X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রিচার্ড ইটনের পদ্মা নদী : বড় তত্ত্বের ছোট খুঁত (শেষ পর্ব)

ফিরোজ আহমেদ
২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:১৩আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৫৮

রিচার্ড ইটনের পদ্মা নদী : বড় তত্ত্বের ছোট খুঁত (শেষ পর্ব) পূর্ব প্রকাশের পর

নদী বিশেষজ্ঞদের চোখে পদ্মা-ভাগিরথী

এবার তাই আমাদের নদী বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় থাকে না। অন্যতম প্রধান ভারতীয় নদী প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য কিন্তু বিখ্যাত সেচ প্রকৌশলী উইলিয়াম উইলকক্সের সাথে একমত পোষণ করে মনে করেন, গঙ্গার আদি খাত পদ্মাই। ভাগিরথী গঙ্গা-পদ্মা থেকে কেটে আনা খাল ছাড়া আর কিছুই না। কপিল ভট্টাচার্য থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক:

“বাংলাদেশের মানুষের মনের সংস্কার কিন্তু ভাগীরথীকেই গঙ্গার প্রধান প্রবাহ খাত বলে মনে করে। হিন্দু সভ্যতায় গঙ্গা মাহাত্ম্যের প্রচারণা এই ভাগিরথীকেই গঙ্গা বলে প্রচার করেছে। উইলকক্স সাহেবের পরবর্তী বহু ঐতিহাসিক ও ইঞ্জিনিয়ারেরাও ১৯২৮ খৃস্টাব্দের পর বলতে চেয়েছেন, ভাগিরথীই গঙ্গার প্রথম মূখ্য খাত।

“কিন্ত ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা ভাগিরথীর গঙ্গার প্রধান খাত হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহ আনে। তারা বলেন, ভাগিরথী-হুগলীর নিম্নাংশ প্রথম থেকেই সমুদ্রের খাঁড়ি ছিল। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ও বিহারের গাঙ্গেয় উপত্যক্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক গাঙ্গেয় পলিস্তরের নিচে যে হরিদ্রাভ লাল কংকর প্রস্তর মিশ্রিত মৃত্তিকার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয়, হিমালয় পর্বত থেকে আজকের এই বিপুলায়তন গঙ্গা সম্পূর্ণ অবতরণ করবার আগে এখানকার সাগরগর্ভ মধ্যপ্রদেশ ও ছোটনাগপুরের পার্বত্য উপত্যক্যায় উৎপন্ন প্রাচীন বিশালায়তন নদীর জলধারায় বাহিত পলির দ্বারাই পূর্ণ হয়েছিল। দামোদর প্রভৃতি প্রাচীন সংস্করণ নদ-নদীর পলি দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ভাগিরথী উপত্যক্যার নিম্নতম স্তর গঠিত। সুতরাং গঙ্গা অবতীর্ণ হয়ে প্রথমেই বর্তমান পদ্মার প্রবাহপথে প্রবাহিত হত, অথবা ভাগিরথীর পথে প্রবাহিত হত, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে গেলে সমস্ত গঙ্গা-পদ্মা ও ভাগিরথীর খাতে গভীর নল পুতে ওই হরিদ্রাভ লাল মাটির ঢাল (slope) পরীক্ষা করতে হবে।”

“পদ্মাকে গঙ্গার প্রধান খাত হিসেবে মেনে নিতে বৈজ্ঞানিক কোন অসুবিধাই হয় না” -এই মতে দৃঢ় থেকে কপিল ভট্টাচার্য ভৌগোলিক ঢালের গঠনগত কারণও স্পষ্ট করেন: “বাংলাদেশের গঙ্গার ব-দ্বীপের উচ্চাবচকতা নিদর্শক মানচিত্র (রিলিফ ম্যাপ) দেখলে বোঝা যায়, গঙ্গা থেকে ভাগিরথীর উৎপত্তি স্থানটিই সর্বোচ্চ, এবং ভাগিরথী অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমি দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে, এর পূর্বদিকস্থ নিম্নাঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়নি। ভগবানগোলা থেকে সুন্দরবনের বিদ্যাধরী নদীর মোহনা পর্যন্ত যদি একটি সরল রেখা টানা যায়, তা হলে এই সরল রেখার পশ্চিমের ভূভাগ ক্রমশঃ পশ্চিম দিকে উঁচু হয়ে ছোটনাগপুরের মালভূমিতে মিশেছে। আর ওই সরল রেখা থেকে পূর্বে ভূভাগ ক্রমশঃ ঢালু হয়ে গিয়েছে মধ্যবঙ্গে। ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি জেলা নিম্নতম ভূমিতে অধিষ্ঠিত, তারপর ভূমি আবার পদ্মা-মেঘনার পূর্বপারে ক্রমশঃ উচু হয়ে ত্রিপুরা-চট্টগ্রামের পর্বতে উঠেছে। গঙ্গা-পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ যে নিম্নের দিকেই, বর্তমান খাতের কাছাকাছি পথ অবলম্বন করে গিয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কারণ কি?”

উইলকক্সের সাথে অবশ্য কপিল ভট্টাচার্য একটি বিষয়ে গুরুতর ভিন্নমত জানান, সেটি ভাগিরথী খননের উদ্দেশ্য বিষয়ক। উইলককস এর মতে ভাগিরথী খনন হয়েছিল সেচের উদ্দেশ্যে, কপিল ভট্টাচার্য তা অসম্ভব মনে করেন। পৌরাণিক সাহিত্যে বৃষ্টির আশায় যজ্ঞাদির কথা বলা থাকলেও সেচকার্যের জন্য খালের উল্লেখ কোথাও নেই; আল, বাঁধ প্রভৃতির উল্লেখ আছে বৃষ্টির জল কৃষিভূমিতে ব্যবহার উপলক্ষে। এবং সে যুগের জনসংখ্যার ঘনত্ব, ধান চাষের ধরন প্রভৃতির বিবেচনায় এই যুক্তি কিছুটা গ্রহণযোগ্যও বটে। নদীখননের পেছনে সেচকার্যের বিকল্প কারণ হিসেবে কপিল বরং অনুমান করেন “ভগিরথী নদী খননের প্রধান কারণ ছিল গঙ্গা নদীর নাব্যতা রক্ষা করা। ভগীরথ ভাগিরথী খালটি গঙ্গার ধারা থেকে কেটে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুরের উপত্যক্যায়  উৎপন্ন নদীর ইতিমধ্যেই মজাখাতগুলি অবলম্বন করে সমুদ্রের খাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন সমুদ্র যাত্রাপথের দীর্ঘতা হ্রাস করার জন্য।পূর্ববঙ্গের সমতটভূমি দুর্ধর্ষ অনার্যদের বাসভূমি ছিল, আর্য রাজারা ওই দেশ পরিহার করেই চলতেন। বর্তমান চব্বিশ পরগণা, হাওড়া ও মেদিনীপুর জেলা কপিলের রাজ্য ছিল, ভগিরথ তাকে সন্তুষ্ট করে তার বন্ধুতার সাহায্যে পৌত্রির্ক কাজ শেষ করতে  পেরেছিলেন। এত বড় পৌত্রির্ক  কাজের মাহাত্ম্য কীর্তিত হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি আছে?”

এই ‘পৌত্রির্ক কাজ’ এর অনুমান যদি সঠিক হয়, তবে আবার অন্য একটি জটিলতা তৈরি হয় দীনেশচন্দ্র-নীহাররঞ্জন এর অনুমানের সাথে, কেননা কপিল ভট্টাচার্যের অনুমানে তো পদ্মা আগে থেকেই অস্তিত্বশীল। পদ্মা ধরে সমুদ্রগামী না হবার কারণ সেক্ষেত্রে পদ্মার অস্তিত্বহীনতা নয়, তার ভাষায় ‘দুর্ধর্ষ অনার্যদের আবাস’। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার, আর্য-অনার্যের এই বিভাজনটির অর্থ কিছুটা বদলে হাল আমলে তা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বদলে সংস্কৃতিগত পরিচয়ে রূপ পেয়েছে। প্রথম যুগের ভারততত্ত্ববিদদের মত এখন আর বর্ণ ও জাতিভেদের অনড় অচল কাঠামোতে প্রাচীন সমাজকে বোঝার চেষ্টা করা হয় না, পুরনো ধারনা মোতাবেক এক একটা আস্ত নতুন জাতিকে বর্ণপ্রথায় নীচু শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত করে ফেলার ব্যাখ্যা গ্রহণ না করার কারণ অজস্র বিপরীত উদাহরণ, যেখানে অন্তুর্ভূক্ত নতুন জাতিগোষ্ঠীর উচ্চশ্রেণীকে বিশেষ করে ক্ষত্রিয় শ্রেণীতে অন্তুর্ভূক্ত করা হয়েছে এবং একই জাতিভুক্ত বাকিরা বৈশ্য বা শুদ্রের মর্যাদা পেয়েছে। এ বিষয়ে আগ্রহীরা রোমিলা থাপার এর  ফ্রম লাইনেজ টু স্টেট গ্রন্থটির সাহায্য নিতে পারেন। আবার, নগরের উদ্ভব, বাণিজ্য প্রভৃতির বিকাশ অজস্র অসবর্ণ বিবাহেরও ভিত্তি নির্মাণ করে। আরও অসংখ্য কারণে বহুক্ষেত্রেই বর্ণবিভাজনকে অটুট রাখা যায়নি। এমনকি বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব যে এই বর্ণব্যবস্থা শিথিলতর হয়ে যাওয়অ সমাজেই ঘটেছিল, সে বিষয়ক ধারণা গঠনে কোসাম্বী যুগান্তরকারী ভূমিকা রেখেছেন তার ভগবান বুদ্ধের জীবনীগ্রন্থটিতে। ক্রমরূপান্তরিত এই বৈদিক সভ্যতা ক্রমশ বর্তমান বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গকে অভিভূত করে দক্ষিণ পুব দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, এবং এই সময় নাগাদ পূর্ব বাংলায় কিছু বিচ্ছিন্ন বৈদিক প্রভাবিত হিন্দু, বৌদ্ধ বসতি, রাজবংশ ইত্যাদি থাকলেও সাধারণভাবে দেশের পূর্বাংশের অধিকাংশটিই অনাবাদী ছিল, অপরপক্ষে পশ্চিমাংশ ইতিমধ্যেই বৈদিক প্রভাবিত জনগোষ্ঠী ও সমাজব্যবস্থা শক্তিশালী হতে শুরু করেছে।

যাহোক, পদ্মা গঙ্গার আদি প্রবাহ নয়, সে বিষয়ে উইলকক্সের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন প্রকৌশলী এস সি মজুমদার। এই এসসি মজুমদারকেই উদ্ধৃত করেছেন ইটন, পদ্মা-ভাগিরথীর বয়স বিচারের জন্য। কপিল ভট্টাচার্যের বয়ানে “পদ্মার চেয়ে ভাগিরথীর প্রাচীনতা প্রমাণের জন্য শ্রী মজুমদার তাঁর নিজস্ব একটি বৈজ্ঞানিক ‘যুক্তি’র অবতারণা করেছেন : পদ্মা-মেঘনার দিকের অপেক্ষা ভাগিরথীর দিকে গঙ্গার ব-দ্বীপ বঙ্গোপসাগর অভিমুখে দৈর্ঘ্যে বড়।” কিন্তু মজুমদারের এই যুক্তি কপিল মেনে নেননি এই কারণে যে “বর্তমান ভাগিরথী-হুগলির দিকে গঙ্গার ব-দ্বীপ সৃষ্টিতে দামোদর, রূপনারায়ণ, কাঁসাই প্রভৃতি বহু প্রাচীন নদ-নদীর হাত রয়েছে। সত্য বটে তাদের অববাহিকা গঙ্গার তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু এরা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভূখণ্ড ছোটনাগপুরের পার্বত্য অঞ্চল থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ বছর ওই অঞ্চলকে ক্ষয়িত করে বঙ্গোপসাগরে মাটি ফেলেছে। তারা যখন কাজ করেছে, তখনও হিমালয়ের জন্ম হয়নি। জন্মগ্রহণ করে হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গের তুষার জমে উঠতেও বহুশত বছর লেগেছে, তারপর সেই সব গলিত তুষারের জল ক্রমশঃ হিমালয়ের প্রস্রবণ ও নদীগুলির সৃষ্টি করেছে। গঙ্গা-যমুনা-ঘর্ঘরা-কুশীর জন্ম হয়েছে আরও পরে।

“পরবর্তী যুগে ভাগিরথীর সৃষ্টির পর, সেই পূর্বতন ব-দ্বীপের উপরে ভাগিরথীর পলি পড়েছে। ...সুতরং এদিকে গঙ্গার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিতে ভাগিরথী-হুগলির যতটা হাত ছিল বলে শ্রী মজুমদার ধরে নিয়েছেন, তা ঠিক নয়।” তিনি দেখিয়েছন, নানান নৈসর্গিক বৈশিষ্টের কারণেও মেঘনা-পদ্মার মুখের অঞ্চলে ব-দ্বীপের দৈর্ঘ্য বাড়েনি। এমনকি সমুদ্রস্থিত পলিমঞ্চের ধ্বংসের ফলেও পূর্বাংশে ব-দ্বীপের আকৃতি হ্রস্বকায় হয়েছে বলে কপিল উল্লেখ করেছেন। বরিশাল জেলার ইতিহাস নামের গ্রন্থেও এই পলিমঞ্চের পতনের কারণে সাগরের ‘গান’ বলে কথিত শব্দের উল্লেখ আছে, যদিও আজকাল আর এই শব্দ শোনা যায় না। কিন্তু সমুদ্রগর্ভে ব-দ্বীপের আকার দিয়ে কেন নদীর পলি সঞ্চয়ের প্রাচীনত্ব মাপা যাবে না, তার পক্ষে চূড়ান্ত যে যুক্তিটি কপিল ভট্টাচার্য দিয়েছেন, সেটিও ভাববার মতই একটি ভৌগোলিক পর্যবেক্ষণ।

“ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত বঙ্গোপসাগর, মার্তাবান সাগর ও শ্যাম সাগরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র, ইরাবতী-সিটাং ও মেনাম-চাও-ভ্রায়া নদীর মোহনাগুলির মানচিত্র একটু নিবিষ্টভাবে দেখলে একটি বিষয়ে তাদের সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। তিনটি মোহনারই পূর্ব দিকের অংশে ব-দ্বীপ পশ্চিম দিকের অংশের চেয়ে ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বেশী দূর ঢোকানো। আমার মনে হয়, যুগ যুগ ধরে জোয়ারের জলের দৈনন্দিন দুই বারের ক্রিয়া তাদের তিনটিকেই এই এক রকম আকৃতি দিয়েছে। পৃথিবী তার মেরুদণ্ডে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে, কাজেই জোয়ারের গতি পূর্ব থেকে পশ্চিমে। তাই পূর্বের ব-দ্বীপের মুখ ভেঙে এনে সমুদ্রের জল ব-দ্বীপের পশ্চিমাংশে মুখের বৃদ্ধি সাধন করে। তাই পশ্চিমাংশে সাগর দ্বীপ প্রভৃতি গঙ্গার মোহনার দ্বীপগুলি পূর্বাংশের সন্দ্বীপ, হাতিয়া প্রভৃতি দ্বীপের চেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতর।”

এভাবে কপিল ভট্টাচার্যের যুক্তি অনুযায়ী বাংলা ব-দ্বীপের পশ্চিমাংশের ভূমি গঠিত হয়েছে গঙ্গা নদীরও জন্মের পূর্ববর্তী ছোটনাগপুর বিধৌত নদীসমূহ দিয়ে এবং পশ্চিমাংশের সমুদ্র অভ্যন্তরে বেশিদূর বৃদ্ধি ভাগিরথী শাখার প্রাচীনত্বের কারণে অতিরিক্তকাল পলিসঞ্চয় নয়। পশ্চিমাংশের ভূভাগ প্রাচীন বটে, তবে তা ছোটনাগপুরের পাথুড়ে শিলাদ্বারা গঠিত, গঙ্গাবাহিত পলি দিয়ে প্রধানত গঠিত হয়েছে কেবল দ্বীপের পূবভাগেরই একটি অংশ।

ইটনের ভ্রান্তির তাৎপর্য কতটুকু?

চর্যাপদে পদ্মাকে একটি খাল হিসেবেই বর্ণনা করা আছে, বলা হয়েছে পউয়া খাল। গুরুত্বপূর্ণ এই যে, চর্যাপদের এই ভুক্তিটিতেই আমরা আমাদের জানা বাঙালি কথাটি প্রথমবারের মতো পাই। পদ্মা, চণ্ডাল আর বাঙালীর মাঝে যে একটা আদি আন্তঃসম্পর্ক আছে, তা যেমন এই পদটিতে ধারণা করা যায়, তেমনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পদ্মাপাড়ের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে চণ্ডাল আখ্যা দেয়া নিয়ে ঊনিশ ও বিশ শতকে ব্রাহ্মণ-কায়স্ত বনাম নমঃশূদ্র সংঘাত।

“বাজ ণাব পাড়ী পঁউআ খালেঁ বাহিউ।

অদঅ বংগালে দেশ লুড়িউ।।

আজি ভুসুক বঙ্গালী ভইলী।

নিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী।”

নীল রতন সেনের পাঠ ও অনুবাদে আধুনিক বাঙলায় এর অর্থ:

“বজ্রনৌকা পেড়ে পদ্মাখালে বাওয়া হল

অদ্বয় বাঙ্গালের দ্বারা দেশ লুঠ হল।।

আজ ভুসুকু বাঙ্গালী হল।

নিজ ঘরনী (রূপে) চণ্ডালীকে নিল।।”

চর্যাপদে গঙ্গা-যমুনা প্রভৃতি বৃহৎ নদীর উল্লেখে বোঝা যায়, পদ্মা তখন শীর্ণ জলাশয়। দীনেশচন্দ্র সরকার তাঁর পালপূর্ব যুগের বংশানুচরিত নামের গ্রন্থটিতে দশম শতকে “ফরিদপুর জেলার ইদিলপুরে প্রাপ্ত দশম শতাব্দীর চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের শাসনে পদ্মা (পদ্মাবতী?) নদীর” উল্লেখের কথা আমাদের জানাচ্ছেন। তার মতে ক্ষুদ্র নদী এবং অনুমান করেছেন যে, গঙ্গার সাথে এর যোগাযোগ নেই। কিন্তু সুলতানী আমলে কৃত্তিবাস ওঝার কাছে আমরা পাচ্ছি বৃহৎ পদ্মার উল্লেখ।

অর্থাৎ ইটনের পদ্মার জন্ম সম্পর্কিত মূল সিদ্ধান্তটি ভ্রান্তিপূর্ণ। কিন্তু ষোড়শ শতক থেকে পদ্মার আবারও প্রধান প্রবাহে পরিণত হওয়া বিষয়ে তার বর্ণনা সর্বাংশে সঠিক। এর আগেও পদ্মা প্রধান প্রবাহ ছিল বটে, কিন্তু ভাগিরথী পাড়েই ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা তখন দৃঢ়বদ্ধ হতে শুরু করেছে, ফলে করতোয়া এবং ব্রহ্মপূত্র ধরে ইটনের উল্লেখিত কৃষি বিস্তারের প্রক্রিয়াটি এর আগেই শুরু হয়ে গেলেও, এবং বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমলে দিল্লীর আক্রমণ ঠেকাতে ব্যতিব্যস্ত সুলতানরা হয়তো পদ্মার পূর্বমুখী প্রবাহের সুবিধাটি নিতে পারেননি। সম্ভবত সুলতানী আমলেই পদ্মা আবারও শীর্ণকায় হয়ে পড়ে। যে কারণে মোঘল আমলে ১৫৭৪ সালে আইন-ই-আকবরীতে গঙ্গার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একটি ধারার পূর্বদিকে গমনের কথা বলা হয়েছে। ওই সময়ের ইউরোপীয় মানচিত্রগুলোর কথাও ইটন উল্লেখ করেছেন যেগুলোতে ভাগিরথী স্রোতের নাব্যতা হারানো দেখানো হয়েছে।

সেক্ষেত্রে পদ্মার এইবারের গতি পরিবর্তন এমন একটা সময়ে ঘটলো যখন ১. বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমলের পতন ঘটায় বাংলা যুক্ত হয়েছে দিল্লীর বৃহৎ সাম্রাজ্যের সাথে; ২. মোঘলদের কাছ থেকে পত্তন নিয়ে বিপুল পরিমান উদ্বাস্তু মধ্য এশীয়র বাংলায় আসার সুযোগ সৃষ্টি করে দিলো এই নদীপথ ও শাসনের যুগপৎ পরিবর্তন; ৩.  ইউরোপীয় বাণিজ্যের বিপুল বিস্তার মোগলদের বাড়তি মূল্যবান ধাতুর অধিকরী করলো, বিশেষ করে পর্তুগীজদের কল্যাণে আমেরিকান খনিগুলো ছিল এই ধাতুর প্রধান উৎস।

ইতিহাসের এই যোগসাদৃশ পূর্ববাংলায় অরণ্য ভূমিকে কৃষি ভূমিতে রূপান্তনের নতুন এক যজ্ঞকে সম্ভব করে তুললো, এর আগে যা খুবই ধীরগতির একটি প্রক্রিয়া হিসেবেই চলমান ছিল। ইটনের তত্ত্বের প্রতিষ্ঠার জন্য তাই ভাগিরথীকে প্রাচীন ও পদ্মাকে নবীনতর শাখা হতেই হবে, এমন কোন শর্তের প্রয়োজন থাকে না। বরং পদ্মায় গঙ্গার পুনঃপ্রবাহ ও আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের সম্মিলন, উভয় শর্তই জরুরি এই প্রক্রিয়ার জন্য। এদিকে থেকে বিবেচনা করলে, পদ্মার ষোড়শ শতকের আগেকার সক্রিয়তা একই সময়ের বাঙলা অঞ্চলের রাজনৈতিক বিন্যাসের সাথে মিলিয়ে পাঠ করার চেষ্টা করলে হয়তো ইটনের কৃষি বিস্তারের তত্ত্বটিকেই আরও সুদৃঢ়ই করে। 

** পদ্মা সম্পর্কে এই অনুসন্ধানের বাসনা জাগাবার জন্য ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ নদী বিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্যের ‘বাংলা দেশের নদ নদী’ গ্রন্থটির কাছে। এখানে পদ্মা ও ভাগিরথী সম্পর্কিত আলোচনাই বাকি ইতিহাসবিদ ও সাহিত্য গ্রন্থে পদ্মার উল্লেখগুলো সন্ধানে কৌতুহল জাগায়। এই সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের বক্তব্যগুলোকে সংকলিত করার চেষ্টা করেছি ‘পদ্মার ঢেউয়ে ঢেউয়ে’ নামের একটি রচনায়, যেটি ২০১২ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

ফিরোজ আহমেদ। কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। 


আরো পড়ুন-

রিচার্ড ইটনের পদ্মা নদী : বড় তত্ত্বের ছোট খুঁত

 

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা