঞতার স্মৃতিভাণ্ডার। এই স্মৃতিভাণ্ডার থেকেই আমরা আমাদের জীবনীশক্তি আহরণ করি; আমরা বেঁচে থাকি; আমরা মৃত্যুকে অতিক্রম করি। সুতরাং শেষাবধি যাবতীয় ধর্মীয় পুস্তক আমাদের পথ দেখাতে সাহায্য করে। আচার্য শান্তিদেব ‘বোধিচর্যাবতার’ গ্রন্থের ‘ধ্যান-পারমিতা’ অংশের ৫৬ নম্বর শুক্তিতে বলেছেন, ‘অন্যের দেহ অপবিত্র পদার্থে পরিপূর্ণ,- ইহা যে তুমি জান না- তাহা আশ্চর্য নহে। কিন্তু তোমার দেহ যে অশুদ্ধি পদার্থে পূর্ণ,- ইহাও তুমি জান না- তাহাই বড়ো আশ্চর্য।’

আরো পড়ুন-

মিথ-পুরাণের করণসূত্র : প্রজ্ঞা ও প্রকাশ || পর্ব-১

 

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!