X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বব ডিলানের কণ্ঠ

দুলাল আল মনসুর
১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২২:৪৬আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:১৭

বব ডিলান
আমেরিকার সংগীতজ্ঞ বব ডিলান এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। সাহিত্যের সম্ভাব্য নোবেলজয়ী লেখক হিসেবে যাঁদের নাম পছন্দের ওপরের দিকে ছিল, তাঁরা কেউ পেলেন না। পেলেন বব ডিলান। অন্যান্য কবি সাহিত্যিকের নামের সঙ্গে তাঁর নামও কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছিল। গানকে কবিতার মর্যাদা দান করতেই নোবেল কমিটি হয়তো এরকম বিচার করেছেন। কবিতা তো সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী শাখা। তার ওপরে কবিতার সঙ্গে সুর যোগ করে সরাসরি শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেয়া গেলে তার প্রভাবও তাৎক্ষণিক এবং জোরালো হয়। আর বব ডিলানের গান বিশেষ করে মানবতার পক্ষে কথা বলে। ভৌগলিক সীমা ছেড়ে মানবতার ব্যাপক পরিসরে পৌঁছে যায় তাঁর গানের আবেদন। সুতরাং ‘আমেরিকার গানের ঐতিহ্যের মধ্যে নতুন কাব্যিক প্রকাশ ঘটানোর ক্ষমতার জন্যই’ তাঁকে এ বছর সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার থেকে কাউকে না বেছে নিয়ে নোবেল কমিটি তাঁকে বেছে নিয়েছেন বলে কারো কারো দ্বিমত থাকতেই পারে। আবার তাঁর গানের শ্রোতা দর্শকদের মধ্যেও একেবারে এক বাক্যে সবাই তাঁর গানকে পছন্দ করবেন তাও নয়। শ্রেতাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর গানকে অতিশয় বালকসুলভও মনে করেন। তবু নোবেল কমিটির পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে তিনিই নির্বাচিত হয়েছেন। সেটাই বড় কথা। এখন তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে তাঁর ভক্ত-শ্রোতা এবং সমালোচকরা তাকে আরো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাবেন ।  
বব ডিলানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৪ মে আমেরিকার মিনেসোটায়। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান। তাঁর সময়ের অনেক উত্থানপতনের কথা উঠে এসেছে বব ডিলানের গানে। তবে তিনি নিজেকে তাঁর সময়ের মুখপাত্র ভাবতে নারাজ। আবার অন্যদিকে একথাও স্পষ্ট, তাঁর প্রথম দিকের গান ‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’ এবং ‘দ্য টাইমস দে আর আ-চেঞ্জিন’ যথাক্রমে আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সংগীত হয়েছিল। .
বব ডিলান প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সুর আর কথার যাদুতে বেধে রেখেছেন শ্রোতাদের। তাঁর গান দিয়ে অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলেছেন ব্যাপকভাবে, তাদের একতার বন্ধনে বেধেছেন। গানের মাধ্যমে তিনি মানবাধিকারকর্মীদের সাহস জুগিয়েছেন। মানুষের ওপরে চাপানো নৃশংসতাকে তিনি আলোর সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি শিখিয়েছেন, কঠিন সময়ে কীভাবে সাহস রাখতে হয়, শক্ত থাকতে হয়। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যারা অবিরত লড়ে যায় তাদের মধ্যে তিনি একাত্বতার বোধ তৈরি করেছেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, সরব থেকেছেন।
বব ডিলান বব ডিলান আক্রমণের তীর ছুড়েছেন চারপাশের সব অনিয়ম আর শঠতা দিকে। অনেকের কাছে বব ডিলান বিটলসের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী, বিশেষ করে জনপ্রিয়তার দিক থেকে। তার কারণ হলো, কবিতা, চেতনা প্রবাহ, দৈনন্দিন জীবনের মামুলি ঘটনাসহ বোধগম্য কোনো সাধারণ ঘটনাও তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর শ্রোতাদের সামনে। ডিলানের পূর্বে জনপ্রিয় গানের গণ্ডি ছিল সীমাবদ্ধ। আর ডিলানের পরে গান হয়ে গেল কবিতা কিংবা কথাসাহিত্যের মতো ব্যক্তিগত অনুভূতি আর মতামত প্রকাশের মাধ্যম। সাহিত্যের এই দুধারায় অতীতে বিশেষভাবে ব্যক্তিগত মনোভোবের প্রতিফলন ছিল বেশ প্রবল। তবে ডিলানের গানকে বলা যায় তাল-লয়ের ওঠানামার তাৎক্ষণিক প্রভাবের প্রকাশ। গণসংগীত কিংবা প্রতিবাদের গান অবশ্য অন্য বিষয়, সেখানে জনপ্রিয়তার ব্যাপার এমন নয়। আর তেমন সংগীতও সংখ্যার দিক থেকে সীমিত।
তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘ফ্রিহুইলিন’-এর মাধ্যমেই তিনি যেসব বিষয় অগ্রহণযোগ্য মনে করেছেন সেগুলোর দিকে প্রশ্নের আঙুল তুলেছেন। জনপ্রিয় সংগীতের কথা কতটা প্রভাবশালী হতে পারে তার উদাহরণ ডিলানের গান। গানের কথার প্রসঙ্গে ডিলানকে তুলনা করা যেতে পারে শেক্সপিয়ারের সঙ্গে; দুজনই ভাষাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছেন। শেক্সপিয়ারের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করলে অবশ্য অনেকটা অতিরঞ্জনও হয়। তাঁকে এভাবে তুলনা করার পেছনে কারণ হলো, তাঁর গানের প্রতি শ্রোতা-পাঠকদের প্রতিক্রিয়া। অনেকের কাছে তিনি ইহ-সাধকের মর্যাদায় উঠে গেছেন। তবে ষাটের দশকের গানের তুলনায় কারো কারো কাছে তাঁর সত্তর ও আশির দশকের গান ততটা গভীরতা বহন করে না। যে যা-ই বলুন এখানে একটি বিষয় লক্ষ করলেই সে যুক্তিও খণ্ডন করা যেতে পারে। সময় মানুষের সৃষ্টির পেছনে অনেকটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বব ডিলানের গানের ক্ষেত্রেও হয়তো সে রকমই। তাঁর নিজের দেশ এবং বৈশ্বিক আবহ ষাটের দশকে যেমন উত্তাল ছিল সে অনুযায়ী তাঁর গানেরও জোরালো আবেদন তৈরি হয়েছে। পরবর্তী দশকগুলোতে হয়তো তেমন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি তাঁর গান তৈরির ক্ষেত্রে। সে বিষয়টি-সহ আরো অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় মাথায় রেখেই তাঁর গানের সমালোচনা করা দরকার।  বব ডিলানের গানের কথা এমনই জোরালো যে, তাঁর চিত্রকল্প তাঁর গানের কথার ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে শ্রোতা পাঠকের হৃদয় পর্যন্ত।  
ষাটের দশকে তাঁর গানের কেমন অবস্থা ছিল সে বিষয়ে কয়েকটি গান সম্পর্কে দু’একটি কথা বললেই বোঝা যেতে পারে। ‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’ গানটির মধ্য দিয়ে এক মানবতাবাদী দরদী কণ্ঠের পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে। বক্তা প্রশ্নের মতো করে মানবতার অসহায়ত্বের কথা বলে যাচ্ছে:
কত পথ হাঁটলে তবে
মানুষকে মানুষ বলবে তুমি?
কত সাগর উড়াল দিলে শ্বেত পায়রা
পারবে ঘুমাতে বালির ’পরে?  

আবার ‘মাস্টারস অব ওয়ার’ গানটিতে ঝরে পড়ে প্রতিবাদী এক দ্রষ্টার কণ্ঠ:
আমি প্রত্যাশা করি তোমার মৃত্যু হোক
তোমার মৃত্যু খুব শিঘ্রই হোক
এক বিবর্ণ বিকেলে
আমি তোমার শবাধারের পিছে যাব।

আমি দেখব তোমাকে
কবরে নামানোর সময়
তুমি মরে গেছ- নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত
আমি তোমার কবরের ওপরে দাঁড়িয়ে রইব।

প্রেমের গানেও তিনি প্রবল আবেদন তৈরি করেছেন। যে কোনো আবহে, যে কোনো ভৌগলিক সীমায় তাঁর গানের প্রাসঙ্গিকতা বদলে যায় না, কিংবা কম বেশি হয় না। তাঁর গানের চিরন্তন আবেদন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়। যেমন ‘গার্ল ফ্রম দ্য নর্থ কান্ট্রি’ গানটিতে তিনি উচ্চারণ করেন:

জানি না আমার কথা তার মনে আছে কিনা  
আমার রাতের আঁধারে
আমার দিনের আলোতে
কতবার, কতবার মনে করেছি, করেছি প্রার্থনা

অন্যদের বেলায় আর যা-ই হোক বব ডিলান হয়তো আমেরিকার স্বপ্নকে পুরোপুরি যাপন করতে পারেননি। তিনিও কখনও কখনও কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বিমতে জড়িয়েছেন। সেটা একান্তই তাঁর সীমিত গণ্ডির ব্যাপার। তবে তিনি অন্যদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন। তাঁর দেশের স্বপ্ন, জাতির স্বপ্ন তাঁকে সব সময়ই তাড়িত করেছে। তিনি অন্যদের মনে সেসব স্বপ্নের রং ছড়িয়েছেন তাঁর গানের মাধ্যমে। পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর কাছে ঋণী থাকবে বহুকাল। তাদের জন্য তিনি তৈরি করেছেন বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার প্রাণবন্ত আবহ। যেমন ‘বব ডিলানস ড্রিম’ গানটিতে পাওয়া যায়:

আধো ভেজা চোখে রুমের ভেতর তাকিয়ে দেখি-
এখানে আমার বন্ধুদের সাথে কাটিয়েছি কত না বিকেল
হেসে গেয়ে ভোরের আলো ফোটা অবধি
আমরা পার করেছি কত ঝড় এখানে একসাথে

কাঠের পুরনো স্টোভের পাশে ঝুলেছে আমাদের হ্যাট
বলা হয়েছে কত কথা, গাওয়া হয়েছে আমাদের গান
এখানে আমাদের ছিল না কিছু পাওয়ার বাসনা- আমরা তুষ্ট ছিলাম
ঠাট্টা তামাশায় বাইরের জগতের কথা বলে পার করেছি সময়

বব ডিলান অ্যালেন গিন্সবার্গ এমনকি হুইটম্যানের দিকেও চলে যায় বব ডিলানের চিত্রকল্পের ধারা। তবে মাত্রাগত পার্থক্য অবশ্যই আছে এবং আছে গভীরতার সীমাবদ্ধতা। কবিতার নীরব আবেদনের চেয়ে গানের সরব নাড়া সব সময়ই প্রত্যক্ষ। প্রত্যক্ষ আবেদনের চেয়ে পরোক্ষ আবেদনের প্রভাব নিশ্চয়ই দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। সে বিচারে বব ডিলান প্রথমত তাঁর দেশের এবং পরবর্তীতে অন্য দেশের ভাবীকালে হয়তো ফিকে হয়ে যেতে পারেন। কারো কারো মতে, বব ডিলান শুধু অন্যদের দিকে তীর তাক করেছেন, তাঁর নিজের দোষত্রুটির দিকে তাকাননি।
তবে অতি উপরিতলে তাকালে এমন কিছু পাওয়া গেলেও তাঁর মেধার প্রশংসা না করে উপায় নেই। তাঁর গানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হতে পারে নানা দিক থেকে, নানা মাত্রার গভীরতায়। তাঁর গানের মধ্যে পরক্ষে কিংবা প্রত্যক্ষে কোথাও রয়েছে বহুল প্রচলিত কথার উল্লেখ, কোথাও আঞ্চলিক লোককথার মিশেল, কোথাও কালজয়ী প্রাচীন সাহিত্যের ছায়া। তাঁর ‘হার্ড রেইন’ গানটির মধ্যেই যেমন একটি কালো ডালের কথা বলা হয়েছে। সে ডাল থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। এখানে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার ইঙ্গিত রয়েছে। আবার দান্তের “ইনফার্নো”র কথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ কথার মধ্যে।
সর্বোপরি, তাঁর গানের শিকড় মানুষের হৃদয়ে চিরন্তন জায়গা পেয়েছে। সেখানে পরিবর্তন কিংবা রঙের বদল ঘটা দীর্ঘ কালের বিষয়। অতি অল্পতে সময় সেখানে খুব বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারবে না।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা