X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আগে গাছ হতে দিন অর্থাৎ মানুষ হতে দিন : সমরেশ মজুমদার

.
১৯ জুন ২০১৭, ১২:৪৯আপডেট : ১৯ জুন ২০১৭, ১২:৫৪

আগে গাছ হতে দিন অর্থাৎ মানুষ হতে দিন : সমরেশ মজুমদার [ছোটবেলায় জলপাইগুড়ির বাবুপাড়া পাঠাগারে বসে বসে যিনি সারাদিন বই পড়তেন, এখন তার লেখা বইয়ের জন্যই বিভিন্ন লাইব্রেরিতে একটি আলাদা বুকসেল্ফ থাকে। তিনি সমরেশ মজুমদার। বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই লেখক পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। তার সঙ্গে কথা বললেন অরুণাভ রাহারায়।]

অরুণাভ রাহারায় : উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ—এই ট্রিলজির জন্যই বাংলা সাহিত্যে আপনার আসন স্থায়ী। সম্প্রতি সেই তালিকায় যোগ হয়েছেন নতুন নাম মৌষলকাল।

সমরেশ মজুমদার : মমতা বিভ্রান্তির সঙ্গে ক্ষমতায় এসেছে। মমতাকে কেউ ক্ষমতায় আনেনি। মমতা এসেছে একদম Nagative মুমেন্টে। আমরা বামফ্রন্টকে আর চাই না কংগ্রেসকেও চাই না। কিন্তু কোনও একজনকে তো ক্ষমতায় বসাতে হবে। সুতরাং মমতা। তখনকার কিছু বুদ্ধিজীবী সমর্থন করেছিলেন মমতাকে। মমতা ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই বুদ্ধিজীবীরা মমতার পাশ থেকে একে একে সরে গেলেন। তারা বললেন এই পরিবর্তন আমরা চাইনি। এখন একটার পর একটা পৌরসভা যেমন মালদা, জলপাইগুড়ি এদের দখলে। মমতা হচ্ছে একটা গভীর স্রোত, আশেপাশের মানুষেরা সেই জলে সব ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তো এই স্রোতটা মমতা এনজয় করছেন আর কি! কাউকে বলছে না তোরা আয়, কিন্তু এরা সব নিজেরাই আসছে, আমার খুব বিস্ময় লাগে। আমি একবার লিখেও ছিলাম মমতা আসার পর, এত অপদার্থ লোক নিয়ে তিনি কীভাবে এত বড় শাসনভার চালাবেন। এমনি একটা মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙে গেলেও সেখানে মমতা ছুটে যান।

মমতা একদিন আমায় ফোন করেছিলেন। আমি বললাম আগে গাছ হতে দিন অর্থাৎ মানুষ হতে দিন। তখন তিনি বললেন এরা গাছ হলে আমাকেই উপরে ফেলবে। তো এই অবস্থাতে আবার বিপুলভাবে তিনি দ্বিতীয়বারও জিতলেন। আমার মনে হয় আমাদের সামনে একজন উদাহরণ আছে যিনি সারা পৃথিবীটাকে আকর্ষণ করতে পারেন। কৃষ্ণ যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে করেছিলেন।

কালবেলা যখন লিখেছিলাম তখন ভরা বামফ্রন্ট এবং সিপিএম-এর চতুর্দিকে দুর্ণাম। লেখার সময় আমাকে কেউ কেউ বলেছিল তোমায় মারবে। মানে মেরে ফেলবে। কিন্তু কেউ কিছু করেনি। আর ২০১২-১৩ সালে যখন মৌষলকাল লিখলাম তখনও কিন্তু আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তবে এখন লিখলে কী হত জানি না।

অরুণাভ রাহারায় : ‘এক জীবনে অনেক জীবন’  বইটি পড়ে আপনার জীবনের অনেক কথা জানা যায়। বইটি আপনি উৎসর্গ করেছেন আপনার মাস্টারমশাই বেণু দত্তরায়কে।

সমরেশ মজুমদার : বেণুদাকে আমি আমার বাল্য-কৈশোরে তেমনভাবে পাইনি। বেণুদা জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়াতেন। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি ধুতি পরে আসতেন। সুদর্শন যুবক ছিলেন। আমরা তখন বালক বা কিশোর হব হব। তিনি আমাদের রচনা লিখতে বলতেন। একদিন আমার রচনা দেখে বললেন ‘তুই গল্প লেখ। তোর গল্প হবে।’ এটা  আমার কাছে কোনও প্রতিক্রিয়া  সৃষ্টি করেনি। কারণ গল্প লেখার ইচ্ছা বা বাসনা তখন আমার ছিল না। কিন্তু বেণুদা যেটা করলেন আমাদের ক্লাসের সবাইকে কিছু লেখকদের সন্ধান দিলেন, তাঁদের লেখা পড়তে বললেন। ক্লাসের ৩০ জন ছাত্রের মধ্যে ৬ জন সেই উপদেশটা নিয়েছিল। আমাদের বাবুপাড়া পাঠাগার ক্লাবে আমরা পড়তে যেতাম। পাঠাগারের সম্পাদক ছিলেন সুনীল পাল। তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন বেণুদা। ফলে প্রচুর বই পড়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এটা বেণুদার জন্যই হয়েছিল। মাঝে মাঝে ছুটির পর জলপাইগুড়ির পাহাড়ি পাড়ার জীবনের বইয়ের দোকানে আসতেন। সেখানে আমাদের দেখা হত, আড্ডা হত। গল্পও লিখতেন খুব ভালো কিন্তু হঠাৎ করেই অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে আলিপুরদুয়ারে চলে গেলেন। আমার সঙ্গে বেণুদার যোগাযোগ থেকেই গেল। যত বড় হতে লাগলাম ওনার বন্ধু হতে লাগলাম। আর আমি জলপাইগুড়ি-নর্থবেঙ্গলে যখনই যেতাম ওনার সঙ্গে দেখা হত। লাস্ট যখন গেলাম, সেবার আমি নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে ডিলিট পেয়েছি। সকাল সাতটায় বেণুদার বাড়িতে গেলাম, বেণুদা তখন ঘুমাচ্ছেন। ওনার স্ত্রী দরজা খুলতেই আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। বেণুদা উঠে মুখ ধুলেন। বললেন আসলি! আমার হাত দুটো ধরে বললেন এটাই তোর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আমি বললাম কি যা তা বলছেন। উনি বললেন যখন নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে ডিলিট পেয়ে মঞ্চে তুই আমার কথা বললি আনন্দে আমার বুক ভরে গেল। প্রণাম করে আমি বেরিয়ে এলাম। তখন আমিও বুঝিনি এটাই আমাদের শেষ দেখা।

অরুণাভ রাহারায় : সংবাদ প্রতিদিনের ‘রোববার’-এ আপনি একবার কবিদের বিরুদ্ধে একটি চাবুক লেখা লিখেছিলেন। কবি শক্তি চট্টোপ্যাধায়ের ‘এত কেন কবি’র পর বোধহয় সেই লেখাটাতে কবিদের বিরুদ্ধে এত আক্রমণ করা হয়েছে।

সমরেশ মজুমদার : মুশকিলটা অন্য জায়গায় জয়ের পর থেকে যারা কবিতা লিখছেন তাদের নিয়ে। শ্রীজাতকে একটু জোর করে ভাবছি। সাধারণ মানুষও কবিতা পড়েন এবং সব কবিকে মনে রাখে না। জয়কে মনে রেখেছে কিছুটা ব্রততী ও লোপামুদ্রার জন্যে। লোপামুদ্রা ওর কবিতা গান গায় আর ব্রততী আবৃত্তি করে। সুবোধ এখন কবিতা আকাদেমির চেয়ারম্যান। কিন্তু শক্তিদাকে কোনও দিন সে জায়গায় কল্পনা করা যায়? ভাবতো শক্তিদা সেজেগুজে একটা পরিচ্ছন্ন চেয়ারে বসে আছে, এ যেন আমরা কল্পনাই করতে পারি না। কালকেই একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তোমরা তখন জন্মাওনি। ১৯৬০-৬২-৬৫ সালে বাঙালি বাড়ির সঙ্গে তখনকার গায়ক বা গায়িকাদের একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়েছিল। ধর তোমার মা আলিপুরদুয়ার থাকে তিনি কখনও সতীনাথ মুখার্জিকে দেখেননি। কিন্তু রেডিওতে অনুরোধের আসরে যখনই ওনার গান বাজত সেটা শোনার জন্য ছটফট করত। কবিতার মতো বাংলা গানও তেমন গত কুড়ি বছরে তেমন এগোয়নি। কবির সমুন ছাড়া আর নচিকেতা দু-একটা গান ছাড়া কোনও গানই মানুষের হৃদয়ে গেঁধে নেই। এই প্রশ্নটা শুধুই ঘুরপাক খায়। ফলে আজকের কবিতা সম্বন্ধে আমি যে কথা বলেছিলাম সেই লেখায় কিছু ভুল বলিনি।

সেবার আমি শিলচর গিয়েছিলাম। শিলচরে যে এত কবি আছে আমি জানতাম না। আমি রাত্রিবেলা দেখলাম ৭০ টা কবিতার বই আমার ঘরে। পরেরদিন সকালে আমার ফ্লাইট। রাতে ঘরে বসে আমি কবিতার বইয়ের পাতাগুলো ওল্টাতে লাগলাম। একটা কবিতাও পড়ার মত নয়। তাহলে এই বইগুলো এক্সট্রা খরচ দিয়ে ফ্লাইটে করে বাড়ি নিয়ে যাব কেন! তাই বইগুলো ঘরে রেখে আমি আমার ব্যাগপত্তর গুছিয়ে যখন হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি তখন ওয়েটার বইগুলো একটা ব্যাগের মধ্যে নিয়ে এসে বলল স্যার আপনার লাগেজ ফেলে যাচ্ছেন। কবিতার বইকে লাগেজ বলাটা আমার ভালো লাগেনি। কবিতা যত খারাপই হোক কবিতার বই কখনও লাগেজ নয়। তো আমি বললাম ওটা থাক আপনারা পড়বেন। এমনও হয়েছে একবার আমি মালদা গিয়েছি। একজন দুস্থ মানুষ এসে বলল আমি একটা কবিতার পত্রিকা বের করেছি এটা আপনাকে দিলাম। এখন ২০১৬ সাল কিন্তু পত্রিকাটা ২০১২ সালের। তার মানে ১২ সালে পত্রিকাটা বেরিয়েছিল তারপর সেটা আর বের করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ সেটাই আমাকে দিচ্ছেন। তার ভালোবাসা থেকে দিচ্ছেন।

অরুণাভ রাহারায় : সেই লেখায় একজনের প্রতি মুগ্ধতাও ছিল...

সমরেশ মজুমদার : এটা কেমন হয় জানো, ধরো বাবা বা মা মারা গেছেন। আমার স্ত্রী হয়তো ভালো পায়েস রান্না করে আমায় খাওয়ালো। কিন্তু খেতে গিয়ে মনে হল, মা এর চেয়ে ভালো পায়েস করত। এই মনে হওয়ার আগের মুহূর্তে কিন্তু আমার মায়ের কথা মনে পড়েনি। পায়েসের স্বাদটাই আমার মা-কে মনে করিয়ে দিল। অথচ এই কথাটা যদি আমার স্ত্রীকে বলি মনে মনে কষ্ট পাবে। ভাববে আমি কষ্ট করে পায়েস রাধলাম সেটা খেয়ে মায়ের পায়েসটা মনে পরে গেল! এই যে মনে এসে যাওয়া, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সেটা বলেছিলাম।

অরুণাভ রাহারায় : বাংলাদেশে আপনার বই জাল হয়। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে টাকা নয়, বই জাল হয়!

সমরেশ মজুমদার : ধরো একটা বইয়ের দাম ১০০ টাকা। কলকাতা বইমেলায় ১০ শতাংশ ডিসকাউন্টে সেটা ৯০ টাকায় পাওয়া যাবে। সেই বইটা যখন সীমান্ত পার হয় তখন অনেকরকম ট্যাক্স দিতে হয়। যে লোকটা এখান থেকে বইটা ৭৫ টাকায় কিনল সে ট্যাক্স দিতে দিতে যখন ঢাকায় পৌঁছবে তখন বইটার দাম হয় ১২৫ টাকা। তাকেও কষ্ট করে অত দূরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্তত ২৫ টাকা রাখতে হবে। অতএব সে যখন ১৫০ টাকায় বইটা পাঠকদের কাছে বিক্রি করছে পাঠক জিজ্ঞেস করছে ১০০ টাকার বই ১৫০নিচ্ছেন কেন? সেজন্যেই বই জাল হয় এবং কম দামে কিনে অনেকে পড়ে।

অরুণাভ রাহারায় : পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত ‘যাযাবরী’ ভ্রমণসমগ্র পড়ে আপনার বিচিত্র ভ্রমণকাহিনি জানা যায়। আপনি তো এত জায়গায় বেড়াতে গেছেন কোন জায়গাটা সব থেকে বেশি প্রিয়?

সমরেশ মজুমদার : এটা বল খুবই মুশকিল। এখনও আমি যখন গয়েরকাটা যাই আমার মন খুব ভালো হয়ে যায়। আমি ওখানে জন্মেছি ওখানকার পাঠশালায় পড়েছি। এখনও ওখানকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, লোকে জিজ্ঞেস করে কেমন আছি। এখন সব পাল্টে গেছে, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর। তখন দোকানপাটও সেরকম ছিল না। এখন দোকানাপাট সব হয়েছে। মাঝে মাঝে মনের মধ্যে স্মৃতির ঢল নামে।

আর প্রথম বিদেশে গিয়েছিলাম ১৯৮৪ সালে নিজের পয়সায় যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। আমেরিকান গভর্নমেন্ট একটা স্কলারশিপ দিয়েছিল, পুরো দেশটা ঘুরে দেখে আসার জন্য। তো একটা মজার ঘটনা বলি আমরা ওয়াশিংটন গিয়েছি। একটা ভালো হোটেলে রাখা হয়েছে। কমিটির লোকজন আমাকে বলল—‘আগামি ১৫ দিন আপনি আমাদের গেস্ট। আপনি সারা আমেরিকা উত্তর থেকে দক্ষিণ বিভিন্ন জায়গা ঘুরবেন। সবসময় আপনার জন্য গাড়ি থাকবে। আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।’  মানে, একেবারে এলাহি আয়োজন। মানে রাজকীয় ব্যাপার। সেবার আমার খুব ভালো লেগেছিল।

অরুণাভ রাহারায় : আমাকে সময় দিয়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের কথা এখনো শুরুই হলো না। আরেকদিন অনেক কথা শুনবো।

সমরেশ মজুমদার : আবার এসো। ভালো থেকো।


আরও পড়ুন-

আবার সোভিয়েত হয়ে গেলো রাশিয়া : হায়াৎ মামুদ

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ