সময়
শরীর মূলত সময়ের বোঝা।
এই যে তুমি হাঁটছ, আসলে চলছে সময়; এই যে কথা বলছ, আসলে শব্দের মাধ্যমে নিজেকে জানান দিচ্ছে সময়; এবং এই যে তুমি হাসছ, তোমার মধ্য দিয়ে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে সময়।
আকাশের নক্ষত্রদের দেখো, যারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে অনেক আলোক নিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে সময়। এবং তুমি যখন দেখবে, মরুভূমিতে একটা লোকটা একা একাই চলছে, তার মানে সময়ই একাকীত্ব যাপন করছে।
এই যে মেঘের জন্ম হওয়া, সময়েরই জন্ম হওয়া এবং মেঘেদের মুছে যাওয়াও সময়েরই মুছে যাওয়া।
তুমি সময়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এবং এটাও ঠিক যে তুমি বুঝতেও পারছ না, তোমার মধ্য দিয়ে সময়ের জন্ম হয়েছে এবং তোমার মধ্য দিয়েই মৃত্যু হবে তার।
লাল শার্টে নিজেকে রোহিঙ্গা লাগে
কিছু মৃত্যু বিক্রি করে ফিরছিলাম, যেরকম সবজিবিক্রেতা নিজের জন্য রেখে দেয় শাকের শেষ আঁটি, তেমনি আমারও আছে একটি লাল শার্ট।
আজ সেই শার্ট গায়ে তুমিও পাহাড় দেখতে পারো, সবুজ দেখতে পারো, নদী এবং সাগর দেখতে পারো, তারচেয়ে বেশি দেখতে পারো আগুন; শুধু মানুষ দেখছ না।
কেননা মানুষ শুধু জাতিসংঘে থাকে।
আজ লাল শার্ট গায়ে দিতেই নিজেকে রোহিঙ্গা লাগছে।
মনে হচ্ছে নাফের নীল জলে শঙ্খচিলের ধারালো ঠোঁটে একটি রক্তাক্ত মাছ হয়ে খুঁজে ফিরছি মানুষের মুখ।
উত্তরের দিন
শোনো নদী, আমাদের গ্রামের উত্তরে থাকো তুমি; উত্তরে থাকে তাই পা-ছুঁয়ে যাওয়া, চাল-ছুঁয়ে যাওয়া, নির্জনতার হাসিভাঙা অসংখ্য আকাশের গল্প। আর ঝরাজলের মৌমাছিগুলো তোমার ঢেউয়ে গুঞ্জন করা দিনগুলোও থাকে উত্তরে।
তোমাকে ভেবে ভেবে নিজেকে মেপে নিই নদীর নিয়মে।
তোমারও উত্তরে থাকে উপস্থিত মাঠের দেশ, খাঁ খাঁ-লাগা নয়, ধানের বসন্ত যেন কবিতার মতো মুখ করে জ্যোৎস্না ফলায়। আর নাড়াগাছের আগুনে জুটে যায় রাঙামাটির চোখ।
ওই মাঠ তোমার খোঁপার মতো।
অস্পষ্ট আলোয় যেখানে কুয়াশা নেমেছে, সেখানেই পরে আছ সোনার মুকুট, আর বাতাসেরা ভালোবেসে তোমাকে দিয়েছে সুরের সুনাম।
তোমাকে ভাবতেই মনে হয়, নদী মানে আকাশের গ্রাম।
যার উত্তরে থাকে রাখালের চর।
এতদিন পরে, তোমাকে ঘিরে সেই মাঠে মনের প্রত্যাবর্তন বড়ো অপার্থিব লাগে। আজো আমি উত্তরের দিন নিয়ে থাকি, বড়শি ফেলি উত্তরের জলে।
মৃত্যু
আমাকে ঘিরে আছে যেসব অসংখ্য মৃত্যুর দল; তাদের ভয়ার্ত মুখ, লাজুক চাহনি দেখে আমি অধিক করুণাকাতর। ওরা পালাচ্ছে আমায় দেখে।
মানুষকে দেখে মৃত্যুরা এভাবে পালায়!
ওই যে মৃত্যুটা, চৌরাস্তার মোড়ে হাসছিল, কানু কাকাকে নিয়ে যাবে বলে চড়ে বসেছিল গাড়ির চাকায়, পালাল আমায় দেখে। আর নীলু জ্যাঠা, সেই যে গাছের ডালে লাগানো দড়িটাকে বলেছিল, সাহস থাকে তো ভালোবেসে দেখা, সেই মৃত্যুও পালাল আমায় দেখে।
একুশ দিন কোমায় থাকা বাবার পাশে ঘুরঘুর করা মৃত্যুটাকে আমি চুমু খেতে চেয়েছিলাম, শুষে নিতে চেয়েছিলাম আমার সবটুকু দিয়ে। সেও আমার অগোচরে পালিয়েছে বাবাকে নিয়ে।
এভাবে সহস্র সহস্র মৃত্যু ঘিরে আছে আমায়, যারা ভীতু নতমুখো, পলাতকের দল; শুধু একটা মৃত্যু কোথাও লুকিয়ে আছে সর্বস্ব সাহস নিয়ে, যার চোখ মুখ লাল টকটকে, ভয়ানক তৃষ্ণার্ত...
নির্ভেদের ধ্যান
অন্ধকারে বসে যখন রাত্রি স্পর্শ করো, মুঠোয় মুড়িয়ে রাখো শত বছরের স্তব্ধ নির্জনতা, তখন তোমার শরীরে ঢুকে যেতে দেখি বহু পুরাতন পাখি, যে গাঙের জলে দেহ ধুয়ে বসেছিল বাঁশের কঞ্চিতে আর জলের গহনে ফুটে ওঠা নিজের প্রতিচ্ছবিতে মজে গিয়েছিল ধ্যানের স্বভাবে...
মূলত এভাবেই মানুষ হয়ে ওঠে সহস্র ডানামেলা
যেদিন জেনেছি, ঠিক সেদিন থেকেই অসংখ্য পানকৌড়ি মেঘমন্ত্রে আমাকে আক্রান্ত করে আর আমি দেখি একটি নদীর আকাশ পরিপূর্ণ পানকৌড়ি মেঘে ছাওয়া, যার দিন-রাত্রি সব সমান, যারা উজান-ভাটি সমান এবং তোমার ও আমার মধ্যে যেমন সম ভাবাপন্ন, যতটা নির্ভেদ অসুখ...
আরও পড়ুন-