X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস নিয়ে

স্বকৃত নোমান
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৩০আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৩৮

সৈয়দ শামসুল হক লেখক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক আমার নমস্য। তিনি যে লেখকজীবন যাপন করেছেন আমিও সেই জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখি। তাঁর বিস্তর কবিতা রয়েছে, যেগুলো বারবার পড়ি। বারবার পড়ার মতো তাঁর একাধিক নাটকও রয়েছে। বিশেষ করে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নূরলদীনের সারাজীবন।’ কিন্তু, অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে বলছি, তাঁর বিস্তর গল্প বা উপন্যাস নেই, যেগুলো বারবার পড়ার মতো। উপন্যাসের একজন গৌণ পাঠক হিসেবে মহান ঔপন্যাসিকদের কাতারে সৈয়দ শামসুল হককে রাখতে পারছি না। যে অর্থে তিনি বড় কবি, বড় নাট্যকার, সেই অর্থে তিনি বড় ঔপন্যাসিক কিনা এ ব্যাপারে আমার মধ্যে সংশয় রয়েছে। উপন্যাস পড়ে যে একটা ঘোর পাঠক হিসেবে আমার মধ্যে তৈরি হয়, সেই ঘোরটা তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাস পড়ে তৈরি হয়নি।

তাঁর ‘খেলারাম খেলে যা’ খুব আলোচিত একটি উপন্যাস। বাংলা ভাষার সত্যিকারের জনপ্রিয় উপন্যাস বলা যায় এটিকে। বেশ কয়েকটা এডিশন হয়েছে। মুদ্রণের পর মুদ্রণ হচ্ছে। কিন্তু এটিকে খুব বড় মাপের উপন্যাস কি বলা যায়? আমার মতে, না। বিশ্বের পাঠককূলের হৃদয়ে যেসব উপন্যাস গেঁথে আছে, চিরায়তের জায়গা করে নিয়েছে, সেসব উপন্যাসের মধ্যে ‘খেলারাম খেলে যা’ কি পড়ে? আমার মনে হয় পড়ে না। উপন্যাসটি পড়েছি আমি বছর আট আগে। একটানে। পড়তে খারাপ লাগেনি। পড়ে শেষ করার পর ভালোই লেগেছে। বাবর আলীর জন্য মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু মাস ছয় পর উপন্যাসটি আমার সঙ্গে আর থাকল না। মহৎ উপন্যাস কিন্তু পাঠকের সঙ্গে থাকে, পাঠক সহজে ঐ উপন্যাসের ঘোর থেকে বেরোতে পারে না। পুরোপুরি না হলেও খানিকটা হলেও ঘোর থেকে যায়। যেমন আমি হয়ত কোনোদিনই ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’ বা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘শত বছরের নির্জনতা’ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বা সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানসে’র ঘোর থেকে বেরোতে পারব না। দেশি এবং বিদেশি ভাষার এরকম বিস্তর উপন্যাস আছে, যেগুলো নিত্য আমার সঙ্গে থাকে। অথচ ‘খেলারাম খেলে যা’ থাকল না। উপন্যাসটি সম্পর্কে এই হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এ হয়ত পাঠক হিসেবে আমার রুচির সমস্যা। পাঠকেরও রুচি থাকে। একেকজন পাঠক একেক রুচির। আমার কাছে যে উপন্যাস ভালো লাগল না, অন্যের কাছে তা ভালো লাগতেও পারে।


অপরদিকে, আঙ্গিকের কারণে সৈয়দ শামসুল হকের ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ উপন্যাসটি অসম্ভব ভালো লেগেছে। এমন আঙ্গিকে লেখা বিদেশি ভাষার উপন্যাস পড়েছি। যেমন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা।’ টানা লেখা, কোনো অধ্যায় বিভাজন নেই। কিন্তু বাংলা ভাষায় এমন উপন্যাস আগে পড়িনি। সৈয়দ শামসুল হকই সম্ভবত প্রথম বাংলা ভাষায় এমন অভিনব আঙ্গিকে উপন্যাসটি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর যে কটি উপন্যাস নির্মাণশৈলীর অভিনবত্বে অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছে তার মধ্যে ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ অন্যতম বলে মনে করি। মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ এবং ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’র আঙ্গিক প্রায় কাছাকাছি। হলেও, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আঙ্গিকটি তিনি মার্কেসের কাছ থেকে নেননি। এটি তার নিজস্ব উদ্ভাবন। কেননা ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে, আর ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ ১৯৮৫ সালে। সুতরাং মার্কেস থেকে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পরিবর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা রূপায়ণে উপন্যাসটির বিশিষ্টতা সুচিহ্নিত। আর এর ভাষাও অসাধারণ। তাঁর অন্য উপন্যাসগুলোর ভাষার সঙ্গে এই উপন্যাসের ভাষা মেলে না। একেবারেই স্বতন্ত। ‘খেলারাম খেলে যা’ পাঠক হিসেবে আমার সঙ্গে থাকেনি, কিন্তু ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ থেকেছে, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও হয়ত থাকবে। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
এর বাইরে তাঁর ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, মহাশূন্যে পরান মাস্টার’, ‘ময়লা জামায় ফেরেশতারা’সহ আরো কটি উপন্যাস পড়েছি, কিন্তু ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’র মতো ভালো লাগেনি। এমনও হতে পারে, উপন্যাসটি আমার ভেতরে গেঁথে গেছে, তাই অন্যগুলো পড়ে আর ওরকম আনন্দ পাইনি। ‘ময়লা জামায় ফেরেশতারা’র একুশ পাতা পড়ে আর এগুতে পারিনি। মনে হয়েছে, লেখক খেই হারিয়ে ফেলেছেন।
সাবির্ক বিচারে আমার মনে হয়েছে, ঔপন্যাসিক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক তথাকথিত জনপ্রিয় হতে চাননি, আবার খুব সিরিয়াসও হতে চাননি। মিনিমাম একটা স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে তিনি তাঁর উপন্যাসগুলো রচনা করেছেন।

২৩.১২.২০১৬

 

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের’ এক সদস্য গ্রেফতার
‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের’ এক সদস্য গ্রেফতার
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের