X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
কামাল চৌধুরী

তুমি কাঁথা দরিদ্র নিশীথে || জহর সেনমজুমদার

.
২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ০৯:৩৪আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১০:০৩

তুমি কাঁথা দরিদ্র নিশীথে || জহর সেনমজুমদার আগামীকাল কবি কামাল চৌধুরীর ৬০তম জন্মদিন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট এই কবি ‘প্রেম ও দ্রোহের কবি’ হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

মানুষের দুঃখ যখন কান্নায় পরিণত হয়, কান্না যখন ঘৃণায় পরিণত হয়, ঘৃণা যখন ক্ষোভে পরিণত হয়, ক্ষোভ যখন অন্তর্গত ক্ষরণে ও দহনে পরিণত হয়—তখন কবিতাকেও বিদুৎবাহী সংবেদনশীলতা নিয়ে মানুষের পাশে আত্মীয়ের মতো এসে দাঁড়াতে হয়; ব্যথাতুর সে কবিতা; মেঘাতুর সে কবিতা; স্বজন সান্নিধ্যের সে কবিতা; রাগে সংরাগে অবিনশ্বর সহমর্মিতায় সে কবিতা অন্তর্গত অনুভব থেকে বার হয়ে এসে মানুষের হাত ধরে হেঁটে যায় বহির্বিশ্বে শিকল ছেঁড়া আকাঙ্খার চাষাবাদ করবার উষ্ণতার দিকে; রবিকরোজ্জ্বল কোনা আকাশের দিকে; কবি কামাল চৌধুরী এরকমই সংবেদনশীল বিদ্যুৎবাহী; কবিতাকে পথঘাট ধুলোজল ঝিঝি ছায়া জোনাকির স্বাভাবিক বাস্তবতার সঙ্গে ক্রমাগত সংলগ্ন করতে করতে এবং সে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের তৎসহ মানুষেরও, ঠিক সেই জীবনের রক্তপ্রবাহে কবিতাকে যেন স্বপ্ন ও স্বপ্নেভঙ্গের খসড়াসহ ছেড়ে দিয়েছেন; ওই ওই তাঁর কবিতা পাড়াগাঁর চৈত্র সঙ্গে নিয়ে ক্রাচে ভর দেওয়া যুবকের সঙ্গে হেঁটে চলেছে; ওই ওই তাঁর কবিতা স্বপ্নের কাকাতুয়া হয়ে মৃত্যুর তীরন্দাজ লক্ষ্যে অবলীলায় অতিক্রম করে গান গাইতে গাইতে জীবনের দিকে উড়াল দিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে; ওই এই তাঁর কবিতা রক্তবমি করতে করতে তমিস্র রজনীর ভেতর কালো এক ভিখিরি সময়ের শতছিন্ন জামার দুঃখে প্রবেশ করছে; ওই ওই তাঁর কবিতা হৃদয়ে অপ্রিয় ক্ষুধা নিয়ে আদিগন্ত খোলামাঠে নেমে চাঁদের গ্রীবায় চুমু দিতে বদ্ধপরিকর; ওই ওই তাঁর কবিতা, যেন এক অনার্য যুবক, সাপের মাথায় রূপকথা লিখবে বলে অনায়াসে হাতকড়া ছিন্ন করছে; ওই ওই তাঁর কবিতা পাখিদের মানচিত্রে প্রণয়ের লিপি স্থাপন করে ছেলেবেলার স্কুল থেকে বীজের ভাষা সংগ্রহ করে অচেনা বাড়ির রহস্য ভেদ করতে ছুটে যাচ্ছে; ওই ওই তাঁর কবিতা, যেন লাল, যেন ভাটিয়ালি, যেন কলাপাতা, যেন ধলেশ্বরী, যেন পীর হুজুরের মাজার; যেন মহুয়া তলায় গীতিকবিতার খাতা, যেন ‘তুমি কাঁথা দরিদ্র নিশীথে...’

দুই
কবিদের মধ্যে সকলে নয়, কেউ কেউ আছেন—ভৌগোলিক ভূমিবাস্তবতার সঙ্গে নিয়ত ও নিরন্তর সংযোগ রেখে, লোকায়ত বীজভূমির ভেতর তাঁর কেন্দ্রবাসী আত্মা স্থাপন করে, সমকালীন তরঙ্গাভিঘাতে, একই সঙ্গে সময়ের সন্ত্রাসে এবং জীবনের জ্যোৎস্নায় ক্রমাগত প্রবেশ করতে থাকেন; কবি কামাল চৌধুরী তাঁর কবিতায় এই কাজটি চমকপ্রদ সফলতায় একটানা করেছেন; একটু নিবিড় পর্যবেক্ষণে গেলে দেখা যাবে—তাঁর কবিতায় যেন পরস্পরবিরোধী এবং পরস্পরসংলগ্ন দুটি সত্তা যুগ্মরূপে রয়েছে; প্রথম সত্তা স্পষ্টত অনমনীয় যোদ্ধা; দেশ-মাটি-মানুষের সমকাল লাঞ্ছিত পীড়ন ও লাঞ্ছনা দেখতে দেখতে এই উদ্দীপক সত্তাটি রক্তেভেজা জনপদের ভেতর ক্রমাগত পদচারণ করে; তার লড়াই সর্বদাই সময়েল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে; একধরনের জেদি আত্মবলিষ্ঠতায় সে একটু একটু করে এক থেকে বহুতরে পরিণত হয়ে যায়; আর দ্বিতীয় সত্তাটি? অনমনীয় যোদ্ধা নয়, ভিজে বিষণ্ন এক প্রেমিক; রক্ত অশ্রু ঘৃণা ও ঘ্রাণের মধ্যে দিয়ে প্রেমকে সংকীর্ণ খাঁচায় নয়—আদিগন্তে ক্রমাগত খোঁজে; আর একটি দেবদারু মেয়ে, হতে পারে বিশেষ কিংবা নির্বিশেষ, তাঁর দিকে হেঁটে যেতে যেতে চাঁদকে অবলম্বন করে অচেনা বাড়ির রহস্য ভেদ করতে চায়; কে এই দেবদারু মেয়ে; সে জানে না; সে শুধু মেয়েটির জন্য নতুন লেখার খাতায় সৎ ভাষায় কবিতা লিখে রাখে; কবিতার পঙক্তিগুলো হাঁটতে থাকবে, কখনো অন্ধ এবং কখনো চক্ষুম্মান, সেই মেয়েটির দিকে; প্রেমিকে শুধু প্রেমিক যেন; তার কোনো রণরক্ত লড়াই নেই—শুধু আছে অনন্ত বিস্ময়বোধ এবং বিস্ময়চিহ্ন; এজন্যই কামালের কবিতার দুটি বিশেষ অভিমুখ, যেখানে গভীরতার সংকটসংঘর্ষ থেকে বারবার দুটি ভিন্ন স্বর ক্রমাগত উথলে উঠতে থাকে; আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই সময়ের সন্ত্রাসে দাঁড়িয়ে একদিকে অনমনীয় যোদ্ধা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলছে—‘এখন ভাতের স্বপ্নে চতুর্দিকে সাঁতার কাটছে ক্ষুধার্ত থালা’, অন্যদিকে বিষণ্ন সেই প্রেমিক, সেও বিষাদ কাতর বাষ্পাচ্ছন্ন, প্রেমের শব্দহীন জামা গায়ে দিয়ে, নিশীথের বহমান স্রোতে একা একা ঘুরে ঘুরে বলছে—‘সামান্য হৃদয় ছিল এক ভাগ প্রেমিকের বাকিটুকু অনিন্দ্র কবির।’ বোঝা যায়, এভাবেই তার কবিতার ধারাবাহিক চলমানতায়, বারবার, সময়ের সন্ত্রাস এবং জীবনের জ্যোৎস্নার পাপরক্ষার পরিপূরক সাক্ষাৎ ঘটে যাচ্ছে; শুধু তই নয়— তাঁর কবিতার অভ্যন্তরে যোদ্ধা এবং প্রেমিক, সময়ের সন্ত্রাস এবং জীবনের জ্যোৎস্না, এত এত চকিত চমৎকারে, একে অপরের পাশাপাশি এসে  দাঁড়াচ্ছে—রূপবদল বা স্থানবদল করছে, সত্যিই ভাবা যায় না; নিজের এই দ্বৈত সত্তার কথা কিংবা দ্বৈত আবর্তনের কথা কামালেরও সম্ভবত অনুধাবনে ছিল; তাই ‘কবিতাাংশ’-এর অষ্টম পর্যায়ে তিনিও স্বীকার করে নিয়েছেন;
বহুধা বিভক্ত সত্তা, ছায়া আমি দু’ভাগ করেছি
আগুন, বৃষ্টির পাশে বিভাজিত অস্পষ্ট আগামী
পিছনে রেখেছি যাকে, সে-ও জানি অভিভাজ্য নয়
শুধুই দ্বান্দ্বিক ধূলি, বাতাসের দোদুল্য গমন।

এই যে পরস্পর পরিপূরক দুই সত্তা, হয়তোবা আসলে অন্তর্গতে এক, কামাল নিজে তাকে দু’ভাগ করলেও মনে মনে এ সত্যও জানেন সত্তা দুটি অবিভাজ্য নয় কখনো কোনোদিন; জীবনধর্মের চলমান ক্রিয়া ও প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় একটা রূপ যখন সামনে এগিয়ে আসে, অন্য সত্তাটি তৎক্ষণাৎ পিছনে চলে যায়; আবার পিছনের সত্তাটি সামনে এলে সামনের রূপটি আড়ালে অন্তরালে চলে যেতে থাকে; মানবজন্মের মধ্যে  এইভাবে সত্তাগত রূপান্তরীকরণ ক্রমাগত ঘটতে থাকে বলে। যোদ্ধাসত্তা তুলকালাম দক্ষযজ্ঞ করতে করতে জনারণ্যে মিশে যায়; আর প্রেমিকরূপ নিজস্ব ও নিজত্বের শেকড়বাকড় সহ বহু অতৃপ্ত রাত্রির চুম্বন ও ভূকম্পন নিয়ে একান্ত ব্যক্তিগত এক নির্জনের গহনে এসে দাঁড়ায়; ফলে তাঁর কবিতায় একটা সময় জাগরণ্য ও নির্জন গহন ক্রমশ একাকার হয়ে যায়; প্রশ্ন জাগতে পারে দুইয়ের মধ্যে কাকে নেবো আমরা? কার কাছে যাবো আমরা? এক্ষেত্রে এও সত্য— ব্যক্তিগত রুচিভেদে কোনো কোনো পাঠক হয়তো আমূল সমপ্রাণতায় যোদ্ধাসত্তাকে আশ্লেষে গ্রহণ করতে উন্মুখ হবে, আবার কোনা কোনো পাঠক সমাচ্ছন্ন হবেন প্রেমিক সত্তার অন্তগর্ত বিরহদহনে; কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, এক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে আমাদের; কামালের কবিতার সামগ্রিক মৌলিকত্বে পৌঁছুতে হলে এভাবে একজনকে পছন্দ বা নির্বাচন করে নিলে চলবে না; বরং দুইয়ের মিলিত সংরাগ নিয়েই, দুইয়ের মিলিত স্বতস্ফুর্ততা নিয়ে দেখতে হবে তাঁর কবিতা খাতার পরিশ্রুত অবয়ব; আসলে এই দুটো সত্তা কামালেরই চলন্ত দুই পা; একটিকে ছাড়া অপরটি কিছুতেই মাটিতে দাঁড়াতে পারবে না; আর এই দুই পা-কে সর্বদা চলমান রাখছে আরও একটি তৃতীয় সত্তা; সে কে? কামাল নিজেই জানিয়েছেন তার কথা; সে আর অন্য কেউ নয়, ‘অনিন্দ্র কবি’; আর যোদ্ধা ও প্রেমিক? বলা যায়, তারা যেন ওই অনিন্দ্র কবিরই দুই চলমান সত্তা; যোদ্ধা সেক্ষেত্রে যদি হয় বহির্মুখী সত্তা, তাহলে প্রেমিক অবশ্যই তার অন্তর্মুখী সত্তা; কামালের কবিতার আদিগন্ত চলনে ও গমনে বারবার এই দুই রূপ সময়ের স্বর ও প্রেক্ষিত অনুসারে নানাভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে; মুখ্যত এই যুগ্মতাকে অবলম্বন করেই কামালের কবিতা বহুকৌণিক বীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণসহ সময় সমাজ বাস্তবের অনুপুঙ্খ অনিন্দ্রার ইতিহাস হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে; সুতরাং এই অনিদ্রের ইতিহাসটাকে ঠিক ঠিকভাবে শনাক্ত ও আত্বস্থ করতে পারলে কামালের কাব্যবিশ্বে প্রবেশ সহজতর হয়ে উঠতে পারে।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া