X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের উন্মুক্ত রাজনৈতিক মঞ্চ

ফজল হাসান
০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:১০আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৪

ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী ‘ট্যাঙ্ক ম্যান’

বিলাসবহুল বাসে করে ড্রাইভার আমাদের টিয়ান’আনমেন স্কয়্যারের একপশে নামিয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট পার্কিং জায়গায় চলে যায়। আমরা বাস থেকে নেমে দলপতি ওশেনের পরবর্তী নির্দেশনার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করি। এই ফাঁকে নিজেকে তিন শ’ ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে আনি।

বাস থেকে নামার পর আমাদের জড়ো করে গাইড ওশেন খোলাখুলি বলে দিয়েছে যে, টিয়ান’আনমেন চত্বরের আশেপাশের দর্শণীয় স্থান সম্পর্কে তাকে যেকোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সে অনায়াসে জবাব দিবে, কিন্তু কোন রাজনৈতিক ঘটনা বা দূর্ঘটনা সম্পর্কে কোন প্রশ্নের জবাব দিবে না। সে আরো বলেছে যে, এসব বিষয়ে বিশদ জানতে চাইলে আমরা যেন সবজান্তা ব্রাদার গুগলের শরণাপন্ন হই। তার কাছে সব তথ্য জমা আছে এবং সে নির্দ্ধিধায় জানিয়ে দিবে। ফলে আমাদের মধ্যে কেউ রাজনৈতিক বিষয়ে মুখ খোলেনি। কথায় আছে, প্রয়োজনের তুলনায় কখনো খুব বেশি জানতে নেই। বেশি জেনে বিপত্তি ডেকে আনার চেয়ে অল্প জেনে সুখে থাকা ঢের ভালো।

অনেকে অপরিচিত জায়গায় ভ্রমণে যাওয়ার আগে ওই জায়গার দর্শণীয়, চিত্তাকর্ষক এবং রোমাঞ্চকর জিনিস সম্পর্কে পঁই পঁই করে জ্ঞান আহরণ করেন। তাদের ধারণা, তাতে জানার সঙ্গে দেখার মধ্যে একটা অদ্ভুত যোগসূত্র গড়ে ওঠে এবং স্মৃতির পাতায় অনেক দিন সতেজ থাকে। অন্যদিকে অনেকে আছেন, যারা আগে থেকে কোন কিছু জেনে যেতে চান না। কেননা হঠাৎ চাক্ষুস দেখার বিস্ময় এবং মুগ্ধ হবার অপূর্ব সুযোগ তারা হারাতে বা হাতছাড়া করতে মোটেও রাজি নন। তারা মনে করেন যে, অচেনা-অজানা জায়গায় বেড়ানোর আনন্দই আলাদা। আমার বলতে কোন দ্বিধা বা সংকোচ নেই যে, আমি প্রথম দলের একজন একনিষ্ট সদস্য। নতুন কোন জায়গায় যাওয়ার আগে আমি রীতিমত পড়াশুনা করে যাই, এমনকি প্রয়োজনে সঙ্গে টুকটাক নোটও নিয়ে যাই। তাই টিয়ান’আনমেন চত্বরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আমি আগে থেকেই ওয়াকিবহাল ছিলাম। কেননা ২০১৫ সালে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত আমার অনূদিত ‘‘চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প’’ সংকলনের দীর্ঘ ভূমিকা লেখার সময় আমি চীনের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বিভিন্ন রাজতন্ত্র, সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শণ এবং রাজনৈতিক আন্দোলন ও প্রতিবাদের ঘটনা-দূর্ঘটনার মতো বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রচুর পড়াশুনা করেছি। যাহোক, উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে শুরু করে নবম দশক পর্য্যন্ত টিয়ান’আনমেন চত্বরে এবং তার চারপাশের জায়গায় যেসব উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক আন্দোলন বা প্রতিবাদ হয়েছে এবং স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে, উৎসুক পাঠক/পাঠিকাদের সুবিধার্থে তার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা তুলে ধরার লোভ সংযম করতে পারলাম না।

চীনা ভাষায় টিয়ান’আনমেন শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘গেইট অফ হেভেনলি পীস’, অর্থাৎ ‘স্বর্গীয় শান্তির তোরণ বা সিংহদ্বার’। কেননা অতীতে মিং এবং চিং সাম্রাজ্যের রাজত্বকালে নিষিদ্ধ নগরী বা ফরবিডেন সিটির ইম্পেরিয়াল প্যালেসের প্রধান প্রবেশ পথ হিসাবে এই তোরণ ব্যবহার করা হতো। এটি মিং রাজবংশের শাসনামলে ১৪১৫ সালে নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে সতের শতাব্দীতে চিং সাম্রাজ্যের সম্রাট এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধের কারণে সিংহদ্বারের বিস্তর ক্ষতি হয়। নতুন নকশা প্রণয়নের পর ১৬৫১ সালে পুনরায় নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। বিভিন্ন সময়ে টিয়ান’আনমেন চত্বরের সংস্কার এবং পরিবর্ধনের সুবাদে প্রথম নির্মিত এলাকা থেকে বর্তমানের এলাকার আয়তন চার গুণ বড়। বলা হয়, আয়তনের দিক থেকে এই টিয়ান’আনমেন স্কয়্যার বিশ্বের চতুর্থতম খোলা চত্বর। এই চত্বরের আয়তন চার লক্ষ চল্লিশ হাজার বর্গ মিটার, অর্থাৎ পুরো এলাকা প্রায় এক শ’ নয় একর জমি জুড়ে বিস্তৃত।

টিয়ান’আনমেন চত্বরে যেসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ছাত্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, তার মধ্যে ১৯১৯ সালের ‘মে ফোর্থ আন্দোলন’ বা ‘মে ফোর্থ মুভমেন্ট’, ১৯৪৯ সালে মাও সেতুঙের স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের মৃত্যুর পর তীব্র প্রতিবাদ এবং ১৯৮৯ সালের আমজনতার বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অন্যতম ঘটনা। এছাড়া এই বিশাল খোলা জাগায় ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত বাৎসরিক এবং ১৯৮৪, ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে ৩৫তম, ৫০তম ও ৬০তম গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সামরিক কুচকাওয়াজ ও সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

কথিত আছে, প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র ১৯১৯ সালের ৪ মে ‘প্যারিস শান্তি সম্মেলনে’ গৃহীত জার্মানী অধিকৃত শ্যানডংয়ের দায়িত্ব জাপান রাজতন্ত্রের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে, যা ‘মে ফোর্থ আন্দোলন’ (মে ফোর্থ মুভমেন্ট) হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীতে এই আন্দোলন রাজনীতিতে পরিণত হয় এবং সাংহাইসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পরে। বলা বাহুল্য, এই আন্দোলনের পরে বুদ্ধজীবীদের মধ্যে দেশপ্রেম প্রগাঢ় হয় এবং চীনের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

টিয়ান’আনমেন চত্বরের উত্তর পাশে রয়েছে টিয়ান’আনমেন গেইট বা টাওয়ার। এই টাওয়ারের বারান্দায় চেয়ারম্যান মাও সেতুং ১৯৪৯ সালের পয়লা অক্টোবর বিকেল তিনটায় তিন লক্ষ উপস্থিত বেইজিংবাসী এবং সৈনিকদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এখানেই দাঁড়িয়ে তিনি দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘চীনা জনগণ সগর্বে দাঁড়িয়েছে।’ টিয়ান’আনমেন গেইটের দেওয়ালের মাঝখানে আছে ঝোলানো আছে মাও সেতুঙের বিশাল ছবি। তার একপাশে লেখা, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন দীর্ঘজীবী হোক এবং অন্য পাশে লেখা, ‘দীর্ঘজীবী হোক দুনিয়ার মানুষের একতা।’ বলা হয়, টিয়ান’আনমেন এবং মাও সেতুং এক এবং অভিন্ন, আলাদা করা যায় না।

গণতন্ত্রের সোচ্চার দাবীতে ১৯৮৯ সালের মাঝামাঝি (১৫ এপ্রিল থেকে ৪ জুন) সময়ে কম্যুনিস্ট চীনা সরকারের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ আপামর জনগণ টিয়ান’আনমেন স্কয়্যারে সমবেত হয়ে তীব্র প্রতিবাদ করে, যা ‘টিয়ান’আনমেন স্কয়্যার হত্যাযজ্ঞ’ কিংবা ‘ঊনাশির গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ হিসাবে পরিচিত। সৈনিকেরা ভারী অস্ত্র নিয়ে সেই বিক্ষোভ প্রতিহত করে এবং এক পর্যায়ে গুলি বর্ষণ করে। এতে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ নিহত হয়। একজন অপরিচিত অকুতোভয় তরুণ সামরিক বাহিনীর সারি সারি ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে অবরোধ করে। পরবর্তীতে সে সারা বিশ্বে ‘ট্যাঙ্ক মানব’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন অষ্ট্রেলিয়ার টেলিভিশনের সান্ধ্যকালীন খবরের মূল বিষয় হিসাবে সেই নৃশংস্য হত্যাযজ্ঞের সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছিল। সেই রাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বব হক জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় অশ্রু সম্বরণ করতে পারেননি। তিনি কান্না বিজড়িত গলায় তীব্র নিন্দা করেন এবং ভাষণের এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন যে, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সব চীনা ছাত্রছাত্রীরা ইচ্ছে করলে নাগরিকত্বের জন্য দরখাস্ত করতে পারবে। এই সুযোগে প্রায় পঁচিশ হাজার চীনা ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব লাভ করে।    

আগেই উল্লেখ করেছি যে, টিয়ান’আনমেন চত্বরের উত্তর পার্শ্বে রয়েছে টিয়ান’আনমেন গেইট বা টাওয়ার। টিয়ান’আনমেন চত্বরের মাঝে আছে ‘গ্রেট মিং টাওয়ার’, যা আগে ‘গ্রেট চিং টাওয়ার’ হিসাবে পরিচিত ছিল। রিপাবলিকান আমলে (১৯১১-১৯৪৯) এই টাওয়ারের নামকরণ করা হয় ‘গেইট অফ চায়না’। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে পুরো এলাকার কলেবর বাড়ানোর জন্য এই গেইট ভেঙে ফেলা হয়। টিয়ান’আনমেন চত্বরের চতুর্দিকে দশটি বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে পশ্চিম দিকে রয়েছে ‘গ্রেট হল অফ পিউপল্’, পূর্ব দিকে রিভ্যুলিউশনারী হিস্টরি মিউজিয়াম (বর্তমানে ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ চায়না’) এবং দক্ষিণ পাশে ‘মনুমেন্ট অফ দ্য পিউপলস্ হিরোজ’ অবস্থিত। এছাড়া একদিকে রয়েছে মাও সেতুঙের সমাধি ভবন বা মজেলিয়াম। উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতার পর থেকে টিয়ান’আনমেন চত্বরকে ‘নতুন চীনের প্রতীক’ হিসাবে গণ্য করা হয়।

যাহোক, সময়ের স্বল্পতার জন্য এসব অট্টালিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে ভবিষ্যতে কখনো আবার গেলে অবশ্যই এগুলো বিস্তারিত দেখার ইচ্ছে আছে। 

আরো পড়ুন-

যেখানে এসে সব পথ মিশে গেছে

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
সর্বাধিক পঠিত
‘ভুয়া ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে’
‘ভুয়া ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে’
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
এবার নায়িকার দেশে ‘রাজকুমার’ 
এবার নায়িকার দেশে ‘রাজকুমার’ 
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫