X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিতুমীরের জন্মভিটায় || পর্ব-৩

মুহম্মদ মুহসিন
০৯ মে ২০১৭, ১১:৩২আপডেট : ০৯ মে ২০১৭, ১৫:৪৪

তিতুমীরের জন্মভিটায় || পর্ব-৩

পূর্বপ্রকাশের পর

কুঠুরির ছবি তুলে ফিরে ঐ লোকটিকে আবার জিগ্যেস করলাম ভিতরে ভিতরে ইমাম হোসেনের (রাঃ) স্মরণে নির্মিত ওটি কি? লোকটি বিরক্তির সাথে উত্তর দিলো- ‘কেন? কারবালা’। আমি নাদান বুঝলাম না কিছুই। আমি তো জানি কারবালা হলো ইরাকের এক প্রান্তর, যেখানে কুখ্যাত ইয়াজিদের চক্রান্তে মহানবীর (সঃ) নাতি ইমাম হোসেন সপরিবারে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন। নারিকেলবেড়িয়ার একটি ভবন কীভাবে কারবালা হয় আমার মাথায় তার কিছুই ঢুকলো না। মাথায় কিছু ঢুকলো না বলেই বোকার মতো ক্ষোভ নিয়ে আবার ঢুকলাম ঐ বেষ্টনীর মধ্যে। আমি ঢুকলাম ঠিকই তবে আমার মাথায় এবারও কিছু ঢোকানোর পেলাম না। তবে ইমাম হোসেন লিখিত ভবনের গায়ে দুটো পোস্টার পেলাম প্যানাফ্লেক্সের। একটিতে ছিল খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর নিম্নরূপ একটি উক্তি :

৯২/৭৮২/১১০
হোসাইনের নামে আমার জীবন উৎসর্গকৃত, আমি কেবল তারই গোলাম যিনি হোসাইনের গোলাম।
—খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী
সৌজন্যে : হজরত আলী আকবার (আঃ) এ্যাসেসিয়েশন
পোস্টারটা দেখলাম, কিন্তু ভেবে বুঝে উঠতে পারলাম না কিছুই। কোনো লেখার শুরুতে ৭৮৬ লিখলে তা দিয়ে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বোঝায়। আরবি বর্ণমালার প্রতি হরফের সংখ্যা মান আছে। বিসমিল্লাহর হরফের সংখ্যামান যোগ করলে সমষ্টি দাঁড়ায় ৭৮৬। সেই ভিত্তিতে ৭৮৬ হলো বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। কিন্তু ৯২ এবং ১১০ দ্বারা এমন কিছু বোঝানোর কাহিনি আমি কোথাও শুনিনি। বুঝলাম না সে সংখ্যার ভেদ। আবার মঈনউদ্দীন চিশতীকে চিশতীয়া তরিকার প্রবর্তক এক সুন্নী মুসলমান হিসেবে জানতাম। তিনি নিজেকে হোসাইনের গোলাম মর্মে শিয়া আকিদার স্বীকৃতি দিয়েছেন এমনটাও কোথাও শুনিনি। এইসব মাথা ঘুরানো বিষয়াদি দেখে মনে হচ্ছিলো এখানে ঘুরে ঘুরে মূর্খতা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। বেরিয়ে পড়ি। তবে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দ্বিতীয় পোস্টারটির কাছে গেলাম ছবি তুলতে। এই পোস্টারটিতে অবশ্য মাথা আর নতুন করে ঘুরলো না। এটিতে শিরোনাম দেয়া আছে ‘কারবালার ৭২ শহীদের নাম’। নিচে অবশ্য ৬৭ জনের নাম আছে। বাকী ৫ জনের নাম নেই কেন? নাই থাকতে পারে। এতে আর মাথা ঘোরার কী আছে?
এমন শক্তিশালী সান্ত্বনা নিয়ে বের হয়ে এলাম তিতুমীরের নারিকেলবেড়িয়া বাঁশের কেল্লার স্মৃতি বিজড়িত ভূমির বেষ্টনী থেকে। বের হওয়ার সময় বেষ্টনীর মূল ফটকের পাশে দেখলাম একটি কাগজের পোস্টার। এই পোস্টারের লেখাটি ছিল নিম্নরূপ :
৯২ (৭৮৬) ১১০
বিষাদময় শাহাদাৎ দিবস স্মরণে:
পরিচালনাঃ আল-মাহদী (আঃ) ফাউন্ডেশন
স্থান : কেওটাশাহ মসজিদ হইতে নারিকেলবেড়িয়া কারবালা
তারিখ : ইং ৫মার্চ ২০১৭, বাং ২১ শে ফাল্গুন ১৪২৩, রবিবার
সময় : সকাল ১২ টা হইতে প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত

উল্লিখিত নির্ঘণ্ট অনুসারে সর্বকালীন বিশ্বনারীকুল সম্রাজ্ঞী, নির্যাতিতা হযরত ফাতিমা যাহরা (সাঃ আঃ) এর ১৪২৭ তম শোকবহ শাহাদাৎ দিবস পালনে এক বিশেষ শোক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইয়াছে।

উক্ত অনুষ্ঠানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি একান্ত কাম্য।

আহ্বায়ক
আল-মাহদী (আঃ) ফাউন্ডেশন
হেড অফিস- মন্দ্রা, জেলা- উত্তর ২৪ পরগনা

ভিতরে বেষ্টনীর মধ্যে মাথা বেশিই ঘোরার কথা। এবার বাইরে আলো বাতাসে দাঁড়িয়ে এই পোস্টারটির অনেক অসংলগ্ন তথ্যও যেন মাথাটাকে অতোটা ঘুরালো না। বরং এই পোস্টারটি থেকে বুঝতে পারলাম এখানকার শিয়ারা বাংলাদেশের মতো শুধু ইমাম হোসেনের শাহাদাৎ নিয়েই শোক করে না। এখানে শোক হযরত আলীর পরিবারের অনেককে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হয়। এরা কি তাজিয়া না বলে বাংলায় সরাসরি শোক অনুষ্ঠান বলে? আর এরা বাংলাদেশের শিয়া তো বটেই এমনকি সুন্নীদের চেয়েও উদার। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- মর্মে যে শ্লোগান বাংলাদেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীরা বলে থাকেন এখানে শিয়ারা খোদ তাদের ধর্মীয় আহ্বানপত্রেই সেই কথা স্পষ্টাক্ষরে উদারভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে- ‘উক্ত অনুষ্ঠানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি একান্ত কাম্য’। পোস্টারটি থেকে আরো বুঝলাম গোসল করতে থাকা ভদ্রলোক আব্দুল কাদের বিরক্তিতে হোক আর স্বাভাবিক মেজাজে হোক ঠিক কথাই বলেছেন, এ স্থানের নাম সত্যিই কারবালা- নারিকেলবেড়িয়া কারবালা।
আব্দুল কাদের ভদ্রলোক তার গোসল ও ধৌতকার্য তখনো চালিয়ে যাচ্ছিলো। গোসল করতে থাকা টিউবওয়েলটির পিছনেই একটি মসজিদ। ১০০ গজের মধ্যে পূর্ব দিকে আরো একটি মসজিদ। সাহস করে আব্দুল কাদের সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম- ‘এত কাছাকাছি দুটি মসজিদ কেন?’ আব্দুল কাদেরের উত্তরে আবারও বিরক্তি কিংবা বিস্ময়। ‘ওটাতো শিয়া মসজিদ, আর এটা হলো সুন্নী মসজিদ’। ‘ও আচ্ছা! এই সুন্নী মসজিদওয়ালা বাড়িটার নাম কী’? ‘বিশ্বাস বাড়ি’।
বিশ্বাসবাড়ি কথাটার মধ্য দিয়ে আমার ইতিহাস পাঠ হঠাৎ যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলো। এটিই তাহলে সেই মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসের বাড়ি? মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাস ছিলেন নারিকেলবেড়িয়া গ্রামের সেই ব্যক্তি যিনি সরফরাজপুরে তিতুমীরের প্রথম মসজিদ কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক ভস্মীতূত হওয়ার পরে তিতুমীরকে তাঁর তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার সংস্কার ও জমিদার এবং ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের কার্যক্রমের সদরদপ্তর স্থাপনের জন্য নিজ বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলেন। তিতুমীরকে তাঁর ধর্মীয় সংস্কার ও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের সমর্থনে তখন বাড়িতে স্থান দেয়া ছিল অনেক ঝুঁকির বিষয়।
বিশ্বাস বাড়ির এই ইতিহাস যখন মনেই পড়লো সে সুযোগে তিতুমীরের ইতিহাসের একটি প্রাথমিক ধারণা এখানে টেনেটুনে হলেও হাজির করা যায়। একথা মোটামুটি অনুমান থেকেই বলা যায় যে, তিতুমীর ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন যথেষ্ট ডানপিটে। সাহসী কিছু ঘটিয়ে ফেলার সম্ভাবনায় তিনি ছিলেন সকলের জন্যই ভয়ের এক ব্যক্তি। ছেলেবেলায় গ্রামীণ মাদ্রাসায় পড়াশোনাকালেই তিনি পার্শ্ববর্তী এক ব্যায়ামাগারের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেখানে অনুশীলনের মাধ্যমে একজন কুস্তিগীর হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ১৮১৫ সালে তিনি কোলকাতায় একজন পেশাদার কুস্তিগীর হিসেবে বাস করতেন। পরে নদীয়ার এক জমিদারের অধীনে একজন লাঠিয়াল হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। লাঠিয়ালের চাকুরিতে থাকাকালে একবার এক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় তিনি ধৃত হন এবং বিচারে তিনি কিছুকাল জেলে আবদ্ধ থাকেন। জীবনের এই পর্যন্ত তিতুমীর ছিলেন একজন লাঠিয়াল মাত্র।
তাঁর তিতুমীর হয়ে ওঠার টার্নিং পয়েন্টটি ছিল তৎকালীন মোগল সম্রাটের দরবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার ঘটনা। অনুমান করা যায় যে, কুস্তিগীর হিসেবে খ্যাতিতেই তিতুমীরের নামটি পৌঁছায় মোগল রাজদরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তি মির্জা গোলাম আম্বিয়ার দরবারে। মির্জা গোলাম আম্বিয়া তখন ছিলেন কোলকাতার মির্জাপুর এলাকার জমিদার। এ ঘটনা ১৮২০-২২ সালের দিকের। মোগল দরবারের এই প্রভাবশালী লোকটির আশীর্বাদে তাঁর সাথে তিতুমীর ১৮২৩ সালে মক্কায় হজ্ব করতে যাওয়ার সুযোগ পান। হজ্জব্রত শেষে তিতুমীর মক্কায় আরো চার বছর অবস্থান করেন। চার বছর মক্কা অবস্থানকালেই মূলত তাঁর জীবনে ঘটলো সেই যুগান্তকারী ঘটনা যা তাঁকে পরিণত করেছিল আমাদের জানা তিতুমীরে। ঘটনাটি ছিল শহীদে বালাকোট সৈয়দ আহমদের বেরেলভির শিষ্যত্ব লাভ।
ফলত তিতুমীরের পরবর্তী জীবন নিয়ে কথা বলার জন্য বলে নেয়া দরকার কে ছিলেন এই সৈয়দ আহমদ বেরেলভি। সৈয়দ আহমদ ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরেলির সন্তান। বয়সে তিতুমীরের চেয়ে চার বছরের ছোট। অর্থাৎ ১৭৮৬ সালে জন্ম। সৈয়দ আহমদের পিতার নাম ছিল সৈয়দ মুহাম্মদ ইরফান এবং পিতামহ ছিলেন সৈয়দ ইলমুল্লাহ। সৈয়দ আহমদ ছিলেন ইমাম হাসানের বংশের অধস্তন ৩৪তম পুরুষ। তৎকালীন ভারতীয় মুসলমানদেরকে জাতীয়ভাবে উজ্জীবিত করনের প্রয়াসে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার একজন অনুসারী। শাহ ওয়ালীউল্লাহর প্রসঙ্গটি বুঝতে এবার আরও একটু পিছনে যাওয়া দরকার।
১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মুত্যুর পরে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর ত্রিমুখী বিপদ আপতিত হয়। মারাঠারা, শিখরা এবং ইংরেজরা তিন দিক দিয়ে মুসলমানদের জীবন-যাত্রা বিপর্যস্ত করে তোলে। এই সব বিপদ ও অনৈসলামিক অনুষঙ্গ মুসলমানদের আত্মপরিচয় বিপন্ন করে তোলে এবং মুসলমানরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হীনমন্য এক সম্প্রদায়ে পরিণত হতে থাকে। তারা ধর্মাচারের শুদ্ধি হারিয়ে অপর ধর্মাদির সাথে লীন হতে শুরু করে। এই অবস্থা থেকে মুসলমানদেরকে জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত করতে যাঁর আবির্ভাব হয়েছিল তিনি ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভি। তাঁর জন্ম হয়েছিল আত্তরঙ্গজেবের মুত্যুর চার বছর পূর্বে ১৭০৪ সালে। শাহ ওয়ালীউল্লাহর পিতা আব্দুর রহীম ছিলেন আওরঙ্গজেবের বিখ্যাত গ্রন্থ ফতওয়ায়ে আলমগীরির অন্যতম সংকলক। শাহ ওয়ালীউল্লাহ পরবর্তী জীবনে মুঘলদের পতনকালে ক্ষয়িষ্ণু ও দুর্দশাগ্রস্ত মুসলমানদেরকে জাগ্রত করে তোলা ও এক মঞ্চে দাঁড় করানোর প্রয়াসে তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়া নামে একটি সংস্কার আন্দোলনে মুসলমানদেরকে সম্পৃক্ত করতে ব্রতী হন। তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়া ছিল অনেকটাই আরবের পণ্ডিত ও সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের সংস্কার কার্যক্রমের অনুরূপ। শাহ ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর এই আন্দোলনের হাল ধরেন তাঁর পুত্র শাহ আবদুল আজিজ। শাহ আব্দুল আজিজের মৃত্যুর পর এ আন্দোলনের ঝাণ্ডা চলে আসে যাঁর হাতে তিনিই হলেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, শহীদে বালাকোট।
১৮২০ সালে সৈয়দ আহমদ বেরেলভী গিয়েছিলেন হজ্জ করতে। তিনিও চার বছর মক্কায় অবস্থান করেছিলেন। এই সময়ই তিতুমীরের সাথে মক্কায় দেখা হলো সৈয়দ আহমদ বেরেলভির। মক্কায় সৈয়দ আহমদের সাথে দীর্ঘ সান্নিধ্যে তিতুমীর দীক্ষিত হন সৈয়দ আহমদের সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনায়। মক্কা থেকে সৈয়দ আহমদ ১৮২৪ সনে দেশে ফেরেন আর তিতুমীর ফেরেন ১৮২৭ সালে। কিন্তু দুজনই ফেরেন একই উদ্দেশ্যে, মুসলমানদেরকে উজ্জীবিত করতে হবে অধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রামে।
তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়া প্রচারে আত্মনিয়োগের শুরু থেকেই সৈয়দ আহমদের পরিকল্পনা ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের। এ লক্ষ্যে তিনি ১৮১১ সালে টংকের নবাব আমীর খান পিন্ডারির সেনাবাহিনীতে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮১৬ সালে আমীর খান ইংরেজের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হলে তিনি আমীর খানের সেনাবাহিনী থেকে প্রশিক্ষণ ছেড়ে দিল্লী ফেরেন। ১৮২৪ সালে হজ্জ থেকে ফিরে তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যে, তিনি ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে দুর্ধর্ষ উপজাতীয় মুজাহিদদেরকে সাথে নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করবেন। সেখান থেকে শুরু করে বিজয়ের ঝাণ্ডা নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে দাঁড়াবেন ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু সে অগ্রসর হওয়ার পথে তাঁর প্রথম বাঁধাই শিখ রাজ্য পাঞ্জাব। তাই তাঁর প্রথম যুদ্ধ ছিল পাঞ্জাবরাজ দুর্ধর্ষ রণজিৎ সিং এর বিরুদ্ধে।
রণজিৎ এর সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর সহযোদ্ধা মুজাহিদরা শুধু উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতিরা ছিল না, বরং তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার অনুসারী সারা ভারতের হাজার হাজার ভক্তের অনেকেও সেখানে যোদ্ধা ছিল। বিশেষ করে তাঁর সহযোদ্ধা ছিল শত শত বাঙালি। আবার তাঁর সকল ভক্তের প্রতি নির্দেশ ছিল না উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে গিয়ে তাঁর সাথে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। বরং শত শত তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার ভক্ত ও মুজাহিদকে তিনি দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন ভারতের বিভিন্ন স্থানে নিজ নিজ এলাকায় তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার পক্ষে মানুষকে একত্রিতকরণের এবং মুসলিম-বিরোধী শক্তি বিশেষ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের। সৈয়দ আহমদের এই শেষোক্ত দায়িত্বের ভক্ত ও মুজাহিদদের একজন ছিলেন তিতুমীর। তাঁর দায়িত্ব ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে না গিয়ে বাংলায় তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার ভক্তগণকে একত্রিতকরণ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা।
তিতুমীরের প্রচারিত তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার দিকে মানুষ দলে দলে ঝুঁকলো এ কারণে নয় যে, তদবধি প্রচারিত অন্য চারটি তরিকা অর্থাৎ কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার চেয়ে ইসলামের সাধনায় এটি যোগ্যতর কোনো তরিকা ছিল; বরং এই তরিকার প্রতি গরিব-মেহনতি মুসলমানরা দলে দলে এই কারণে ঝুঁকলো যে এই তরিকার অধীনে একত্রিত হয়ে তারা নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। এই তরিকা শুধু এবাদাতের ধরন বাৎলালো না, বরং একতাবদ্ধ হয়ে নিপীড়ক শক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তালকিন দিলো। বিশেষ করে জমিদারি নিপীড়ন-নির্যাতন রুখে দাঁড়ানোর আহ্বানে অজস্র মানুষ তিতুমীরের ভক্ত হয়ে উঠলো। বোঝাই যায়, সেই ভক্তদের মধ্যে বীরোচিত একজন ছিলেন মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাস। তিনি চাইলেন রুখে দাঁড়ানোর এই শক্তি বিপ্লবে রূপান্তরিত হোক। সেই বাসনায় জীবনের ঝুঁকি জেনেও তিনি তিতুমীরকে আহ্বান করলেন নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য এবং তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার কার্যক্রমের জন্য তার বাড়িতে এর সদরদপ্তর পুনঃনির্মাণের। তদনুযায়ী তিতুমীর মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসের বাড়িতে নির্মাণ করলেন তাঁর প্রতিরোধশক্তির দুর্গ, বাঁশের কেল্লা। আমি তখন সেই মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসের বাড়িতে দাঁড়িয়ে। ইতিহাসের অনেক ট্রাজিক ও রোমাঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী এই মাটিতে দাঁড়িয়ে ভিতরে এক কাঁপন অনুভব করলাম। এ ধরনের আবেগের কম্পনে নিজেকে প্রায় নিশ্চল ও নির্বাক অনুভব করলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ভদ্রলোককে জিগ্যেস করলাম আপনি কি এই বাড়ির অর্থাৎ আপনি কি আব্দুল কাদের বিশ্বাস? লোকটি হাঁ-সুচক মাথা নাড়লো।
জিগ্যেস করলাম- আপনি কি মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসের নাম জানেন? পাশের পাড়ার এক মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসকে তিনি চেনেন বললেন; তবে তিনি তখন বাড়ি ছিলেন না বলেও জানালেন। আমার তখন হাসির পরিবর্তে বরং একটু হলেও দুঃখই লাগছিলো। মনে হলো কত সার্থক ছিল ইংরেজদের পরিকল্পনা! তারা এমন ব্যবস্থা করে যেতে পেরেছে যে এই মাটিতে জন্মেনি আর কোনো তিতুমীর কিংবা মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাস এবং এমনকি এই মাটি থেকে তারা ভুলিয়ে দিতে পেরেছে তিতুমীর কিংবা মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসের নাম। ইতিহাসের এই সকল গল্প মনে করতে করতেই মনে পড়লো কী ঘটেছিল তিতুমীরের মৃতদেহের ওপর। তাঁকে সহ ৫০ জন সশস্ত্র সংগ্রামীর দেহ তারা পুড়িয়ে দিয়েছিল যাতে তিতুমীরকে স্মরণের জন্য কবরটিও আর না থাকে। এই কাহিনি মনে পড়ার সাথে সাথে নিজেকে নিয়ে ভিতরে ভিতরে একচোট রঙ তামাশাই হয়ে গেল- ‘বাহ্, কী কায়দা! যার লাশই ছিল না আমি পুরো দুপুর জুড়ে তার মাজার খোঁজায় ব্যস্ত’।
পাশাপাশি দুটি মসজিদ কেন তা বুঝতে না পারায় আব্দুল কাদের বিশ্বাস আমার উপর যে-বিরক্তি প্রকাশ করেছিল, সে-বিরক্তি এখন আমার নিজের ওপরই হতে শুরু করলো। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কম সে ঠিক আছে, কিন্তু যেটুকু আছে তাতেই তো বোঝা উচিত ছিল যে, বিশ্বাস বাড়ির মসজিদ তো শুধু বিশ্বাস বাড়ির জন্যই কারণ এ মসজিদ সুন্নী রীতির এবং এ বাড়ির মানুষেরা তো মুঈজ উদ্দীনের বংশধর হিসেবে সুন্নী রীতিরই ছিল। মুঈজ উদ্দীন তো তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার লোক ছিল। তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার লোকদের শিয়া হওয়া তো স্বাভাবিক নয়। সুতরাং পাশের শিয়া মসজিদ তো তাদের মসজিদ হতে পারে না। তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়া ধর্মীয় সংস্কারে যা যা বন্ধ করছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল মহররম অনুষ্ঠান তথা মহররমের তাজিয়া ও মাতম। ফলে এতদঞ্চলে তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়া শিয়ারীতির বিরুদ্ধে ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ সাহায্যে হোক কিংবা স্থানীয়দের আগ্রহে হোক তিতুমীরের মুহাম্মাদীয়া তরিকা থেকে এতদঞ্চল শিয়া মতে পুরোপুরি ফিরে যায়। তবে মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়ার মসজিদটি সুন্নী বা তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ায়ই রয়ে গেছে। এতিমের মতো সেই মসজিদ এখন এটুকুই জানান দিচ্ছে যে এই বাড়িতে একসময় ছিল তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার মূল ঘাঁটি, তিতুমীরের ধর্মীয় সংস্কার কার্যক্রমর এককালীন সদরদপ্তর। (চলবে)

তিতুমীরের জন্মভিটায় প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে

আরো পড়তে ক্লিক করুন :
তিতুমীরের জন্মভিটায় || পর্ব-১

তিতুমীরের জন্মভিটায় || পর্ব-২

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া