X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমার মেঘশিরীষ

মোকারম হোসেন
০৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:২১আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৩০

আমার মেঘশিরীষ
ছেলেবেলার কথা, একদিন উত্তরবাগে আম কুড়াতে গিয়ে দেখি ছোট্ট ঝোপের পাশে একটি ফুটফুটে সতেজ চারা। কিন্তু চারা গাছটির মাথা ভাঙা। খুবই নির্মম কাজ। দেখে মায়া হলো। তুলে এনে ঘরের পাশে টিলার উপর লাগিয়ে রাখি। পাশেই ছিল কয়েকটি পেঁপে গাছ। বাবা দিনে কয়েকবার পেঁপে গাছগুলো দেখতে যান। পেঁপে গাছের ক্ষতি হবে ভেবে তিনি হঠাৎ একদিন এই অচেনা চারাটি তুলে ফেলেন। স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি বেচারা চারাগাছটি নিয়ে খেলায় মেতেছে ছোটরা। ভাগ্যিস গাছটির পাতা ছিঁড়ে পয়সা বানায়নি ওরা! আমি সযত্নে চারাটি তুলে বাড়ির শেষ প্রান্তে জামরুল গাছের পাশে লাগিয়ে দিলাম। দিন কয়েক পানি দিয়ে যত্ন-আত্তি করার পর সেই যাত্রা গাছটি বেঁচে যায়। বেশ কিছু দিন গাছটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের ক্লাশের মিতুলের হাতে কলকে ফুলের ডাল দেখে আবার চারাটির কথা মনে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরে গাছটির কাছে যাই। প্রায় হাতখানেক লম্বা হয়েছে। বর্ষাকাল হওয়ায় তখন গাছটি বেড়েছেও ভালো।
বর্ষার শেষদিকে চারপাশে হঠাৎ পানি বাড়তে শুরু করলো। এ ফাঁকে কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হলো। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উঠানে পানি থই থই করছে। বাড়ির বড়রা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ঘর থেকে বাইরে যাবার উপায় কি? কিন্তু আমরা এসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত না হয়ে কাগজের নৌকা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নৌকা ভাসানোর এমন সুযোগ খুব কমই আসে। উঠানের এক চিলতে বাগানের দিকে চোখ পড়তেই আবার চারাগাছটির কথা মনে পড়ে। পা টিপে টিপে গাছটির কাছে চলে যাই। পাতাগুলো বুঁজে আছে। যেন ঘুমাচ্ছে। পানির ভেতর গাছটি বেঁচে থাকবে কিনা ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলি। গাছটি মাটিসহ তুলে নিয়ে আসি। তারপর আমাদের পুরনো দুধের টিন জোগাড় করে সেখানে বসিয়ে দিই। সবই তো হলো, এবার গাছটি রাখব কোথায়। খুব বেশি ভাবতে হল না, পুঁইশাকের মাচা তো আছেই। মাসখানেক পর বন্যার পানি শুকাতে শুরু করল। বন্যায় কলা, কাঁঠাল আর পুঁইশাকের গাছ মরে ভূত হয়ে গেল। অবশ্য আমার চারা গাছটি এই ফাঁকে আরো হাতখানেক লম্বা হয়েছে।
এবার গাছটির ঠাঁই হলো আমাদের বাহিরবাড়ির কাছারি ঘরের সামনে। একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিলাম তাকে। সে অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হতে থাকলো। বছর ঘুরতেই ডালপালা ছাড়িয়ে বেশ সুশ্রী হয়ে উঠলো। গাছটির চমৎকার ভঙ্গি ও ডালাপালার সুদৃশ্য গড়ন সবার নজর কাড়তে সক্ষম হলো। ধীরে ধীরে সবাই তাকে পছন্দ করতে শুরু করলো। এখন আর কেউ তাকে উপড়ে ফেলার কথা ভাবে না। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে আগে দেখি পাতাগুলো জোড়ায় জোড়ায় বন্ধ হয়ে থাকে। আমি গায়ে হাত বুলিয়ে বলি, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো! ব্যাপারটা সেরকমই। বিকেলের শেষভাগেই ওরা ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করে। এতদিনে অবশ্য গাছটির পরিচয়ও জানতে পেরেছি। গ্রামের মানুষ বলে রেনডি কড়ই (রেইনট্রি বা মেঘশিরীষ)। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা মেঘশিরীষ বা বৃষ্টিশিরীষ নামে ডাকেন।
আসলে জীবজগতে সকল প্রাণীর জন্ম ও বেঁচে থাকার চিত্র অনেকটা এমনই। একটি ‘প্রাণ’ বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করতে থাকে। এই সংগ্রামের মধ্যে আছে খাদ্য গ্রহণ, অভিযোজন, বংশবৃদ্ধি ও প্রতিযোতিার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা যদি একটি বনতল বা বনের উপরিভাগ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একসময় গ্রামে কিছু মাঝারি ঘনত্বের বন ছিল। যেখানে ছিল বিচিত্র গাছপালার আবাস। অন্যান্য বড়সড় বনের মতো এসব বনেও প্রাকৃতিকভাবেই গাছ জন্মায়। কিছু কিছু গাছ থেকে নিচে বীজ পড়ে আপনাআপনিই চারা হয়। এসব চারার ঘনত্ব এতই যে, মাটিও দেখা যায় না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এধরনের ছোটখাটো বনে বিলেতি গাবের চারার ঘনবদ্ধ গাঁথুনি চোখে পড়ে। যার অধিকাংশই বনতলে জীবন শেষ করে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা গাছগুলোই কেবল পর্যাপ্ত আলো বাতাসের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তাই জীবনের দৌড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম অনিবার্য। অভিযোজনের চেষ্টাও নিরন্তর।
আমরা কিন্তু অতটা খেয়াল করি না যে একটি গাছ কিভাবে জন্মে ও বেড়ে ওঠে। প্রতিটি কাজই হয় কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে। একজন কৃষকের কথাই বলি, তিনি যখন মাঠে শস্য বোনেন তখন একেবারে সরাসারি বীজ থেকে চারা জন্মানোর দৃশ্যটি তার দেখার সুযোগ হয়। নরম তুলতুলে মাটিতে প্রথম তার শিকড় ছড়িয়ে পড়ে, তারপর দুটি বুঁজে থাকা পাতা নিয়ে ছোট্ট একটু কাণ্ড বেরিয়ে আসে মাটি ফুঁড়ে। পৃথিবীতে এসে আলো বাতাস পেয়ে ছোট্ট পাতা দুটি পাখনা মেলে দেয়। তারপর হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় মাঝখানের পাতাটির। উদার প্রকৃতির আহ্বানে সেও নিজেকে বিকশিত করে। এভাবেই শুরু হয় বৃক্ষের জীবন। প্রতি মুহূর্তেই বদলাতে থাকে তার রূপ। আজ এক রকম তো পরের দিন আরেক রকম। আমরা অবাক হয়ে ভাবি, একটি ছোট্ট গাছ কিভাবে বদলে যেতে থাকে। এক বছর পর আমরা আরো অবাক হয়ে ভাবি সেদিনের দুই পাতার গাছটি এতটা বদলে গেল কী করে?
গাছের বয়স যখন এক বছর, তখন আমাদের ভাবতেই হয় এই সময়টা সে কিভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখল। কারণ আমরা জানি যে একটা ছোট্ট গাছের পদে পদে বিপদ থাকে। হাঁস-মুরগী খেতে পারে, মানুষ পাড়াতে পারে, পোকা কাটতে পারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে পারে—সবকিছু এড়িয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা সত্যি সত্যি কঠিন কাজ। আমরা হয়তো বুঝতে পারি না, সংগ্রামমুখর জীবনে গাছপালারও শিশুকাল আছে, যৌবন আছে, তারপর পরিণত বয়সে জরা দেখা দেয়, একসময় হারিয়ে যায় আমাদের আশপাশ থেকে।  
আমার মেঘশিরীষ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে গাছ ও পাতার গড়ন। এ কারণে ছোট গাছ আর বয়সী গাছের সঙ্গে অনেক তফাৎ দেখা দেয়। চিনতেও কষ্ট হয়। কিছু কিছু গাছের পাতা কখনো একসঙ্গে ঝরে পড়ে না, সারা বছরই দু’একটি করে ঝরতে থাকে। এ ধরণের গাছকে চিরসবুজ বা চিরহরিৎ গাছ বলে। নাগেশ্বর এ রকমই একটি গাছ, সারা বছর কিছু না কিছু তামাটে রঙের নতুন পাতা গজাতে থাকে। আর যেসব গাছের পাতা বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে ঝরেপড়ে সেগুলোকে পাতাঝরা বা পত্রমোচি বলা হয়। আমাদের দেশে এরকম গাছের সংখ্যা বেশি, যেমন—জারুল, সোনালু, কনকচাঁপা ইত্যাদি।
পাতা গাছপালার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূলত পাতার আলঙ্করিক বিন্যাসই গাছের শোভা বাড়ায়। পাতা গাছের কি কাজে লাগে, এমন একটা প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে। পাতা গাছের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। প্রধান কাজ হচ্ছে খাদ্য সংগ্রহ করা। পাতা সূর্যের তাপ ও অক্সিজেন সংগ্রহ করে তা কাণ্ড ও ডালপালায় ছড়িয়ে দেয়। এভাবে সে গাছকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এছাড়াও গাছের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে তার পাতা। পাতাহীন গাছ কখনোই সুন্দর হতে পারে না। পাতা ও ডালপালার চমৎকার গড়নের জন্য কোনো কোনো গাছ আমাদের খুবই প্রিয়। এধরণের একটি গাছের নাম মেঘশিরীষ। দেখতে ছাতার মতো। ডালগুলো অনেকদূর গিয়ে কিছুটা বাঁকা হয়ে মাটির দিকে নেমে আসে। এরা ছায়াবৃক্ষ। বটও তাই। ঝুরি নামিয়ে নামিয়ে এরা কয়েক একর জায়গা দখল করতে পারে। ঝুরিগুলো মাটিতে লেগে যাবার পর সেগুলোই কাণ্ডে পরিণত হয়। তখন আর মূল কাণ্ডটি খুঁজে পাওয়া যায় না।
বেঁচে থাকার লড়াইয়ে একটি বৃক্ষ বা তৃণ-গুল্ম জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কতগুলো ধাপ বা পর্যায় অতিক্রম করে। জীবজগতের আন্তঃপ্রক্রিয়ায় একটি গাছ সর্বপ্রথম অভিযোজনের চেষ্টা করে। পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াই ওদের প্রধান কাজ। এক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা মুখ্য। মূলত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বংশবৃদ্ধির প্রয়োজন। আর এজন্য ওরা কতগুলো কৌশলের আশ্রয় নেয়। কিছু বীজ বাতাসে উড়ে উড়ে অনেক দূর-দূরান্তে পাড়ি জমায়। আবার কিছু বীজ পানিতে ভেসে ভেসেও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে, কোনো কোনো বীজ মাটির ওম বা তপ্ত বালুর ভেতর কাটিয়ে দিতে পারে বছরের পর বছর। তারপর পৃথিবীর সান্নিধ্যে এসে প্রাণ সঞ্চারের পরপরই শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান