X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাযযাদ কাদির ভাই : স্মৃতি ও সৃষ্টিতে

নূর কামরুন নাহার
০৭ এপ্রিল ২০১৭, ০৭:৩৬আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:১৮

সাযযাদ কাদির। জন্ম : ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৭ মৃত্যু : ৬ এপ্রিল ২০১৭
সাযযাদ কাদির এই নামটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো ব্যক্তি সাযযাদ কাদিরকে জানার অনেক আগেই। পত্রিকার পাতাতেই তিনি ছিলেন পরিচিত নাম। আমি যে পত্রিকা পড়া খুব পছন্দ করি তা নয়। কিন্তু জনসংযোগ পেশায় আছি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। তাই পেশার অংশ হিসেবেই পত্রিকা পড়তে হয়। গণযোগাযোগ ও  সাংবাদিকতার ছাত্রী হিসেবেও উল্টাতে হতো পত্রিকার পাতা। তারও আগে আমার বাবাও জনসংযোগে ছিলেন। আমাদের ঘরে আসতো নানা পত্রিকা। তাই পত্রিকা পড়াটা না চাইলেও হয়ে যেত, আর এভাবে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখা যেন একটা বদঅভ্যাসেই পরিণত হয়ে গেলো। তাই পত্রিকা দেখতেই হতো আর এই পত্রিকা দেখতে গিয়ে প্রায়ই দেখতাম এই নাম বিশেষ করে জনকণ্ঠে  প্রায় প্রতিদিন তার লেখা প্রকাশিত হতো। নানা বিষয়ে লিখতেন তিনি। বিভিন্ন বিষয়ে তার জানাশোনা দেখে অবাক হয়ে যেতাম। আরো অবাক হয়ে যেতাম একটা মানুষ এতো লিখতে পারেন কি করে? সত্যি বলতে নানা বিষয়ে এতে লেখা, এতো বিষয়ে তার জানাশোনাই আমাকে তাড়িত করেছিলো সাযযাদ কাদির ভাইয়ের সাথে পরিচিত হতে। নানা অনুষ্ঠানে তার সাথে দেখা হবার সুযোগ বহুবার ঘটলেও প্রথম কথা হয় টেলিফোনে। ২০১১ সালে আড়িয়াল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় সাহিত্যপত্রিকা ফেরারির। পত্রিকাটির জন্য কবিতা পাঠানোর অনুরোধ জানাতেই তার কাছে আমার এ টেলিফোন। খুবই আন্তরিকতার সাথে তিনি সে অনুরোধ গ্রহণ করলেন এবং শুধু গ্রহণ করলেন না বললেন আমার হাতেই কবিতাটি দিতে চান।  প্রতি শুক্রবার বিকেলে নাটমণ্ডলে তখন ম্যাজিক লণ্ঠনের কবিতার আড্ডা হত। ম্যাজিক লণ্ঠনের আড্ডাতে তিনি আসতেন। আমিও এই আড্ডার সাথে বহু বছর ধরে সম্পৃত্ত। দুদিন পরেই ম্যাজিক লণ্ঠনের আড্ডা। তিনি আমাকে অবশ্যই আড্ডায় আসতে বললেন। আড্ডার এক ফাঁকে আমার হাতে তুলে দিলেন কবিতা। আর সেই প্রথম আমি সামনাসামনি কথা বললাম সাযযাদ কাদির ভাইয়ের সাথে। বেশ অনেকক্ষণ কথা হলো। কবিতা, গল্প, সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হলো। মনে হলো না এই প্রথম আমরা কথা বলছি। সে দিনের আলোচনা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছি, গাছের গুড়িতে সামান্য হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এলো, জ্বলে উঠলো লাইটগুলো। তখনও তিনি নানা বিষয়ে উৎসাহ নিয়ে কথা বলছেন, মগ্ন হয়ে পড়েছেন সাহিত্য আলোচনায়। মনে হচ্ছিলো আরো অনেকক্ষণ কথা বলতে চান । কিন্তু কবিতার আড্ডা হচ্ছে। আমরাও আড্ডায় যোগ দেব । তাই কথা আর বাড়ানো যায়নি। সেইদিনই তিনি বলেছিলেন– আপনার সাথে সাহিত্য নিয়ে অনেক আলোচনা প্রয়োজন।
সাহিত্য নিয়ে আলোচনার ব্যাপক আগ্রহ ছিলো সাযযাদ ভাইয়ের। অনেক বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ না হলেও মাঝে মাঝেই সাযযাদ ভাইয়ের সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে। সেইসব আলোচনার বেশির ভাগ জুড়েই থাকতো বর্তমান সময়ের লেখা। লেখার সমস্যা এই সব। তাতে আমার মনে হতো সাযযাদ ভাই তরুণদেও লেখা বেশ পড়েন। আমার গল্প নিয়েও তিনি দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন আমার সাথে। লেখালেখির প্রসঙ্গে আমার সেই কৌতুহল আর মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলাম– সাযযাদ ভাই আপনি এতো লেখেন কি করে? কিভাবে এটা সম্ভব? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন– আমি কোনো সময় নষ্ট করি না। সবসময় লেখা নিয়েই ভাবি। লেখি নয়তো পড়ি, তাই এটা সম্ভব হয়।  
লেখার ক্ষেত্রে তার এই একাগ্রতা নানাভাবেই দেখেছি, ফেরারির জন্য এরপরও তিনি আমাকে প্রবন্ধ দিয়েছিলেন। ঠিক সময়ের মধ্যেই তিনি লেখা দিয়েছেন। কোনদিন কোনো কারণেই দেরি করেননি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন– ‘সব লেখাই আমি লিখি আগাগোড়া ভেবেচিন্তে। কোনও লেখার ভাবনা মাথায় এলে তা কোত্থেকে শুরু করে, কি-কি লিখে, কোথায় শেষ করবো– তা মনে-মনে ছকে নিই আগে। তারপর লিখতে বসি।’ সম্ভবত এজন্যই তিনি এতো লিখতে পেরেছেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি । সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি রেখেছেন তার মেধাও প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। শুধু লেখক নয় সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবেও তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। খুবই কর্মময় এবং সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন তিনি, ভাষার ওপর তার দখল ছিলো অসাধারণ, বিশ্ব সাহিত্যের ওপরেও তার পড়াশোনা ছিলো প্রচুর। খুবই আন্তরিক ছিলেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোটগল্প নিয়ে যখন বড় একটা লেখা লিখছি তখন সে সময়ের একটা গল্প সংকলন ফটোকপি করে নিজে আমার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। ভালো লেখার প্রশংসা করতেন প্রাণ খুলে। একইভাবে কোনো লেখায় তথ্যের ঘাটতি বা লেখা ভালো না হলে সেটাও মুখের ওপর বলে দিতে কুণ্ঠা বোধ করতেন না।
সাযযাদ কাদির ভাই খুবই প্রাণবন্ত একজন মানুষ ছিলেন, ছিলেন উদ্যোগীও। সাহিত্যের জন্য, বাংলা সাহিত্যের বিকাশ এবং আরো ভালো কিছু করার জন্য তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন। সাহিত্যের সর্বজনীন চেতনাকে লালন করার তীব্র তাড়না ও  ভালবাসা থেকে ২০০৪ সালে গঠন করেন ‘বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’। তিনি এই সংগঠন থেকে সাহিত্যের নানা অনুষ্ঠানে সকলকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। সাযযাদ কাদির ভাই ১লা আশ্বিনকে ‘বাংলা কবিতা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন ‘বিশ্ব কবিতা দিবসের’ মতো বাংলা কবিতা দিবস থাকুক। তিনি তার সংগঠনের আয়োজনে ‘বাংলা কবিতা দিবস’ পালন করতেন। তার এই বাংলা কবিতা দিবস’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণেরও সুযোগ হয়েছিলো আমার। কবি শাহীন রেজা ভাইয়ের ‘বৈচিত্র’ পত্রিকা অফিসে এক উৎসবে এবং গাজীপুরের নয়নপুরে খোলা প্রকৃতির মাঝে অনুষ্ঠিত আরেকটি উৎসব এই দুটো অনুষ্ঠানে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। দুবারই তিনি প্রচণ্ড আগ্রহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে এই কবিতা দিবস অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এবং মনেপ্রাণে চাইছিলেন এই দিনটি বাংলাদেশের কবিতার এবং কবিদের হয়ে উঠুক। তার সেই প্রচেষ্টা পুরোটা সফল হয়েছে এমন হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু সাযযাদ ভাই কবিদের সামনে একটি দিন নিয়ে এসেছেন যেটা একান্তই বাংলা কবিতার ।  
তিনি মানুষের সঙ্গ চাইতেন। আড্ডা দিতে খুব পছন্দও করতেন। যতটুকু তাকে বুঝতে পেরেছি তিনি খুব আবেগপ্রবণ ছিলেন। যেমন দুবাহু বাড়ায়ে কাছে টানতেন তেমনি আবার মনে কষ্টও পেতেন তাড়াতাড়ি। তিনি যেমন ব্যস্ত মানুষ ছিলেন তেমনি আমিও নয়টা– পাঁচটার অফিস সময়ে আর সংসারের নানা কাজের বেড়াজালে বন্দি, তাই অনেক সময়ই তার অনেক আমন্ত্রণে যেতে পারিনি। এ নিয়ে তার ক্ষোভ ছিলো অভিমান ছিলো। সেটা আবার তিনি চেপে না রেখে প্রকাশও করতেন। যতটুকু তাকে বুঝতে পেরেছি অনেক সৃষ্টি, অনেক বন্ধু অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরেও সাযযাদ ভাইয়ের ভেতরে কোথাও একটা বেদনা ছিলো, একটা জ্বালা ছিলো আর তাই তার ভেতরে ছিলো এক টুকরো শান্তি আর স্বস্তির প্রার্থনা, একটু ছায়ার আশ্রয়ের আকুলতা । যেমনটি তিনি তার কবিতায় বলেছেন– 
ছায়া কোথায়? হাত-পা ছড়িয়ে উদোম হয়ে
রোদ্দুর শুয়ে আছে সবখানে।
কাল রাতে বৃষ্টি ছিল, আজ একটু ছিঁটেফোঁটা নেই
গাছের পাতায়।
পলাতক সব মেঘ।
হাওয়া-ও নেই আজ। তাই
কোথায় পাবে একটু স্নিগ্ধময়তার ছোঁয়াছুঁয়ি?
কিছুটা সুশীতল আরাম?

(সামনে রোদ্দুর)

অনেক পরিকল্পনা করে লিখলেও জীবনের সবটুকু তিনি গুছিয়ে হয়তো যেতে পারেননি। অনেক কাজ করতে চেয়েছেন। তার অনেক কিছুই সমাপ্ত হয়নি। এই একটা কর্মময় জীবনে তাকেও নানা সমস্যা চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। প্রশংসার পাশাপাশি নিন্দাবাক্যও শুনতে হয়েছে। একজন কবিকে তো এভাবেই ঘাত আর প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হয় আর তাই কবি যতো প্রস্ততিই নিক আসলে জীবন কেটে যায় প্রস্তুতিহীন তার কবিতার লাইন থেকেই বলা যায়–
একটা জীবন তোমার কেটে গেল কেমন প্রস্তুতিহীন
ঢাল নেই, তলওয়ার নেই
তবুও দাঁড়িয়ে পড়লে যুদ্ধক্ষেত্রে–
তারপর বুক পেতে নিতে হল
ঝাঁকে ঝাঁকে বিষমাখা তীর
মুখ বুজে সইতে হল কত হামলা আর হুঙ্কার ।

তোমার সাজানো বাগান বার বার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল,
কতবার তোমার বধুয়া চলে গেল
তোমারই আঙ্গিনা দিয়ে
আর অপ্রস্তুত তুমি সবসময় দাঁড়িয়ে থাকলে
কেমন কাচুমাচু হয়ে মনে মনে নিজেকে শোনালে নিজে;

সাযযাদ কাদির ভাই আকস্মিক চলে গেলেন। খানিকটা বেদনা নিয়েও গেলেন বোধ হয়। বাংলা একাডেমির পুরস্কার তিনি পেলেন না। এই নিয়ে তার কষ্ট ছিলো, সে কষ্ট তিনি চাপা দিয়ে রাখেননি। কাছের মানুষ, বন্ধু মানুষদের কাছে বলেছেনও। প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য পুরস্কার কোনো বড় বিষয় নয়। কবি পুরস্কারে বেঁচে থাকেন না, বেঁচে থাকেন তার সৃষ্টিতে। তিনিও বেঁচে থাকবেন তার কবিতায় আর সৃষ্টিতে, মানুষের ভালোবাসায়–
তবুও ভালোবাসা নামে এক
আলো ও আশা থাকুক বুকের গভীরে।

 

আরো পড়ুন-

সাযযাদ কাদির : যথেচ্ছ ধ্রুপদী এবং উইকিপিডিয়া-ব্রেন

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী