এ বইটি পড়তে শুরু করা আর শেষ করার পরের অনুভূতির মধ্যে বিস্তর তফাত আছে। যারা পড়বেন তারাই কেবল টের করবেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘ফিল ফুল’ বাংলায় যাকে আমরা ‘সয়ম্বর’ বলে জানি। এর অর্থ করলে দাঁড়াবে আপাতত আমার আর কিছুর দরকার নেই, আমি ভরা আছি। নিজের সামনের পথটা যখন পরিষ্কার দেখা যাবে, আত্মবিশ্বাস থাকবে তখন কেবল একটা ফুল ফিলিং তৈরি হয়। ‘একুশ শতক : অন্যরকম শিক্ষার সন্ধানে’ বইটি পড়ার পর মনে হবে অনেক কিছু জানলাম। নিজের চেনা-পরিচিত জগতটাই নতুন করে চেনা যাবে এই বই পড়লে। বইটি সবারই কাজে আসবে আসলে। এর লেখকের নাম ফারাহানা মান্নান।
বইটি মূলত শিক্ষা নিয়ে হলেও, শিক্ষা কার্যক্রম বা সহজ অর্থে পড়াশোনা করে কী হবে ভবিষ্যতে, এর অভিমুখ মানে গন্তব্য স্থল কোথায়। অর্থাৎ শেষ থেকে শুরু করেছেন ফারহানা মান্নান। এখনকার সময়ে যাকে আমরা একবিংশ শতক বলে দাবি করছি, এই সময়ের পরিবর্তনগুলো কোথায় কোথায় ঘটেছে। ফারহানা বলছেন, ‘আগামী দশকগুলোয় বেশিরভাগ মানুষই জ্ঞানভিত্তিক কাজ করবে। যে কেউ যেকোনো বিষয়ে যতই পারদর্শী তা নিয়েই ঘরে বসে কাজ করতে পারবে।’ (পৃষ্ঠা-১১) এই পরিবর্তন ঘটছে ঠিকাছে। কিন্তু এর জন্য সবাই কি আমরা প্রস্তুত? মনে হয় না। তাছাড়া বাজারে অনেকেই ভিড় করবেন। তাদের মধ্যে টিকে থাকার যেসব যোগ্যতা এই একুশ শতকে এসে নিজে আত্মস্থ করতে হবে সেগুলো কী কী? এসব জানাবোঝা আমার অভিজ্ঞতায় বলতে গেলে বেশিরভাগেরই নেই। যাদের জানা আছে, তাদের জন্যও বলছি, মানুষের অভ্যাস হচ্ছে তাকে কেউ বলে দিতে হয়। নইলে ঠিক খেয়াল থাকে না, গুরুত্ব উপলব্ধ হয় না। ফারহানা মান্নান সেই বলে দেয়ার, মনে করিয়ে দেয়ার, নির্দেশিকার কাজ করেছেন এই বইয়ে। তিনি দায়িত্বশীল মানুষ, লেখনিতেও তা বুঝ যায়।
তিনি বইয়ে লিখেছেন, ‘সুক্ষ্মচিন্তন দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে অনেকেই আসলে একুশ শতকের দক্ষতার ক্ষেত্রে নতুন ধারণা হিসেবে বিবেচনা করে। এখানে সুক্ষ্মচিন্তন দক্ষতা বলতে বোঝায় তথ্য বিশ্লেষণ (analyze), ব্যাখ্যা প্রদান (interpret), সংক্ষেপ করা (summarize), ও সংশ্লেষণ (synthesize)। এবং এই ফলাফলকে কোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা।’
কোনো উদ্যোক্তার জন্য এসব প্রসঙ্গ জরুরি। তিনি যখন কোনো ‘বিজনেস’ এ নামবেন তখন তাকে চিন্তাশীল থাকতে হবে। চারটি দক্ষতাকে বর্তমান বিশ্বে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এক মৌলিক দক্ষতা, দুই চিন্তন দক্ষতা, তিন মানুষ সম্পর্কিত দক্ষতা এবং চার ব্যক্তিগত যোগ্যতা। এই ব্যক্তিগত যোগ্যতার বিষয়টি আসেল কী? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ফারহানা জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগতভাবে এই সমেেয় ‘ডিজিটাল’ হতে হবে। এর বিকল্প নেই। প্রযুক্তি বিনে উদ্যোগ গ্রহণ চলবে না একুশ শতকে। যে কাজই করা হোক না কেন সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। এছাড়া থাকতে হবে ‘সৃজনশীলতা’, মানে হলো নতুন ভাবনা, সতুন কিছুকে সবসময় হাজির রাখা। নিজের আলাদা বৈশিষ্ট্য কী তা চিহ্নিত করা। এসবের সঙ্গে সঙ্গে, আরো যা জরুরি তা হলো পারস্পরিক সহযোগিতা, যোগাযোগের দক্ষতা, আন্তসাংস্কৃতিক বিনিময়- এসব রপ্ত করা।
নিজেকে টিমের কর্তা না ভেবে কর্মী ভাবা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা। ‘করপোরেট কালচার’ বলতে একেই বুঝায়। পশ্চিমা দেশগুলো এসবের চর্চা করে আসছে অনেক দিন। আমরা করছি না তেমন। যে কারণে অনেক উদ্যোগ সফল হচ্ছে না আশানুরূপ। নিজেকে কর্মী ভাবা, দলের সবার সঙ্গে সমান অংশ মনে করা, দলের কর্মীদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখা, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সাবলিলতা না থাকলে উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হবে না।
অল্প পরিসরে বিশেষ আলাপ সম্ভব নয়। তবে এই বইয়ের আসল মজা তার যে মূল আলাপ সেখানে। আর তা হলো শিক্ষা। একদমই শিশু কাল থেকে নিজের সন্তানকে কীভাবে গড়ে তুলতে হবে একুশ শতকের এই সদা পরিবর্তনীয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার খোলামেলা এবং সহজ উপায় বাৎলে দিয়েছেন ফারহানা। তার বলা পদ্ধতিগুলো আপনারা বইয়ে পড়ে নেবেন। আমি দার্শনিক জায়গাটা উপস্থাপন করছি। ফারহানা শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। অনেকের লেখা পড়েছেন। অনলাইনে ঘুরেছেন। বিভিন্ন স্থানে যারা শিক্ষা নিয়ে নিরন্তন কাজ করে যাচ্ছেন তাদের নজরে রেখেছেন। তিনি দেখেছেন, কেবল ‘মুখস্ত বিদ্যায়’ কিছু হয় না। বরং শিশু যখন ‘অ’, ‘আ’ শিখবে তাকে এসব হরফ সংশ্লিষ্ট বস্তু, প্রাণীর সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে প্রাণ, প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটবে, শিশুর সঙ্গে তার পরিপার্শ্বের একটা আত্মার আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হবে। শিশুর মুখস্তের প্রতিভা নয়, বরং তার স্মৃতিতে কী কী জমা হচ্ছে সেসবের খেয়াল রাখাই অভিভাবকদের কর্তব্য বলে মানছেন ফারহানা। আমিও তা মানছি।
এছাড়া গল্প করার বিষয়টিকেও তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন। শিশুর সঙ্গে সৌহার্দ্য ও বিস্তৃত সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলছেন। তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করা যেতে পারে। তাকে ছবি আঁকতে দেওয়া যেতে পারে। অন্যদের সঙ্গে আচরণ ও ব্যবহার বিষয়ে কোন পদ্ধতি অবলম্বন প্রয়োজন তার ফর্দও হাজির আছে তার বইয়ে।
বয়ঃসন্ধিকাল, যৌন শিক্ষা বিষয়েও অভিজ্ঞতাসহ করণীয় তুলে ধরেছেন ফারহানা মান্নান। যৌন শিক্ষা কোন ভাষায় এবং কতটুকু দিতে হবে কিশোরবয়স্ক সন্তানকে তার একটা পরামর্শপত্র এই বইয়ে পাওয়া যাবে। আবার একেবারেই যদি সেই শিক্ষা না দেওয়া হয় তাহলেও যে যে বিপদ ঘটতে পারে সে বিষয়েও তিনি সতর্ক করেছেন।
এই বইয়ের লেখক মনে করেন ফলাফলই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং জীবনে টিকে থাকা, নিজের জীবনের বিকাশ ঘটানোই উদ্দেশ্য হতে পারে। সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে প্রয়োজন মানসিক দৃঢ়তা। মনোজগতটাকে তৈরি করার কথা বলেছেন ফারহানা। আর সেটা শুরু করতে হয় শিশুকাল থেকেই। জগত ও জীবনকে বুঝতে বুঝতে নিজের উন্নতি সাধন এবং পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার কৌশল তিনি হাজির করেছেন এখানে। বইটি ফলে সবার জন্যই জরুরি। নিছক কৃৎকৌশল দিয়ে তিনি সমাধানের পথ রচনা করেননি। বরং সামাজিক উপায়ে, নিজের জড়তা আর অপারগতাকে উৎরে যেতে কী কী করণীয় তা উপস্থিত করেছেন। অনেক খাটতে হয়েছে তাকে। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে মেলাতে হয়ে বিশ্বের অপরাপর অংশের সঙ্গে। মনোজগতকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। সেখানকার প্রস্তুতিটা আগে দরকার তারপর প্রযুক্তি রপ্ত করার বিষয়টি সামনে আসবে।
এই একটি বই সত্যি বলতে আমার ব্যক্তি জীবনেও প্রভাব ফেলবে।