X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্য হচ্ছে মধ্যবিত্তের বিষয় : পেদরো হুয়ান গুটিয়েররেজ

অনুবাদ : দিলওয়ার হাসান
২৮ মে ২০১৭, ১১:২৩আপডেট : ২৮ মে ২০১৭, ১২:২৮

সাহিত্য হচ্ছে মধ্যবিত্তের বিষয় : পেদরো হুয়ান গুটিয়েররেজ
[কিউবার লেখক পেদরো হুয়ান গুটিয়েররেজ স্বদেশে ও বিদেশে সমধিক পরিচিত। কবিতা, ছোটগল্প আর উপন্যাস মিলিয়ে ২০টির বেশি বই লিখেছেন। আর প্রায় সব লেখারই পটভূমি সেন্ট্রো হাবানা আর তার আশপাশের এলাকা, যেখানে আছে নানান বাণিজ্যিক কেন্দ্র, অফিস ভবন, হোটেল, বার, ক্লাব আর আছে চায়না টাউন (বাররিও শিনো)। হাবানা শহরের মধ্যে এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। শুধু ভৌগলিক অবস্থানই নয়, ১৯৮৯ সালে কিউবা থেকে সোভিয়েত সাহায্য প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল তার চালচিত্রও পাওয়া যায় গুটিয়েররেজ-এর লেখায়। তার জন্ম ১৯৫০ সালের ২৭ জানুয়ারি কিউবার মানতানজাসে। জীবিকার জন্য তিনি গ্রহণ করেছেন বহু বিচিত্র পেশা। কাজ করেছেন আইসক্রিম বিক্রেতা, খামারের শ্রমিক, সাঁতার প্রশিক্ষক, নির্মাণ শ্রমিক ও সাংবাদিক হিসেবে। খোলামেলা যৌনতার ছড়াছড়ি আছে তার লেখায়।
উল্লেখযোগ্য বই : ডার্টি হাবানা ট্রিলোজি, কিং অব হাবানা, ট্রপিক্যাল এনিমেল, দ্য ইনসাটিয়ের স্পাইডারম্যান, মেলাঙকলি অব লায়নস, ডগ মিট,  স্নেকস নেস্ট ও আওয়ার জিজি ইন হাবানা। তাকে সমালোচকেরা ‘কিউবান ডার্টি রিয়েলিজম’-এর পুরোধা বলে অভিহিত করেন।
গত বছরের গোড়ার দিকে খ্যাতনামা লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক ও অধ্যাপক ইজিও নেয়রা গুটিয়েররেজ-এর একটি প্রাণবন্ত সাক্ষাৎকার নেন। ওই সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বয়ান এখানে পত্রস্থ করা হলো। -অনুবাদক]

সাক্ষাৎকারী : পাঠক হিসেবে আপনার জীবনের সূত্রপাতের কথা দিয়ে শুরু করতে চাই। আপনার পড়া প্রথম বই কোনটা? সাহিত্যের বাইরের শিল্পের কোন শাখায় আপনার জীবনের প্রথম দিকটাতে প্রভাব ফেলে?
গুটিয়েররেজ : ছোটবেলায় কমিকসের বই খুব পড়েছি। পিনার দেল রিও নামের এক ছোট্ট শহরে থাকতেন আমার এক খালা। তার একটা বার্তা সংস্থা ছিল। তিনি মেক্সিকো থেকে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা কমিক্সের বই আমদানি করতেন যা সংখ্যায় ছিল বিপুল। তার সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছিল আমার, প্রতিটা বই ৫ সেন্টে কিনে নেব আর বিক্রি করবো ৭ সেন্টে। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ব্যবসা। ওই কাজটা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছি, আর মুফতে পেয়েছি গাদা-গাদা বই।
মোনতানজাস শহরে যে গুটি কয়েক লাইব্রেরি ছিল তার একটা নাম গুইটারাস। আমাদের বাড়ির খুব কাছে ছিল সেটা। ওখানে গিয়ে অনেক বই পড়েছি। ছোটবেলায় যেসব বই সাধারণত সবাই পড়ে আমি তা-ই পড়েছি : সালগারি, ভার্ন, টোয়েন, ডিফো এ রকম আরকি। ১৬ বছরের বয়সের সময় ট্রুম্যান কাপোট-এর ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিস’ বইটা পড়ার সৌভাগ্য হয়। বইটা আমার জীবনটা একেবারে বদলে দেয়, কারণ বইটা পড়ে বুঝতে পারি সাহিত্য এমনভাবে রচনা করতে হয় যাতে বোঝা না যায় এটা সাহিত্য। সেই মুহূর্তেই আমি সিদ্ধান্ত নেই কোনো দিন যদি লিখি তাহলে এমনি করে লিখব।

সাক্ষাৎকারী : আপনি তো নানা ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। সবচেয়ে বেশিদিন যে-কাজটা করেছেন তা হচ্ছে সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার ব্যাপারটা আপনার সাহিত্যকর্মে কতখানি প্রতিফলিত হয়েছে?
গুটিয়েররেজ : আমার ধারণা আমার লেখায় সাংবাদিকতার উপস্থিতি বেশ প্রবল। ২৬ বছর সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলাম, ওগুলো বাদ দেয়া কঠিন ব্যাপার। সাংবাদিকতার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা নিয়েছি তা হচ্ছে ভাষার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চর্চা। ভাষার প্রয়োগ হতে হবে সরাসরি, সংক্ষিপ্ত। আপনি যা লিখছেন তার একটা শব্দও অনাবশ্যক বা প্রয়োজনাতিরিক্ত হবে না।

সাক্ষাৎকারী : আপনার গল্প ও উপন্যাসের পটভূমি হাবানা শহর। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে সেন্ট্রো হাবানার আশপাশের এলাকা যেখানে আপনি নিজেও থাকতেন। ওই এলাকাকে পটভূমি করার বাসনা আপনার কোত্থেকে জাগলো?
গুটিয়েররেজ : সাহিত্য আমার কাছে সব সময়ই একটা বিরোধিতা ও সংঘাত। এই দুটির উপস্থিতি না থাকলে আমার আগ্রহ হয় না তাতে; আমার কাছে তা খুব বিরক্তিকর বলে প্রতিভাত হয়। ওগুলোকে মনে হয় বিরক্তিকর লোকজনদের ব্যাপার, যাদের জীবনে কোনো ঘটনা নেই, যারা বাস করে বিরক্তিকর একটা পরিবেশে, নিরস স্থানে। কিউবাতে ব্যাপারটা একটুখানি ভিন্ন। খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে এ রকম লোক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর নয় এখানে। নানা রকম ব্যাপার রয়েছে (দারিদ্র্য, কিউবার লোকজনের চরিত্র, মেজাজ মর্জি, সামাজিক ও ঐতিহাসকি উন্নয়ন) যা একসাথে এমনভাবে এসে হাজির হয় যে, মনে হয় আমাদের জীবনটা একেবারে শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছে গেছে। ওই সব বিষয় বিস্তর বিরোধ ও দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। সেন্ট্রো হাবানায় চলে আসবার আগে একটা পার্থিব জীবন যাপন করেছি। রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতাম। প্রতিদিন গায়ে দিতাম ছোট হাতার গুয়াইয়েবেরা শার্ট, ক্লিন শেভ থাকত, ঘড়ি পড়তাম, গাড়ি ছিল- যাকে বলে একটা মধ্যবিত্ত জীবন যাপন। ছোট্ট একটা পরিবার ছিল, ছিল দুটি সন্তান, ড্রইং রুমে ক্যাকটাসের বাহার, কুকুর পুষতাম একটা। ওই জীবনের সঙ্গে ভালভাবে খাপ খাওয়াতে পারিনি। ১৯৮৬ সাল নাগাদ এসেছিলাম ওখানে। চার-পাঁচ বছর পরেই তো আমাদের দেশ পড়ল এক মহাসংকটে। ১৯৮৯ সালে ‘বার্লিন ওয়াল’ ভেঙে ফেলা হলো আর ১৯৯১-তে পতন ঘটল সোভিয়েত ইউনিয়নের। ওই দুটি ঘটনাই দেশের সংকট ডেকে এনেছিল। আর সবার ওপরে ছিল আমার নিজের ব্যক্তি জীবনের সংকট। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছিল আমার জীবনে, খুবই মানসিক ব্যাধি উদ্রেককারি একটা ব্যাপার। জীবনে এসেছিল গভীর বেদনা। সব কিছুই ত্যক্ত-বিরক্ত করেছিল আমাকে। নিকটাত্মীদের অনেকেই চলে যাচ্ছিল পৃথিবী ছেড়ে। এ সময় মারা যান আমার বাবা, আমার এক পরম বন্ধু, আমার এক সন্তানের মা। শেষে কতগুলো ব্যাপার এক সাথে চলে আসে- মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে।

সাক্ষাৎকারী : কিউবার ‘পেরিওদো এস্পেসিয়াল’ (সংকটের কাল)-এর সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত জীবন মিলে যায়...
গুটিয়েররেজ : তখন মদটদ খেয়ে একেবারে মাতাল হয়ে যেতাম। একটা দ্বৈত জীবন যাপন চলছিল আমার। যে এলাকাতে  থাকতাম, সেখানে চলত অবাধ যৌনাচার, মদ আর পাগলামি; অন্যটা ছিল একজন নিরেট সাংবাদিকের। যেমন করেই হোক, না-বুঝে না-জেনে বই লেখার জন্যে বিস্তর মালমশলা জোগাড় করে ফেলেছিলাম। তখন বুঝিনি লেখার কাজটা ঘটে যাচ্ছে। ওই প্রবল বিশৃঙ্খল জীবন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছিলাম আর ‘যৌন-নেশা’ পেয়ে বসেছিল আমাকে। এটাকে বিশৃঙ্খলা বা বাছবিচারহীনতা বলা যায় না। শৃঙ্খলাহীনতা এক জিনিস আর যৌনতার প্রতি প্রবল ঝোঁক বা নেশা, তামাক, মারিজুয়ানা বা মদে আসক্তি আরেক জিনিস। পাগলামিতে ভরা জীবন আরকি! পরে স্পেনের মালাগাতে গিয়ে স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। ১৯৯৪ সালে কিউবায় সবচেয়ে সংকট কালে হাবানাতে ফিরে আসি। সে-বছর ৫ আগস্ট স্বাধীনতার দাবিতে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উন্মুক্ত মঞ্চে। যেহেতু মঞ্চের কাছেই আমি থাকতাম, সবকিছু সচক্ষে দেখার সুযোগই হয়েছে আমার। অবাকই হয়েছিলাম। ভাবতেই পারিনি কিউবার মানুষ এভাবে প্রতিবাদ করতে পারে। মানুষ এত ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছিল যে, রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল শেষে। ফিদেল সে রাতে একটা ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন, বর্ডার খুলে দেওয়া হবে (ওটা বাক্যালংকার ছাড়া কিছুই ছিল না, আমাদের কোনো সীমান্ত ছিল না, যা ছিল তা হচ্ছে  সমুদ্র, যেখানে ছিল গণ্ডায় গণ্ডায় হাঙ্গর)। ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাস জুড়েই শুধু বালসেরা বা কিউবার ভেলা আরোহীর গল্প শোনা যায়। ব্যাপারটা চলে ওই সমুদ্র পাড়ি দেয়া বন্ধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্ব পর্যন্ত। খুবই অপমানজনক একটা ব্যাপার ছিল আমার চোখে। আমি তো নিজে চোখের দেখেছি, মদমত্ত ভেলা আরোহীরা কী করছে তা না জেনেই সমুদ্রে পথে পাড়ি জমাত। নির্ভর করত এইসব দুর্বল, ক্ষীণ পন্থার ওপর। কখনো কখনো তারা ফাপানো টায়ার, কাঠের তক্তা বা রামের বোতলের ওপর ভর করে সমুদ্র পাড়ি দিত, জানত না কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা ক্ষুব্ধ করতো আমাকে। নৈতিকভাবে আমি খুব অপমান বোধ করেছি। আমার মনে হয়েছে কিউবার ইতিহাসে ওটা ছিল সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও অপ্রীতিকর সময়। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কত জন হাঙ্গরের পেটে গেছে কারও জানা ছিল না। কতজন পৌঁছুতে পেরেছিল তা আমাদের জানা থাকলেও কতজন কিউবা ত্যাগ করেছিল তা জানা ছিল না কারও, কেননা ওই ব্যাপারটা খুব কমই তদারক করা হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে আমি এত ক্ষুব্ধ ছিলাম যে, ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে কী ঘটছে তা নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলি।

সাক্ষাৎকারী : হাবানা ট্রিলোজির শুরুতেই ব্যাপাটা ছিল, তাই না?
গুটিয়েররেজ : ঠিক বলেছেন। ওই গল্পটা লেখার পর আমার কানে অনেক ঘটনা আসে, তো আমি আরেকটা গল্প লিখে ফেলি। প্রায় ৩ বছর আমার মনের ওরকম অবস্থা ছিল। কাজেই ৭০টার মতো গল্প লিখি। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, একটা গল্পের সঙ্গে আরে একটার সম্পর্ক ছিল, যদিও তা আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না। আমার লক্ষ্য ছিল গল্পগুলো যাতে আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে যায়। তিন বছর শেষ হলে ওই গল্পগুলো নিয়ে তিনটি বই প্রকাশিত হয়। সান্তিয়াগো দ্য কিউবার প্রকাশক এডিটোরিয়াল অরিয়েন্ট বইগুলো ছাপাবে এ রকমা সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি, কারণ তারা ভয় পেয়েছিল। পরে যখন পাণ্ডুলিপি তাদের কাছ থেকে ফেরত পাই তখন এক ফরাসি প্রকাশিকা হাবানা হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি পাণ্ডুলিপিগুলো ইউরোপে নিয়ে যান। তিনি এমন এক ব্যক্তির কাছে ওগুলো রাখতে দেন যিনি পরে আমার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। বস্তুত ওই মহিলাই অ্যানাগ্রামা পাবলিশিং হাউসের কাছে পাণ্ডুলিপিগুলো তুলে দেন। এখন তো ধরুন বিশ্বের ২০টি ভাষায় ওই বই প্রকাশিত হয়েছে।

সাক্ষাৎকারী : আপনার লেখার পেছনে যে-রাজনৈতিক অনুপ্রাণনা আছে সে বিষয়ে জানার খুব আগ্রহ আমার। আপনি কি বলবেন, ওই সময়গুলোতে কিউবায় যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ ছিল তার একটা সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া হাবানা ট্রিলোজি?
গুটিয়েররেজ : আমি তা মনে করি না। এর পেছনে ছিল আসলে প্রচণ্ড ক্রোধ আর প্রবল হতাশার অনুভূতি। আমার তাবৎ প্রজন্মের অনুভূতিও সে রকমই ছিল। আমার বয়স এখন ৬৫। ওই সময় ধরুন ৪০ বা তার বেশি যারা মনেপ্রাণে বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন তারা ভীষণ প্রতারিত বোধ করেছেন। অনেকেই তার ধর্ম ত্যাগ করেছেন, অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, আবার আমার মতো অনেকেই নেশা আর পাগলামির ভেতর ডুবে গেছেন। কিন্তু ওই লেখাটাতে সমালোচনা বা প্রতিবাদ করার কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ আমার ছিল না, কারণ রাজনীতি ও সাহিত্যের ফারাক আমার  কাছে খুবই স্পষ্ট। রাজনীতি সব সময়ই অবস্থানগত একটা ব্যাপার। আপনি যদি রাজনীতি করতে চান তাহলে তা করতে হবে সাংবাদিকতা বা অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে; কিন্তু ও সবে আমার আগ্রহ ছিল না। রাজনীতি, রাজনৈতিক বিতর্ক বা বীরত্ব ও শৌর্য বীর্যের ব্যাপারে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। যে-কারণে আমার বইয়ে কোনো বীরগাঁথা বা বীর নেই, আর অবস্থানগত রাজনীতি বিষয়ে একটা লাইনও পাওয়া যাবে না। এ বাবদে আমার আদর্শ দস্তয়েভস্কি, যিনি জেল খেটেছেন, তাঁকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছিল। অপর দিকে তিনি তার রাজনৈতিক প্রচারপত্র রচনা করেছিলেন আর লিখেছিলেন ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। তিনি খুবই সমসাময়িক লেখক। তিনি যথার্থ স্থানে গিয়ে সম্পাদনা করেন। রাজনৈতিক পরোক্ষ উল্লেখ হিসেবে যা কিছু পাঠ করা যেতে পারে তিনি বাদ দিয়ে দেন। এ রকম ভাবে যদি লেখাটা তৈরি হয় তাহলে সেখানে একটা কাব্যিক ফর্ম তৈরি হয়।

সাক্ষাৎকারী : সে যা-ই হোক, আপনার লেখা কিন্তু প্রায়শই রাজনৈতিক হিসেবে পাঠ করা হয়, বিশেষ করে হাবানা ট্রিলোজি ও দ্য কিং অফ হাবানা। বিষয়টার প্রতিক্রিয়া আপনার ভেতর কী রকম?
গুটিয়েররেজ : বেশ ভাল রকমের প্রতিক্রিয়া হয় আমার ভেতর। অনেকে তো রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য আমার দ্বারে এসে হাজির হয়েছেন, যেন আমি ভিন্নমতাবলম্বী। মৌলিক একটা কিছু অনুধাবন করার পূর্ব পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, প্রত্যেকের একটা নিজস্ব পাঠ আছে, যা কিনা শিল্পের মৌলিক ধারণা। হ্যাঁ, সবারই একটা নিজস্ব পাঠ আছে। রাজনীতিতে আপনার আগ্রহ থাকলে তা আপনি এক কাপ কফিতেও তা দেখতে পাবেন। তবে আপনার যদি আগ্রহ থাকে সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান বা যৌন বিষয়ে, তাহলে এর সব কিছুই পাবেন আমার বইয়ে। সব পাঠকই যা বিশ্বাস করেন তা নিয়ে নিজেকে আগ্রহান্বিত করে তোলার শিক্ষা লাভ করিনি আমি।

সাক্ষাৎকারী : নিজেকে কেন এমন লেখক হিসেবে উপস্থাপন করলেন যিনি রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন না, আর রাজনীতি বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে চান না। কথাটা জিজ্ঞেস করছি এ কারণে যে, হয়তো আমরা এই বিষয়ে একমত হয়ে পারি যে, রাজনীতি বিষয়টা নিয়ে কথাবার্তা না বলাটাই হচ্ছে এক ধরনের অবস্থান, তাই না?
গুটিয়েররেজ : ব্যাপারটা আসলে কী হয়, এ দেশটা তো খুবই রাজনৈতিক, যেখানে রাজনীতি নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা হয়। যে কারণে আমি জোয়ে ভালদাসের মতো হতে চাই না। তিনি লেখক হলেও জীবিকার জন্যে সাহিত্যের বদলে রাজনীতির ওপর নির্ভর করেন। অন্যসব লেখকদের বেলায়ও এ রকম ঘটে। লেখক যখন রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে থাকেন তখন তো তাকে চাপের মধ্যে পড়তেই হয়। চাপের মধ্যে পড়তে হয় কারণ সারাটা জীবন ধরেই তাকে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হয়। ঠিক এই সময়ের কথাই ধরুন না- রাউল ক্যাস্ট্রো আর বারাক ওবামার সঙ্গে আলোচনা বিষয়ে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭/৮ জন সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু রাজনীতি বিষয়ে আলাপে কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। আমি একজন লেখক।

সাক্ষাৎকারী : আমাদের এই কথাবার্তার সময় ২/৩টি বাক্যে রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যার শীর্ষে ছিল কিউবার চরম সংকটকালে আপনার ক্ষোভের বিষয়টা। আপনাকে বিরক্ত করবার মতো কোনো ইচ্ছে পোষণ না করেই বলি, বিপ্লবের পর সব কিছুই কি রসাতলে গেছে?
গুটিয়েররেজ : আমার মনে হয় তারা যেটা করছেন আসলে- একটা সামাজিক-গণতান্ত্রিক পরিকল্পনা উদ্ধার করতে চাইছেন। ওই শব্দটা এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না, কেননা রাজনীতিকদের জন্য তা সুবিধাজনক নয়, কারণ তারা ইউরোপীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে পারছে না, আর ওখানে তাদের সর্বোচ্চ স্বার্থটা নেই। আমার মনে হয় কিউবা এখন খুব কৌতূহলদ্দীপক প্রকল্পের সম্মুখীন হচ্ছে- চেষ্টা তদবির করতে হবে আস্তে-আস্তে, তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা ফিরিয়ে আনতে হবে, গরিবদের সাহায্য করতে হবে, যাতে একদিনের জন্যেও তাকে রাস্তায় নামতে না হয়। এই প্রকল্পটা আমি সমর্থন করি, আমার দৃষ্টিতে এটি হচ্ছে সামাজিক-গণতান্ত্রিক। অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যাতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো অবস্থা না হয়। সবকিছুই চাপে আছে এমন মনে করি না। আরো ভাল কিছুর জন্য নানান কিছু উদ্ভাবিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার বইগুলো এখন কিউবা থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যেই ৬/৭টা বেরিয়েছে, আরও তিনটা প্রকাশিত হয়েছে হাবানা বইমেলার সময়। এ সবই হচ্ছে খোলামেলা ও  শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির লক্ষণ।

সাক্ষাৎকারী : ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি এবার। সেক্স আপনার উপন্যাসে কীভাবে কাজ করে? ওখানে যে-যৌনদৃশ্যগুলো আসে তা কি আপনার জীবনযাপনের প্রতিফলন ঘটায় অথবা আপনার আশপাশে যা ঘটেছে তার চিত্রায়ণ? ওগুলোর কি কোনো বর্ণনামূলক ভূমিকা আছে?
গুটিয়েররেজ : অংশত তা-ই। ব্যাপারটা আমার কাজে আসে। আমার লেখার যৌনদৃশ্যগুলো কিন্তু অকারণ নয়। বর্ণনার জন্যে যখন তা অর্থপূর্ণ তখনই কেবল তা ব্যবহার করি। আগাথা ক্রিস্টির মতো লোকজনকে খুন না-করিয়ে আমি বরং সেক্স করাই, যা কিনা অনেক বেশি কিউবান বলে মনে হয়, আর অবশ্যই অনেক বেশি শোভন। এর পেছনে একটা আইডিয়া অবশ্যই আছে। একজন কিউবান হিসেবে আমার মনে হয়, আমরা খুব সেক্সুয়াল। এদিক থেকে বিচার করলে আমরা বহুলাংশে পশুর মতো, কিউবানদের মতো নয়। আমার ধারণা যেভাবে আফ্রিকানরা স্প্যানিশদের সঙ্গে মিশেছে, দেশিয়দের সঙ্গে সেভাবে মিশেনি। মেক্সিকো, পেরু আর বলিভিয়ার মানুষ জন্মগতভাবেই অন্যরকম, ফলে তাদের মেজাজ-মর্জিও ভিন্ন রকমের। আমরা যদি এমন ধারার সেক্সুয়াল হয়ে থাকি, আমরা যদি নিউ জার্সি বা ভেরমন্টের বাসিন্দা না হই, আমরা যদি হয়ে থাকি কিউবান, ক্যারিবিয়, তাহলে কেন  আমরা সেক্সের ব্যাপারটা বাদ দেব, কেন আমরা পরিহার করবো। কেন বাদ দেব ওখানে বসবাসরত লোকজনের অশ্লীল, প্রলাপ আক্রান্ত আর অকেজ ভাষা। ও রকমই আমার সাহিত্য। আমি সময় ও স্থানের প্রতিফলন ঘটাই যা আমাকে স্পর্শ করে। একই সঙ্গে মধ্যবিত্তদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের একটা তৃষ্ণা আমার ভেতর আছে। সাহিত্য হচ্ছে মধ্যবিত্তের ব্যাপার-স্যাপার। আমি বলতে চাইছি লেখকরা সব সময়ই মধ্যবিত্ত- পাঠকরাও, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন সম্পাদক, এজেন্ট, সমালোচক তারাও মধ্যবিত্ত। এলিট শ্রেণির লোকজন আর যারা খুবই দরিদ্র সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত নয়। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন বা আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে আমরা অভ্যস্ত, তাদের সমস্যা, সংস্কার বা কুসংস্কার, দু’হাজার বছরের পুরনো খ্রিশ্চিয়ান ধর্ম বিশ্বাস প্রোথিত আছে সাহিত্যে, আছে গোটা বিংশ শতাব্দি। মধ্যবিত্তের দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখা যৌনতার ব্যাপারটা সব সময় ভাবায় আমাকে (‘আমরা তা নিয়ে কথা বলি না’)। ওটা যদি পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার ও স্বাভাবিক ব্যাপার হয় তাহলে তা নিয়ে কেন কথা বলব না? এটা হচ্ছে মানব-মানবীর স্বাভাবিক দৈহিক ক্রিয়া- মলমূত্র ত্যাগ বা থু থু ফেলার মতোই সাধারণ ব্যাপার। কেন আমরা সেক্স থেকে দূরে থাকবো? অনেক লেখক লেখেন, ‘তাদের মধ্যে দেখা হলো, তারা প্রেমে পড়ল এবং তারা বিছানায় গেল’ -আমাকে খুবই বিরক্ত করে এমন ধারার বর্ণনা।

সাক্ষাৎকারী : আপনার লেখাকে ‘আত্মজৈবনিক’ বললে কি যথার্থ হয়? এই শব্দটি কি আপনার জন্য খাপসই?
গুটিয়েররেজ : হ্যাঁ। গভীর একটা আবেগপূর্ণ জীবন আমি যাপন করেছি। জীবনে অনেক নারী এসেছে, বিস্তর ভ্রমণ করেছি, অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল আর ছিল অফুরাণ পাগলামি। আবার অনেক সময় কেটেছে বিরক্তি, বিশৃঙ্খলা আর বিহ্বলাতার মধ্যে। অনেক মাল মশলাই আছে যেগুলো গুছিয়ে লেখা যায়। কাজেই ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখাতে কোনো আগ্রহ আমার নেই। দেখুন, কোনো আবিষ্কার করারও দরকার নেই। আর চল্লিশ বছরও তো বাঁচব না। নিজের গল্প-কাহিনী খুবই স্বচ্ছ। আমার লেখা খুবই আত্মজৈবনিক, ওগুলো সে-সব লোকজনের জীবনের ওপর ভিত্তি করে লেখা তাদের আমি চিনতাম, যা কিনা আমার জন্য বিস্তর সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

সাক্ষাৎকারী : এখন কী লিখছেন? আত্মজৈবনিক কথাটার প্রেক্ষিতে তা কি নব্বই দশকের চেয়ে ভিন্ন কিছু?
গুটিয়েররেজ : হ্যাঁ, জীবনের পরিবর্তনের সাথে সাথে লেখাতেও পরিবর্তন এসেছে। আমার কবিতায় বিশেষ করে ‘আরাসত্রানদোস আ সেকাস আ লা অসকিউরিদাদ’-এর পর থেকে। উদাহরণ হিসেবের বলতে পারি সম্প্রতি ‘ফবিয়ান ইয়েল কাওস’ নামে একটা উপন্যাস লেখার কাজ শেষ করেছি। ওখানে আমার জীবনের আগের ঘটনাবলী প্রাধান্য পেয়েছে। ষাট ও সত্তর দশকের পটভূমিকায় রচিত। ওই বইয়ে আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে খুব নিবিড়ভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি- এক তরুণ সমকামী পিয়ানো বাদকের জীবনে যা ঘটেছিল। আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু যে কিনা আমার ভাইয়ের মতো ছিল, আত্মহত্যা করেছিল। ওই উপন্যাসটা লিখব কি লিখব না তা স্থির করতে বিশ বছর লেগেছে। শেষ পর্যন্ত ওটা লিখে উঠতে সক্ষম হয়েছি।

সাক্ষাৎকারী : আমি জানি কিউবান/ট্রপিক্যাল/ক্যারিবিয়ান বুকোস্কি এসব শব্দ আপনার বিরক্তি জায়গায়। তারপরও আপনার প্রতি জিজ্ঞাসা বুকোস্কির কবিতা ও উপন্যাস সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
গুটিয়েররেজ : বুকোস্কিকে আমি খুবই পছন্দ করি। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকাডেমিয়া তাকে স্বীকৃতি দেয়নি, কারণ তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে লেখবার সাহস দেখিয়েছেন, দুনিয়ার কোনো কিছুকে পরোয়া করেননি, তোয়াক্কা করেননি প্রাতিষ্ঠানিক লোকজন ও সমালোচকদের। যে সময় লেখকরা ভাল বেতনের সন্ধান করতেন, তিনি তখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ক্লাসও নেননি। হয়েছে কি, তার অভিজ্ঞতাটা ছিল মার্কিন আদলের। তার বাবা ছিলেন জর্মন। একটা ভয় ও শঙ্কার মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছেন, কারণ তারা বাবার ছিল মারধরের স্বভাব। আমার বেলায় সে রকম ঘটেনি। আমার বাবা ছিল ভাল একজন মানুষ। নাৎসি হওয়ার মিথ্যে দাবিদার বেজম্মা জর্মন বাপের সন্তান বা ওই ধরণের কিছু তিনি ছিলেন না। কাজেই ব্যথা-কাতরতায় আমার বাল্যকালটা নস্যাৎ হয়নি। চমৎকার ছিল আমার বাল্যকাল। দারুণ মানুষ ছিলেন আমার বাবা-মা আর দাদা-দাদি। বুকোস্কির সব বই আমার কাছে ছিল। মাঝে মধ্যে বের করে বার বার পড়তাম। তবে আমার মনে হয়, আমার নিজের লেখা থেকে ওগুলো ভিন্ন রকমের।

সাক্ষাৎকারী : ‘জাতীয় সাহিত্য’-এর মতবাদে আপনার বিশ্বাস আছে কি? যদি থাকে তাহলে বলুন, কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় কিউবার সাহিত্যকে সবচেয়ে ভালভাবে সংজ্ঞায়িত করে?
গুটিয়েররেজ : দেখুন, জাতীয় সাহিত্য বিলোপ ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সাহিত্যের আলোচনা বেশ আধুনিকতার পর্যায়ভূক্ত। এ সবে আমার আস্থা নেই। আমি বিশ্বাস করি অন্যসব শিল্পের মতো সাহিত্যও অঞ্চল ভিত্তিক কাজ করে। হতে পারে আমরা, আপনি বা আমি লাতিন আমেরিকান লেখক গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। কিউবান ঐতিহ্য হচ্ছে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম বড় অংশ। আর্জেন্টিনা বা মেক্সিকোর মতো। এগুলো এমন ধরনের রচনা যা অন্য ঐহিত্যের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। এগুলোর নিজস্ব একটা ধরন ও চরিত্র আছে। আমি মনে করি, কিউবার সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য- যার শাখা-প্রশাখা ক্রমেই বিস্তৃত ও প্রসারিত হচ্ছে। মধ্যবিত্তের এই সাহিত্য যা স্পেন বা জার্মানি ও ফ্রান্সে রচিত হচ্ছে- আমাকে উদ্বিগ্ন করে। এলমার মেন্ডোজা, গুয়াদালুপে নেটেল অথবা গুলিয়ারমো আরিয়াগার ব্যাপারে আমার আগ্রহ আছে।

সাক্ষাৎকারী : কিউবান ঐতিহ্যের কোন সারি থেকে আপনার আগমন? কোন কোন লেখককে কাছের বলে মনে করেন?
গুটিয়েররেজ : এ-বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র একটা তত্ত্ব আছে। আমি ওসব দেখতে চাই এই ধারণা দিয়ে যে, কিউবান সাহিত্যের একটা গোপন ঐহিত্য আছে। যা শুরু হয়েছে কার্লোস মন্টিনিগ্রোকে দিয়ে আর ‘হোমব্রি সিন মুজের’ নামের গ্রন্থ আছে সে তালিকায়। পরে তো ওই সারির অনেক বই বের হয়, এই যেমন গুইল্লারমো বোসাল্স’ এর বোর্ডি হোম, হোয়েন্ডি গেরবা’র টোডোস সি ভান আর আমার নিজের বইগুলো। আরও আছে সম্ভবত, আমি ঠিক নিশ্চিত নই কতগুলো- থ্রেস ত্রিসতেস তাইগ্রেস যেটি কিনা কাবরেরা ইনফানতের। অ্যাঞ্জেল সান্তিয়েসস্তিবান আর গুইল্লারমো ভিদাল-এর বই। ছোট গোষ্ঠীর কিছু কিছু লেখক বেশ কৌতুহলোদ্দীপক ও মান সম্পন্ন কাজ করেছেন। আমার পছন্দের তালিয়ায় আছেন- কারপেনতিয়ার আর লিজামা লিমা। তবে তাদের লেখার দ্বারা আমি প্রভাবিত হইনি। প্রভাবের কথা বললে উত্তর আমেরিকার লেখকদের কথা আসে যাদের লেখা অবশ্য পাঠ্য ছিল, অর্থাৎ তাদের আমি মৌলিক লেখক বলে মান্য করি। গল্পের বেলায় আর্নেস্ট হেমিংওয়ে- তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি আমার পছন্দের লেখক নন। তার লেখা পড়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। রেমন্ড কারভার, রিচার্ড ফোর্ড, গ্রেস প্যালি হচ্ছেন গুরু লেখক। মোপাসাঁ আর চেখভ সব সময় আমাকে উদ্দীপিত করে।

সাক্ষাৎকারী : লাতিন আমেরিকার লেখকদের মধ্যে কাদেরকে আপিনি কৌতুহলোদ্দীপক মনে করেন?
গুটিয়েররেজ : বোর্হেস আর কোর্তাসার। গেলমানের কবিতাগুলোও বিস্ময়কর। আরো অনেক বড় বড় লেখকদের একটা গোষ্ঠী আছে যাদের ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই- কার্লোস ফুয়েন্তেস, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস কিংবা মারিও ভার্গাস ইয়োসা। তাদেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যেমন ফুয়েন্তেসের ‘আউরা’ বা ইয়োসার প্রথম তিন বই- কিন্তু এর পরের বইয়ের ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই। হুয়ান রুলফো একজন সত্যিকারের গুরু লেখক, যার লেখা আমি বারবার পড়ি। লাতিন আমেরিকান বুম-এর বড় লেখকদের যে ব্যাপারটাতে আমি বিরক্ত হই তা হচ্ছে- সবকিছুর ব্যাপারেই তাদের একটা বক্তব্য থাকে। এ ধরনের ব্যাপারগুলো আমি ঘৃণা করি, কারণ একজন লেখক হচ্ছেন সাদামাটা ও সাধারণ একজন মানুষ- এমন সাধারণ যিনি নিজেই চা-কফি বানান কিংবা ঘরদোড়, অফিস সাফ করেন।

সাক্ষাৎকারী : সর্বশেষ প্রশ্ন- কিউবার মূল ভূখণ্ডে বসে লেখা ও নির্বাসনে থাকা কালে লেখাগুলোর মধ্যে কি থিমগত ও নান্দনিক কোনো পার্থক্য আছে?
গুটিয়েররেজ : নির্বাসনে থাকা অবস্থায় লেখাগুলোর ব্যাপারে আমার ধারণা নেই। তবে আমার মনে হয়, নির্বাসনে কিউবার লেখককূল পটভূমিকার ভেতর ম্লান হয়ে যান। এরকম ধারণাই আমি পাই। ক্যাবরেরা ইনফান্তের মতো লেখক লন্ডনে বসে কার্যত কিছুই লেখেননি। তবে নির্বাসনে থাকা দুজন লেখকের ব্যাপারে আমি আগ্রহী। এদের একজন সেভিরো সারদুয়ে, যার লেখা আরও বেশি পাঠ ও প্রকাশ প্রয়োজন। অন্যজন রেইনালদো আরিনাস; কিন্তু এই লেখকের বই মাত্র একটি- আন্তেস কুয়ে এনোসেজকা। তার পূর্বেকার লেখার ভেতরে ঢোকা হয়নি, তবে আমার মতে ওগুলো ছিল মিথ্যা বর্ণনা ও অতিকথন দোষে দুষ্ট। তারপরও আন্তেস কুয়ে এনোসেজকা (যেটি কিনা তিনি টেপ রেকোর্ডারে রেকর্ড করেছিলেন মুখে বলে, পরে তার সঙ্গী লেখ্য রূপ দেন)-একটা অসাধারণ গ্রন্থ। একটা আত্মজীবনী, তবে খুব শারীরিক শ্রান্তি, পাগলামি আর চটজলদি করে বলা। পুরো লেখাটাতে আছে পূর্ণ আন্তরিকতা। আমাদের মধ্যে যারা লেখালিখি করি তারা জানি আমাদের নিজেদের জীবনের সবচেয়ে আন্তরিক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে উচ্চমানের সচেতনতা অর্জন কতটা কষ্টসাধ্য। তারপরও রেইনালদো আরিনাস অধিকাংশ নাজুক এলাকা সন্ধান করার দুঃসাহস প্রদর্শন করেছেন, আর তিনি তা করেছেন খুব দক্ষতার সাথে।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
আজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
হৃদয় বিদারক সেই ঘটনার ১১ বছরআজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা