X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একুশে বইমেলা : প্রকাশকদের কথা

রিপোর্ট : অহ নওরোজ
১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:৩৪আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:৪৮

একুশে বইমেলা : প্রকাশকদের কথা গত শনিবার বাংলা ট্রিবিউন সাহিত্য বিভাগের আয়োজনে কাগজ প্রকাশন অফিসে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘একুশে বইমেলা : প্রকাশকদের কথা’ শীর্ষক আড্ডা। এই আড্ডায় ছিলেন ছিলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী রবীন আহসান, আদর্শ প্রকাশনীর মাহাবুব রাহমান, ভাষাচিত্র’র খন্দকার মনিরুল ইসলাম, উৎস প্রকাশনীর মোস্তফা সেলিম, গদ্যপদ্য’র শাহ্ আনোয়ার সাদাত, প্রকৃতি’র সৈকত হাবিব এবং ক্রিয়েটিভ ঢাকা’র মুম রহমান। আড্ডা পরিচালনা করেন সাহিত্য সম্পাদক জাহিদ সোহাগ।


রবীন আহসান শুরুতেই শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী রবীন আহসানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বছরের ঠিক এই সময়ই বই প্রকাশের তাড়া কেনো? রবীন আহসান বলেন, ‘এটার প্রথম কারণ হচ্ছে, নিয়মিত বই বিক্রি হওয়ার যে চেইন সেই চেইন আমাদের দেশে না থাকা। আমাদের দেশে শুধু বইমেলাতেই বই বিক্রি হয়। তবে এটার জন্য শুধুমাত্র বইমেলাই দায়ী নয়। বই বিক্রির জন্য অনেকগুলো বইয়ের দোকান না থাকাও দায়ী। তখন সারা বছর বই প্রকাশ করে সঠিকভাবে ডিস্ট্রিবিউশন করা সম্ভব হতো। এছাড়াও বইয়ের মিডিয়া কভারেজ ফেব্রুয়ারি ছাড়া অন্যসময় পাওয়া যায় না। একাণেই আমরা মেলাকেন্দ্রিক। সারা বছর বই বিক্রির ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব আসলে কার? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এগুলো প্রকাশকরাই করবেন, কিন্তু বইয়ের দোকান থাকতে হবে।
পাঠক যদি গড়ে না ওঠে তাহলে বইয়ের দোকান কিভাবে গড়ে উঠবে? এই প্রশ্নের জবাবে রবীন আহসান বলেন, রিডিং সোসাইটি না থাকলে সুন্দর সুন্দর বইয়ের দোকান বানালেও বই বিক্রি হওয়া কষ্টকর। সমাজে আস্তে আস্তে রিডিং সোসাইটি কমে যাচ্ছে। রিডিংএর জায়গাটাই নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যদি বই পড়ার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠে, শিক্ষকরা যদি ছাত্রছাত্রীকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য আরও বিশটা বই পড়তে উদ্বুদ্ধ না করেন, তাহলে বড় বড় বইয়ের দোকান থাকলেও বই বিক্রি হবে না। রবিন আরও বলেন, একুশে বইমেলা এক শ্রেণির লেখকদের আত্মপ্রেম ও আত্মপ্রচারের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা বাংলা একাডেমি ঠেকাতে পারছে না।

মাহাবুব রাহমান আদর্শ প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী মাহাবুব রাহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়- অধিকাংশ প্রকাশনী কেনো এক ব্যক্তির পকেট প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে? মাহাবুব বলেন, আমি প্রথমেই বলবো আমার জেনারেশনের কাউকেই দেখিনি যে, প্রস্তুতি নিয়ে প্রকাশনায় নামতে। এটা যে অন্যান্য ব্যবসার মতো একটা ব্যবসা, তা তারা ভাবছে না। প্রকাশনা যে ব্যবসা হয়ে উঠতে পারে সেই সম্পর্কে আমাদের তাদের ধারণা নেই। তবে আমি মনে করি, প্রকাশনায় আসলে একজন প্রকাশককে সর্বপ্রথম ব্যবসার বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত। কারণ শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য প্রকাশনা ব্যবসায় আসা কোনো কাজের কথা নয়। তাই এটা ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠছে না।
খন্দকার মনিরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ভাষাচিত্র’র স্বত্ত্বাধিকারী খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের প্রকাশকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ প্রকাশক ইমোশনাল হয়ে প্রকাশনী খুলে বসেছেন। এই ইমোশনাল প্রকাশকদের কারণেই আমাদের প্রকাশনা ব্যবসা গ্রো আপ করেনি। একটা ভালো বই প্রকাশ করার জন্য যেরকম সময় নেওয়া দরকার, যেমন লেখক-প্রকাশক দরকার, তেমন লেখক-প্রকাশক এই দেশে ২০ জনও খুঁজে পাওয়া কঠিন। অথচ প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার বই প্রকাশিত হয়। এই টাকাটা কোথা থেকে আসছে? এটি লেখকদের পকেট থেকেই আসে। যেটা আসলে হওয়া উচিত নয়।
এই প্রেক্ষিতে রবীন আহসান বলেন, আমাদের অধিকাংশ প্রকাশক সাহিত্যচর্চা করতে এসে প্রকাশক হয়ে গেছেন। তারা ব্যবসার নিয়ম মানে না, জানেও না। যেটা বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের জন্য একটি বড় ভয়ের কারণ। তবে প্রকাশকরা বাণিজ্যিকভাবে প্রকাশনী করতে পারছে না কারণ তেমন সমাজ-কাঠামো আমাদের নেই।

অনেক প্রকাশক বলেন, তারা বইয়ের ব্যবসা করতে এসে দিনের পর দিন লস দিয়ে যাচ্ছেন। তবু আমরা দেখছি, সেইসব প্রকাশনী বছরের পর বছর বহাল তবিয়তে আছেন। এগুলো কিভাবে সম্ভব?

এই প্রশ্নের জবাবে মাহাবুব বলেন, বর্তমানে ট্রেন্ড এমন যে, যে লেখে তার বন্ধু-বান্ধব, বড় ভাই সবাই মিলে ছাপানোর টাকা দেয়। এবং প্রকাশকরা অধিকাংশ সময় চাপে পড়ে এই বইগুলো ছাপায়।

শাহ আনোয়ার সাদাত তবে কি আসলেই প্রকাশক হতে গেলে তেমন কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই? এমন প্রশ্নে  ‘গদ্যপদ্য’ প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী শাহ্ আনোয়ার সাদাত বলেন, একজন প্রকাশকের অন্তত কিছু যোগ্যতা থাকা উচিত। যেহেতু সে বই নিয়ে কাজ করবে সেহেতু তার শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। কোন বই ছাপানো প্রয়োজন, বইয়ের বানান ঠিক আছে কিনা, বইয়ের মেকআপটা কেমন হবে, সেসব সম্পর্কেও তাদের ধারণা থাকা দরকার। তাই একজন অশিক্ষিত লোকের ক্ষেত্রে একটি ভালো বই প্রকাশ করা সম্ভব না।
এখন দেখা যায়, অনেকে রাতারাতি প্রকাশক হয়ে যান। যেমন ধরুন, কোনো লেখক তার বই নিয়ে প্রকাশকের কাছে গেলো। প্রকাশক তার বইটি প্রকাশ করতে অসম্মতি জানালো। দেখা গেলো পরের দিন সে নিজেই একটি প্রকাশনী করে ফেললো।
আড্ডার এই পর্যায়ে, উৎস প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী মোস্তফা সেলিমের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এখন কি সেই বাস্তবতা আছে যে মোস্তফা সেলিম , প্রকাশকরা নিজেরাই এমন কলেবরে সফল মেলা করতে পারেন? মোস্তফা সেলিম বলেন, এটা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। কারণ প্রকাশকদের মধ্যে একতা নেই। এইরকম একটা প্লাটফর্মে হয়তো সবাই বলবে আমরা সবাই এক থাকবো, কিন্তু প্রাক্টিক্যালি আসলে তারা এক থাকে না। সকল প্রকাশকের ব্যবসায়িক স্বার্থ কিন্তু এক না। বড় প্রকাশকরা যেমন বইমেলায় ব্যবসার জন্য থাকতে চান তেমনি ছোট প্রকাশকরা বইমেলায় থাকতে চান তার অস্তিত্বের জন্য। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে প্রকাশকরা ঐক্যবদ্ধ না। সুতরাং প্রকাশকরা চাইলেই তাদের মতো করে মেলা করা সম্ভব না।
এ প্রসঙ্গে রবীন আহসান বলেন, বইমেলা বাংলা একাডেমিরই করা উচিত। কারণ বইমেলার নামটি হল একুশে বইমেলা এবং বাংলা একাডেমি এই মেলাটাকে বহুবছর ধরে চর্চা করে একটি জায়গায় এনেছে। তবে এজন্য তাদের একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল করা উচিত। যারা সারা বছরই এই মেলা নিয়ে ভাববে।

সৈকত হাবিব একই কথা প্রসঙ্গে প্রকৃতির স্বত্ত্বাধিকারী সৈকত হাবিব বলেন, প্রথমত আমি বলবো, এই মেলাটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত মেলা। এই মেলার গুরুত্ব আমাদের বাঙালির কাছে অপরিসীম। পৃথিবীর সকল বইমেলার দিকে তাকালে দেখা যাবে, সে সকল বইমেলা করে প্রকাশক গিল্ড। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় না। কেন হয় না সেটার কারণ রয়েছে এবং প্রেক্ষাপটও রয়েছে। তবে আমাদের দেশে এখন সেটা সম্ভবও নয়। এজন্য যে, আমাদের দেশের প্রকাশকদের মধ্যে একতা নেই, এবং একটি ভালো পাঠকসমাজও গড়ে ওঠেনি।
এদিকে, বাংলা একাডেমি প্রায় প্রতি বছরই স্টল ফি বাড়াচ্ছে। কিন্তু মেলার পরিবেশ বা নিরাপত্তা  সন্তোষজনকভাবে বাড়েনি। সব মিলিয়ে দুই ইউনিটের একটি স্টলের পেছনে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। এর বাইরে প্রকাশকের নিজের শ্রম তো আছেই। শেষে হিসেব করে দেখা যায় পুরোটাই অলাভজনক মেলা।
মুম রহমান নতুন প্রকাশক ‘ক্রিয়েটিভ ঢাকা’র স্বত্ত্বাধিকারী মুম রহমান বলেন, আমার জানা নেই, বাংলাদেশে এমন কোনো প্রকাশনী আছে কি না- যারা আগামী পাঁচ বছরে কি কি বই প্রকাশ করবে তার পরিকল্পনা আগে থেকেই করে রাখে। কিন্তু প্রকাশনা ব্যবসায় এটা থাকা উচিত। আমি ক্রিয়েটিভ ঢাকা করেছি এখন পর্যন্ত আমার এগারোটা বই প্রকাশিত হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে আমি কি কি বই প্রকাশ করবো সেটি আমার মাথায় আছে। প্রকাশককে শুধু প্রকাশক হলেই চলে না। বই সম্পর্কে তার ধারণা থাকা জরুরী। তাকে ভালো পাঠকও হতে হয়।
আসলে মূল সমস্যা হল, আমরা বইকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারছি না। বাংলাদেশে প্রতিটি মহল্লায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান যেমন আছে, সৌখিন জিনিসের দোকানও রয়েছে। কিন্তু বইয়ের দোকান প্রতি মহল্লায় নেই।
খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, নির্দিষ্ট কয়েকজন লেখকের বই নানা শিরোনামে অনেক প্রকাশনী প্রকাশ করছে। সূচিপত্রে দেখা যাবে তাতে খুব বেশী পার্থক্যও নেই। এইসব লেখকের বই সবাই করেন এজন্য যে, সরকার বা বিভিন্ন সংস্থা যখন প্রকাশকদের কাছে থেকে বই কেনেন, তখন নাম দেখে কেনেন, বইয়ের কনটেন্ট দেখে কেনেন না। তাই সবাই জ্যেষ্ঠ বা বাজারে কাটতি আছে এমন লেখকের বই যেকোনো ভাবেই প্রকাশ করতে চান। লেখকও বাধা দেন না। বই কেনার এইসব অলিখিত নীতি বদলাতে হবে।

আড্ডা শেষে প্রকাশকরা আশা প্রকাশ করেন, পারিবারিকভাবে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠলে এবং মানুষ তার যেকোনো প্রয়োজনে বইকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারলে বইয়ের দোকান বাড়বে, সারা বছর কোথাও না কোথাও বড় আকারে মেলা হবে।


ছবি : এনামুল হক সাকিব

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!