X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আচার্যের ইশকুল

সাকিরা পারভীন
১৪ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:০৫আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:২৮

সেলিম আল দীন
কলেজে পড়ি। ১৯৯৩ সাল। ড. মিজানুর রহমানের  রচনা ও নির্দেশনায় ‘লাল ক্ষুধা’ নাটকে একমাত্র নারী চরিত্রে অভিনয়ের রিহার্সাল করছি। সেদিন রিহার্সাল হচ্ছে ভাইস প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে। গম্ভীর হয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। চোখে চশমা। ভাবছি রিহার্সালের সময় এই গম্ভীর ভদ্রলোককে কে এখানে আসতে বলেছে? রিহার্সাল শেষ হলে ভদ্রলোক আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কী পড়বে?’ —আমি কি জানি কী পড়ব? ডাক্তার, ব্যারিস্টার এইসব কত কী—তার ঠিক আছে? মনে মনে বলছি। ‘তুমি কি জানো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব নামে একটি বিষয় পড়ানো হয়?’ —জ্বি না। ‘আমার মনে হয় ওখানে পড়লে তুমি ভালো করবে।’ তিনি আমার ভালোই করেছেন। নাটকে পড়ার বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছেন অন্তরের ভেতরে। বাবার কাছে সুপারিশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেবার জন্য। নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। কোহিনুর আপা রান্না করে খাইয়েছেন। এলাকার যত ছেলেমেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে তাদের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব এই দারুণ দম্পতিই পালন করেছেন হাসিমুখে। বিনিময়ে আমরা কিছুই করিনি। কোহিনুর আপা আমার এলাকা, মানে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় প্রথম যিনি ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েট দু’টোতেই স্ট্যান্ড করেছিলেন। আর ওই গম্ভীর ভদ্রলোক তার স্বামী, অধ্যাপক মঞ্জুর ইলাহী। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান। ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম এই কারণে যে, শ্রদ্ধেয় দুই শিক্ষক আর কোহিনুর আপা ব্যতীত আচার্য সেলিম আল দীন স্যারকে পাওয়া হতো না, তাঁকে পাওয়ার সাধ্য নেই, সামান্য সান্নিধ্যের অহংকারে আত্মতৃপ্তি আস্বাদন মাত্র। 

এই যে শীতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া হনহন করে বুকের ভেতরে গিয়ে ঢোকে! কে তাকে রোখে? হাওয়া আবার বুকের ভেতরে লাগবে কেন? গায়ে লাগবে, সোয়েটার জাম্পার পড়ব, গরম হবে শরীর। তাই তো হবার কথা কিন্তু কখনও কখনও তো এই হাওয়াটা বুকের ভেতরে লাগে না। বাইরে অভিমান করে ঘোরাফেরা করতে থাকে। হাওয়ার আবার অভিমান আছে না কি? কে জানে, সেলিম স্যার জানবেন হয়ত। তিনি তো হাওয়া বাতাস মেঘ এসবের অর্থ বুঝতেন। ‘শোন্ এই যে মেঘটা দেখতে পাচ্ছিস, কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি আসবে।’ মনে মনে বলি, ইস মনে হয় আল্লাখোদা আইসা পড়ছে। মনের কথা বাসী না হতেই বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। এমন বৃষ্টির মেঘ চিনিয়ে যিনি ডুবে রইলেন ঘাসের মধ্যে তাঁর জন্য বৃৃষ্টি নামে মনের উঠোনে। বৃষ্টি হবার মত মেঘের বাড়াবাড়ি রকমের ওড়াওড়ি আকাশে দেখলেই কারো কারো মনে বৃষ্টি যে নামে আচার্যের জন্য, একথা মিথ্যে নয়। 
যিনি নেই তাঁর স্মৃতিচারণ বড় অসহ্য ঠেকে। তাঁর সঙ্গে এই হয়েছিল সেই হয়েছিল এসব বলতে খুব অস্বস্তি। বড় বিপদের মধ্যে আছি এই নিয়ে। স্যার, আপনি একটু বলে দেবেন কী লিখব আমি? আপনার অভিশাপে আমিও মাস্টার হয়েছি স্যার। নতুন ট্রাইমেস্টারের ছাত্রদের বলেছি আপনার কথা। বলেছি তোমরা আকাশ দেখবে, প্রকৃতি দেখবে, সমুদ্রের কাছে যাবে। বলেছি, আমরা মানে এই মানুষদের মন বড় তুচ্ছ-ক্ষুদ্র। সামান্য কারণ নিয়ে কত অকারণ বিবাদে লিপ্ত হই আমরা। বিশাল আকাশের দিকে তাকালে, সমুদ্রের গর্জনে বুক পেতে দিলে, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের দিকে তাকালে চোখের প্রশান্তি হবে, সেই সঙ্গে মনেরও। প্রকৃতির মত তোমাদেরও মন বড় হবে। প্রশান্ত হবে। ওরা মাথা নাড়ল। প্রতি ট্রাইমেস্টারেই আপনার শিখিয়ে দেয়া এসব আরাধ্য জীবন উপকরণ ওদেরকে বলতে থাকি। 
আর বলতে থাকি শিল্পী হবার উপাসনা কেমন করে করতে হয়। সবাই তো তা হয় না, সম্ভবও নয়। এক একটি নাটকের জন্য সহস্র রজনীর শ্রমে নিমগ্ন থাকতেন আপনি। তা না হলে চাকা, যৈবতী কন্যার মন, হরগজ, প্রাচ্য, বনপাংশুল এরা কেমন করে আসত জনসম্মুখে। নিচের তলার মানুষের মানবিক সংগ্রাম আর উপর তলার মানুষের অমানবিক উপাখ্যানগুলোকে কেমন করে মুঠোর ভেতরে পুরে আনলেন আপনি, তাই ভাবি।

চা দিয়ে এনার্জি প্লাস বিস্কুট ভিজিয়ে খাচ্ছেন এক সভাকবি। আর কবি এতই আনমনে কবিতায় নিমগ্ন আছেন যে, ভেজা বিস্কুট চায়ের কাপে পড়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। চা কাপের শেষ প্রান্তে নেমে এলে সেই চা গোলানো বিস্কুট গিলে ফেলছেন কবি। শিশুর সরলতায় এই দৃশ্য অভিনয় করে দেখাচ্ছেন স্যার, আর বলছেন, মনে কর আমি সেই কবি। সবাই হা হা করে হেসে উঠছেন। ‘নিমজ্জন’-এর গভীর পাঠখাঁদে নিমজ্জিত করে কাঁদাচ্ছেন ইচ্ছে মতন, কেননা সেখানে আধুনিক বিশ্বপ্রতিযোগিতার জমিতে যুদ্ধ আর অস্ত্রের ফলায় ফলায় ফসল হিসেবে উপহার পাচ্ছি মানুষেরই হাঁড়-কঙ্কাল। ‘প্রাচ্য’-র সয়ফর মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে বাস্তুসাপের দেখা পেলেও শেষ পর্যন্ত দাদীর আহবানেই অমিমাংসিত জীবনের দরজায় থামতে হয়, দর্শক শ্রোতার আকাঙ্ক্ষামৃত্যু ঘটে জন্মভিটার সুগভীর টানে শিকড়ের সন্ধানে। শিকড়ের সন্ধানই তো করলেন তিনি আজীবন। হাজার বছরের লুপ্তপ্রায় বাংলা নাটকের শিকড়কে টেনে বের করলেন পাঠক গবেষকের সামনে। বললেন এবং প্রমাণ করলেন, লেভদেফের নাট্যচর্চার মাধ্যমেই আমরা শুরু করিনি; শুরু হয়েছে আরও অনেক আগে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কিংবা গাজীর গানের প্রাণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আমাদের প্রাণের সুর এবং শিল্পপরিচয়। সেই শিল্পপরিচয়কেও নতুন করে করলেন আবিষ্কার। দ্বৈতাদ্বৈতবাদের  নন্দনে অবিষ্ট করলেন আর এক প্রস্থ্। আবার সৃষ্টিশীল কমিটমেন্টের ফাঁক গলিয়ে নিজেকে কখনও কখনও আলগোছে বিভাগ ও ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছেড়ে দিলেও সর্বদাই নিমগ্ন থেকেছেন কর্মযজ্ঞে। জীবনকে তিনি থামাতে তো চাননি কখনও। বারবারই নানা রূপে ফিরে এসেছেন জীবনের কাছে। নিষিদ্ধ সিগারেট দুভাগ করে খেয়ে একভাগ রেখে দিয়ে বলেছেন, এই দেখ বাবা, আমি আর খেলাম না। অর্ধেক রেখে দিলাম। নিজের জামা ভেবে আলীর জামা গায়ে এঁটে আটোসাটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দিব্যি। শরতের সকালে শিষ্যদের পাওয়া মুঠোভর্তি শিউলী ফুল পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছেন। ‘কহন কথা’র গানের খাতায় লিখছেন, আমার হাতে শিউলী ফুল শিউলী ফুল এক মুঠো। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছেন শিউলী ফুল কী কারণে রাতে ফোটে আর সকালে সূর্যের মুখ দেখার আগেই ঝরে পড়ে তার ইতিবৃত্ত। পুরাণ কোরআন বেদ বাইবেল বিশেষ করে উপনিষদের কথা বলছেন বারবার। আর কী বলব কতটুক বলা যায়। বিশ্বভ্রমণ করে আসছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গ্যাটেকে সাথে নিয়ে। মার্লোর ফস্টাসের কঠিন ইংরেজি গেলাচ্ছেন আর বারংবার বোঝাচ্ছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কত বড় লেখক ছিলেন। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ করালেন নিজের নির্দেশনায়। আন্তঃহল নাট্যোৎসবের রিহার্সালে সকাল থেকে রাত বারটা অব্দি ছুটে বেড়াচ্ছেন এক উন্মাদ কিশোর এক ফ্লোর থেকে আর এক ফ্লোরে। অডিটোরিয়ামের মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নামছেন তো ঝাঁপিয়ে উঠছেন আর এক মঞ্চে। ক্লান্তিহীন। মন চাইলে ক্লাস নিচ্ছেন না, মন চাইলে ক্লাস করাচ্ছেন একটানা পাঁট ছয় ঘণ্টা। আমরা বুঝে না বুঝে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথা গিলছি। পেটের ক্ষিধা চরমে উঠলে এনার্জি প্লাস বিস্কুট আর চা। তাই খেয়ে আবারও ঢুকে পড়ছি আচার্যের পাঠশালায়। সেই পাঠশালা কখনও বিকেলের রাস্তায়, কনে দেখা আলোর ঝলকানিতে, চায়ের স্টলে, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের বারান্দা থেকে কালু চত্বরে, মহড়া কক্ষের অন্তরে, আর তাঁর অন্তস্থ জ্ঞানবৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় বিরাজ করেছে বুঝতেও পারিনি। এখনও কী পারি?
জাহাঙ্গীরনগর সাহিত্য কেন্দ্রের আয়োজনে ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের কবিতা বিকেল আর আচার্যের গান করবার নতুন ইচ্ছার করতলে সৃষ্ট ‘কহনকথা’-র মোহগ্রস্থতা তাঁর সান্নিধ্য আর একটু স্পষ্ট হলো বটে। কীবোর্ড কেনা হলো, গীটার কেনা হলো। রোজ বিকেলে পুরানো কলা ভবনের তিন তলায় লেখা সুর করা, প্রাকটিস করা অব্যাহত থাকলো। দু’চারটে অনুষ্ঠানে গাওয়া হলো সেইসব গান ‘আমার হাতের তালুর ভাগরেখায় অন্ধকার লুকিয়ে ছিল’, অথবা ‘আমার মন ভালো নেই ফুলেদের মন ভালো নেই পাখিদের মন ভালো নেই।’ 
স্যার আপনি চলে গেলেন। নিজের উপর অভিমান করে। আমাদেরও মন ভালো নেই।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ইউক্রেনকে ৬২ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
ছেলেকে প্রার্থী করায় এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী