X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

জফির সেতুর কবিতার প্রান্তর

মাসুদ পারভেজ
৩০ ডিসেম্বর ২০১৬, ২৩:২১আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬, ২৩:৪৭

জফির সেতু ভাষাবিজ্ঞানে ‘বাউ-আউ’ (bow-wow) তত্ত্ব নামে একটা বিষয় আছে। এই তত্ত্বানুসারে ভাষাতত্ত্ববিদরা বলেন,‘মুখের ভাষার উৎপত্তি প্রকৃতির বিভিন্ন শব্দের অনুকরণে। জল পড়া, মেঘ ডাকা, কুলুকুলু ধ্বনিতে নদী বহে যাওয়ার নানান শব্দ অনুকরণ করে মানুষ একদা চিত্রকল্প রচনা করত।’ এটাই হচ্ছে বাউ-আউ তত্ত্ব। এইসূত্র ধরে বলা যায় মানুষ প্রকৃতি থেকেই তার প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে থাকে কিংবা প্রকৃতিই প্রকৃত শিক্ষক। আদিকবি বাল্মীকির কবিত্বও প্রকৃতিজাত। তাই বলা যায়, কবি মাত্রই প্রকৃতিমুখী। তবে এই প্রকৃতি নানা অনুষঙ্গ ধরে কবিমনে বিরাজ করে। কখনও নারী, কখনও নদী, কখনও ফুল, কখনও ফসল, কখনও চন্দ্র, কখনও সূর্য আরও কত রূপ। প্রকৃতিরএই জানা-অজানা রূপে আটকা কবি জফির সেতু। ফলে তার কবিতায় প্রতীকী ইঙ্গিত আছে যা কখনও ধরা আবার কখনও অধরা। জফির সেতুর কবিমনের এই রূপটার খোঁজ করা দরকার তার কাব্যের ভেতরে। জফির সেতুর ১৪টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪), সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬), স্যানাটোরিয়াম (২০০৮), তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১), সিন্ধু দ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২), জাতক ও দণ্ডকারণ্য (২০১৩), সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা (২০১৪), Turtle Has No Wings (2014), ময়ূর উজানে ভাসো (২০১৪), ডুমুরের গোপন ইশারা (২০১৪), প্রস্তরলিখিত (২০১৫) ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫), এখন মৃগয়া (২০১৬), আবারও শবর (২০১৬)। এইসব কাব্যের ভেতরের অনুষঙ্গ, আবহ কালানুক্রমিক তার কবিতার দুইটা ধরন পাওয়া যায়। একটা আদিপর্ব আরেকটা বর্তমানপর্ব। আদিপর্বের কাব্য হিসেবে বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪), সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬), তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১) যদি চিহ্নিত করা যায় তাহলে সেখানে জীবনানন্দীয় প্রভাব আর যৌনতার প্রসঙ্গ চলে আসে। আর বর্তমানপর্ব সিন্ধু দ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২), জাতক ও দণ্ডকারণ্য (২০১৩), সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা (২০১৪), Turtle Has No Wings (2014), ময়ূর উজানে ভাসো (২০১৪), ডুমুরের গোপন ইশারা (২০১৪), প্রস্তরলিখিত (২০১৫) ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫), এখন মৃগয়া (২০১৬), আবারও শবর (২০১৬) কাব্যের বৈশিষ্ট্য মিথ-পুরাণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি এবং বিনির্মাণ। আর স্যানাটোরিয়াম (২০০৮) তার নিজস্ব একটা গদ্যভঙ্গি নিয়ে উত্থিত। এবার প্রথমপর্বের কবিতার দিকে নজর দেওয়া যাক।
বাঙালি কবি মাত্রই জীবনানন্দ দাশ দ্বারা প্রভাবিত হন। তবে এই প্রভাবটা সাময়িক হয়ে থাকে কবিতাচর্চার গোড়ার দিকে। তারপর কবি তার নিজস্ব একটা বয়ান কিংবা কাব্যভাষা নির্মাণ করেন যা দ্বারা তার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়। জফির সেতুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ বহুবর্ণ রক্তবীজ-এর কথা ধরা যাক। নগ্ন কমলালেবুর পাশে, নির্বাসনের আগে, আমরা যারা ফেলে আসি- কবিতা তিনটিতে জীবনানন্দ দাশের প্রভাব আছে। যদিও এটি জফির সেতুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ যা প্রকাশিত হয় ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে, তবে নব্বই দশক থেকেই তার কবিতা বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। জীবনানন্দের প্রভাবের জায়গাগুলো যদি খোঁজ করা যায় তাহলে প্রথমেই চোখে পড়বে কাব্যভাষার ব্যাপারটা। আর কবি জফির সেতু এটা দ্বারাই তাড়িত হয়েছেন তার আদিপর্ব কবিতায়।
আমরা যারা ফেলে আসি কবিতা থেকে কিছু শব্দ বাছাই করা যাক : পিঙ্গল ঘুঘু, হলুদ হরিয়াল, মাছরাঙা, খয়েরি হাঁস, অঘ্রাণের রাত, মাছের ঘাই, শিশির, পাড়া গাঁ। এই শব্দগুলো জীবনানন্দ দাশ এত বেশি প্রয়োগ করেছেন যে জীবনানন্দ পরবর্তী কোনো কবির কবিতায় তা এলে জীবনানন্দীয় একটা গন্ধ চলে আসে। জফির সেতুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ বহুবর্ণ রক্তবীজ  আর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ সহস্র ভোল্টের বাঘ-এ এমন কিছু বিষয় আশয় থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে এই জীবনানন্দীয় গন্ধ তিনি ঝেড়ে ফেলেছেন তার কাব্যশরীর থেকে। বহুবর্ণ রক্তবীজ  কাব্যগ্রন্থের ‘সব তীর খুলে’ নামক অংশের কবিতাগুলো ফ্রয়েডিয় তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এখানে আপাতদৃষ্টিতে যৌনতার ইঙ্গিতবাহী একটা সুর আছে ঠিকই কিন্তু একই সঙ্গে এইখানে বৈজ্ঞানিক মনোবিশ্লেষণ ভঙ্গিও উপস্থিত। একটি কবিতার উল্লেখ করা যাক :
শিশুরা আস্বাদপ্রিয়

সকল কিছুতেই তারা খোঁজে লেবু আর জিহ্বার আস্বাদ
আমাদের এই যে আসঙ্গলিপ্সা ও যৌনতা
তা শৈশবেরই পুনরাবৃত্তি
এবার জফির সেতুর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ সহস্র ভোল্টের বাঘ দেখি। এই গ্রন্থে তিনি জীবনানন্দীয় প্রবণতা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছেন। আর কবিতার বিষয় আশয়ে যুক্ত হয়েছে- রাজনীতি, অবদমন, যাপিত জীবন, অযান্ত্রিকতা, আক্ষেপ, অস্তিত্ব সংকট ইত্যাদি। আর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ স্যানাটোরিয়াম-এ তো একেকটি কাহিনি নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। যে-কাহিনিতে চিরচেনা আর অচেনা জগতের মিথস্ক্রিয়া তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সময়ে-অসময়ে। প্রথম পর্ব আর বর্তমান পর্বের মাঝামাঝি যদি কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয় তাহলে সেটা তাঁবুর নিচে দূতাবাস। নামটিতে এক ধরনের রাজনৈতিক ইঙ্গিত থাকলেও কাব্যে সম্মিলিত হয়েছে ধ্রুপদী চরিত্র, আদিম অনুষঙ্গ আর প্রতীক-রূপকের মাধ্যমে নির্মিত অর্থময় চিত্রকল্প। জফির সেতু তার কাব্যবৈশিষ্ট্য নির্মাণ করলেন তাঁবুর নিচে দূতাবাস-এ এসে।  
এবার আসা যাক জফির সেতুর বর্তমান পর্বের কবিতায়। সেখানে প্রথমেই চোখে পড়ে সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী। নামের ভেতরেই একধরনের ইতিহাস আছে। এই কাব্যের দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক :
সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকীর সওয়ারী হয়েছে ইতিহাস-সভ্যতা-প্রকৃতি-পুরাণ। ইতিহাসের খোঁজে কিংবা সভ্যতার খোঁজে পেছনে মুখ ফেরাতে হয়। পেছনে মুখ ফেরাতে হয় সিন্ধুদ্রাবিড়ের কন্যার খোঁজে। আর তখন মুখোমুখি হতে হয়- গ্রিস-রোম-ব্যাবিলন-মায়া-আজটেক সভ্যতার। কিন্তু তখন মুখোমুখি হতে হয় প্রশ্নের- সভ্যতা আসলে কতোটা সভ্য? তখন ভেসে আসে উত্তর :
আমার জামার নিচে আমি সুগভীর ক্ষত পুষে রাখি
তোমার ত্বকের ভেতরেও উজ্জ্বল দাহ জমা আছে
কবি ও সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী একে অপরের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। এই ভারাক্রান্ত হৃদয় ধারণ করে আছে সভ্যতার ক্লেদ-ক্ষত-জ্বরা সর্বোপরি নগ্নতা। কিন্তু কবি ও ঘোটকী প্রেমের যুগল পরিব্রাজক। প্রেমের খোঁজে তারা যখন পৃথিবী জুড়ে পরিভ্রমণ করছে তখন তাদের চোখে ভেসে উঠেছে- সভ্যতার নগ্ন আহাজারি।
‘তোমার চিবুকে লেগে আছে কান্নার দাগ।’ ঘোটকীর এই কান্নার দাগ তো সভ্যতার নৃশংস উল্কি। যার কারণে আপেলের কলির নিচে দাঁড়িয়েও ‘চাঁদজ্বলা রাতে’ ঘোটকীর মুখ হয়ে ওঠে বিমর্ষ। বিমর্ষ ঘোটকীর অপার সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন কবি-
কিন্তু তুমি সুন্দর
আমি দেখি তোমার কপাল কেমন বাঁকা হয়ে আছে
দীর্ঘ ভ্রমণের পর যখন স্নানকাতর হয়ে ওঠো, তখনও।
ঘোটকীর চোখ জুড়ে থাকা চেরির বাগানে একটি রক্তিম চেরি হয়েই থাকা তার বাসনা। এই অভিব্যক্তির পরিণতি হাহাকার :
তারপর করুণ নিয়তির মতো তুমি চলে গেছ তোমার পথে
আমি ছিটকে পড়েছি রাস্তায় তোমার গতির পাশে
ঘোটকীর এই গতি আসলে মহাকালের বিচ্ছুরিত আলো আর এই মহাকাল হলো সভ্যতা থেকে সভ্যতায় লেগে থাকা যুদ্ধ আর ঘৃণার স্ফূরণ প্রতীক। গতির কাছে ছিটকে পড়েছে বেদনার্ত স্বর- তোমার জামার উষ্ণতা ট্রয়ের দুঃসহতা দিয়ে গেছে। ট্রয় হচ্ছে সেই দুঃসহ ইতিহাস কিংবা পুরাণ যেখানে সমাধি ঘটেছে প্রেমের। সমাধিতে থেকেও প্রেমের আকুতি ভরা আহ্বান- তুমি ফিরবে না, সত্যি তুমি ফিরে আসবে না আর? এই আহ্বানে ঘোটকী সাড়া দেয়নি, ছুঁড়ে দিয়েছে মৃত্যু আর বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদের ভার ঘোটকীরও বহন করতে হয় যখন যুদ্ধক্ষেত্রে তীরবিদ্ধ হয়ে মরে তার অশ্ব। আর তখন উন্মোচিত হয় সভ্যতার বর্বরতা। যে বর্বর দশা থেকে মানুষ এই সভ্যতায় উপনীত হয়েছে সেখানে ঘটেছে প্রেমের অপমৃত্যু। সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকীও একসময় ধারণ করেছে রুদ্রমূর্তি আর তখন বিচ্ছেদে ক্লান্তিতে দগ্ধ কবির প্রেমের প্রার্থনা হয়ে উঠেছে পরাবাস্তব।

মিথ, ঐতিহ্য আর ইতিহাসের মেলবন্ধনে ঘোটকী নিয়েছে আপ্তমানবী রূপ। গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে বেয়ে আসা ঘোটকীর প্রতি কবির নিবেদন- হে ঘোটকী প্রণয়ের পথে চলো মৃত্যুকেও লোভাতুর করে তুলি। তাহলে কি প্রেমের অনন্য স্বাদ মৃত্যুতে? প্রশ্নে প্রশ্নে এগিয়ে চলা পরিব্রাজকের মনে জন্ম নিয়েছে বিবমিষা। এই বিবমিষার উৎস কোথায়?
হে অশ্বকুমারী, আজ আমি পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান উগরে ফেলতে চাই
তোমার সামনে উদ্বাহু আমি দাঁড়িয়েছি আমাকে উন্মোচন করতে
যেহেতু দুঃখ ও অনুতাপ ছাড়া জ্ঞান আমাকে কিছুই দিতে পারেনি।

তাই সব পরিত্যাগ করে কবি ঘোটকীর কাছে আশ্রয়প্রার্থী। বারবার হারিয়েও সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকীর আলিঙ্গন ফিরে পেতে চায়। সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী যেন বনলতা সেন আর তাই কবির মিনতি- আজ আমাকে গ্রহণ করো, হে ঘোটকী!
এবার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ডুমুরের গোপন ইশারা  নিয়ে কিছু বলা যাক :
এই আলোচনার পূর্বেই উল্লেখ আছে জফির সেতুর কাব্যে মিথ-পুরাণ-সভ্যতার এক ধরনের সম্মিলন থাকে। আর ডুমুরের গোপন ইশারায় এটা যেন আরও প্রকট হয়েছে। এই কাব্যের নামকরণ থেকে শুরু করলে দেখা যায়, ডুমুরের একটা কাহিনি আছে কিংবা বলা যায় পুরাণের জের আছে যখন স্বর্গচ্যুত হয়ে মানব-মানবী পৃথিবীতে পদার্পণ করলো সেই সময়ের। আর কবি পাঠককে সেই ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ দিচ্ছেন।  
দুটি দীর্ঘ কবিতার ভণিতায় পর্ব:১, পর্ব:২ নামে ইশারা পাওয়া যাচ্ছে বাইবেল আর গীতার। এই ইশারা কবিতার মাঝে কখনও প্রকট আবার কখনও প্রচ্ছন্ন আর যার বাহক সভ্যতা থেকে সভ্যতা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। মানুষকে যেখানে বানানো হয়েছে নিয়তির দাস। আর এই নিয়তি নির্ভার মানুষকে নিয়ে যুদ্ধবিরোধী চেতনার কথা শোনান কবি। শোনাতে শোনাতে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন সেই ডেলফির মন্দিরে যেখানে অন্ধ ইডিপাস আর আন্তিগোনির শোকার্ত ধ্বনির প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এই প্রতিধ্বনি কবি বয়ে নিয়ে বেড়ান সময়ের গিরিখাতে আর তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় মূর্ত জার্মান, কপট আমেরিকান, আর ধূর্ত ব্রিটিশরা।
প্রেমের গোলাপধরা আঙুল যখন একে-৪৭ আপন করে নেয় তখন আর সভ্যতার মাঝে প্রেম থাকে না। আর এই প্রেমহীন সভ্যতার নৃশংসতা দেখি যখন ‘মৃত মায়ের জরায়ুতে কান্না করছে শিশু।’ এই কান্নারত শিশু যে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হতে পারল না তার নিয়তি কে নির্ধারণ করল? উত্তর খুঁজতে গেলে পাওয়া যায়- ফ্রাঙ্কোর ধারালো দাঁত, চসেস্কুর ঘোলাটে বীর্য, হিটলারের গোঁফ, রাতকো স্মাদিচের থুতু, নিয়াজির লালা। তখন আমরা আরও দেখি ইজরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার!
প্রেম-পুরাণ-সভ্যতা-সন্ত্রাস-নিয়তি ঘুরপাক খেয়েছে ডুমুরের গোপন ইশারায়। এই ঘুরপাকের চক্করে আমরাও ঘুরি, গিনিপিগ হই, নিয়তিকে বরণ করি, আর করি সাম্রাজ্যবাদীদের করুণার প্রতীক্ষা। তখন আরও দেখি  সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ফায়দার বাইরে নয়। আর কবি সেই সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণচিত্র বিনির্মাণ করছেন মিথ-পুরাণের আশ্রয় নিয়ে। আর তখন পাঠককে তিনি নিয়ে যান সভ্যতা কিংবা তথাকথিত সভ্য মানুষের জগতে যখন প্রেম উৎসারিত হয় ঠিকই কিন্তু মুহূর্তেই উবে যায় প্রেমের রেশ। তখন দেখি ইতিহাস কিংবা সময়ের জের ধরে টিকে থাকা সভ্যতার সার্কাস। রক্তপিপাসু ছাড়া যেখানে কোনো চরিত্র নেই, নেই কোনো শীতল অনুভূতি, যা টিকে থাকে তা হয় নিয়তি।
ডুমুরের গোপন ইশারায় প্রেমের যে স্মৃতিকে ধরে কবি থাকতে চেয়েছেন, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন তা উবে যায় নৃশসংতায়। আর পরাজিত মানুষের প্রতিধ্বনি সভ্যতায় দলিত হয়। দলিত স্বপ্নবীজ নিয়ে প্রেমের গীত শোনাতে চায় কবি কিন্তু নিয়তিনির্দিষ্ট চক্রে আমরা কেবল সুতোয় বাধা পুতুল হয়ে ঘুরি। যেমন ঘুরেছিল কবির সিন্ধু দ্রাবিড়ের ঘোটকী
নিবিড় আবেগ আর সংবেদনশীল অনুভূতি দিয়ে ডুমুরের গোপন ইশারা  শুরু হলেও তা অতি ধীরে পাঠককে নিয়ে যায় মিথ-পুরাণের জগতে যেখানে আমি কিংবা আমরা নাই, তবে আমরা থাকি নিয়তিতাড়িত মানুষের কাতারে।    
জফির সেতুর সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হলো আবারও শবর । কাব্যের নামকরণের মধ্যেই একটা নৃতাত্ত্বিক বয়ান তৈরি হয়। কিন্তু জফির সেতু ঘটালেন বিনির্মাণ। মহুয়া, চন্দ্রাবতী, বেহুলা, বিষ্ণুপ্রিয়া, চণ্ডী, মনসা, ফুল্লরা, খুল্লনা, শুকপক্ষী, রাধাবিরহ, ফরহাদের উুক্তি, জোলেখা, লাইলির প্রতি, অন্নদামঙ্গল, নবিবংশ, গোপীচন্দ্রের গান, রাধা, দেওয়ানা মদিনা, ভুসুকু, নির্বাণ, শবর, ইত্যাদি শিরোনামে কবিতা আছে আবারও শবরকাব্যে। এইসব বিষয় তো বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনযুগ আর মধ্যযুগ দখল করে আছে। তবে জফির সেতু আবার নতুন করে কী লিখলেন! এখানেই তিনি বিনির্মাণ করলেন। বিনির্মাণ করলেন দেশীয় আবহ আর তার ব্যক্তি অভিজ্ঞান ওইসব পৌরাণিক, লোকজ, সামাজিক কাহিনি আর বক্তব্যকে ঘিরে। টিলা নামক একটা কবিতার প্রসঙ্গ টানা যাক :
টিলায় আমার ঘর আমি টিলাতেই থাকি
আমার কোনো পড়বেশি নাই
টিলায় খাই আমি টিলাতেই নিদ্রায় যাই
মৃত্যু ছাড়া টিলায় কেউ আসে না।

এই কবিতার আবহ, অনুষঙ্গ সবই চর্যাপদ থেকে নেওয়া। কিন্তু শেষ চরণটি দিয়ে কবি নিজের করে নিলেন কবিতাটিকে। আবারও শবর  কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় জফির সেতু এমনই একটা নিজস্ব বয়ান তৈরি করেছেন যা একই সঙ্গে পাঠকেরও বয়ান হয়ে উঠেছে। আর এইসব বয়ান ধরেই নির্মিত হয়, বিনির্মাণ চলে জফির সেতুর কবিতার প্রান্তর।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী