জ্যঁ লুক গোদারের ‘ফিল্ম সোশ্যালিজম’ (২০১০) ম্যুভিটি শেষ করেছেন অস্পষ্ট এই কথাটি দিয়ে ‘নো কমেন্টস’। আর ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবের প্রেসনোটে স্বনির্মিত সাক্ষাৎকারটি (‘সিউ রাই’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত) ১৭ মে সোমবার ২০১০ সালে পুনমূদ্রিত হয়; সেখানে তিনি প্রশ্ন করেছেন :
দ্য ফ্যাঁ : আর ‘কেন’ শব্দটা?
গোদার : জন্মের পর, শিশু শব্দমালা ব্যতিরেকেই কথা বলে, সেই কথা কীভাবে জন্ম হয় শিশু মনে? তা নিয়ে ফ্রয়েড চর্চা করেননি। একা জীবজন্তুরাই সে ভাষার দায়িত্ব নেবে।
দ্য ফ্যাঁ : তা হলে জ্যামিতি?
গোদার : পিরামিডের ভাষাটা ইউক্লিড ধরতে পেরেছিলেন, আরিস্টটল পারেননি।
সত্যিই তো, যাঁর কবিতাকে লাশকাটা ঘরের টেবিলে রেখে বিশ্লেষণ করতে বসেছি, তাঁর শব্দবিশ্ব, চিত্রবিশ্ব, কল্পনাবিশ্ব, নন্দনবিশ্ব কীরূপে জন্ম হয়; তাঁর যাপিত জীবনের ইতিহাস, অভিজ্ঞতার সারৎসার কতটুকু জেনেছি? যে অনির্বচনীয়কে জহর সেনমজুমদার পাঠকের কাছে পৌঁছতে গিয়ে পরাবাস্তবতা, ফ্যান্টাস্টিক রিয়ালিটি কিংবা জাদুবাস্তবের অসম্ভবের রাজ্যে স্বীয় অভিজ্ঞতায় লিপিবদ্ধ করেন; তার প্রবেশ ও প্রস্থানের মধ্যবর্তী পৃষ্ঠাগুলি পাঠ করে কতটুকুই বা উপস্থাপন করতে পারবো পাঠক সম্মুখে, জানি না; তবে এতটুকু উপলব্ধি করছি, আমি ফ্রয়েড, ইউক্লিড কিংবা আরিস্টটল নই, কিন্তু কবি যে আলোর খোঁজে, ‘ভবচক্র; ভাঙা সন্ধ্যাকালে’ চারাগাছ হাতে ‘নিজেরই মৃত দেহ কাঁধে’ নিয়ে চলেছেন, এলিয়টীয় ঐতিহ্য আর নিজস্ব সৃজন ক্ষমতায়; ইতিহাসকে ধারণ করে কোনো এক স্বপ্ন-জাগানিয়া দারুচিনি দ্বীপের সন্ধানে; ঘোর অমাবস্যার অন্ধকারে তাঁর এই পথচলা, সত্যিই তিনি নিঃসঙ্গ, একা। কবি ছোট-ছোট আগুনের নদী পার হচ্ছেন এক-এক করে; আন্দ্রে তারকোভস্কির মতো সময়কে উপলব্ধি করতে-করতে বর্তমানের অগ্নিদগ্ধ চোখকে অনুভব করে ভবিষ্যতকে অনুধাবন করার প্রয়াসেই জহর যেন অতীতকে বিশ্লেষণ করে চলেছেন, ইতিহাসকে গ্রহণ করেছেন অনিবার্যতায়। তারপরও আমরা দেখতে পাবো একটা আগুনের নদী পার হয়ে আর একটা আগুনের নদীর একপাড়ে একটি দ্বীপে দাঁড়িয়ে বিপন্ন এক কবি, সামনে অগুণতি আগুনের নদী, পেছনে তার বানানো একাকী সরু পথ; সেই পথে কেউ-কেউ হেঁটে নিজস্ব পথ খুঁজে নেবেন আপন মহিমায়, হয়তো আগামী প্রজন্ম পূর্বপুরুষের খোঁজে হাঁটবেন, খুঁজবেন মিউজিক রুমের নভ, স্বর্ণালি আগুনের দগদগে হাওয়াই তার, সাউন্ড, সুর, তাল, লয়, সর্বোপরি লাইট।
এমন নিঃসঙ্গ পথিক সম্বন্ধে হয়তো জীবনানন্দ নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে কথা বলেছেন তাই শিরোধার্য, ‘সাহিত্যের বড় বাজারে আমার কবিতা কাটে বলে মনে হয় না, তবে যে বাজারে কাটে সেখানে গ্রহীতার সংখ্যা ঢের কম।’ (চিঠিপত্র, ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৪৫, সর্বানন্দ ভবন)
সত্যিই এই কবিতার পাঠক হাতেগোনা; যদিও কবিকে পাঠকের বুদ্ধি ও কল্পনাকে উসকে দিতে হয় সাবলীল বাক্-ভঙ্গিমায়, যদিও জহর সাবলীল বাক্-ভঙ্গিমার চেয়ে নিরীক্ষাপ্রবণ ভাষা-মন নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হতে পছন্দ করেন। কবি বোধকে জাগিয়ে তোলেন কল্পনাতীতভাবে, স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্নস্রষ্টা এই কবি পাঠকের মনোরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে কবিতা লেখেন না। জহরের লেখার মধ্যে নিহিত আছে এক মহান বিনষ্টির বোধ মূলগতভাবে আশাবাদী বটে কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে কবি নিজে হয়ত বিয়োগান্ত।
যদিও একরৈখিক মনে হবে ১৫টি কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষে একটি কাব্যগ্রন্থই পাঠ করছি বলে আন্দাজ হতে পারে পাঠকের; একথা মান্য করেই বলছি, প্রশ্ন জাগতে পারে মানুষের জীবন যদি ২৪ ঘণ্টার হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টায় মানুষ কতক্ষণ ফ্যান্টাসিতে থাকে? কতক্ষণ স্বপ্ন দেখে? কতক্ষণ ঘুমায়? কতক্ষণ কাজ করে? কতক্ষণ আরাধনা করে? কতক্ষণ যৌনকর্ম করে? কতক্ষণ বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ায়? আরো কত-শত প্রশ্ন সংগতভাবেই করা যায়। সেখানে জহর সেনমজুমদারের কবিতা দ্বিধাগ্রস্ত বা সংশয়াপন্ন কিন্তু সংযোগের জন্য উন্মুখ, বিষয়ের একমুখিনতা বর্ণনার পরোক্ষ ও বহুমাত্রিক রীতিতে জটিল-জটিলতর হয়ে পড়ে তাঁর কবিতা; বিষয়ের বাহুল্য ও জটিলতায় আর বর্ণনার পরোক্ষ ও বহুমুখী রীতিতে একই সঙ্গে জ্যঁ লুক গোদারের ফিল্মের মতো জটিল কিন্তু পাঠকের কাছে চ্যালেঞ্জিং। জহরের কবিতা পাঠ করতে করতে ডেনমার্ক নিবাসী সোরেন কিয়ের্কেগার্দের (১৮১৩-১৮৫৫) কথা মনে পড়বে :
I stick my finger into existense- it smells of nothing. Where am I? What is this thing called the world? Who is it who has lured me into the thing, and now leaves me here? Who am I? How did I come into the world? Why was I not consulted?
অস্তিত্বের অর্থহীনতা কবিকে বিশেষ করে ব্যক্তি মানুষকে ভরিয়ে তোলে উদ্বেগ ও হতাশায়, আশাহীনতার বোধে ও গভীর বিষণ্নতায়। নিরাশার দোলাচলে সসীম-অসীমের সংশ্লেষে পৌঁছতে না পারার অক্ষমতা থেকে কবি লিখে চলেন তাঁর কল্পবাস্তবের ভাষ্য, তার প্রজ্ঞালিপি—
ক. তুমি সখা, বর্ষাবিজড়িত, মরা প্রেমিকার পিঠে ওংকার দাও, মরা প্রেমিকের চোখে
শ্রী ও শৃঙ্গার দাও, মৌমাছির মৌচাক ক্রমশ উল্টে পড়ে...
(বর্ষাবিজড়িত)
খ. মায়ের পেটের ভিতর রতিগাঢ় ফড়িঙ ওড়ে, গোপিকাগণ ময়ুরীর মতো যেন
লীলামৃত আস্বাদন করে, তুমি শুধু হরণ করো, কোনোকালে বিবাহ করো না
(ডোরাকাটা বাঘছাল)
গ. এত মৃত্যু কেন? এত বন্ধন কেন ? গাধারাও যৌনবাক্স দংশন করে
তোমার অস্থায়ী পথে একটি বাচ্চা মেয়ে আজও বিড়ালের লেজে মিশে আছে
(তামসিক কালপ্যাঁচা)
ঘ. আমাদের চক্ষুর ভিতর মউচাক, পোষা খরগোশ ঋতুবন্ধ জ্যোৎস্নায় কাঁদে
আমরা সে কান্না শুনেছি বহুবার, দেশলাইবাক্সের ওপর বসে এই মহাবিশ্ব
প্রতিদিন ভাগ করি আমরা, ...
(মনে হয় মউবিজ্ঞানী)
ঙ. ... তুমি চিরকাল মূলাধারে ক্রমাগত
কাঁকড়া ও কবীরের জন্ম দাও, আমরাও জলপাই লণ্ঠন জ্বালাই, মনে হয়
পৃথিবীর শস্যক্ষেত থেকে ময়ূরের কুটিরশিল্প নিয়ে তোমার বংশীবাদক এখনই আসবে
(তোমার পদছাপ)
‘মায়ের পেটের ভিতর রতিরাগ ফড়িঙ ওড়ে’ এই বীর্যপাতের বাস্তবতা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ফড়িংয়ের অ্যাবস্ট্রাক্ট চিত্রকল্পে, কিংবা ‘কাকড়া ও কবীরের জন্ম’ প্রাণী জগতের তুচ্ছ একটি জীবের সঙ্গে মধ্যযুগের ঋষি কবি ‘কবিরে’র জন্মবৃত্তান্ত কীভাবে কত সহজেই কবিতায় ধারণ করেন; মহাজাগতিক এই খেলায় জহর যে ভবচক্রের নতুন সেতু নির্মাণে আগ্রহী; সেখানে আসলে কোনো তত্ত্ব নয়, জ্যঁ পল সার্ত্রীয় অস্তিত্ববাদ কিংবা পরাবাস্তবতা নয়; পিকাসো যেমন বলেন, অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে কিছু নেই, থাকতে পারে না, আমি বাস্তবতাকে পুনর্নিমাণ করি, তেমনি জহরও যেন পিকাসোর সুরে তার কবিতায় বলেন—
‘Every one wants to understand art why not try to understand the songs of a bird? Why does one love the night, flowers, everything around one, without try to understand them?’
এমন চিত্রকল্পের উপর চিত্রকল্প, এমন দৃশ্যরূপের উপর দূরান্বয়ী দৃশ্যরূপ নির্মাণ করে চলেন জহর আপন মহিমায়। প্রস্তুতি না নিয়ে সাধারণ পাঠকের প্রবেশ নিষেধ এমন আগুনের মিউজিক রুমে।
‘জনৈক ঈশ্বরের বাণী’ (১৯৭৮) থেকে ‘ভবচক্র; ভাঙা সন্ধ্যাকালে’ (২০১৫) পর্যন্ত মোট ১৫টি কাব্যগ্রন্থ পড়তে- পড়তে পাঠক এক ঘোরগস্ত ম্যাডনেসের ভেতর থেকে নিজেকে আবিষ্কার করবেন হারানো অখণ্ড বাংলার বর্তমান ভাঙা রূপের, খণ্ডিত-ক্ষয়িষ্ণু উর্বর কৃষিক্ষেতে; খুঁজে পাবেন পয়ার, মহাপয়ারে বেশির ভাগ কবিতা, নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরায় চর্যাপদে, মঙ্গলকাব্যে, নাথসাহিত্যে, ইউসুফ জোলেখায়, ময়মনসিংহ গীতিকার লৌকিক কোলাহলে, লোরচন্দ্রানীতে সর্বোপরি জীবনানন্দের ইস্কুলে; ‘এই ক্রমজায়মান চলার মধ্যে সর্বব্যাপ্ত বীজ ও শিকড় সন্ধানের আকাঙ্ক্ষা ও প্রবণতা রয়েছে’; জহর স্বীকার করেছেন ‘চিত্রক কবিতা পত্রিকা’-২০১৭ সালে দেয়া সাক্ষাৎকারে; আরো বলেছেন, ‘নিজেকে চিনব কি করে? বুঝব কি করে? পরম্পরাগত ভৌগোলিক অবস্থান চিনতে ও বুঝতে এই আত্মভ্রমণ, এই অন্তর্গত যোগস্থাপন একান্ত জরুরি; আমাদের জীবন তো সাময়িক ও সমকালীন এই সাময়িক সমকালীনতা থেকে চিরচলমানতায় পৌঁছোতে হলে পরম্পরাগত প্যাঁচা, হিজলগাছ, শঙ্খমালা বা দারুচিনি দ্বীপের ভেতরটাকে প্রচ্ছন্ন পুনর্নিমাণ করতে হবে; এই ক্রমান্বয় চৈতন্যভাবনায় শাক্ত ও বৈষ্ণবের মিলন করি আমি; এই ক্রমান্বয় চৈতন্যভাবনায় বাউলতত্ত্ব ও ভৈরবীসাধনার সংযোগ করি আমি; করতে করতে অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের একটা চলমান সাঁকো আমার সামনে তৈরি হয়ে যায়; সেই সাঁকোর ওপর চলমান মানবাত্মার মতো, আবহমান মানবাত্মার মতো, দাঁড়িয়ে থাকি আমি;... শুধু লিখে যাই আর বহুরৈখিক চেতনায় চর্র্যাপদ থেকে চৈতন্যদেবে, জয়ানন্দ থেকে জীবনানন্দে বারবার সময়ের স্তর স্তরান্তর ভেদ করে প্রাণ ও প্রাণীর মতো ঢুকে পড়ি—ঢুকে নয় ঢুকে নয়—প্রবেশ করি; এভাবেই দেশ কাল—চেতনাসম্পৃক্ত এক আশ্চর্য কৃষিক্ষেতে বীজ আর শিকড় নিয়ে বার বার নিজেকে নানা রূপে নানা মূর্তিতে বসাই—বসাতে থাকি।’
দেরিদীয় এই বিনির্মাণের ফলে জহরের কবিতা জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে, প্রকৃত রস আহরণে প্রাজ্ঞ পাঠককেও কবির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয় অর্থাৎ কবির চিন্তা-মনন-অনুভূতির সঙ্গে মিশে গিয়ে একটা ধারাবাহিক সুসংবদ্ধতা গড়ে না তুললে জহরীয় ভুবনে প্রবেশ দুরূহ হয়ে ওঠে।
জহরের নিজস্ব ভাষা অন্বেষণ আর পাঠকের তাঁর কবিতায় প্রবেশ নিয়ে ভাবতে ভাবতে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তৃতীয় বিশ্বের পুরোধা মেক্সিকান কবি অক্টাভিও পাজের একটি উক্তি : ‘কবিতা আজকাল আর তেমন জনপ্রিয় মাধ্যম না হলেও মানব জীবনের জন্য কিন্তু অবশ্য প্রয়োজনীয়। কবিতা না থাকলে একটি জাতি ভালো করে কথাই বলতে পারতো না। কবিকে অবশ্যই সমাজের সমালোচক হতে হবে। আমরা একা হয়ে জন্মাই কিন্তু আমাদের প্রধান কর্তব্য একে অন্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া, একাত্মার এই আকুতি অন্যদেরকেও জানাতে হবে। ভাষা জনগণের সম্পদ আর কবি এই সম্পদের অভিভাবক।’
এখন শ্রুতিপদ্যের যুগ নয়, তাই জনপ্রিয় মাধ্যম না হলেও ভাষার অভিভাবক প্রকৃত কবিই। আর এই প্রকৃত কবির খোঁজ পেতে জনগণকেও দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। জহরের স্বতন্ত্র ভাষা অন্বেষণ বিষয়ে বলতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় ভাষার মধ্যে তাঁর যে কর্তৃত্ব স্থাপন তা হয়তো রূঢ়-কঠিন বাস্তবতার অভিঘাতেরই নিষ্ঠুর ফসল। এ ব্যাপারে আমার একটি ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ আছে; নদীর গতি পরিমাপ করা সম্ভব, জলের ধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, কিন্তু স্তব্ধ চাঁপাগাছটি যে গন্ধ বিলায়ে যাচ্ছে তন্দ্রাচ্ছন্ন সকাল-সন্ধ্যা থেকে রাত-ভোর পর্যন্ত সে কথা ক’জন মনে রাখেন। ক’জন মনে রাখেন বৃক্ষটি শুধু সুগন্ধই দেয় না অক্সিজেন বিলাচ্ছে সারাক্ষণ, সচলভাবে অবিচল দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে? কবিও ঠিক ভাষার ভিতরে এমনই সচল কারুকর্ম করে চলেন গোপনে, প্রকাশ্যে-অন্তঃস্রোতে-নির্জনে, যা সাধারণের চোখে ধরা পড়ে না—যেমন ধরা পড়ে না অচল থাকা চাঁপা তরুর স্নিগ্ধতা। একজন প্রকৃত কবি ভাষাকে নতুনভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। প্রচল ভাষার ভিতরে-বাইরে নতুন পাতার মতো ঘোষণা করেন তার আপন অস্তিত্ব। শুধু আকাশের মতো বিশালতা নিয়ে দু’একজন পাঠক কবির নিজস্বতা বুঝতে পারেন, নীরব তারারা অলক্ষ্যে উপলব্ধি করে যায়। আর এই স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার ব্যাপার নিয়ে পূর্বতনকে খারিজ করার প্রবণতা রবীন্দ্রকাল থেকেই শুরু। রবীন্দ্রনাথ বয়ঃসন্ধিক্ষণে অনাস্থা এনেছিলেন মধুসূদনের প্রতি, ভাষা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছিলেন। কল্লোলীয়রা স্বেচ্ছায় রবীন্দ্রবিরোধিতায় নেমেছিলেন, পঞ্চপাণ্ডবরাও কম জাননি রবীন্দ্র-কবিতার সৎকারে। বুদ্ধদেব প্রশ্ন তুলেছিলেন কৃত্তিবাসীয়দের বিশেষ করে পঞ্চাশের শঙ্খ, সুনীল, শক্তি, বিনয়ের ছন্দ-শব্দের ব্যবহার নিয়ে। প্রশ্ন তুলেছিলেন এদের কবিতা হয় কি-না। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী প্রমুখ পূর্ব বাংলার মুসলিম সাহিত্যচর্চার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্যের নিজস্ব আধুনিক ভুবন। এটাই কালের স্বাভাবিক নিয়ম।
জহর সেনমজুমদার বাংলা কবিতার চিরায়ত ছন্দ পয়ার ও মহাপয়ার ব্যবহারে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তেমনি ফ্রি-ভার্স ও মুক্তক অক্ষরবৃত্তে তাঁর পদচারণা লক্ষণীয় কিন্তু প্রচলিত প্রবোধ বাবুকৃত ছন্দে কেন যেন তার মনোযোগ নেই, অনীহা। কিংবা বলা চলে জীবনানন্দের মতো বিদ্রোহ করে তৈরি করলেন নিজস্ব চলার ছন্দ; জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র আলোচনায়, ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় আবুল হোসেন যেমন লিখেছেন ‘কৃষিভিত্তিক দ্বন্দ্ব’; তেমনি জহর সেনমজুমদারের অধিকাংশ কবিতার এই ছন্দকে পয়ার, মহাপয়ারের ‘বাংলার চিরায়ত ছন্দ’ তকমা দিব? তাছাড়া তাঁর সমকালে তাঁর সময়ের কবিরা তাঁকে গবেষক হিসেবে দূরে সরিয়ে রাখতে চান, ভয় পান তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ কবিতার জগতকে। বুঝে শুনে বহুব্যবহৃত ছন্দ-শৃঙ্খলা এড়িয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে ‘চিরায়ত বাংলার ছন্দে’ চলতে চাইলেন নিরীক্ষাপ্রবণ জহর। ‘বাংলার কাব্য’ গ্রন্থে হুমায়ুন কবির লিখেছেন,
‘দেশজ ভাষার সম্ভাবনার আবিষ্কারের উদ্দীপনা বৌদ্ধ দোঁহা, যা বাংলার কাব্য সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ, বৌদ্ধ দোঁহার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার ভাষা। দেশজ ভাষায়ও যে কাব্য সৃষ্টি ইহতে পারে, এই বিস্ময়কর আবিষ্কার বৌদ্ধ দোঁহার নীতি ভাষণকে কাব্যের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু মৌলিকত্বের উন্মাদনা ভাষাকে অতিক্রমণ করে বিষয় ও ভঙ্গির মধ্যেও আত্মপ্রকাশ করেছে।... বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক কাব্যসৃষ্টি বৈষ্ণব কবিতা, কেবল বাংলায় কেন, ভারতবর্ষের সমস্ত দেশজ ভাষার মধ্যেই বোধহয় এই সার্থক ও রসোত্তীর্ণ কবিতা সৃষ্টি হলো। বৈষ্ণব কবিতার উৎস সন্ধানে তাঁর দেশ ও কাল প্রথম বিচার্য। দক্ষিণ ভারতে তাঁর প্রথম বিকাশ অথচ সুদূর বাংলাদেশে এসেই তাঁর প্রকাশ বিস্ময়ে ও বেদনায় যে রূপ নিলো, আজও বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে তার তুলনা বেশি নেই।’
এছাড়া বৈষ্ণব কবিতার আত্মাকে প্রতিস্থাপন করতে দেখবো জহরীয় ভাষায়—‘বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিক রুম’ কাব্যগ্রন্থেও। ‘রোমান্টিক পোড়োবাড়ি’ কবিতায় কবি প্রথমে গদ্য ছন্দে পরবর্তীকালে চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাসকে এনে বিনির্মাণ করলেন সমকালীন সমাজের সেই ‘পাড়াগাঁর বধূটির’ গুমরে ওঠা কান্না—
...আমাদের টেলিস্কোপ নেই, শুধু এই চোখের মণিতে শুক্রগ্রহ রাখি। আর এভাবেই হাতে এসে যায় একটা গোলগাল শুক্রবারের চাকার দাগ। আমরা মাঠের মাঝখান থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি। কোন বাড়িতে কী কী ঘটছে, সেসব ঘটনায় জীবন কতোখানি বাঁক নিচ্ছে—এবার তবে দেখে আসা যাক। একটা ক্ষয়াটে হলদে বাড়ির মধ্যে অশরীরী হয়ে ঢুকে পড়লাম। দেখি মেঝেতে ব্লাউজ খোলা, শুধু ব্রা, একটা বউ গুমরে গুমরে কাঁদছে আর বলছে :
যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি
দুইবেলা মারধোর করেছেন পতি
যাঁহা যাঁহা হেরিয়ে মধুরিম হাস
গলা টিপে পতি বন্ধ করে শ্বাস...
এভাবেই রক্তাক্ত ঢেউগুলো, সমুদ্রে পাক খাচ্ছে। ডানা মেলা বনভূমি। ডানা মেলা ছায়াপথ
বাস্তবতাকে ধরতে গিয়ে আধুনিক বধূটির ভিতরের চিরায়ত কান্নার রঙকে ধরতে গিয়ে, জহর যে বিনির্মাণের ছবি আঁকলেন, গল্প বলতে-বলতে সুরের পৃথিবীতে প্রবেশ করলেন বৈষ্ণবীয় গীতিকায়, তা আবহমান বাংলা কবিতাকে মনে করিয়ে দেবে আর একবার। ‘রোমান্টিক পোড়োবাড়ি’র গল্পকাব্যের শেষ দিকে কিন্তু পাঠক দগদগে বাস্তবতার প্রতিচিত্র লক্ষ্য করবেন—
‘মফস্বল লাফ দিয়ে ধরছে শহরের ফোটনগতি।... এই সব আমরাও দেখি এবং আবার একদিন সমকালীন দৃষ্টিশক্তির অধিকারী হয়ে গরম ভাপ ওঠা ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ি নতুনভাবে। দেখি, বৃদ্ধ বাবাকে ইনজেকশন দিচ্ছে একজন অল্প বয়সী তরুণী আর সেই বাবার আর একটা হাত খামছে ধরেছে তরুণীর নিতম্ব। দেখি, কাগজের হেলিকপ্টার বানাচ্ছে একটা বাচ্চা আর একটু দূরে তার মা ঢলে পড়েছে পাড়াতুতো কাকুটির গায়। আরো একটা ঘরে ঢুকলাম।... সেখানে একটা মৃতদেহ উঠোনে স্থির। আর তার গাল খুবলে দিচ্ছে একজন শকুন। খুবলাতে খুবলাতে সেই শকুন বলছে—‘সব সম্পত্তি আমাকে দিয়ে মরলি না কেন?’ এরপরও আরো একটা ঘর বাকি। কিন্তু সে ঘরে আমরা কিছুতেই ঢুকতে পারছি না; লোহা দিয়ে তৈরি সে ঘর। ভেতরে নববধূ বেহুলা জেগে। লখিন্দর ঘুমোচ্ছে। আমরা দ্রুত সাপ হয়ে খুঁজতে শুরু করলাম গৃহ মিস্ত্রিরির রেখে যাওয়া সেই অনুগত ছিদ্র পথটুকু...’
কী চমৎকারভাবেই সময়ের ক্ষত, বাস্তবতার নির্মম সত্য নিরূপণ করছেন গল্পকাব্যের পরিক্রমায়, মনসা মঙ্গলকাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের চিরায়ত কিংবদন্তীকে বিনির্মাণের অদ্ভুত কৌশলে নতুন সত্যে রূপান্তর করেছেন; এই ক’টা লাইনের মধ্যেই বর্তমান সমাজ-বাস্তবতার নগ্ন রূপটি পরিষ্কার করলেন কবি, যা একটি দুইশ পৃষ্ঠার উপন্যাসে ধারণ করতে হতো একজন ঔপন্যাসিককে; এখানেই জহর অনন্য। বাস্তবতার অভিঘাতে কবিতাও যে এমন গল্পকাব্যে পাঠকের সামনে উপস্থিত হতে পারে তা বাংলা কবিতা সম্ভবত এই প্রথম দেখলো, ‘বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিক রুমে’। সমালোচকরা বলতে পারেন এ আবার কেমনতর কবিতা? একে কবিতা বললে বাংলা কবিতার আকালের কথা ভাবতে হবে, কিন্তু সত্যি বলতে কি চলমান বাংলা কবিতার পরম্পরায় কোমল, গীতল বাণীময় দিন শেষে নতুন দিনের খোঁজ এনে দিয়েছে এমন কবিতার আগুনমুখা বাড়ি। পাঠক, সমালোচক নিজের রুচি, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে যেহেতু চালিত তাই জহর প্রচলিত রুচিকে আঘাত করেন, ভেঙে দেন তাঁর ‘বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিক রুমে’র নিরীক্ষাময় অনন্য এক মহাকবিতা নির্মাণ করে, পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব ও কল্পবাস্তব, দূরান্বয়ী চিত্রকল্পের মাখামাখি হয়ে জহর যেন বলে ওঠেন—
মাথা জলে ভেজা। চিরুনি চালাতেই এ পৃথিবীর সব স্বপ্ন
উড়ে গেল মাথার ভেতর থেকে। স্বপ্নহীন এই দুপুরে
নিজের হাতের চামড়ায় ছবি আঁকলাম। আর
তৎক্ষণাৎ মন বলছে—দেহখানা খাঁটি হয়েছে আগুনে পুড়ে...
... রাস্তায় দুপুরটা যেন বাজতে বাজতে হঠাৎ ট্যাক্সির তলায় চাপা পড়ল।
মোমচোখ যেমন গলে যায়, তেমনি রাস্তায় রাস্তায় টেলিপ্রিন্টার। দেখছি
মূকাভিনয়। দেখছি পায়রার গুনগুন সময় সংগীত। (অঙ্কনশিল্প)
‘বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিক রুমে’র ‘পিকচার গ্যালারি’ কবিতায় সাব-অল্টার্নতত্ত্বের খোঁজ যেমন পাই, তেমনি দেখতে পাই পরাবাস্তবতার ঘোর, জাদুবাস্তবতা, ফ্যান্টাস্টিক রিয়ালিটিও লক্ষ্য করবো আমরা। কবি তত্ত্ব দিয়ে কবিতা লেখেন না জানি কিন্তু বিশ্লেষণে এসবের ব্যবহার আলোচককে একটি গতি এনে দেয়; শুধু এই কাব্যগ্রন্থে নয় জহর সেনমজুমদারের পনেরোটি কাব্যের পরতে-পরতে চিত্রকল্পের পরে চিত্রকল্পে আধুনিক, উত্তরাধুনিক, উত্তর-উপনিবেশবাদী তত্ত্ব দ্বারা বিশ্লেষণ করা সহজ থেকে সহজতর।
একথাও সত্যি যে ফ্যান্টাসি, কিংবদন্তী, পুরাণ, রূপকথা, অতিপ্রাকৃত, অভিব্যক্তিবাদ, পরাবাস্তবতা কিন্তু জাদুবাস্তবতা বা জাদুবাস্তববাদ নয়; ডেভিড লজ-এর মতে, যখন কোনো অন্তর্নিহিত বিষয়কে কার্যকরভাবে উপস্থাপনের জন্য বাস্তববাদী আখ্যানের ভেতরে বিস্ময়কর বা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে— তাকেই জাদুবাস্তববাদ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ‘পিকচার গ্যালারি’ গদ্যকবিতায় আখ্যানের মতো করে কবি বলেছেন—“কিছু কিছু নুনকান্না সরালেই ভেতরের মেজবোন এসে বলে—স্বামী নেয় না, তাই বাপের বাড়ি থাকি।’ ছোটবোন বলে ‘সাঁতার জানি। তাই ডুবে মরতে পারি না।’ প্রত্যেকটি বাঁক প্রত্যেকটি রাস্তা আজ ঘুমন্ত। টেবিলের ওপর রাখা একটি ছোট্ট মাথা উড়ে গেল। সেই মাথাটাই আজ বিস্ময় থেকে দূরে আমাদেরও নিয়ে চলে। কিন্তু কতোদূর যাবো?... তাছাড়া ড্রয়িং করতে বসে এ্যাতো ভয় পেলে চলবে কেন? আমরাতো বোবা অভিলাষসহ মরে থাকা নকশাল পাখিদের শিখা দেখেছি। আর দেখেছি সকাল থেকে রক্ত খেয়ে খেয়ে একটি গাছ সন্ধ্যেবেলা পুকুরের কাছে নিচু হয়ে রক্তবমি করছে। আজ ঐ পিকচার গ্যালারির দুটি পাখি, দু-দিকে মুখ করে, অ্যান্টেনায় বসে বসে রবিবার দেখছে। যেন আর কিছু দেখবার অবশিষ্ট নেই...”। ‘বৈষ্ণব পদাবলী’র অভিসার যাত্রা আর জহরীয় অভিসার কতটা বিপরীতমুখী ‘চাঁদ’ কবিতায় তার প্রতিচিত্র দেখতে পাবো...। এখানেই সার্থক বিনির্মাণ—
কখনো আমি বা সুদূরতা পাইয়াছি, সুদূরতা ধরিয়াছি, এক্ষণে
দাঁড় বেয়ে অগ্নিজলে অভিসারে যাই, অভিসার চিরকাল ঘুম জাগানিয়া...
উপরের কবিতাংশে মেজবোন ও ছোটবোনের স্বগতোক্তি আমরা টের পাই নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্নবর্গের মানুষের অভাবি সংসারের হাহাকার, বিচ্ছেদ, মৃত্যু সংক্রান্ত তৃষ্ণার আহাজারি। পরের লাইনেই দেখি ‘টেবিলের ওপর রাখা একটি ছোট্ট মাথা উড়ে গেল’ এটাকে ম্যাজিক রিয়ালিটি হিসেবে দেখলেও সত্তরের দশকে পশ্চিম বাংলার নকশাল আন্দোলন প্রতিভাবান তরুণদের নতুন স্বপ্নের প্রত্যয়ে আত্মাহুতি সম্পর্কে আমরা জানি। তাইতো যখন জহর লিখেন— ‘আমরাতো বোবা অভিলাষসহ মরে থাকা নকশাল পাখিদের শিখা দেখেছি। আর দেখেছি সকাল থেকে রক্ত খেয়ে খেয়ে একটি গাছ সন্ধ্যেবেলা পুকুরের কাছে নিচু হয়ে রক্তবমি করছে।’—এই ‘গাছটি’ নষ্ট রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের স্রষ্টা কর্তাব্যক্তি, স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছি তারই এই সন্ধ্যেবেলা, একটি জীবনের অস্তগামী কালপর্ব গাছ প্রতীকে আমাদের সামনে উপস্থিত করছেন কবি; আর এই রক্তবমি সত্যিই বাস্তবতার অপর পিঠ, এইতো জাদুবাস্তবতা। বাংলা কবিতায় এমনভাবে খুব কম কবির হাতেই ধরা দিয়েছে, আর এই একই কবিতায় দেখি স্বরবৃত্তের টানে যেন সালভাদোর দালির পরাবাস্তব রেখাচিত্র—
রুগ্ন বাড়ি রুগ্ন বাড়ি অচল মায়ালোক
নারী ঘুমোয় পুরুষ ঘুমোয় কিন্তু খোলা চোখ
চোখের মধ্যে পরিস্ফুট দু-একটা বুদবুদ
ভ্রূণগুলো সব মরে গিয়েও টানছে বুকের দুধ।
‘ভ্রূণগুলো সব মরে গিয়েও টানছে বুকের দুধ’ এমন পরাবাস্তুব চিত্রকল্প জহরের কবিতার চরণে চরণে মূর্ছা যায় যেন, এটা যেমন স্বাভাবিক ঐশ্বর্য হিসেবে পরিব্যক্ত, তেমনি কিন্তু ভাবনার বিষয় এতো এতো দুর্লঙ্ঘনীয় চিত্রময়তা, দূরান্বয়ী চিত্রকল্প, রূপ-অরূপের মিলন এমন কি অতি পরাবাস্তবতার প্রয়োগ দুর্বলতা বহন করে কি-না, ভেবে দেখার সময় এসেছে জহরের কবিতায়।
ইয়েটসের মতে একটি চিত্রকল্প তখনই প্রতীক হয়ে ওঠে যখন সে একটি ঐতিহ্যের মধ্যে স্থাপিত হয়। আর সে ঐতিহ্যটি হতে পারে সাহিত্যের; ধর্মের, অকাট বিশ্বাসপ্রপঞ্চের, তান্ত্রিকের, পুরাণের বিশ্বাসের কিংবা লৌকিক কল্পনার আবেগ ও সন্নিহিত অর্থাবলির এক বিশাল নেটওয়ার্ক।
ইয়েটসের (আইরিশ) মতো জহরও ‘বাংলার’ ইতিহাস ও ভারতীয় পুরাণকে ব্যক্তি চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত করলেন কবিতাবিশ্বে, তবে প্রতীক শুধু ঐতিহ্য নয়, এর রয়েছে অনির্বচনীয় এবং অতীন্দ্রিয়ের সঙ্গে গভীর ও অব্যাখ্যাযোগ্য যোগাযোগ। একটি প্রতীক বারংবার ব্যবহৃত হতে হতেও ‘শুয়োরের মাংস’ হয়ে যায় না, কেননা ইয়েটস মনে করেন প্রতীকের মর্মার্থ অনিঃশেষ; সমকালেই সমস্ত অর্থ বোঝা কঠিন, সমায়ন্তরের পাঠে পাল্টে যাবে প্রতীকের গূঢ়ার্থ, এটাই বিশ্বাস করতেন ইয়েটস; প্রতীকই তাই কবিকে পৌঁছে দেয় গভীরতায়, রহস্য আর প্রাচুর্যের ভাড়ারে। জহরের কবিতায় ‘শিব’ শব্দের (দেবতা) ব্যবহার দেখবো ভিন্নতর ব্যঞ্জনায়—
ক) রাশি রাশি ভারা ভারা বৃথা এই আঁখি-তারা
মহাকাল আসিয়াছে দ্বারে
...
শিবারবে ভয় পাই কতো শিখা কতো ছাই
কুড়ে ঘর দিয়ে যাবো কারে
শুনো শৈল শিরোমণি এই লিঙ্গ এই যোনি
চিরকাল তোমারেই চায়
(চিরকাল)
খ) কালে কালে আমি মাঝি, শুধুমাত্র শিবনৌকা চালাই, দুলে দুলে অন্ধকারে
শুধুমাত্র একখানি শিবনৌকা চালাই, এ জীবনে আর কিছু করিতে পারিনি।
(তুমিও চেয়েছিলে)
গ) মনে হয় তোমার অতীন্দ্রিয়ের ভিতর আমার স্তব্ধ শিবলিঙ্গ বারবার
চক্ষু মেলে চায়; সন্ধ্যাকালে ব্যর্থ শালিকেরা ঠোঁট কোরে এই গৃহে
লালহীন খড়কুটো ছড়িয়ে দিয়েছে;... আমার যাবতীয় বন্ধ পাপড়ি
রমণ পরিতৃপ্ত মেঘ ও রৌদ্রে ক্রমে ক্রমে উদ্ভ্রান্ত হয়
(তোমার নৌকার পাশে)
ঘ) আমপাতার ওপর জামপাতার ওপর রজস্বলা ন্যাংটো বালিকা একফোঁটা দুইফোঁটা রক্ত দিয়ে
শ্রী ও শৃঙ্গারের আলপনা আঁকে, ওং শিবলিঙ্গ, ওং নমো নমো অপরূপ শিবলিঙ্গ
(বনভূমি)
ঙ) তন্ত্র করো, শিবনেত্র, তন্ত্র করো, শিব
খুলে পড়েছে, ঝুলে পড়েছে, মিথ্যে বলা জিভ
স্ত্রী মিথ্যে, ছেলে মিথ্যে, আর মিথ্যে শোক
তন্ত্র ধরো, তন্ত্র ধরো—শ্মশান; পরলোক
একটি শ্মশান মাথার ভেতর একটি শ্মশান বুকে
ঘিলুর রসে ঘুমিয়ে আছে চড়ুই মহাসুখে
(তন্ত্র করো, শিবনেত্র)
প্রতীকের মর্ম যে অনিঃশেষ ইয়েটসীয় ব্যাখ্যা মহান দেবতা ‘শিব’ ঠাকুরের প্রতীকে জহর বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্তিগত করে ফেলেছেন এই শব্দটিকে। ‘চিরকাল’ কবিতায়—‘শিবারবে ভয় পাই কতো শিখা কতো ছাই’—শিবের আগমনী ধ্বনিতে কবি ভয় পান ঠিকই, অগ্নি ও ছাইভস্ম দেখতে পেলেও শেষাবধি তাঁর কল্পবাস্তব কিংবা হৃদয়ের গভীরে লালিত প্রেমিকাকে শারীরিকভাবে আহ্বান করেন চিরায়ত প্রেমিকের মতো। ঠিক ‘তুমিও চেয়েছিলে’ কবিতায় জন্ম-জন্মান্তরে কালে কালে শিবের নৌকার মাঝি হয়ে এই একখানি নৌকা চালাতে-চালাতে ক্লান্ত মাঝি, এ জীবনে এই নৌকার পথ-পরিক্রমায় আর যেন কোনো বৈচিত্র্যের খোঁজ মেলেনি তাঁর, এখানে মহাক্রমশালী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শিবের নৌকাকেও একঘেয়ে লাগে কবির!
‘তোমার নৌকার পাশে’ কবিতায় প্রেমিকার অতীন্দ্রিয়ের ভিতর কবির স্তব্ধ শিবলিঙ্গ চক্ষু মেলে তাকায়, আশ্চর্য একই ‘শিব’ শব্দের প্রতীকায়িত ব্যবহারে ব্যবহারে পাল্টে পাল্টে যায় পাঠকের মনন-জগত।
‘বনভূমি’ কবিতায় ন্যাংটো বালিকার ফোঁটা ফোঁটা রক্তের আলপনায় যে চিত্রকল্পের ব্যবহার হয়েছে তা প্রকৃতি-প্রেমিদেরও ভিন্ন মনস্তস্ত্বে নিয়ে যাবে। আমপাতার ওপর জামপাতার ওপর রজঃস্বলার রক্ত দিয়ে শিবের আরাধনা ভিন্ন ব্যঞ্জনা তৈরি করে। নতুন জন্মের আবাহন লক্ষ করি আমরা।
‘তন্ত্র করো, শিবনেত্র’ কবিতায় শিবের ভূমিকা মহান বিধ্বংসী দেবতার, মিথ্যেবাদীর জিভ ধসে যাচ্ছে শিবের তন্ত্রে, ‘শিব’ শব্দের গভীরে কখনো দেবতা কখনো প্রেমিক, কখনো ভস্মাবৃত, ভীষণ সংহারক। তিন শ্মশানে সর্পজড়িত মস্তকে, গলদেশে কঙ্কালমাল্য ভূষিত হয়ে অনুচরের সঙ্গে ভ্রমণ করেন—তার প্রতিচিত্র জহরের কবিতায় স্পষ্ট।
শিব শুধু ত্রিমূর্তির অন্যতম দেবতা হিসেবে আসেনি কবিতায়, কিংবা প্রলয়ের তমোগুণে রুদ্রমূর্তিতে বিশ্বসংসার হরণ করতেই শুধু ব্যবহৃত হয়নি, শিবকে নিজের সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন কবি। তবে ‘মহাকাল’ হিসেবেও কোথাও কোথাও ব্যবহার হয়েছে। ত্রিনয়ন কিংবা মৃত্যুঞ্জয়ী অগ্নিনেত্রে কামদাহ হেতু উপস্থাপিত হতে দেখি। হলাহল পানে শিব নীলকণ্ঠ, তাইতো মহাদেব সংহার কর্তারূপে প্রধান অস্ত্র ত্রিশূল হাতে পিনাক ধনুক ব্যবহার করলেও শিব বিদ্বান, জ্ঞানী এবং মর্ত্যেও দেবগণের স্রষ্টা ও সাক্ষী। জহরের কবিতায় তাইতো সৃষ্টির রক্ষক হিসাবে শিবের প্রতীক লিঙ্গ অর্থাৎ প্রজননের চিহ্ন বারবার ব্যবহৃত হতে দেখি; আর তিনি মহাযোগী কঠোর তপস্যা ও নির্গুণ ধ্যানের প্রতীকস্বরূপ, তাইতো তিনি সর্বপ্রকার ক্ষমতার অধিকারী। জগন্মাতা পার্বতী এর স্ত্রী; জগন্মাতা, জগজ্জননী হিসেবে বারবার নানান প্রতীকে শিব ও পার্বতীকে ব্যবহার করেছেন কবিতায়।
তেমনি ‘শ্রাবণ’, ‘শবদেহ’, ‘ভূমা’, ‘জগজ্জননী’, ‘মাতৃভক্ত হেলেসাপ’, ‘ইরা ও পিঙ্গলার’ ইত্যাদি শব্দের প্রতীকী ব্যবহার কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে গভীর থেকে আরো গভীরে, রহস্য থেকে অপার সৌন্দর্যে।
শুধু বিষয়বস্তু আর রাজনৈতিক চৈতন্যের বিবর্তনেই নয়, রচনার প্রকাশভঙ্গিতে ভাষার তুলকালাম ওলোট-পালটে ভেঙে দিয়েছেন পুরোনো ছাঁচ, ধরতাই বুলি অলংকার, পুরানো ছন্দ, নিরীক্ষার দুঃসাহস, পরীক্ষার বেপরোয়া স্পর্ধা, অসম্ভবকে দখলে নিয়ে আসার প্রাণান্ত পরিশ্রম এক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকার তিন কবির কথা মনে করিয়ে দেয়। তাঁরা একজন পেরুর সেসার ভায়েহো, চিলির পাবলো নেরুদা আর কিউবার নিকোলাস গ্যিয়েন। গ্যিয়েনকে লোরকা লাতিন আমেরিকার হোমার বলে ডাকতেন, যদিও কেউই কারো মতো লেখেননি; যাঁর যাঁর পটভূমি তৈরি করেছেন, সত্যি বলতে কি এই কবিরা ব্যক্তিগত থেকে পৌঁছেছিলেন সাধারণ্যে, তাঁদের কবিতার খাতা নিয়ে, প্রেম-ভালোবাসা-হতাশার কথায়ও উপস্থাপিত হয়েছে দেশকালের বৃহত্তর পটভূমি।
কিন্তু জহর সেনমজুমদার ব্যক্তিগত থেকে সাধারণ্যে পৌঁছবার চেষ্টা করেছেন শুধু ‘ভবচক্র; ভাঙা সন্ধ্যাকাল’ কাব্যে বিশেষভাবে। নিকোলাস গ্যিয়েনের মতো তিনি অবশ্য বলেন না যে, ‘আমি কবুল করি আমি এক অ-শুদ্ধ মানুষ।’ আত্মস্বীকারমূলক ভঙ্গি, তৎসম, তদ্ভব এমনকি দেশজ-ধ্রুপদী ও সাম্প্রতিকের মিশ্রণ সাবলীল বিশেষ করে দেশভাগ, মা-মাটি-জল-জীবন জহরকে আবিষ্ট করে রেখেছে। জীবনানন্দীয় ভুবনের জ্যোতির্বলয় থেকে নিজেকে খুঁজে অপর সৌন্দর্যে প্রবেশ করেছেন, জটিল মনস্তত্ত্ব ও সংঘাতময় জীবনযাপনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন নিয়ত নিজেকে।
ইমেজিস্ট বা চিত্রকল্পবাদী কাব্য-আন্দোলনের কবিদের মাথায় রেখে বিশেষ করে এজরা পাউন্ড, হিন্ডা ডুলিটল, এমি লোয়েল, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস-কে মনে পড়তে পারে পাঠকের, বিশেষ করে উইলিয়ামের সঙ্গে অন্যরকম মিল আছে জহরের; উইলিয়াম মনে করতেন “The place of my birth is the place where the world begins.” এলিয়টের মতো উইলিয়ামস ইতিহাসের ভিতর থেকে ভূগোলের পরিক্রমায় নিজের সার্থকতা খোঁজেননি বরং নিউজার্সির রাদারফোর্ডের মতো ছোট্ট জায়গায় কাটিয়ে ছিলেন সারাজীবন। জহর সেনমজুমদারও বসিরহাটের বাদুড়িয়া থানার আড়বালিয়া গ্রামকে বিশেষায়িত করেন, ‘বাদুড়িয়াই’ যেন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থল, যদিও উইলিয়ামের মতো নয় জহরের কবিতাবিশ্ব, এলিয়টীয় ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ভূগোলের পরিক্রমায় কবিতার নন্দনবিশ্বে নিজের সার্থকতা খোঁজেন তিনি। গদ্য-পদ্য মিশিয়ে মন্তাজ তৈরি করেছেন উইলিয়ামও Spring and all (1923), Sour Graps (1921)-এ, তেমনি জহর ‘বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিক রুম’ এবং ‘বিপজ্জনক ব্রহ্মবালিকা ’ কবিতায় গদ্য-পদ্য মিশেলে মন্তাজ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন।
Imagist ম্যানিফেস্টোর উপর একটু চোখ বুলিয়ে আসি সেখানে দেখতে পাবো—১৯১৫ সালে ‘Some Imagist poets, প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে ম্যানিফেস্টোর মতোই লেখা ছিল “To use the language of the common speech’, ‘To create new rhythms as the expression of news moods’, ‘To allow absolute freedom in the choice of subject’, ‘To present an image’.”
‘ফ্রি-ভার্স’ কবিতার বাহন করতে হবে কারণ স্বাধীনতা বিঘ্নিত হবে না এই ছন্দে, এটাই জহর যেন মান্য করেছেন তাঁর কবিতায়। এজরা পাউন্ডদের মতোই নিজস্ব ছন্দের চালে নিছক শব্দের কারুকার্যে না গিয়ে কখনো-কখনো মুখের চলতি বুলিতে ধারণ করেছেন পংক্তির পর পংক্তি তাঁর বহুবর্ণরূপময় কবিতায়।
বিশ্বজনীন যে মানবকল্পনা তারই মুক্ত ছন্দ, মুক্ত ভাবনা, চলতি বুলি বা মৌলিক বাকভঙ্গি ও কাব্যের মিশ্রণ, চিরন্তন এসে হাত ধরেছে ক্ষণিক বা সমকালের বক্তব্যের ভিতর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন ‘যে কবিতা জীবনের, সে কবিতার জন্য জীবনকে যোগ্য করে নিতে হবে। এ জীবন সজ্ঞানে, আত্মত্যাগে নয়, সর্বগ্রাসে সর্বভুক কবিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।’ সত্যিই সর্বগ্রাসে সর্বভুক কবিতার জন্য জমিন তৈরি করতে জহর যেন বাংলা কবিতার নতুন কৃষক।
ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে মানবজীবনের স্বর্ণালি রসায়নের মায়াবী উদ্ভাস তৈরিতে সিঁড়ির পর সিঁড়ি তৈরি করেছেন কবিতায়।
জীবনের বিচূর্ণ উপাদান পরাবাস্তব বা অতিবাস্তবের মণিমুক্তায় গদ্য ছন্দের নিরিখে মূলতই পয়ার ও মহাপয়ারে অথবা মুক্তক অক্ষরবৃত্তে স্বপ্ন ও অবচেতনের সমান্তরাল সন্তরণের মধ্যে পংক্তির পর পংক্তি সাজিয়েছেন কখনো বা মনে হবে স্বেচ্ছাচারের মতো; কখনো বা শুদ্ধ সংযমে কবিতার আভ্যন্তরীণ মনোলোকে পৌঁছে গিয়ে তৈরি করেছেন বৈষ্ণবীয়, রামপ্রসাদীয়, জীবনানন্দীয় ঘরানা; কখনো বা মনে হবে নিরন্তর নিরীক্ষাপ্রবণ কবি জহর ‘Let Fleus Du Mal’ লেখক প্রথম আধুনিক বোদলেয়ার বা র্যাঁবো নয়, তার মানসলোক আবিষ্ট করে আছেন মহান জীবনানন্দ। জীবনানন্দে যেমন দেশভাগ জটিল মনস্তত্ত্বে ‘উৎশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খলায়’ ফেলে দিয়েছিল ‘নিহত ঈশ্বরের চেয়েও অন্য কোনো সাধনার ফলের খোঁজে’ নিয়ে গিয়েছিল তেমনি জহরও ‘উৎশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খলার’ শিল্পবিশ্বের আত্মিক নাগরিক। ‘ভাঙা বাংলা’ প্রথম দিকের কবিতায় বৌদ্ধ বামাচারীরূপী শিব যেন কবি; রাগে, অভিমানে বন্ধন বিনাশ করতে আগ্রহী। ঔপনিবেশিক শাসকদের খেলার শিকার আমরা বহন করে চলছি মা-মৃত্তিকার দুই স্তনের বিভাজন; ভাঙা বাংলা, ভাঙা হ্যারিকেন/ এই নাও শিব শক্তি কাম/ অগ্নি আর জলসহ আমি/ এইমাত্র গৃহে থাকিলাম/... আমিও বৌদ্ধ বামাচারী/ বন্ধন বিনাশ করিলাম।
‘আলুলায়িত’ কবিতায় ১৯০৫-এর ‘বঙ্গভঙ্গ’ প্রস্তাবের প্রতিফলন ঘটে যেন ১৯৪৮ তারই প্রতিচিত্র যেন টের পাই এই কবিতার পংক্তি থেকে পংক্তিতে—
যন্ত্রণা যন্ত্রণা কিসের এতো যন্ত্রণা তোমার?
পিতামহের ময়ূরাক্ষী শেষ
মাতামহের কর্ণফুলি শেষ, গঙ্গা ও পদ্মার মাঝে কিশোরীর বেণী ছেঁড়া প্রেম আজও
পড়ে আছে...
পূর্ববঙ্গের কর্ণফুলি; পদ্মা ও পশ্চিমের গঙ্গাকে কিশোরীর দুই বেণীর বিচ্ছেদী প্রেমের চিত্রকল্পে ধারণ করেছেন জহর।
‘বিপজ্জনক ব্রহ্ম বালিকা বিদ্যালয়’ ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি স্বাধীনতাকামী বীরদের নিয়ে জহর যখন লিখছেন গদ্য ছন্দে—“এখনও ভাবছো কোথায় লেখা বসাবে? ঐ যে তিতুমীর, উইলিয়াম স্টর্মের হুগলি কুঠি আক্রমণ করে নীল বাক্স ভেঙে দিচ্ছে। ঐখানে লেখা বসাও। ঐ যে দুদুমিঞা, ফরিদপুর জেলের মধ্যে সাপের খোলস দেখতে দেখতে পুনরায় উড়ে যেতে চাইছে। ঐখানে লেখা বসাও। ঐ যে নিরীহ সাঁওতাল পরগণার মাটিতে সিধু আর কানু অজস্র কাচা মুণ্ডে তা দিচ্ছে।” অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মুক্তির জয়গান, ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর বেনিয়া শাসকদের প্রতি বিদ্রোহ নতুন প্রজন্মকে শিকড়ের খোঁজ দেয়, ইতিহাসের পরম্পরায় আজকের মুক্তির পথের খোঁজ দেয়, নিজকে জানার আগ্রহ তৈরি করে। মহাকাব্যিক দ্যুতি নিয়ে চারু মজুমদারের মুক্তির স্বপ্নের চোখ, উঠে আসে এই গদ্যকবিতায়। ‘ধানক্ষেত’ কবিতায় দেখতে পাই—
আমরা ছিলাম কোনোকালে কোনো চাষা
নদীপাড়ে ছিল আমাদের ছোটো বাসা
মাথাগুলো নিয়ে শ্মশানে যাবার আগে
ভাগ হয়ে গেছি; ঠিক যেন দুই ভাগে।
এইভাবে ‘বারানসী’ কবিতায় সোজাসুজি জহর লিখেন—
দেশভাগ হয়ে গেছে মা? আজ তবে খাঁচা খুলে দাও, আমি চলে যাই
যাই যাই আমি চলে যাই, বরিশাল থেকে বারাণসী তোমার আঁচল আমি।
‘হৃদিমূল’ কবিতায় দেখি হতাশ, উপনিবেশের দালালদের খপ্পরে রাজনৈতিক চালে সর্বহারা কবি বলছেন—
কিছুই পারি না আমি, কঙ্কালের পিছু পিছু মাঝরাতে গৃহ ছেড়ে উড়ি
একদিন চেয়ে দেখি মাতৃভূমি কিছু নেই, মাতৃগর্ভ কবে যেন হয়ে গেছে চুরি
আজ তবে কোথা যাব? গঙ্গাতীরে পড়ে আছে নষ্টভ্রষ্ট কালখণ্ড অতিরিক্ত ছাই
দেশভাগের ফলে বাঙালি জাতির যে হাজার বছরের ধর্মীয় সম্প্র্রীতির ভাঙন, জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে বাঙালির, ষড়যন্ত্রকারী ঔপনিবেশিক শাসক ও তাদের দোসর দেশীয় রাজনীতিবিদগণ যে ক্ষতি সাধন করেছে, ব্যক্তিগত জহর সেনমজুমদারের হৃদয়ের দুটি ভাল্ব দ্বি-খণ্ডিত হয়েছে তা ‘ভবচক্র; ভাঙা সন্ধ্যাকালে’ কাব্যগ্রন্থে স্পষ্ট। সত্যি বলতে কি, ১৫টি কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষে সবচেয়ে পরিণত জহরের চিন্তনবিশ্বের সারৎসার যেন এই ‘ভবচক্র; ভাঙা সন্ধ্যাকালে’ কাব্যগ্রন্থটি; অনেকের মনে হতে পারে জহরের কাব্যবীক্ষায় চূড়ান্ত পর্যায়ের দার্শনিকতার সমস্ত নির্যাস যেন এখানে এসে মজেছে এই ভবচক্রে, সমস্ত কাব্যের প্রসাদ-জল-মাটি-মা এসে মিশেছে ত্রিবেণী সংগমে। তিনি সংকীর্ণ স্থানিকতায় আবদ্ধ নন, স্থানিকতাকে ধারণ করে ব্রহ্মাণ্ডের অপার রহস্যের খোঁজে নিয়ত তাঁর কবিতা খুঁজছে মানবিক সম্পর্কের ঋদ্ধবিশ্ব। মেজাজের দিক থেকে জীবনানন্দের হলেও কোথাও কোথাও অপর কোনো মায়া বা ম্যাজিক রয়েছে যা তান্ত্রিক জগতের খোঁজে তিনি পাঠককে নিয়ে যান অচেনা কোনো জগতে। বোদলেয়ারের এই কথাকে তিনি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছেন তবে কবিতায় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে তিনি সংকীর্ণ স্থানিকতায় আবদ্ধ রাখেননি তাঁর স্বপ্নলোক, তিনি কখনো ছদ্মবেশী ও অদৃশ্য, কখনো-কখনো তান্ত্রিক, জনারণ্যের মধ্যেও ব্যক্তি জহর ও তাঁর কবিতা নির্জন, একাকী, কখনো কখনো শুধুই পর্যবেক্ষণকারী, নিরীক্ষাপ্রবণ সমান আসক্ত পাপ-পুণ্যের প্রতি, নারী সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ, চিরায়ত নারীর ভেতরে শব্দে-শৈলীতে নতজানু নন, হয়তো অবক্ষয়ের রঞ্জনে আক্রান্ত, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও পক্ষপাতিত্ব যেমন আছে নারীবাদে তেমনি একই সঙ্গে নশ্বর ও অমর এক অদ্ভুত উপাসক।
র্যাঁবোর চাওয়াটাই যেন প্রত্যক্ষ করি জহরের কবিতায় ভাব ও আঙ্গিকের নতুনত্বে। ফরাসি আর এক কবি মালার্মেকেও মনে পড়ে যাবে জহরের কবিতা পড়তে-পড়তে নতুন ছন্দগত স্বাধীনতার কথায়।
‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায় হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘আধুনিকতাবাদ এ-তৃতীয় মাত্রার বিশাল বদল ঘটায় সংবেদনশীলতার, সৃষ্টি করে এক অভিনব শিল্পকলা, যার মুখোমুখি অসহায় বোধ করে প্রথাভ্যস্ত শিল্পকলানুরাগীরা। আধুনিকতাবাদ শুধু অভিনবভাবে আসেনি; এসেছিলো বিপর্যয় সৃষ্টি ক’রেও, আধুনিকতাবাদের আগে, পশ্চিমে, শিল্পকলার জগতে বিপ্লব ঘটেছে প্রত্যেক শতকেই, বদলও ঘটেছে সংবেদনশীলতার, তা কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি, ওই বদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে; আধুনিকতাবাদ এক মহাবিপ্লবরূপে, যা আগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপে। এর স্বভাব বিপর্যয়কর।’ জহরের কবিতা যেন পূর্বসূরিদের আত্মস্ত করে তাঁদের সঙ্গে ‘সম্পর্ক ছিন্ন’ করে নতুন পথে সম্পূর্ণরূপে নিজের ভুবন তৈরিতে একাগ্র, ‘বিপর্যয়কর এই স্বভাব দেখবো তাঁর পংক্তিতে পংক্তিতে। যেমন ‘কায়াকল্প’ কবিতায়—
তুমিও শ্রাবণশৃঙ্গার, স্ত্রী-ভেড়ার মুণ্ডমালা সারাদিন টুং টাং করে, শোনো তার ধ্বনি
পাইনগাছের নিচে চলন্ত দুটি পা, একটু দূরে সান্ধ্য বাড়ি, আমিও চুপিসারে
কায়াকল্পে প্রবেশ করি, মেঘাচ্ছন্ন মহাবিশ্ব...
‘নিরালোক, মেঘতামস’ কবিতায় ‘নিরালোক নিরালোক, মেঘতামস মেঘতামস, মন তুমি ভালো হয়ে যাও/ মন তুমি সঙ্গমে ও স্বধর্মে কৃষিকুঞ্জ উদ্ভাবন করো...।’ পূর্বসূরিদের আত্মস্থ করে বলা চলে সম্পর্ক ছিন্ন করে জহর যে ভুবনে যাত্রা করলেন তাকে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কবিতা বলতেন না। জীবনানন্দও নিশ্চিত সন্দেহের চোখে দেখতেন, Imagist কবিদের যে আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছিল, জহরকে তাই সহ্য করতে হবে সমকালে। এই পথে কবিকে একাই হাঁটতে হয়; এটাই স্বাভাবিক সত্য।
Imagisme-এর উপর আক্রমণ আসতে থাকে ১৯১৫ সালের পর, এজরা পাউন্ড ও অন্যান্যদের লেখা কবিতায় যে ফ্রি-ভার্সের কথা বলা হচ্ছে, তা সত্যিকার অর্থে কবিতা কি-না? দ্বিতীয়ত সমালোচকরা Imagist কবিতার সাফল্য সীমিত আকারে দেখিয়ে বিভিন্ন রকম নিবন্ধ রচনা করলেন; জহর সেনের কবিতার তীব্র সমালোচনা করা যায় কনরাড আইকনের মতো। তবে পূর্বে বিবেচনায় আনতে হবে Imagist যাকে বাংলায় (চিত্রকল্প) বলা হচ্ছে শুধুই কি জহরের কবিতায় দেখতে পাই! নাকি পরাবাস্তবতা, অতীন্দ্রিয়িতা, ম্যাজিক্যাল রিয়ালিটি, স্থানিকতা বিশেষ করে উপমহাদেশের চিরায়ত ক্ষত উপনিবেশিবাদ পরবর্তী দেশভাগ-সৃষ্ট বাস্তবতা মানবতার প্রতি নিবিষ্ট দার্শনিকতার সংযোগ ঘটেছে জহরের কবিতায়। কবিতা গড়ে উঠবে এক বা একাধিক স্বচ্ছ ও কঠিন ইমেজ বা চিত্রকল্পকে আশ্রয় করে; দৈনন্দিন ভাষা ব্যবহৃত হবে কবিতায়, যা কি-না ফ্রি-ভার্সে সহজেই উপস্থাপন করা সম্ভব। জহর সেন অনেকাংশে এই জায়গায় সার্থক; কবির থাকবে অবারিত স্বাধীনতা বিশেষ করে বিষয়বস্তু নির্বাচনে এইক্ষেত্রে জহরের কবিতা ইমেজিস্টদের উত্তরাধিকার একার্থে।
Peter Jones-এর পেঙ্গুয়িন বুকস থেকে প্রকাশিত Imagist Poetry বইয়ের Introduction-এ এজরা পাউন্ড ইমেজ এর সংজ্ঞা যেভাবে দেন তা লক্ষ করলে জহরের কবিতা পাঠ সহজ হবে—
An ‘Image’ is that which presents an intellectual and emotional complex in an instant of time. I use the term ‘complex’ rather in the technical sence exployed by the newer psychologists, such as hart, though we might not agree absolutely in our application.
… … … …
It is better to present one Image in a lifetime than to produce voluminous works.
জহরের কবিতার প্রতিটি চরণই ইমেজের ভিতরে ইমেজ দিয়ে ঠাসা, তাই উদাহরণ প্রয়োজন পড়ছে না। আবহমানকাল থেকে মৃত্যুর অনুভূতি ও মানুষের মৃত্যুভীতির অভিব্যক্তি চিরায়ত; বিশ্ব ও বাংলা কবিতায় কীভাবে ঐতিহ্যের অনুবর্তিতায় এসেছে তার সঙ্গে জহরের কবিতার সঙ্গে তুলনা করছি, প্রাচীন মহাকাব্য থেকে বর্তমান অবধি মৃত্যুচিন্তাকে কীভাবে দার্শনিকতায় উপস্থাপন করেছেন তার প্রতিচিত্র দিতে-দিতে জহরের কাব্যবীক্ষায় দেখতে পাবো মৃত্যু সংক্রান্ত বিচিত্র দার্শনিক অভিব্যক্তি।
কঠোপনিষদে দেখতে পাই—গৌতমপুত্র নচিকেতা যমলোকে গিয়ে যমের কাছে জীবন ও অমরতার রহস্য জানতে যতবার প্রশ্ন করেন যম ততবার তার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গ তোলেন, নাছোড়বান্দা নচিকেতাকে বিরক্ত হয়ে উত্তরে বলেন—
নচিকেতা মরণং মাহনুপ্রাক্ষীঃ।
অর্থাৎ হে নচিকেতা, মরণ বিষয়ে অমন প্রশ্ন করো না আর। (কঠোপনিষৎ-১/১/২৫)
দেবতাদের পরাজয়জনিত রোষের অভিশাপে গিলগামাসের বদলে এন্কিডুকেই মৃত্যুবরণ করতে হয়, হৃদয়বিদারক বিচ্ছেদ-বেদনার মুহূর্তে গিলগামেস তাকে সান্ত¦না দেন দার্শনিকসুলভ ভাষায়—
To the one who survives (the gods) leave grieving.
The dream leaves sorrow to the one who survives.
এ এক অপূর্ব করুণ হৃদয়বিদারক অনুভূতি, মৃত্যুর পর জীবনের সব দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান হয়, কিন্তু স্মৃতিকে বহন করে যে মানুষ বেঁচে থাকে তাকে অহরহ দংশন করে দগ্ধ সেই স্মৃতি।
‘ইলিয়াডে’র বিংশ সর্গে বর্ণিত মৃত্যুর অনিবার্যতা ও জীবনের নশ্বরতা সম্বন্ধে আখিল্যেয়ুস-এর সেই নিদারুণ আক্ষেপ—
The day shall come (Which nothing can avert)
When by the spear, the arrow, or the dart
By night or day, by force, or by design,
Impending death and certain fate are mine.
ভার্জিল তাঁর ‘ঈনিদ’ মহাকাব্যের ষষ্ঠ সর্গে Sibyl of cumae অপঘাতে মৃত পালিনুরুস (Palinurus)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন—
They shall build you a monument, they shall year by year
Perform rites in your honour for evermore,
And the place shall have the name Palinurus?
রামায়ণে যুদ্ধকাণ্ডের ১১১ সর্গে রাবণের মৃত্যুতে শোকসন্তপ্তা মন্দোদরীর বিলাপ—
সর্বদা সর্বভূতানাং নাস্তি মৃত্যুরলক্ষণঃ।
তব তদ্বদয়ং মৃত্যুমৈথিলীকৃতলক্ষণঃ।
সীতা নিমিত্তজো মৃত্যুস্ত¡য়া দুরাদুপাহৃত।
মৈথিলী সহ রামেনবিশোকা বিহরিষ্যতি।
(সীতা হরণই তোমার মৃত্যুর কারণ; যেহেতু, বিনা কারণে কোনও প্রাণীই মৃত্যুকে প্রাপ্ত হয় না। তুমি স্বয়ংই সীতার নিমিত্ত মৃত্যুকে দূর হইতে ডাকিয়া আনিয়াছিলে। এক্ষণে মৈথিলী শোকহীনা হইয়া রামের সহিত বিহার করিবে।)
কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত রুবাইয়াই-ই ওমর খৈয়ামের ১১৭ নম্বর রুবাইয়ে মৃত্যুচিন্তার প্রতিফলন—
মৃত্যু যেদিন নিঠুর পায়ে দল্বে আমার এই পরাণ,
আয়ুর পালক ছিন্ন করি’ করবে হৃদয়-রক্ত পান,
আমায় মাটির ছাঁচে ঢেলে পেয়ালা ক’রে ঢালবে মদ,
হয়ত গন্ধে সেই শারাবের আবার হব আয়ুষ্মান!
শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের ৫ম অঙ্কের ৫ম দৃশ্যে সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যাবে আমাদের—
Out, out, brief candle!
Life’s but a walking shadaw...
It is a tale told by an idiot, full of sound
And fury, signiflying nothing.
মহাকবি মধুসূদন দত্ত অমরত্বের প্রত্যাশায় যে এপিটাফ লিখলেন তার মর্মার্থ—মানুষ তাঁর সমাধির পাশে দাঁড়ায়ে স্মরণ করবে, দু’ফোটা চোখের জল ফেলবে শ্রদ্ধায়-সম্ভ্রমে এইটুকুই চাওয়া কবির...
দাঁড়াও, পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে...।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যে জীবনকে করুণ ব্যাকুলভাবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন—
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবণে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
আরো কত শত প্রাজ্ঞ চরণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনাজনিত, পাঠকের অজানা নয়।
T.S. Eliot তাঁর Whispers of Immortality কবিতায় লিখেছেন—
Wesbster was much possessed by death
and saw the skull beneath the skin?
জীবনানন্দ ‘অন্ধকার’ কবিতায়—অনন্ত মৃত্যুর সঙ্গে কীভাবে মিশে যেতে চেয়েছেন দেখুন;
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর
অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।
আবুল হাসান ‘জন্ম মৃত্যু জীবপযাপন’ কবিতায় লিখেছেন—
মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,
....
পৃথিবীতে তবু আমার মতোন কেউ রাত জেগে
নুলো ভিখিরীর গান, দারিদ্র্যের এত অভিমান দেখলো না!
একের পর এক বিশ্বযুদ্ধ, দেশ ভাগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পুঁজির বিশ্বায়ন, নকশালবাড়ি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, উদ্বাস্তু, পাকিস্তান-ভারত টানাপড়েন-যুদ্ধ, বিভ্রান্তি, বিমূঢ়তা, উত্থান-পতন, হিংসা-ঘৃণা-রিরংসাভরা জীবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে জহর প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের ক’জনের সত্যিকারের হাত পা মাথা আছে বলতে পারো?’ তাইতো তাঁর কবিতায় মৃতের চিত্রকল্প ছাড়াও নানাভাবে হাতকাটা মানুষ, পা-কাটা মানুষ বা মুণ্ডুকাটা মানুষের দেখা মেলে, কেউ হয়তো তুকতাক-তন্ত্রবাদের কথা, জাদুবাস্তবের কথা, পরাবাস্তবের কথা ভাবতে পারেন; এটা ঠিক যে শ্বাশত মৃত্যুচেতনার সম্প্রসারিত বাস্তবতা এই কবিতামৃত, এখানে ফ্যান্টাসি নেই আছে ক্লেদাক্ত, কর্দমাক্ত দগদগে ঘায়ে মনের—মল-মূত্র-পুঁজ ভরা জীবনস্রোত যার একমাত্র পরিণতি মৃত্যুতে শান্তি খোঁজা, বিনাশ খোঁজা, তবুও আশার বাণী হাতে ভাদ্রের ধানক্ষেতে বীজরোপণের মাধ্যমে জহরও যেন নতুন জীবনের আবাহন করেন।
১) তুমি চেয়েছিলে অধিক জীবন, যাবতীয় নীরব দংশনের পর
মেঘলা রাত্রির বুকে জেগে ওঠে অর্ধস্ফুট হরিণার এই চাঁদমালা
... আমাদের সকলের মৃতদেহ ক্রমশ
ত্রিশূলের তিন ডানা ধরে উঠে যায় অজানিত শূন্যের ভিতর
এইখানে মৃত্যুভয় ভুলে কারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গায়? এইখানে
জন্মসূত্র ভুলে কারা সারাদিন শিবায়ণ করে? (তুমিও চেয়েছিলে)
২) এই গৃহ; যতবার গৃহে ঢুকি; যোগিনীর মৃতদেহে প্রজাপতি উড়ে এসে
গুনগুন করে; যতবার গৃহে ঢুকি, যোগিনীর মৃতদেহে রহস্যময় জ্যোৎস্নার
উদগম হয়; এসব ছেড়ে আমি কি আর কোথাও কখনো যেতে পারি?
তবুও ভৈরবীর আঠারোটি হাতে আমাদের আঠারোটি মুণ্ডু ঝুলে থাকে (কালসখা কালপ্যাঁচা)
৩) তুমি সখা, জীবিত ও মৃতের মাঝে যৌন এক জবাগাছ প্রতিরাত্রে স্থাপন করেছো
আমি এক বিমূঢ় বিস্ময়, চাঁদের ছিদ্রপথে স্বপ্ন নিয়ে চিরকাল প্রবেশ করি... (দাঁড় ও শিয়াল)
৪) তুমিও আমারই মতো নিশ্চয়ই দেখেছ পৃথিবীর শান্ত জ্যোৎস্নায় তুমিও মৃত আমিও মৃত
মাঝখানে একটি জীবন্ত নদী গৌড় গোধূলির প্রেমে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আছে, মাঝখানে
একটি অলৌকিক পথ হৃদি চিরে টাঁড় বাংলার চাঁদ ধরিয়াছে, তুমিও আমারই মতো
একটি অলৌকিক পথ হৃদি চিরে টাঁড় বাংলার চাঁদ ধরিয়াছে, তুমিও আমারই মতো
জিহ্বা বার করো, জিহ্বার উপরে রাখো পদ্মা ও গঙ্গার গ্রামীণ জনপদ।
৫) সারারাত রক্তমাখা চাঁদ নিয়ে খেলা করো তুমি
স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থাকে মেঘাতুর এই বনভূমি
ঝরাপাতা উড়ে উড়ে, শিহরিত, গোধূলির তীরে
শবদেহ ফিরে আসে হিংসা ও হেঁয়ালির নীড়ে (রতিক্লান্ত)
৬) জলে ডোবা মৃত বালিকার বক্ষসন্ধি থেকে দুটি স্বপ্ন আস্তে আস্তে ডাঙায় উঠে আসে
ভূমিপোকা, ওগো ভূমিপোকা, আমাদের সকলের ইচ্ছা তুমি এই, স্বপ্ন দুটি গ্রহণ করো
আমরা ওই কিশোরীভক্ত, আমরা ওই কিশোরী প্রেমিক, তিন শতাব্দী আগে
আমরা একবার ওকে বাঁশবাগান বাঁশপাতা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা কান্না মুছতে দেখেছিলাম (স্বপ্নযাত্রা)
৭) তুমিও লেখক, তোমার লেখায় মেয়েদের মৃতদেহের ওপর সারাদিন গঙ্গাফড়িঙ লাফায়
... একা একা অতৃপ্ত বয়ঃসন্ধির শীত ও শীতকার নিয়ে সারারাত সাগ্রহে তোমার
ধড় দেখি, মুণ্ডু দেখি, হিজলগাছের ছায়ায় কোটি কোটি ভ্রূণ নিয়ে আমার মা
পড়ে আছে,... (সৎকার)
৮) আমাদের মৃতদেহ আমরাই কাঁধে তুলে হাত রাখি অঙ্কুরিত বীজে;
জল ছিল; অগ্নি ছিল; পিঁপড়ের ডিম ছিল; বালিকারা উঠেছিল কেঁদে
মায়েদের জন্ম হয়, মায়েদের মৃত্যু হয়; (ঋতু)
‘জীবন-মৃত্যুর শব্দ শুনি’ প্রবন্ধে জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ যে কথা তুলেছেন তা জহরের কবিতা আলোচনায়ও যথার্থ বলে মনে হয়—“... ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, কোনো দূরবীক্ষণ বা অনুবীক্ষণে আর পাওয়া যাবে না তাকে। জীবন মানে মানব পতঙ্গের বিস্তার শুধু, যেন গ্রহমণ্ডলের ক্ষত কিছুই নিশ্চিত নয় এখানে, একমাত্র পরাভব আর মৃত্যু ছাড়া। জীবন যেন এক ঘুম, যা থেকে জেগে উঠবার কোনো সম্ভাবনা নেই আর। ... আশা না নিরাশা, জীবন না মৃত্যু, সঞ্চার না স্তব্ধতা—এর মধ্যে কোন্টা শেষ পর্যন্ত বড়ো হয়ে ওঠে জীবনানন্দের লেখায়? এ প্রশ্ন কখনো কখনো উঠেছে। এর উত্তরে হয়তো বলাই যায়—কোনোটাই নয়।... এমন একটা জগৎ তৈরি করে তোলেন জীবনানন্দ যেখানে একই সত্তা পেয়ে যায় জীবনের মধ্যে মৃত্যু, আশার মধ্যে নিরাশা, সঞ্চারের মধ্যে স্তব্ধতা; যেখানে অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ।” কিংবা ‘মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?’
জহর সেনমজুমদারে ‘জীবিত ও মৃতের মাঝে যৌন এক জবাগাছ’ দেখতে পাই এই জবাগাছ জীবনের প্রতীক হয়ে আসে আমাদের কাছে, আর বিমূঢ় বিস্ময়ে জীবনানন্দের মতো ‘চাঁদের ছিদ্রপথে স্বপ্ন নিয়ে’ প্রবেশ করেন; এভাবেই বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে নেন। ‘যোগিনীর মৃতদেহে প্রজাপতি উড়ে’ এখানে প্রজাপতি জীবনের জয়গানই গেয়ে চলেন, এ যেন জীবনানন্দের—‘মৃত্যুরে ডেকেছি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধরে’ এরই পুনরাবৃত্তি, বিনির্মাণ। যেমন—
পৃথিবীর শান্ত জ্যোৎস্নায় তুমিও মৃত আমিও মৃত
মাঝখানে একটি জীবন্ত নদী গৌড়গোধূলির প্রেমে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আছে।
জীবনানন্দের কবিতা বলে ভ্রম হতে পারে তবে শেষ লাইনে এসে অলৌকিক হৃদি পথ ধরে জহর যখন বলেন, ‘তুমিও আমারই মতো জিহ্বা বার করো, জিহ্বার উপরে রাখো পদ্মা ও গঙ্গার গ্রামীণ জনপথ’, তখন জাদুবাস্তবতার ছোঁয়ায় অন্য এক দৃশ্যরূপের জন্ম হয় যা জীবনানন্দ থেকে সম্পূর্ণতই আলাদা; দেশভাগের ক্ষত; এই তুমি আমির মৃত্যু মূলত দৃশ্যত শারীরিক কিন্তু মনগতভাবে জীবিত। ‘জলে ডোবা মৃত বালিকার বক্ষসন্ধি থেকে দুটি স্বপ্ন আস্তে আস্তে ডাঙায় উঠে আছে’—জহরের কবিতায় এই মৃত বালিকার বক্ষসন্ধি থেকে উত্থিত স্বপ্নই সৃষ্টির আহ্বান। কিংবা ‘তোমার লেখায় মেয়েদের মৃতদেহের ওপর সারাদিন গঙ্গাফড়িং লাফায়’—এখানেও গঙ্গাফড়িং জীবনের প্রতীক হয়ে নিরর্থকতার, নিরাশার, মৃত্যুর মানে খুঁজে এনে দেয়। জীবনানন্দের ‘বসন্তের জ্যোৎস্নায় অই মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই, এর সঙ্গে যদি জহরের ‘ঋতু’ কবিতা তুলনা করি; জহর লিখেছেন ‘আমাদের মৃতদেহ আমরাই কাঁধে তুলে হাত রাখি অঙ্কুরিত বীজে।’ জীবনানন্দের জীবনের স্পন্দন দূর থেকে শুধু ‘বসন্ত জ্যোৎস্নায়’ খুঁজতে চাইলে খোঁজ মিলবে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে; এদিকে জহর নিজের মৃতদেহ কাঁধে তুলে কিন্তু হাত রাখেন অঙ্কুরিত বীজে! এখানেই জীবন চেতনায় অন্তর্দীপ্ত জহর, অনন্য।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যেমন বলেন—“কাব্যের মুক্তি পরিগ্রহণে; এবং কবি যদি মহাকালের প্রসাদ চায়, তবে শুচিবায়ুতা অবশ্যবর্জনীয়, তবে ভুক্তাবশিষ্টের সন্ধানে ভিক্ষাপাত্র হাতে নগর পরিক্রমা ভিন্ন তার গত্যন্তর নেই। কারণ কাব্যের পথে উল্লঙ্ঘন চলে না; সেখানকার প্রত্যেকটি খাত পদব্রজে তরণীয়, প্রত্যেকটি ধূলিকণা শিরোধার্য, প্রত্যেক কণ্ঠক রক্তপিপাসু; সেখানে পলায়নের উপায় নেই, বিরতির পরিণাম মৃত্যু, বিমুখমাত্রেই অনুগামীর চরণাহত।”
সত্যিই জহর সেনমজুমদার জীবনানন্দ থেকে যেমন পরিগ্রহণ করেছেন, তেমনি মহাকালের প্রসাদের উদ্দেশ্যে সমকালকে পুরাণ ও প্রকৃতির মধ্যে ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন অনিবার্যতায়; প্রত্যেক কণ্ঠক রক্তপিপাসু জেনেই ভুক্তাবশিষ্টের সন্ধানে ভিক্ষাপাত্র হাতে গ্রাম ও নগর পরিক্রমায় নেমেছেন কবি।
কিন্তু সুধীন দত্তের পাঠকও যেমন হাতেগোনা তেমনি কি জহরের ব্যাপারেও ঘটতে পারে? তবে মেহিকোর আমাদো নের্ভো (১৮৭০-১৯১৯) নালিশ করে যখন বললেন :
মেহিকোয় লোকে তাদের জন্যেই লেখে যাঁরা নিজেরাও লেখেন। কোনো সাহিত্যিকের মাত্র বাছাই করা পাঠকের একটা বৃত্ত বা গণ্ডি আছে—তারাই তাঁর একমাত্র সবেধন পাঠক। ফরাসিরা যাকে বলে ‘সাধারণ লোক’ তারা বইও কেনে না, বোঝেও না—তা যত সহজ করেই কেউ লিখুক না কেন।
তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরে জহর সেনমজুমদারের কবিতা কেমন? কিংবা কারা তার পাঠক? শ্রেষ্ঠ কবিতার আলোচনা কিংবা পাঠক সংক্রান্ত প্রশ্নে জ্যঁ লুক গোদারের সেই ‘ফিল্ম সোশ্যালিজম’ মুভিটির শেষ কথাটিই বলা চলে—‘নো কমেন্টস।’