X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় সেশাদ্রির সঙ্গে কিছুক্ষণ

ওয়াসীম পলাশ
১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১০:২৯আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১০:৩২

কবি বিজয় সেশাদ্রির সঙ্গে লেখক
ভদ্রলোককে দেখে আমার অর্থনীতির অধ্যাপক মনে হয়েছিল, কবি একবারও মনে হয়নি। এ বঙ্গের মানুষরা কবি বলতে যা বোঝে এবং যে বিষয়গুলো আমাদের মনে ভেসে ওঠে তার সবগুলোই ছিল তার মধ্যে অনুপস্থিত; শুধু ব্যতিক্রম তার অবিন্যস্ত ধূসর চুলগুলো। মধ্যাহ্ন ভোজের সময় স্যাণ্ডুইসে কামড় দিয়ে নিজে নিজেই বলছিলেন এগুলো ওখানে পাওয়া যায় না। বোধহয় কোনো স্বাধ বা উপাদানের কথা বললেন। আমি মনোযোগ দিয়ে তাকালাম এবং হোচট খেলাম, দেখলাম, চেহারায় ভারতীয় হলেও ভাষায় পূর্ণাঙ্গভাবে আমেরিকান। টেবিলে অন্য একজন ভদ্রলোক ছিলেন তাকে কিছুটা বোঝাতে চাইছেন কিন্তু ভাষা বিভ্রাটের কারণে হয়ে উঠছে না। আমি সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলাম পাশের চেয়ারে; মিলে গেল একটা মোক্ষম সুযোগ। তিনি নিজেই পরিচয় দিলেন বিজয় সেশাদ্রি, কবি। কবি পরিচয়ের প্রতি অগাধ আস্থা। মুহূর্তেই আমি নড়েচড়ে বসলাম কারণ কবি শামীম রেজা আমাকে আগেই বলেছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী কবি বিজয় সেশাদ্রী এসেছেন। মনে হলো ভি. এস. নাইপলের ছায়ায় অনেক প্রখ্যাত লেখক, কবি ঢেকে আছেন এই মিলন মেলায়।

প্রথমেই আমার ভাবনার একটা ছন্দ পতন হলো, আমি তাকে যতটা ভারতীয় বা দক্ষিণ এশীয় ভাববার চেষ্টা করলাম তিনি ততটাই নিজেকে মার্কিন মুলুকীয় বোঝাবার চেষ্টা করলেন। এর অনেকটা কারণও আছে। শৈশবেই, মাত্র চার বছর বয়সেই ভারতীয় পিতার সঙ্গে পাড়ি জমিয়েছেন আটলান্টিকের ওপাড়ে। অন্যদের মতো অতটা সোজা পথ মাড়াননি। পেশায় অধ্যাপক হলেও কবিতার মধ্যেই নিজেকে নিমজ্জিত রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রায় পনের বছর ধরে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছেন।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসতেই আমার চোখের সামনে ভেসে আসল বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিলিজ, জ্যাকরি ভি. স্যাকস এবং তুলনামূলক সাহিত্যের প্রখ্যাত এডওয়ার্ড ডাব্লিউ সাঈদ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিবাকের কথা। মুহূর্তেই মনে হলো এসব নামের আড়ালে তার হারিয়ে যাবার আশঙ্কা চোখে মুখে ফুটে উঠল। বিষয় পাল্টানোর চেষ্টা করলাম। তিনি নিজেই আয়েশা জালালের নামটা মনে করিয়ে দিলেন, এবং টেনিউর না পাওয়ার কারণে কলাম্বিয়া ছাড়লেন তার স্মরণ করিয়ে দিলেন।
২০১৪ সালে পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী এ লেখক এই অঞ্চলের কবিতাপ্রেমিদের কাছে তেমনটা পরিচিতি নয়। এ নিয়ে নিজের ভেতর কিছুটা মেদ টের পেলাম। একজন কবির শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে বৈশ্বিক হয়ে ওঠবার চেষ্টায় এক ধরনের শূন্যতাও তো তৈরি হয়। এ শূন্যতা তাড়ানোর কিছুটা বোধ থেকেই হয়তো প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আগমন। ভারতের ব্যাঙ্গালোরে ১৯৫৪ সালে জন্ম নেয়া এ কবি ভারতের সঙ্গেও তার কিছুটা বিচ্ছিন্নতা আছে।
বিক্রম শেট, অরুন্ধুতী রায়ের কথা উঠতেই বললেন তারা অনেক জনপ্রিয়, তাদের হয়তো একটা রাজনৈতিক ভাষা আছে, জন-সম্পৃক্ততা আছে। বাংলাদেশও তার সাহিত্য কিছুটা বোঝবার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, বাংলাদেশ চলছে। এ চলতে থাকাটা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষের ভেতরের অন্তর্নিহিত শক্তির কথা বলতে ভোলেননি ‘ওয়াইল্ড কিংডম’ কাব্যের রচয়িতা।

“কবির সম্পর্ক এককের সঙ্গে মহাবিশ্বের, চারপাশের আলোড়ন তাকে আলোড়িত করবে কিন্তু বিচলিত করবে না।”- বিজয় সেশাদ্রির এ উপলব্ধি আমাকে তাঁর দার্শনিক সত্তাকে উন্মোচিত করে। তার সঙ্গে এ দু’দিনের অন্তরঙ্গে তা অনেকটাই প্রশমিত হলো। তাঁর আচরণে, কথায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি একধরনের সুক্ষ্ম অনীহা প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের শেকড় বিচ্ছিন্নতা শেকড়ের প্রতি একধরনের নির্মোহ করে তুলেছে। একই সঙ্গে তাকে তরুণদের প্রান্তিক মানুষ, তার গান, হাজার বছরের আধ্যাত্ববাদের প্রতি গভীর অনুরাগের কথা মনে করিয়ে দিতে উচ্ছসিত হলেন কিন্তু ভাবিত হলেন না। পাঠক মহলে তাঁর একটি বিশেষ পরিচয় কবিতায় ‘স্টাকচার/ মেথড’ অনুসরণ করার জন্য। এটা হয়তো বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় কাটানোর ফসল।
অনেক মৌলিক কবিরা পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারেন না। অনেকে পাঠকপ্রিয় হয়ে যান অল্পসময়ে; এ দায় বা সফলতা তিনি কবিকে দিতে চান না। তিনি মনে করেন, কবি চলমান থাকবেন। পৃথিবীর অনেক মৌলিক চিন্তাই অপঠিত রয়ে গেছে। মানুষের কাছে পৌঁছানো কবির উদ্দেশ্য নয়, নিজের পথে তিনি এগিয়ে যাবেন। তরুণ কবিদের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ হলো প্রচুর পরিমাণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের কবিদের লেখা পড়া। শব্দের অপচয় তিনি অপছন্দ করেন তাই তিনি প্রতিটি শব্দ ব্যবহারের আগে সচেতন থাকেন। বারবার ড্রাফস করা তিনি অপছন্দ করেন। লেখা এবং বলা উভয়ক্ষেত্রেই শব্দ সম্পর্কে সচেতন এ আপাত আত্মনিমগ্ন কবি।

এ দেশ, এ শহর ও এখানের মানুষ সম্পর্কে তার কল্পনা এবং এর প্রত্যক্ষণের পরও ভাবলেশহীনতা চোখে পড়ল। তার ‘দ্যা ভিসত্রপিয়ারেস’ কবিতায় নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে ৯/১১ নামক বিভীষিকার প্রকাশ দেখা যায়। উন্নয়নশীল দেশ তার সাহিত্যকেও নিজের ব্যাকরণে বোঝবার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে বিদ্যায়তনের অনুপস্থিতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতার কথা মনে করিয়ে দিলেও এ উৎসব এবং সাধারণের সরব উপস্থিতির বিষয়ে কিছুটা আশাবাদী। এ শহরের দুটি ‘গোলাপী ভবনের’ সৌন্দর্যের কথা বলতে ভোললেন না। মনে হলো, আহসান মঞ্জিল ও লালবাগের কেল্লার কথাই বলছেন।
নিরাপত্তার বিষয়টা কিছুটা বাড়াবাড়িই ভাবলেন ‘লং মিভো’ কাব্যগ্রন্থের এ স্রষ্টা। কোনো নিরাপত্তাহীনতাই তিনি বোধ করছেন না। নিজ দেশে বসে যা শুনেছেন তা কিছুটা বাড়াবাড়িই মনে করেন। আমরা এ পাললিক ব-দ্বীপের মানুষেরা কবিদের কাছ থেকে যে উষ্ণতা ও মানবিকতা প্রত্যাশা করি তার অনেকটাই ঢেকে গেছে তার পেশাগত জীবনের খোলসের কারণে অথবা ভাষা ও ভাবনার ব্যবধানের কারণে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে খোলস ভেঙে অনেক কিছুই জানা হয়নি ‘থ্রি সেকসনস’ নামক কাব্যগ্রন্থ রচয়িতার কথা। এ ‘থ্রি সেকসনস’ কাব্যগ্রন্থই তাকে পুলিৎজার পুরস্কার এনে দেয়।
মধ্যাহ্ন ভোজের শেষ প্রান্তে এসে চামচ দিয়ে ‘ফিরনী’ মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে যে তৃপ্তি দেখেছি এবং এ ফিরনীর প্রশংসা শুনেছি, তখন মনে হয়েছে এ ভারতীয় বংশোদ্ভূত কবি ভারতীয় খাদ্যাভাস ভোলেননি। নিজেকে একজন সাহিত্যানুরাগী এবং এ রকম সাহিত্যানুরাগীর সংখ্যার কথা মনে করিয়ে দিতেই বললেন সাহিত্যের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা দরকার এবং বাংলাদেশ বোধহয় সেদিকেই এগুবে। সময় লাগবে। পৃথিবীর সকল কবিরাই নিজেদের কবি পরিচয়ে আনন্দ এমনকি গর্ববোধও করেন। বিজয় সেশাদ্রিও ব্যতিক্রম নয়; শুধু মনে হলো নতুন জনপদকে ও তার মানুষকে খুব ধীরে ধীরে অবলোকন করেন ম্যাথড ফলো করে। সেটা অনেকটা বিদ্যায়তনিক সংস্কৃতিরও প্রভাব হতে পারে।
বিদায় নেয়ার আগে কিভাবে পরবর্তীতে যোগাযোগ করা যাবে জানতে চাইলে নিজেই আমার ভিজিটিং কার্ড নিয়ে বললেন মেইল করবেন। আমি অনেকটা সন্দিগ্ধ হয়ে তাকালাম। আসলেই কি লিখবেন? আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম তার কবিতা পড়ব। হয়তো একদিন অনুভূতিও জানাবো ‘দি ভিসত্রপিয়ারেসের’ মতো কোন কাব্যিক ভাষায়। আরো সঙ্গ দেয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কিনা বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেই বললেন আয়োজকরা আমার সঙ্গে একজন তরুণীকে গাইড হিসেবে দিয়েছেন। সে এখনই আসবে। মনে মনে চাপা হাসিতে দুজনে বিদায় নিলাম এই ভেবে কবির সঙ্গে তরুণী থাকাই ভালো।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ