X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মা আমাকে বাঁচান

মুহম্মদ নূরুল হুদা
১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৩০আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৩৮

মা আমাকে বাঁচান
১৬ ডিসেম্বর আমি ঢাকা শহরেই ছিলাম। ওই সময় আমি, হুমায়ূন কবির-সহ কয়েকজনকে নিয়ে একটা গ্রুপ ছিলো, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন যে চিফ ইঞ্জিনিয়ার তার সঙ্গে যারা গেরিলা যুদ্ধ করতো তাদের একটা লিয়াজো ছিলো। তখন আমরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাম। ১৪ তারিখে আমি ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের একটি দোতালা বাসায় ছিলাম। বাসার নাম্বারটা আমার মনে নেই, তবে তা রাস্তার কাছাকাছিই ছিলো। এই বাসাটি আমাদের এলাকার একজন অধ্যাপক, তার নাম আলী আহম্মদ, উনি ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজে পড়াতেন। অংকের শিক্ষক ছিলেন। তিনি তার কলেজের কিছু জুনিয়র ছাত্রদের ওই বাসায় আশ্রয় দেন। আমিও তাদের সঙ্গে আশ্রয় নিলাম। তখন তো আমি অনার্স কমপ্লিট করে ফেলেছি। ওদের সঙ্গে থাকায় কেউ আমাকে সহজে শনাক্ত করতে পারবে না, এটা ছিলো উদ্দেশ্য। ওখান থেকে ১৪ তারিখ রাতেই চলে এসেছি। 
১৫ তারিখের বিকেল থেকে আমাদের মনে হতে লাগলো ঘটনাপ্রবাহ উল্টে যাচ্ছে। সারারাত দুঃশ্চিন্তার মধ্যে কাটলো। কেউ ঘুমাতে পারলাম না। 
জিগাতলার ইপিআর গেট থেকে হঠাৎ করে সৈন্যরা বের হয় আর এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। তখন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধরা ঢুকে পড়েছে। কে কোথায় আছে জানে না। আমরা গেরিলা গ্রুপে যারা ছিলাম– আমি আমার পরবর্তী কাজ কী সেটা জানি। এরপর সেখানে কে আছে সেটা আমি জানি না। 
ওই সময় আমি কিছু প্যাকেট এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিতাম। এটাই আমার কাজ। সেই প্যাকেটে কী আছে আমি তা জানতাম না। গ্রেনেডও থাকতে পারে। বিস্ফোরকও থাকতে পারে। টাকা পয়সাও। আমাদের মূল কাজটা ছিলো লিয়াজো মেইনটেনন করা। 
যেদিন মুহসীন হলে রেইট হলো। সেদিন আমরা কয়েকজন– আমি আর হুমায়ূন আহমেদ হলের ভেতরে ছিলাম। রফিক নওশাদ ছিলো। রফিক কায়সারও ছিলো। হুমায়ূন কবির হলে থাকতো না, তার বোনের বাসায় থাকতো। 
তো তখন থেকেই বলা হলো, তোমরা এখন যে যার মতো করে আলাদা হয়ে যাও। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। তবে এসময় র‌্যানডন কিলিং হবে সেফটিতে চলে যাও। 
সকাল থেকেই বুঝতে পারলাম একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। ইন্ডিয়ান প্লেন থেকে সারেন্ডারের কাগজপত্র ফেলা হলো। 
১৪ তারিখ ঠিক একটা কি দেড়টার দিকে দেখলাম ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানী আর্মি বেরিয়ে উত্তর দিকে অর্থাৎ মিরপুরের দিকে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে কী পরিমাণ যে বৃষ্টির মতো গুলি করতে করতে যাচ্ছে। কখনও কখনও ঘরের ভেতর গুলি ঢুকে পড়ছে। তখন বাচ্চাদের চিল্লাফাল্লা শুনে আমাদের ঘরটা কিন্তু টার্গেট হয়ে গেল। আমি দেখলাম এখান থেকে পালানো ছাড়া পথ নেই। তখন পেছনের দিকের একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। সেই বাড়ির চারপাশে তখন মিলেটারি ঘিরে ফেলেছে। ওই বাড়িতে এক মহিলা আছেন তাকে বললাম, মা আমাকে বাঁচান। উনি বললেন, বাবা আমার জীবন থাকতে তোমার কিছু হবে না। তখন একটা আলমারি টেনে তার পেছনের দিকে আমি লুকিয়ে পড়লাম। বাড়ির দরোজাটা খোলা রেখেই তিনি বসে থাকলেন। অবাক কাণ্ড, আর্মিরা বাড়ির ভেতর ঢুকে নাই। জিজ্ঞেস করেছে ভেতরে কেউ আছে কিনা? উনি বলেছেন, কেউ নেই। দরোজা জানালা খুলে রেখেছি দেখতে পাচ্ছো না? এটা বেশিক্ষণ না, ঘণ্টাখানেক আলমারির ফেছনে লুকিয়ে ছিলাম। তারপর সেখান থেকে পালালাম। 
পাকিস্তানী সৈন্যরা সারেন্ডার করতে যাওয়ার সময়ও কিন্তু গুলি করছিলো। শেরাটনের কাছে এসে ওরা কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা বা ইন্ডিয়ান আর্মির উপর গুলি ছুড়েছিলো। সাধারণ মানুষের উপরেও গুলি ছুড়েছে নির্বিকারভাবে।
আমরা রেসকোর্সের দিকে যেতে শুরু করলাম। কিন্তু এলিফেন্ট রোডের পর থেকে আর যেতে পারছিলাম না। ওইখান থেকেই নানা ধরণের বাধা আসতে শুরু করলো। আমরা শাহবাগ পর্যন্তই যেতে পেরেছি। 
তখন রাস্তায় প্রচুর মানুষ বেরিয়ে এসেছে। মানুষ কম ছিলো সকালের দিকে। দুইটা আড়াইটার দিকে মানুষ বেরুতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হতে থাকে। জিপ নিয়ে ঘুরতে থাকে। শ্লোগান দিচ্ছে গান গাইছে। পতাকা উড়েছে। চিৎকার করেছে। ফাঁকা গুলি করেছে। উচ্ছাস যাকে বলে!
১৫ তারিখে যখন বুঝতে পারলোম বাংলাদেশ স্বাধীন হচ্ছে। তাহলে আমার অবশ্যই একটা নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো। ১৬ তারিখ একটা ষোড়শ বাহিনিও তৈরি হয়েছিলো। যারা আসলে মুক্তিযোদ্ধা না। তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করলো। এই ষোড়শ বাহিনির দাপট দেখে একটা মিশ্র অনুভূতি হলো, ভাবছিলাম যেই স্বাধীনতা আমরা পেয়ে গেলাম সেটা আমরা কীভাবে রক্ষা করতে পারবো?
ভেতরে তো বিজয়ের আনন্দ ছিলোই। সেদিনই কবিতা লিখেছিলাম– ‘তোমার হাড়গোড় জ্যোৎস্না রাতে উড়ে যাওয়া সাদা কবুতর।’ 

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি