একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে মাসুদুজ্জামানের ‘নির্বাচিত কবিতা’। প্রকাশ করেছে ‘চৈতন্য’। মূল্য ২০০ টাকা।
চিৎকার করো মেয়ে…
চিৎকার করো মেয়ে। সুতীক্ষ্ণ কামড়। ছোট্ট একটা সুইং। বাঁক নিয়ে ঢুকে গেল তোমার শরীরে। গ্যালারিতে যারা জয়ী হচ্ছে বলে উল্লাস করছে তাদের কেউ কেউ শিশ্নজীবী। তোমাকে নিয়ে খেলছে। তোমার শরীরে অসংখ্য আগুনের সূঁচ। স্নায়ু দিয়ে শির শির বয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। মনোলীন ব্যাট দিয়ে স্বর্গীয় বলটাকে এবার ৯৮ মিটার দূরে গ্যালারিতে আছড়ে মারো। ছক্কা। যারা শরীরজীবী তাদের উরুসন্ধিতে চালাও ধারালো ব্লেড। মিড উইকেটের ওপর দিয়ে কী মসৃণ পুল। আত্মরক্ষার মিহি ইস্পাত।
শুধু কি পুরুষ? নারীরও প্রণয়ের রাবীন্দ্রিক ফাঁদ আছে। মুঠো মুঠো পিল গলাঃধকরণ করে নাভিচক্রে ঘুরতে ঘুরতে পুরুষের শরীরে ছোবল দেয় রোমশ নিঃশ্বাস। কোহলির ম্যাজিক্যাল শট। তামিমীয় তুণ। স্বামীপ্রবরের সঙ্গে সহবাসের সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে প্রেমিকের দিকে লালা জড়ানো মিথুন ইয়র্কার ছোঁড়ে। নিজের দিকে জোর করে প্রেমিককে টেনে নেয়। আত্মঘাতী রান আউট হয়ে ফিরতে ফিরতে জিঘাংসার জুপকাষ্ঠে নিজেরই হৃৎপিণ্ড শূন্যে ঝুলিয়ে রাখে। ব্যাটে-বলে না হতেই আম্পায়ারের আঙুল উঠে যায় শূন্যে– বোল্ড!
চিৎকার করো মেয়ে। গলা চিরে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হোক। শ্লগ ওভার। তিন বলে দুই রান। শক্ত চোয়াল, স্তন, অগ্নিপিণ্ডের মতো উইকেট লক্ষ করে ছুঁড়ে দাও। বাউন্সার। মাথা বরাবর ছুটে আসতেই ব্যাট ফসকে কীপারের হাতে ক্যাচ। গ্যালারিতে এবার নারী দর্শকের প্রচণ্ড উল্লাস।
চিৎকার করো মেয়ে। পুরুষেরা পুরুষতান্ত্রিক প্রেতজীব। তুমি ছলাকলার অন ড্রাইভ দিয়ে আ্উট হবার পরিবর্তে শেষ বলে শেষ রানটা করো। আহা, কী টেনশন। তনু…এইতো সেই ম্যাজিকাল শট আর স্নায়ুক্ষয়ী রান। পুরুষেরা উড়ে গেল।
একরান…একরান…জীবন জয়ের গান।
তেপান্তর
-অতল তুমি চলেছো কোথায়? নিশিথের রোদনভরা বসন্তের পাতাঝরা গন্ধ নিয়ে কেনই-বা এলে, আবার কেনই-বা চলে গেলে! এখন কোথায় তোমাকে খুঁজে পাবো!
-ওই যে তোমার শিঁড়দাড়া বেয়ে কুয়াশা নামছে, সেই কুহকপথ ধরে শরীরদীঘিতে নেমে দেখ। শরীর তো এক অচিনপুর, তুমি তার দাহ্যপ্রবণ দগ্ধ পুরুষ, ওখানেই খুঁজে পাবে।
-খুঁজেছি, তর্পণের ছলে তোমার চিবুক ছুঁয়ে দেখি কী ঠাণ্ডা, হিমবাহ, অনুরাগের জলজ আর্তনাদ। কবে তুমি রৌদ্রালোকে এসে দাঁড়াবে?
-সূর্য যদি দেবতা, তুমি তবে আলোর তস্কর। আমাকে অন্ধকারের তরঙ্গে ভাসিয়ে কোন তেপান্তরে নিয়ে এলে, যেখানে দীঘির অতলে রাক্ষসের প্রাণভোমরাটা লুকানো আছে!
-কিন্তু এতো এক অসীম ভূতল। অভিকর্ষের শেষ প্রান্ত। মাধ্যাকর্ষণরহিত পৃথিবীতে টলছে মানুষ। যাবতীয় বস্তুপুঞ্জ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মহাশূন্যে। দৃশ্যপট অনিত্য, ভারহীন, মানুষেরা মহাশূন্যে ভাসমান। উচ্ছ্রিত সমুদ্রতরঙ্গের শীর্ষে দুলছে অথবা পাহাড় চূড়ায় গেঁথে যাচ্ছে।
-হাত ধরো তুমি, অন্ধকার, অতিকায় ঝড়ের তীব্র নখরে ছিন্ন কর ছায়া, পাথরের ফেনায় ফেনায় পুষ্ট আর জেগে ওঠা দেও-দানোদের সামাজ্য ছাড়িয়ে আমাকে আনন্দধামে নিয়ে চলো।
-স্বপ্ন তোমার চিহ্নহীন কিউবিক, জীবনবৃ্ত্ত আঁকা হবে না তোমার।
-সূর্য যদি দেবতা, আমি তবে আলোর তস্কর। তোমাকে অন্ধকারের তরঙ্গে ভাসিয়ে তেপান্তরের দিকে নিয়ে যাব, যেখানে দীঘির অতলে তোমার প্রাণভোমরাটা লুকানো আছে!
অকথিত ক্ষতের ভিতরকাহন
দুঃখদিনের নদীগুলি এরকমই ছিল। কারো কারো অশ্রু আমার আত্মার ওপরে
ঝরে-পড়ার মুহূর্তে সমস্ত জীবন দিয়ে আমি তাকে শুষে নিয়েছিলাম। ওরা ছুরি
চালাতে চালাতে আমার কণ্ঠনালি চেপে ধরতো। খুব বেশি শব্দ হতো না, কিন্তু
ঝুরঝুর করে পাড় ভাঙতো। আসলে সেগুলি ছিল ভেতরনদীতে বহমান এক-একটি
জটিল তরঙ্গ। জলের ঘূর্ণিপাকগুলি আমাকে টেনে-হিঁচড়ে পাতালে নিয়ে যেতো।
এরই মাঝে এক কাঠুরিয়া-বৌ পরম মমতায় আমাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু
কুঠারের মতো গজরাতে গজরাতে দুই-দুইবার তরঙ্গ তুলে কাঠুরিয়া যখন আমাকে
আঘাত করে বসলো আর ওই কাঠুরিয়া-বৌ কারো কারো সঙ্গে যুক্তি করে টুকরো
কাঠের মতো আমাকে জলন্ত চুল্লিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মারতে চাইলো,
তখনই মনে হলো ওই ছায়াসবিতার কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে মেঘের ভেতরে
গিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে। কাঠুরিয়া বৌয়ের চোখে তবু আমি দেখেছিলাম
পাতাঝরা বিষণ্নতা। আজও আমি সেই অপার্থিব চোখ দুটি ভুলতে পারিনি যা ছিল
মেঘেঢাকা নক্ষত্রের মতো অনুজ্জ্বল, দীপ্র, আকাশের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে তূতলে
পতিত আমার শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সবুজ রোদ্দুর।
আবর্তন
আমার জন্মের আগে পৃথিবীটা নিঃশব্দে
লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল
আমার জন্মের পর পৃথিবীটা উন্মত্তের মতো
জেগে উঠলো
ঘড়ির কাঁটার মতো মানুষ কেবলি অন্তহীন, অনিঃশেষ,
আবর্তিত…
সারাটা জীবন ১ থেকে ১২ সংখ্যাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে
এই মানুষেরই কিছু স্বপ্ন থাকে, থাকে একাকীত্ব, ঘুম,
থাকে ভালোলাগার মতো পুরুষ অথবা নারী
যতই সে জীবনের দিকে এগোতে থাকে
ততই সে একটু একটু করে শূন্য হয়ে যায়
কবি
লোকটার ধারালো জিভটা স্নিগ্ধ, কিছুটা মসৃণ
শব্দগুলি হিম বরফকুচি ছড়ানো ফসিল
ত্বকে মৃদু রোমহর্ষ নিয়ে সারক্ষণ জেগে থাকে
রাত্রির আকাশে ফুটন্ত নক্ষত্রে চোখ ডুবিয়ে
দূর থেকে পৃথিবীটাকে দেখে
হৃদয় কার্তুজ শীত ভেঙে-পড়া নৈশবিদ্যালয়ে
যে পার্পেল মেঘমালা পাঠ্য এই প্যাগোডার দেশে
অধিকন্তু রুটি ঝর্ণা ঘুমের জিরাফ হেঁটে গেলে
টলতে টলতে সে এসে বসতো নৈঃশব্দ্যের পাশে
নারীবন্ধুদের দিকে উড়ে আসতো রুপোলি রুমাল
তাতে লেগে থাকতো রৌদ্র আর সমুদ্রের ঘ্রান
পুরুষবন্ধুরা তার দিকে থুতু ছুঁড়ে দিত
এভাবেই তার দিন কাটাতো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে
কোনো দিন কেউ তাকে ঘুমুতে দেখেনি