X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন

মতি রহমান
৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৫৪আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:২৮

মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন লোক সাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক। সারাজীবন তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেমন থেকেছেন নিজের জীবন যাপনেও ছিলেন সাধারণ। সরল নিরহঙ্কারী, নির্লোভ, এই সাধক মানুষটিকে বঙ্গবন্ধু একবার কোনো একটা সরকারি দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন, ‘আমি তো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষ না।’ মনসুর উদ্দীন ক্ষমতা চাননি কোনোদিন।আজীবন সাধনা করেছেন। জীবদ্দশায় একটা ফোকলোর ইনস্টিটিউট করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ঘুরেছেন দেশে বিদেশে। বুঝেছিলেন আমাদের প্রকৃত সম্পদ কি? কোনো নাম বা খ্যাতির জন্য তিনি এই কাজ করেননি। আপন তাগিদেই ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার পথে প্রান্তরে। নিজ শিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যা শিখতে পারিনি সাধু ফকিরদের কাছ থেকেই আমি তা শিখেছি। আমাদের সমস্ত সম্পত্তি শিক্ষিত দুর্বৃত্তরা সব বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।’ লন্ডন জাদঘর ঘুরে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বিক্রমপুর অঞ্চলের সব রত্নগুলো সেখানে ইংরেজরা লুট করে নিয়ে গেছে। ওগুলো কিন্তু নষ্ট করেনি। আদর করে সাজিয়ে রেখেছে। এখনও আমাদের যা আছে তা যোগার করে সংরক্ষণ করতে হবে। মানুষকে দেখাতে হবে। মানুষের কাছাকাছি আনতে হবে।’


এই মহান মনীষীর জন্ম কাগজ অনুসারে ৩১ জানুয়ারী ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে। আমাদের দেশের খবরের কাগজওয়ালারা হয়তো ২ লাইন লেখার সময় পাবেন না। তাতে কী যায় আসে? তার গল্প শুনেছি নানা মানুষের কাছে। সেই গল্পগুলোই আমার লেখা। তিনিও আমাদের জাতির সম্পদ। এই ভূমির সন্তান মনসুর উদ্দিন। তার প্রতি আমার প্রণাম ও শ্রদ্ধা।
জহিরুজ্জামান থিয়েটার করেন, সাংস্কুতিক অন্দোলন-সংগ্রাম করে বেড়ানো মানুষ। ছবি তুলে বেড়াতেন ফিল্মের যুগে। এখন আর তার হাতে ক্যামেরা দেখি না। তবে দেখা হলেই তার কাছে গল্প শুনি। সেই গল্প আমার কাছে কালের স্বাক্ষীর মতো মনে হয়। জহিরুজ্জামান বললেন, “এক বিকেলে শান্তিনগর গিয়েছি মনসুর উদ্দীনের বাসায়। ওনার সঙ্গে দেখা হলো, গেঞ্জি গায়ে, পরনে লুঙ্গি, লম্বা চুলের মানুষটি দেখলেই মনে হবে একজন সুফি সাধক মানুষ। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি করেন?’ একটা পানির মগ হাতেই উত্তর দিলেন, ‘আমরা তো সব সময় নিজেদের খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি তাই ওদের একটু খাওয়া দাওয়া দেই।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘জহির ভাই, কাকে খাবার দিচ্ছিলেন?’ জহির ভাই বললেন, উনি গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছিলেন। একজন মানুষের ভাবনা এতো গভীরে অথচ তার প্রকাশ এতো সরল, তিনিই মনসুর উদ্দীন।

শিল্পকলা একডেমীতে একবার লালন ফকিরের গানের এক কর্মশালায় আমি গান শিখতে গিয়েছিলাম, সেখানে প্রশিক্ষক ছিলেন পাগলা বাবলু। মূল তত্ত্বাবধানে ছিলেন আব্দল করিম শাহ—কুষ্টিয়ার এই সাধুর লালনের গান নিয়ে ছিল বিশাল বিচরণ—তার সাথে পরিচয় হলো, কথা হতো মাঝে মাঝেই। বিশেষ করে খাবার বিরতির সময়। একদিন মনসুর উদ্দীনের কখা বলতেই উনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি তো আমার ভাই লাগো।’ আমি তো অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। করিম শাহ্ বললেন, ‘আমি তো ওনাকে বাবা ডাকতাম। উনি হলেন সাধুদের সাধু। আজকালকার রেকর্ডার হাতে নিয়ে চলা গবেষকদের সাথে কিন্তু ওনার তুলনা করা যাইবো না।’

আমার বাবা মুহম্মদ দবির উদ্দীনের মুখে তার কথা প্রায়ই শুনতাম। একদিন ওনার সংগে কুষ্টিয়া গেলাম। লোকজন প্রচণ্ড ভিড় জমালো ওনাকে দেখতে। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। মানুষ ওনাকে এরকম মান্য করত অথচ উনি তো কারো জন্য কোনো তদ্বির করেননি কখনো। আর বাড়ি থেকে কেউ ঢাকায় আসলেই বলত, ‘রান্না হলেই খেয়ে নিও। এইটা তো সাধু সন্যাসীগো জায়গা। বাড়ির মতো কেউ আদর কইরা খাওয়াইব না।’

এ্যাই-ই যা, পয়সা নষ্ট করিস নে। আমার হুক্কা টানার একটা বেদনার ঘটনা আছে। আমার পরিবারে ছয়টা মৃত্যু ঘটে গেছে আমারই সামনে। আমার বড় মেয়ের মৃত্যুর পর দুঃখ ভোলার জন্য আমি হুক্কা ধরেছি

একটা ব্যাপার আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে। ওনার স্ত্রী প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। বড় মেয়েই মাকে যত্ন করত। তারপর এতগুলো পোলাপান। অনেক ব্যস্ত থাকা সত্তেও মনসুর উদ্দীন নিজেও স্ত্রীকে গোসল করাতেন নিজ হাতে খাওয়াতেন। তারপর কলেজে পড়াতে যেতেন। কোনোদিন অবজ্ঞা করেননি স্ত্রীকে। 
নাসির আলী মামুন বিখ্যাত আলোকচিত্রী। বিখ্যাত লোকদের ছবি তুলেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি মনসুর উদ্দীনেরও ছবি তুলেছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। মনসুর উদ্দীন মাথায় বড় চুল রাখতেন ও হুক্কা টানতেন। সেগুলো নিয়ে কথা বলেছিলেন নাসির আলী মামুন—
নাসির আলী মামুন : আপনি কিভাবে লোক সাহিত্যের সংগ্রহক হলেন?
মনসুর উদ্দীন : একবার প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রকাশিত লালনের কয়েকটি গান দেখি এবং মুগ্ধ হই ভাববাদী তত্ত্বে। পাবনায় আমাদের গ্রামে সেকালে প্রায়ই বাউল ও সংসার ত্যাগীদের আসর হতো। কিশোর বয়সে আমি তাদের নাচ ও গান উপভোগ করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমি বাউলদের প্রতি আগ্রহী হই।

নাসির আলী মামুন : আপনিও স্যার বাউলদের মতো চুল দাড়ি রাখছেন?
মনসুর উদ্দীন : এক থাপ্পর মারব।
নাসির আলী মামুন : স্যার, আপনার হুক্কাটা ধরেন। আমি একটা ছবি তুলব।
মনসুর উদ্দীন : এ্যাই-ই যা, পয়সা নষ্ট করিস নে। আমার হুক্কা টানার একটা বেদনার ঘটনা আছে। আমার পরিবারে ছয়টা মৃত্যু ঘটে গেছে আমারই সামনে। আমার বড় মেয়ের মৃত্যুর পর দুঃখ ভোলার জন্য আমি হুক্কা ধরেছি।

প্রতিতী ঘটক। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের তিন মিনিটের বড় বোন। বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। তার কাছে একবার মনসুর উদ্দীন সম্পর্কে কথা বলছিলাম। দিদি বললেন, ‘আমি একবার খুব অসুস্থ ছিলাম। প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। নানা চিকিৎসা, ওষুধ চলছিল। তারপর মাসখানেক পর বাসায় ফিরলাম। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ্ হইনি তখনো। অসুস্থতার খবর জেনে এক বিকেলে মনসুর উদ্দীন স্যার আমাকে দেখতে এলেন। স্যারের হাতে ছিল দুধ ভর্তি একটা জগ। সেই দুধ খেয়ে কাটল আমার অসুস্থ শরীরের দুর্বলতা। স্যারের মতো মানুষকে কী ভোলা যায়।’

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!