X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
জন্মশতবর্ষে আহসান হাবীব

‘আমি কোনো আগন্তুক নই’

অরণি হক
০৩ জানুয়ারি ২০১৭, ০০:৩১আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০১৭, ০০:৫৩

আহসান হাবীব (জন্ম : ২ জানুয়ারি, ১৯১৭ - মৃত্যু : ১০ জুলাই, ১৯৮৫) আহসান হাবীব বেঁচে থাকলে আজ শতবর্ষী হতেন। শতবর্ষী কবি দেখতে কেমন হতেন- আমি তা জানি না। নাসির আলী মামুনের তোলা মাথাভর্তি সাদা চুলের মধ্যে নিবিড়-মনস্ক এক কবির ফটোগ্রাফের সামনে যখন নিজের দু’টো চোখ রাখি, মনে হয়, আরো কত কাল পর এই কবির ধ্যান ভাঙবে! আমার মতো যাদের বয়স ৩০ পেরিয়েছে তারা আহসান হাবীবের শারীরিক আকৃতি, কথা বলা, হাঁটা-চলা বা সাহিত্য সম্পাদকের চেয়ারে বসা ব্যক্তিটি কেমন তা জানবেন না। আশির দশকের কবিরা তাকে দেখেছেন ভালোভাবে; নব্বইয়ের কেউ কেউ দেখতেও পারেন। ১৯৮৫ সালে তিনি পরলোকে গিয়েছেন মাত্র। তবু তিনি আমাদের কাছে দূরের কোনো দ্বীপ। যাকে আমরা পেয়েছি ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের ভেতর : ‘খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,/ স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।/ এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,/ চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।... বা আরো কোনো কিশোর কবিতা বা ছড়ায়। ক্লাসের পাঠ্যবই আমাদের এমন ধারণা দিয়েছে যে, এরা মহাকালের আকাশে গেঁথে থাকা মিটিমিটি তারা। এর বাইরে আর কী ভাবতে পারি!
পরবর্তিকালে যারা সাহিত্য পাঠের সঙ্গে নিবিষ্ট থেকেছেন, বা সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেছেন তারা আহসান হাবীবকে পড়েছেন, বুঝতে চেষ্টা করেছেন। ১০০ বছরে একজন কবির কাব্যগ্রন্থ টেবিল থেকে তো শেলফেও ওঠে না! আহসান হাবীবের জন্ম-মৃত্যু কোনোটাই তেমনভাবে পালন করা হয় না। সাহিত্য পাতায় বিশেষ ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হয় না। যেনো অনতিক্রম্য এক দূরত্বের সঙ্গে আমাদের আর সাঁকো বাঁধা সম্ভব নয়।
যদি বাংলা কবিতার (পূর্ববঙ্গ/বাংলাদেশ) উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হয়, তাহলে আমারা আমাদের সূচনাবিন্দু হিসেবে কাকে গ্রাহ্য করি? সেটা চল্লিশের দশক। চল্লিশের দশকে আছেন- আলী আহসান, ফররুখ আহমদ, সুফিয়া কামাল, আবুল হুসেন এবং আহসান হাবীব। এরমধ্যে ফররুখ আহমদ ইসলামী পুনর্জাগরণের স্বপ্নে জাহাজের মাস্তুলে দড়ি বাঁধলেন; আলী আহসান অস্পষ্ট; সুফিয়া কামাল যতটা প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত কবিতায় ততটা আলোকিত নন; আবুল হুসেনকে দেখি মন্থর-স্বপ্নকাতর। এই প্রজন্মের মধ্যে একমাত্র আহসান হাবীবের মধ্যে দেখি একজন আধুনিক কবিকে। যে কবির কবিতার বিষয় ও শৈলী ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার উত্তরসূরী। যিনি আবার ছাপ ফেলেছেন উত্তরকালের কবিদের উপর। বলা যায়, শামসুর রাহমান আহসান হাবীবের চলার পথে অনেকখানি হেঁটেছেনও। এই অঞ্চলে নগরমনস্ক কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল তার কলমেই। আহসান হাবীবের জন্মশতবর্ষে এই কথাই বারবার মনে হচ্ছে।


আহসান হাবীবের কবিতা

আমি কোনো আগন্তুক নই


আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা–
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই। এই
খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা’র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে
হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।
দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।

 

অসুখ

আমি বড় অসুখী। আমার আজন্ম অসুখ। না না
অসুখে আমার জন্ম।
এই সব মোহন বাক্যের জাল ফেলে
পৃথিবীর বালক-স্বভাব কিছু বয়স্ক চতুর জেলে
মানব-সাগরে।
সম্প্রতি উদ্দাম হাতে নৌকো বায়। আমরা বিমূঢ়।
কয়েকটি যুবক এই অসুখ-অসুখ দর্শনের
মিহি তারে গেঁথে নিয়ে কয়েকটি যুবতী
হঠাৎ শৈশবে গেলো ফিরে
এবং উন্মুক্ত মাঠে সভ্যতার কৃত্রিম ঢাকনায়
দুঃসাহস-আগুন জ্বালিয়ে
তারস্বরে কেবল চিৎকার করে:
আমরা বড় অস্থির। কী চাই,
আমাদের কী চাই, কী চাই!
ওরা বলে : সন্ত্রাসতাড়িত আমরা সন্ত্রাসিত পৃথিবীতে তাই
আমরা কেবল ছুটি। বলে আর ঊর্ধ্বশ্বাসেছোটে।
কোথায় ছুটেছে যদি জানতে চাও ওরা অনায়াসে
জবাবে জানায়, নেই ঠিকানা,
অথবা কোনো ঠিকানার বাসনাও নেই।
নৈরাশ্যের হাওয়া থেকে ক্রোধের আগুন জ্বেলে নিয়ে
ওরা বলে : পুড়ুক পুড়ুক
দু’পাশের শ্যামশোভা, পুরনো ঘরের
পুরনো সম্ভার সব পোড়াবো এবং
শূন্যতাকে একমাত্র সত্য বলে রেখে যাবো দুয়ারে সবার।
আর এই উন্মাদ উৎসবে যদি হঠাৎ কখনো
ব্যথিত প্রবীণ কোনও পথচারী প্রশ্ন করে : শূন্যতার বোঝা
কে বয় এমন করে, কোন অর্থে, কী লাভ, কী লাভ!
ওরা বলে : অর্থ নেই। অর্থ নেই এ জীবনে এই শুধু সার
জেনেছি। জেনেছি কোনো লাভ নেই অর্থের সন্ধানে।
লাভ নেই লাভের আশায় কালক্ষেপে
অথবা শূন্যের কড়ি গুণে গুণে লাভ নেই অলিক ছায়ায়।
তার চেয়ে উদ্দাম জোয়ারে
ভেসে যাবো। এবং যেহেতু
ভেসে ভেসে ডুবে যাওয়া একমাত্র সত্য পৃথিবীতে
সত্যের সজ্জিত বৃদ্ধ গাধাটাকে ডুবিয়ে আমরাও
কিছুকাল মত্ত হাতে নৌকা বেয়ে
জোয়ারের জলে ভেসে যাবো।
এবং একদা ডুবে যাবো।

 

দোতলার ল্যান্ডিং মুখোমুখি দুজন

মুখোমুখি ফ্ল্যাট
একজন সিঁড়িতে, একজন দরজায়
: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি ?
: চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব।
: বছর দুয়েক হল, তাই নয়?
: তারো বেশী। আপনার ডাক নাম শানু, ভালো নাম?
: শাহানা, আপনার ?
: মাবু।
: জানি।
: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।
: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইন্যাল, তাই নয় ?
: এবার ফাইন্যাল।
: ফিজিক্স-এ অনার্স।
: কী আশ্চর্য! আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?
: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে?
: কী করে জানলেন?
: এই আর কি! সেরে গেছে?
: ও কিছু না, প‌যাসেজটা পিছলে ছিল মানে…
: সত্যি নয়। উচুঁ থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?
: মা বলেছে?
: শুনতে পাই। বছর দুয়েক হল, তাই নয়?
: তারো বেশী। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?
: নেবেন? না থাক। রিকসা এল, মা এলেন , যাই।
: আপনি সন্ধ্যে বেলা ওভাবে কখনও পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই।
: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন, যাই।

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা