X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
হাসান আজিজুল হক

প্রসঙ্গ ‘শকুন’

ইলিয়াস বাবর
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:৪৩আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:০৬

হাসান আজিজুল হক
‘আমার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই একটা বিশ্বস্ততা কাজ করে, কেউ বন্ধু চিরকালের জন্য বন্ধু। আর আমি দেখেছি, মধুর ব্যবহার করলে মানুষ খুব আনন্দ বোধ করে। কটকট করে কথা বললেও কাজ হয়, সবই হয়। কিন্তু ওই পরিবেশটি নষ্ট হয়ে যায়। সে কারণে হয়তো ভাষাটা এভাবে তৈরি হয়েছে’—নিজের গল্পভাষ্য সম্পর্কে এভাবেই জানান হাসান আজিজুল হক। দীর্ঘ জীবনে, বিট্রিশ-পাকিস্তান পর্ব শেষ করে সার্বভৌম বাংলাদেশে বসবাস করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যের ভূবন। শৈশব-কৈশোর কাটানো সে রুক্ষ রাঢ়বঙ্গকে ভুলতে পারেন না বলেই, নিজের ভেতর উদ্বাস্তু অনুভূতিরেখাটা প্রবলভাবেই খনন করে যান হয়তো—এভাবে দুই বাংলার যৌথ পরিবেশনায় হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য ব্যাঙ্গময় হয়ে আছে। নিজের জীবনকে দিয়ে, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও জানাশোনাকে নিয়ে তিনি মুগ্ধ রাখেন পাঠককে, আদায় করে নেন সমীহ। ক্রমশ পরিবর্তনশীলতার মধ্যে দিয়ে হাসান আজিজুল হক কথাসাহিত্যে আঁকেন মানুষের জীবন, জীবনের গভীরতম সংবেদ। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘শকুন’-এ প্রমাণ দেন তার দৃষ্টিশক্তির, অনেক দূরে যাওয়ার অভিপ্রায়কে তিনি বাস্তবে রূপ দেন—বাংলা কথাসাহিত্যে পোক্ত করে নেন নিজের আসন।
‘শকুন’ গল্পে দিনের আলোয় ফিরতে বাড়ি ফিরতে না পারা, আটকে পড়া একদল গ্রাম্য কিশোরদের সংলাপের মাধ্যমেই এগিয়ে যায়। গ্রাম্য নানা কিসিমের বালকেরা মিলেমিশে যা করে—দুষ্টামি, হৈহুল্লোড় এসবের কেন্দ্রিয় চরিত্রে থাকে একটি শকুন। বালকেরা নানান কথা বলে, মন্তব্য করে। হাসি-তামাশার মধ্যেই আবর্তিত হয় শংকায় ভরা সময়টি। সময় যেতে থাকে, গড়িয়ে বাড়তে থাকে কৌতূহলের পরাকাষ্টা। একেবারেই গ্রামের ছেলে—নিবিড় বৃক্ষঘেরা, ঝোঁপেভরা নির্জনে ছেলেরা অসহায় শকুনকে তুলনা করে মহাজনের সাথে। হয়তো লেখক কিশোরদেরই চোখে শ্রেণি-বিভাজনের ব্যবধান উপড়ে ফেলতে চান শকুনের পালক তুলে ফেলার মাধ্যমে। তবে কি শোষকেরা শেষপর্যন্ত লাঞ্চিত হয় শোষিতদেরই উত্তরাধিকারে? মানুষের বিজয়কে, তৃণমূল পর্যায়ের ভাবনাবলয়কেই হাসান আজিজুল হক ‘শকুন’ গল্পে বিধৃত করেন মূলত। পাঠক হয়তো চমকে যাবে গল্পপাঠে, এই কি তবে শকুন গল্পের পরিণতি? কিংবা শকুনমার্কা সমাজ ব্যবস্থার? এক সময়, হয়তো কৈশোরিক উন্মদনা শেষে, শকুনটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় রেখে বালকেরা ফিরে যায় বাড়ি। যাওয়ার পথে, রাতের প্রায় অন্ধকারে বালকেরা আবিষ্কার করে জমিরদ্দি ও কাদু শেখের বিধবা বোনকে। তারা বিধ্বস্ত, অনেকটা ক্লান্ত, বাড়ি ফেরার তাড়ায় আচ্ছন্ন—হয়তো বয়সে বড়ো একজনকে সে সময় দেখতে প্রস্তুত ছিল না, দেখেও আগ্রহ দেখায়নি—যেমনি দেখায় না বুর্জোয়ারা চলমান নিচুশ্রেণির বাস্তবতাকে।
ন্যাড়া বেলতলা থেকে একটু দূরে প্রায় সকলের চোখের সামনেই গতরাতের শকুনটা মরে পড়ে আছে। মরার আগে সে কিছু গলা মাংস বমি করেছে। কত বড় লাগছে তাকে! লেখকের ভাষায় বালকের দল সকালে রোদের আলোতে দেখতে পায় গতরাতে তাদেরই হাতে প্রহৃত শকুনটিকে। অসহায় আত্মসর্মপনের চিত্র এরচেয়ে নিবিড় হয় কীভাবে? দলে দলে শকুন নেমে আসে—শকুন তো আর শকুনের মাংস খায় না, তাহলে? মূলত শকুন গল্পের গোপন-মোড়টা এখানেই অপেক্ষা করে পাঠকের জন্যে—মরা শকুনটার পাশে পড়ে রয়েছে অর্ধস্ফুট একটি মানুষের শিশু, তারই লোভে আসছে শকুনের দল। পানিতে—প্রায় নির্জনতায় শকুনটি  মরে আছে, সেখানে কেনইবা আসবে মানুষের সন্তান? লালসার কঠিন জিহ্বাটি সংবরণ করতে পারে না কতিপয় মানুষ; বিশেষ করে—নারীকে যে সমাজ পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারে না, ব্যবহার করে পণ্য হিসেবে। বুকের ভেতরের হাহাকারে কাদুশেখের বিধবা বোনকে জলাঞ্জলি দিতে হয় রাতের আঁধারে, ঝোপের নির্ভরতায়, শকুনেরই পাশে! সামাজিক রীতিকে অস্বীকার করবার যোগ্যতা হয়ে উঠেনি আমাদের মানসে কিংবা রিপুকে সংবরণ করতে না পারলেও ভয় পাই সমাজকে, সমাজস্থিত আত্মমর্যাদাকে মোটাদাগেই ধিক্কার দেন গল্পকার। স্বাভাবিক ঔসুক্যে সবাই দেখতে আসে মরা শকুন, মানুষের সন্তানকে; বালকদের চোখ কেবলি পায় না কাদুশেখের বোনকে। প্রসুতির বেদনা নিয়ে হয়তো সে নিজেকে লুকায় পার্থিবতার দেয়াল থেকে কিন্তু তাকে তো ঠিকই ফ্যাকাশে দেখায় দিনের আলোতেও! বিধবাবোনের পরিণতি বাংলার সমাজে এখনো বরণ করে নেয় অনেকেই—নিজেরই অবহেলায়, অসচেতনতায় কিংবা লোকরীতির ধারালো অপবাদের কারণে। মানুষ না জাগলে—অনেক বছর আগে লেখা গল্পকে ডিঙাতে পারে না অনেক উৎকর্ষতার কল্যাণে পরিবর্তিত হওয়া এই সমাজ।  
হাসান আজিজুল হক নিজেই শকুন গল্প সম্পর্কে জানান—এখনো অনেকে বলেন যে আমি শকুন গল্পটি অতিক্রম করতে পারিনি। তার পরে কতো কিছুতো লিখলাম। এই সূত্রপাতের পরে আমি গল্প লিখতে শুরু করলাম। মহৎ লেখকদের অনেকেরই জীবনে এ অভিজ্ঞতা নতুন নয়; শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রথম সৃষ্টি অবশ্যই দিক-নির্দেশন করতে সমর্থ হয়—আসলেই কী হতে যাচ্ছে। হাসান আজিজুল হকের গল্প-ভাষা সম্পর্কে বর্তমান লেখার শুরুতেই স্বয়ং হাসান আজিজুল হকের উদ্বৃতিসমেত দেখতে পাই। চমৎকার কাব্যভাষায় মোড়া তার গল্প-জগৎ। শকুন গল্পের উদ্বৃতি দিয়ে আমরা দেখি—গোটানো ঘুনবুনুনির পালক মেলে গেল। বুনট যেন পাৎলা হয়ে এল। স্তরে স্তরে সাজানো পালক পাশাপাশি চওড়া হয়ে কারকিত করা গালিচার মতো বিছিয়ে গিয়েছে তার পালক। এখন তাই অনেক ফাঁক। পাশাপাশি পালক অনেক ছিটেনো ছিটেনো। দুই ডানা অসহায়ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আত্মসমর্পন করল শকুনটা।  ভাষার বিভায় তার গল্প হয়ে উঠে অনন্য, দীর্ঘ সাহিত্যজীবন পেয়ে খুব বেশি না লিখেও হাসান আজিজুল হক তার অন্বিষ্ট, শ্রম-অধ্যয়নলব্ধ গল্পচর্চার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম উদাহরণ রেখে যান বাংলা কথাসাহিত্যে। বিশদ ও বিশ্বস্থভাবে প্রকৃতি বর্ণনা, জন্ম-মৃত্যুর প্রসঙ্গ, সমাজকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করা তো আছেই, দেশভাগ-মুক্তিযুদ্ধ এমন হৃদয় দিয়ে আর কজন দেখিয়েছেন বাংলা কথাসাহিত্যে? হাসান আজিজুল হক জীবনের জয়গান গেয়ে যান তার সৃজনে—শকুন গল্পে কাদুশেখের বিধবা বোন হয়তো শারীরিক চাহিদা মেটাতে অথবা কারো জোর-জবরদস্তিকে নিজের ভেতর ধারণ করেও সময় শেষে পরিণতিটুকু বিসর্জন দেয় ঝোঁপের আড়ালে, রাতের আঁধারে। রাতের আঁধার কি তবে মনের আঁধার লুকাবার জন্যেই? মূলত মানুষ লোকরীতিকে উপেক্ষা করবার শক্তি অর্জন করতে না পারলেও অনেকটা নিষ্কলুষ জীবন যাপন করার ভাব দেখাতে চায়, এ প্রেক্ষাপটই বিধৃত হয় শকুন গল্পে; তা-ও জীবনের জন্যে, নিজের জীবনের পরিষ্কার একটা অবয়ব দাঁড় করাতে। হাসান আজিজুল হক তবুও দেখাতে চান জীবনের নানা দিক। তিনি যেমন মনে করেন—মানুষ জন্মায়, মরেও যায়। এই দুইয়ের মাঝের সময়টায় খুবই দাপাদাপি করে। লেখকদের যতো আগ্রহ তার প্রায় সবই এই মাঝের অংশটা নিয়ে—জীবন যার নাম। আর কোনো কিছুর মূল্য আছে কি নেই, জীবনের কষ্টিপাথরেই তার যাচাই। হয়তো এ দর্শন থেকেই, পোড়খাওয়া ইতিহাস থেকে সত্যের আঁকরটুকু নিয়ে হাসান আজিজুল হক আমাদের শুনিয়ে যান জীবনের কথা। শকুন গল্প দিয়ে শুরু হওয়া এ সাধনা এখনো অব্যাহত রেখেছেন হাসান আজিজুল হক তা এক ধরনের বিস্ময়ও বটে। তাকে শ্রদ্ধা, তার কথায় জেগে থাক, জীবন্ত হয়ে থাক মানুষের জীবন!

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না