X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সেভলদ পুদোভ্কিন : সোভিয়েত সিনেমার অগ্রদূত

মূল : ডেভিড গিলেস্পি | অনুবাদ : রুদ্র আরিফ
২১ জুন ২০১৭, ১৪:০২আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ২০:০৮

 

সেভলদ পুদোভ্কিন : সোভিয়েত সিনেমার অগ্রদূত

সেভলদ ইলারিয়োনোভিচ পুদোভ্কিন [১৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ - ৩০ জুন ১৯৫৩]। স্যোসালিস্ট রিয়েলিস্ট সিনেমার অন্যতম অগ্রদূত এবং আইজেনস্টেইনের পাশাপাশি, এপিক ধারার সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটানো ফিল্মমেকার হিসেবে বিখ্যাত। তার ১৯২০ দশকের সিনেমাগুলো ‘রেভ্যুলুশনারি রোমান্টিসিজম’কে ধারণ করলেও ১৯৩০ দশকে সেটি হয়ে ওঠে ‘পার্টি’ ভাবাদর্শের কাঠামোগত ও নির্দেশিত পথে স্যোসালিস্ট রিয়ালিজমের অংশ। বিপ্লবের প্রতি পুদোভ্কিনের উদ্যমী পক্ষপাত, এবং শ্রেণি সংঘাত ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় বর্ণনা- তার এই সিনেমাটিক প্রবণতাগুলো হয়ে ওঠে সোভিয়েত সিনেমা বিকাশের কী-ফ্যাক্টর। পেঞ্জা নামের এক প্রাদেশিক শহরে, হকার হিসেবে কাজ করা এক দিনমজুরের ঘরে, ১৮৯৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন পুদোভ্কিন। তার বয়স যখন চার বছর, তখন পরিবারটি চলে আসে মস্কোতে; পরে পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রে পড়াশোনা করতে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, পড়াশোনার বিরাম ঘটে তার; আর ১৯১৫ সালে তাকে অ্যাকটিভ সার্ভিসে যোগ দেওয়ার জন্য তলব করা হয়। কিন্তু সরকারের সেই নির্দেশ অমান্য করে ইতস্তত ঘুরে বেড়ান তিনি। পরিণামে হন গ্রেফতার। জেল থেকে পালিয়ে, ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে মস্কো ফিরে আসেন পুদোভ্কিন। এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন এবং ১৯১৯ সালের আগ পর্যন্ত কাজ করেন একটি ল্যাবরেটরিতে। এরপর ১৯২০ সালে, লেভ কুলেশভের অধীনে স্টেট সিনেমা স্কুলে [তখনকার নাম, Goskinoshkola; পরবর্তী নাম- ভিজিআইকে : দ্য অল-ইউনিয়ন স্টেট সিনেমাটিক ইনস্টিটিউট] শুরু করেন পড়াশোনা।

গৃহযুদ্ধের সময়, বেশ কিছু প্রোপাগান্ডা শর্টফিল্মে সম্পৃক্ত হন পুদোভ্কিন। এর মধ্যে অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন ‘হামার অ্যান্ড সিকল’ [Serp I Molot; ভ্লাদিমির গার্দিন; ১৯২১], ‘হাঙ্গার, হাঙ্গার, হাঙ্গার’ [Golod, Golod, Golod; ভ্লাদিমির গার্দিন; ১৯২১] ও ‘লকস্মিথ অ্যান্ড দ্য চ্যান্সেলর’ [Slesar I Kanrsler; ভ্লাদিমির গার্দিন; ১৯২৪] সিনেমায়। এর মধ্যে প্রথম দুটি সিনেমাতেই আইজেনস্টেইনের ভবিষ্যতের ক্যামেরাম্যান এদুয়ার্দ তিসে কাজ করেছেন। ১৯২২ সাল থেকে লেভ কুলেশভের সঙ্গে কাজ শুরু করেন পুদোভ্কিন; অভিনয় করেন কুলেশভের ‘দ্য এক্সট্রা অর্ডিনারি অ্যাডভেঞ্চার্স অব মিস্টার ওয়েস্ট ইন দ্য ল্যান্ড অব দ্য বলশেভিক’-এ [১৯২৪; এখানে গ্যাংস্টার জোবানের চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি]। ১৯২৫ সালের নিজের প্রথম সিনেমাগুলোর ডিরেকশন দেন পুদোভ্কিন- ‘মেকানিকস অব দ্য ব্রেন’ ও ‘চেস ফিভার’। এরপর যে তিনটি সিনেমা তিনি নির্মাণ করেন, ক্ল্যাসিক হিসেবে বিবেচিত সেই সিনেমাগুলোই ফিল্মমেকার হিসেবে পুদোভ্কিনের নাম বিখ্যাত করে দেয় : ‘মাদার’, ‘দ্য এন্ড অব সেন্ট পিটার্সবুর্গ’ও ‘স্টর্ম ওভার এশিয়া।’ এর মধ্যে শেষোক্ত ফিল্মটি সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘দ্য হ্যের অব চিঙ্গিস খান’ শিরোনামে মুক্তি পায়।

সিনেমায় সবাক যুগের প্রবর্তন ঘটলে, পার্টি পলিসির চাহিদার সঙ্গে আরও অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠেন এই ফিল্মমেকার। ক্রসকাটিং, মন্তাজের ফ্লুইডিটি ও ইমেজারি নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনক্ষম হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৩০ দশকে নির্মাণ করেন ‘অ্যা সিম্পল ইনসিডেন্ট’, ‘দ্য ডেজার্টার’, ‘ভিক্টোরি’ও হিস্টোরিকেল এপিক ‘মিনিন অ্যান্ড পোঝার্সকি।’ রুশ ইতিহাসের নায়কদের নিয়ে সিনেমা নির্মাণ অব্যাহত রাখেন তিনি- ‘সুভরভ’, ‘অ্যাডমিরাল নাখিমভ’ ও ‘অ্যারোনিউটিকেল ইঞ্জিনিয়ার জুকভস্কি।’ তার সর্বশেষ সিনেমা, ‘দ্য রিটার্ন অব ভাসিলি বর্তনিকভ’ নির্মাণ করেন গালিনা নিকোলেয়েভার বিতর্কিত উপন্যাস ‘হারভেস্ট’ [Zhatva; ১৯৪৮] অবলম্বনে। এটি যুদ্ধোত্তর প্রান্তিক জীবনের উদ্ভট মিথ্যাচারকে ফুটিয়ে তুলেছে। ১৯৫৩ সালের ৩০ জুন মৃত্যুবরণ করেন এই ফিল্মমাস্টার। যদিও তার জীবনের শেষ বছরগুলো খুব একটা গর্বের ছিল না। এ ব্যাপারটি পিটার কেনেজ সুস্পষ্ট করেছেন এভাবে :

‘স্তালিনের শাসনামলে নির্মিত বেশির ভাগ ফিল্মের মোরাল কনটেন্টই ছিল নিন্দনীয়। বলতে গেলে, ব্যতিক্রম কেউ ছাড়াই, সব ফিল্মমেকার তাদের মেধাকে নিয়োজিত করেছিলেন একটি ঘৃণ্য আদর্শের প্রচারণা চালাতে। নির্দিষ্ট করে দেওয়া টপিক প্রত্যাখ্যান করার মতো কোনো অজুহাত কিংবা এ রকম কিছুর দ্বারস্থ কোনো ফিল্মমেকার হয়েছিলেন কিনা [যদি হয়েও থাকেন]- তার কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। দ্বিতীয় সারির ফিল্মমেকারদের সঙ্গে মেধাবীদের কোনো পার্থক্য ছিল না। এই ইন্ট-কসমোপলিটান ক্যাম্পেইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ‘মাদার’ ও ‘দ্য হ্যের অব চেঙ্গিস খান’-এর নির্মাতা পুদোভ্কিন।’

১৯২৫ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা চলাকালে নির্মিত হয়েছে ‘চেস ফিভার।’ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জোসে ক্যাপাব্লাঙ্কা এ সিনেমায় ছোট্ট একটি ভূমিকায় [নিজ চরিত্রে] অভিনয় করেছেন। ফিল্মটি মাত্র ৩০ মিনিটের হলেও, আইডিয়া, প্রাঞ্জল্যতা ও কমেডির সংমিশ্রণে সাড়া জাগিয়েছিল বেশ। ছোট ভূমিকায় হলেও, এই ফিল্মটি সোভিয়েত সিনেমার সে সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জাহির করেছে; যাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা- ভ্লাদিমির ফোগেল, আনাতলি ক্তোরভ, ইভান কোভাল-সামবোর্সকি, কনস্তানতিন এগার্ত ও মিখাইল ঝারভ; স্ক্রিনরাইটার- ফিদর অজেপ এবং পরবর্তী সময়ের ফিল্মমেকার বরিস বারনেত ও ইউলি রাইজমান এবং ইয়াকভ প্রোতজানভ প্রমুখ।

এ সিনেমায় দাবা চ্যাম্পিয়নশীপ নিয়ে নামহীন নায়কটি [ফোগেল অভিনীত] এতটাই ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়ে, নিজের প্রেমিকাকে [স্রেফ ‘নায়িকা’ হিসেবে পরিচিত এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আন্না জেমৎসোভা] এড়িয়ে যেতে থাকে সে। যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণ সে দাবা খেলে- এমনকি কখনো কখনো নিজের সঙ্গে নিজেই। ভীষণ কষ্ট পেয়ে তার প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে গিয়ে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে উদ্ভ্রান্তের মতো মস্কোর রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে, ক্যাপাব্লাঙ্কার সান্নিধ্যে চলে আসে সে। এই মেয়েটির মনে দাবা খেলার আনন্দ ছড়িয়ে দেন ক্যাপাব্লাঙ্কা। মেয়েটির মন বদলে যায়; এবং ফিল্মটির শেষবেলায় তাকে দেখা যায় ফোগেলের সঙ্গে পুনর্মিলিত হতে। পরিশেষে তারা দুজনই প্রতিযোগিতাটি নিয়ে ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একটি সুনিশ্চিত ডিরেক্টরিয়াল হ্যান্ডে, ফোগেলের দাবা-ম্যানিয়াকে একটি কমিকরূপে ঘুরিয়ে দিয়েছেন পুদোভ্কিন; এবং সাবজেক্ট ম্যাটারগুলোর ছেলেমানুষি ও চাঞ্চল্য হয়ে উঠেছে তার পরবর্তী সিনেমাগুলোর ভারিক্কিপনার বিপরীত।

এরপর ১৯০৫ সালের বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে রচিত ও স্যোসালিস্ট রিয়ালিজমের একটি বহুল প্রশংসিত মডেল হিসেবে বিবেচিত, মাক্সিম গোর্কির ১৯০৮ সালের উপন্যাস ‘মাদার’ অবলম্বনে একই শিরোনামে সিনেমা বানাতে গিয়ে, সর্বোচ্চ আদর্শগত ইফেক্ট দিতে, মূল উপন্যাসটির ব্যাপ্তিকে অধিকতর বিস্তৃত করে নেন পুদোভ্কিন। [বলাবাহুল্য, এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে অন্তত আরও দুইবার সিনেমা নির্মিত হয়েছে : ১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেন মার্ক দনস্কয় ও ১৯৯০ সালে গ্লেব পানফিলভ] ফলে, বুদ্ধিজীবীদের সম্পৃক্ততায় ও দিনমজুরদের ‘স্রষ্টা-সৃষ্টিকারী’ ভাবনা থেকে আবির্ভূত কোনো বলশেভিক ‘সত্যের’ কোনো বিকল্প প্রস্তাবনা জাহির হয়নি এখানে; আর এটির এন্ডিং ছিল ইচ্ছেকৃতভাবেই ট্রাজিক- যা আমাদের সামনে গোর্কির দেখানো প্রাণ-বিনাশী ও সামাজিক বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে হাজির করেনি, বরং বলশেভিক বিজয়ের অবশ্যম্ভাবিতা ও নায়কের রাজনৈতিক সচেতনতা জাগরণীর একটি বোধকে করেছে জাহির।

মন্তাজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইজেনস্টেইনের চেয়ে পুদোভ্কিন একেবারেই আলাদা ছিলেন। আইজেনস্টেইন যেখানে মন্তাজ ব্যবহার করতেন ইমেজের টক্করে দর্শকদের সামনে চমকে দেওয়া ও অস্থিতিশীল আবহ সৃষ্টি করতে, সেখানে পুদোভ্কিনের মন্তাজ হলো একতাবদ্ধতা ও ধারাবাহিকতার একটি ছবিকে হাজির করার উদ্দেশে সরল ও যৌক্তিক। ফলে, মাদার সিনেমাটির শুরু হয় লেনিনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে, তারপর পর্দায় ১৯০৫ সালের বিপ্লবের কিছু স্টিল ফটোগ্রাফের আবির্ভাবে; এরপর বিশাল আকাশ, মাঠ ও গাছপালার দীর্ঘস্থায়ী শটগুলো দেখতে পাই আমরা। একটি মহাকাব্যিক রাজনৈতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটকে জাহির করে এ দৃশ্য। সিনেমার নায়ক পাভেল ভ্লাসভ [নিকোলাই বাতালভ অভিনীত] একজন কারখানা-শ্রমিক। সে আর তার মা পেলাজিয়ার [ভেরা বারানোভস্কাইয়া অভিনীত] ঘনিষ্ঠতার ইশারাতেই টের পাওয়া যায়, তাদের সম্পর্কটা শুধু ভালোবাসার নয়; বরং গভীরতর বোঝাপড়ারও। এই বোঝাপড়াটা খুব দ্রুতই রাজনৈতিক একতাবদ্ধতায় রূপ নেয়। পাভেলের বাবা নিজ বাড়িতে এক স্বৈরশাসক, এবং কর্তৃত্বপরায়ণ সংস্কৃতির এক প্রতীক। সে যে কারখানায় কাজ করে, সেখানকার মালিকপক্ষের প্রলোভনে তাদের কাছে রাজনৈতিক সক্রিয়কর্মীদের খবর পাচার করার মাধ্যমে, নিজ শ্রেণির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে। স্থূলদেহী ও কেতাদুরস্ত মালিকপক্ষের উদরপূর্তি ও পানাহারের দৃশ্যটি ক্ষুধার্ত ও বিক্ষিপ্ত শ্রমিকপক্ষের একটি বিপরীতচিত্র হয়ে ফুটে আছে এ সিনেমায়।

সেভলদ পুদোভ্কিন : সোভিয়েত সিনেমার অগ্রদূত পাভেলকে বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে দিয়ে যায় এক তরুণী সক্রিয়কর্মী [উপন্যাসে এটি ছিল না]; পাটাতনের নিচে সেগুলো সে যখন লুকিয়ে রাখে, তখন অর্ধঘুমন্ত অবস্থায়, ঝাপসা চোখে তার মা তা দেখে ফেলে। এ সিনেমায়, কারখানা ও সেটির নিছক বিশালতা ফুটিয়ে তুলতে, আইজেনস্টেইনের ‘স্ট্রাইক’ [Stachka; ১৯২৫] সিনেমার মতোই, কারখানার চিমনি ও বিল্ডিংয়ের বেশ কিছু শট হাজির করেছেন পুদোভ্কিন। আর তার মধ্যে মোরগের ডাক হয়ে ওঠে শ্রেণির সচেতনতা জাগরণের ইঙ্গিতবাহী একটি সুস্পষ্ট রূপক।ধর্মঘট ডাকা হয়েছে; কর্তৃপক্ষও প্রস্তুত ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনি নিয়ে। আসন্ন দাঙ্গায়, কর্তৃপক্ষের হয়ে কাজ করা পাভেলের বাবা খুন হয়ে যায়। নিজের বাড়িতে, তার মৃতদেহ ঘিরে, পাভেল ও তার মা যখন শোকসন্তপ্ত, তখন অস্ত্রের তল্লাশে এসে হাজির হয় পুলিশ। পাভেলকে সনাক্ত করে জনৈক দাঙ্গাবাজ; কিন্তু পুলিশ যখন তল্লাশি শেষে কিছু না পেয়ে, খালি হাতে ফিরে যাচ্ছিল প্রায়, তখন পাভেলের মা লুকোনো অস্ত্রগুলো বের করে তাদের হাতে তুলে দেয় এই ভেবে- এক্ষেত্রে জেল কিংবা তার চেয়েও খারাপ কোনো শাস্তির আশঙ্কা থেকে ছেলেকে বাঁচাতে পারবে। সময় বয়ে যাওয়ার অর্থ বোঝাতে- নালা দিয়ে জলের প্রবাহ বয়ে যাওয়ার একটি কন্টিনিউয়াল ইনার-কাটের মাধ্যমে পুরো বিষয়গুলো উপস্থাপিত হয় সিনেমাটিতে।

পুলিশ যখন পাভেলকে ধরে নিয়ে যায়, তখন রাশিয়ান সাইলেন্ট সিনেমার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী শটগুলোর একটিকে আমাদের সামনে হাজির করেন পুদোভ্কিন : বাড়িতে পেলাজিয়া একা; মাটিতে বসা; একদৃষ্টিতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। তার অভিব্যক্তির মধ্যে গভীরতর নৈঃসঙ্গ; মাত্রই হারিয়েছে স্বামীকে, আর এখন সেই খুনের দায়ে তারই একমাত্র পুত্রকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। ক্যামেরার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে, তাতে প্রথমে নিঃসঙ্গতা ও মর্ম-যাতনা ফুটে ওঠলেও, পরে তা হয়ে ওঠে দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক সচেতনতার সূচনাবিন্দু।

আদালতে, পাভেলের বিচার প্রক্রিয়ার অপেক্ষায় পেলাজিয়া যখন বসে থাকে একা, তখন তার নিঃসঙ্গতা প্রবল হয়ে ওঠে। এই বিচার প্রক্রিয়াটি স্বয়ং একটি মাস্টারক্লাস দৃশ্য হয়ে উঠেছে এডিটিং ও ইন্টার-কাটিংয়ের মুন্সিয়ানায়। পাভেলের স্বপক্ষের আইনজীবী নিজের মক্কেলকে রক্ষা করার কোনো পেশাদারী মনোভাব দেখায় না; আর তার আচমকা হ্যাঁচকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার নিষ্ক্রিয়তা সুনিপুণভাবে তাৎপর্যময় হয়ে আছে। বিচারকদের একজন নিজের রাইটিং পেডে আঁকিবুঁকি করছে- এতেই বোঝা যায়, বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই; কেননা, রায় আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। একজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে অনুভূতিহীন অবস্থায়, তবে এই বিচারের নামের প্রহসন ঠিকই ফুটে উঠেছে তার একটি অভিব্যক্তিতে। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের ছবির সামনে, আর দুই মাথার ঈগলের সাম্রাজ্যবাদী প্রতীকের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রসিকিউটরকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে- যাতে স্পষ্টতই কোনো যথাযোগ্য বিচারপ্রক্রিয়ার সম্ভাবনা এখানে শূন্য। একজন মধ্যবিত্ত নারী পাবলিক গ্যালারি থেকে বিচার প্রক্রিয়া চলতে দেখে হাতে ধরে চশমায় রাখে চোখ, আর তার চোখে-মুখে ফুটে থাকে তাচ্ছিল্য। নানা মুখ ও নানা ভঙ্গিমার যে বিদ্রুপাত্মক জাক্সটাপজিশন পুদোভ্কিন ফুটিয়ে তুলেছেন এ সব শটে, তা এই বিচারের নামে প্রহসনের পাশাপাশি সমাজেরও ক্রসসেকশনের একটি বহুমুখী ও রূঢ় কমিক চিত্র ধারণ করে আছে। বিচারে পাভেলকে কঠোর শ্রমের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

অভিব্যক্তিতে গুচ্ছ গুচ্ছ আবেগ, চোখে-মুখে আতঙ্ক, নৈরাশ্য ও শোকের অভিব্যক্তি বদলে বদলে তারপরে ভয়ানক দৃঢ়তা- সব মিলিয়ে বারানোভাস্কাইয়ার অভিনয় এখানে দুর্দান্ত নিখুঁত। এই দৃঢ়তা কাকতালীয়ভাবে একাকার হয়ে যায় পুনর্জন্ম ও পুনরুত্থানের রাশিয়ান সাংস্কৃতিক প্রতীক- বসন্তের আগমনীবার্তায় : নদীর উপরে জমে থাকা বরফ গলে আবারও চলতে শুরু করেছে জলের প্রবাহ; খেলছে শিশুরা। কারাগারে পাভেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে, তার কাছে কমরেড বা সহযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করতে থাকে পেলাজিয়া। তার রাজনৈতিক বিবর্তন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে।

প্রাকৃতিক পৃথিবীর ইমেজগুলো ছড়াতে থাকে। বিস্তীর্ণ মাঠ ও আকাশ, আর জলের অবাধ প্রবাহের কাব্যিক সব ইমেজ। পাভেলের সহযোদ্ধা কারাবন্দিদের সারিও প্রকৃতি আর স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত- ঠিক যেন জমি কর্ষণের মতো। এক শিশুর স্তন্যপান করার শটটি আসন্ন নতুন পৃথিবীর আরেকটি প্রতিনিধিত্বশীল শট হয়ে আছে।

মে দিবসে শ্রমিকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে, আর কারাবন্দিদের মুক্ত করতে হয় উদ্যত। তাদের উপর গুলি চালায় নিরাপত্তারক্ষীরা [তাদের কমান্ডিং অফিসারকে একটা ষাড়ের জাক্সটাপজিশন দিয়ে জাহির করা হয়েছে এখানে] আর আমজনতার বিদ্রোহের শটগুলো পুদোভ্কিন ফুটিয়ে তোলেন নিকটবর্তী নদীতে বরফের ভাঙনের সঙ্গে ইন্টার-কাটের মধ্য দিয়ে। অবজ্ঞা ও ঘৃণা নিয়ে প্রকাশ্যে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহকে অবলোকন করা বুর্জোয়াদের একটি ছবিও [‘নিউ ব্যাবিলন’-এ (Novyy Vavilon; গ্রিগরি কজিনৎসেভ ও লিওনিদ ত্রাউবার্গ; ১৯২৯) দেখা ছবির মতোই] আমাদের সামনে হাজির করেছেন পুদোভ্কিন- যেখানে বিদ্রোহীদের এক তরুণ যোদ্ধা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে সেটির শব্দ আমাদের কান বিদীর্ণ করে দেয়।

যেন বিদ্রোহের মুহূর্তটির অপেক্ষারত-  কারা-ময়দানে কারাবন্দিদের একটি বৃত্তে এভাবে হেঁটে যাওয়ার যে ছবি আমরা দেখতে পাই, সেটি তুখোড় প্রাণশক্তিতে পুরনো সাম্রাজ্যের আসন্ন পতনের ইঙ্গিত বহন করে। বিদ্রোহীরা কারা ফটকের কাছে পৌঁছে গেলে, কারাবন্দিদের নিজ নিজ গারদে ফেরার নির্দেশ দেয় প্রহরীরা; কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে পালাতে উদ্যত হয় তারা। সৈন্যদের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে নিহত হয় কয়েক ডজন কারাবন্দি। বরফ-গলতে-থাকা নদীর উপর, বরফ-বন্টকের উপর দিয়ে পালিয়ে যায় পাভেল; এই প্রাকৃতিক ইমেজটি তার নতুন পাওয়া মুক্তির একটি শক্তিধর প্রতীক হয়ে আছে। হাতে লাল পতাকা নিয়ে, বিদ্রোহে এখন নেতৃত্ব দেওয়া তার মায়ের সঙ্গে, বিদ্রোহীদের দলে ভীড়ে যায় সে। বিদ্রোহীরা সেনাদের উপর আক্রমণ করে; আর পুদোভ্কিনের দুর্দান্তভাবে সৃষ্ট ইন্টার-কাট দৃশ্যাবলির ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই, গণমানুষের অগুণতি দেহ পড়ে আছে মাটিতে। পাভেলও গুলিবিদ্ধ হয়; আর তার মাকে, লাল পতাকা হাতে, সন্তানের গুলিবিদ্ধ শরীরের সামনে এক নায়কোচিত চেহারায় দেখার মধ্য দিয়ে দৃশ্যটির কাট-ডাউন করেন এই ফিল্মমেকার। বরফ ভেঙে নদীর স্রোতে মিলিয়ে যাওয়া মতো, আকাশে মিলিয়ে যেতে থাকে খণ্ড খণ্ড মেঘ; আর ক্রেমলিনের [রাশিয়ান সিটাডেল] উপর লাল পতাকা উড়তে দেখে আমরা বুঝি, শ্রমিকদের বিজয় হয়েছে। নায়কের মতো প্রাণ দেয় পাভেল ও তার মা; আর এ সব মৃত্যু হয়ে ওঠে নতুন একটা পৃথিবীর জন্য তাদের আত্মবিসর্জন।

সকল সোভিয়েত শিল্পের ‘বেসিক আর্টিস্টিক মেথড’ হিসেবে, সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমে কয়েক বছরের মধ্যেই জায়গা করে নেওয়া শ্রেণি বৈষম্যের আর্টিস্টিক প্রতিকৃতিকে অফিসিয়ালি সমালোচনা করে, ব্যক্তি মানুষের নায়কোচিত অবয়ব ও শ্রমিক বিদ্রোহের একটি চিত্রকে জাহির করেছে ‘মাদার।’ ফিল্মটির আদর্শবাদী বার্তার পরিপূরক ভূমিকা ও শক্তিমত্তা যেসব বহুর্মুখী ইমেজ ও প্রতীকের ইন্টার-কাটের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে- সেগুলোর কিছু কিছু ছিল নিশ্চিতভাবেই স্টেরোটিপিক্যাল; আর বাকিগুলো পুদোভ্কিনের এডিটিং দক্ষতায় সুনিপুনভাবে ও ব্যাপক পরিসরে গতিময় ও উত্তেজনাকর একটি ন্যারেটিভকে প্রেরণা ও প্ররোচনা জুগিয়েছে এবং ভারসাম্যপূর্ণ করেছে। ‘মাদার’কে যদি বিপ্লবের সূচনাপর্ব হিসেবে ধরা হয়, তাহলে আইজেনস্টেইনের ‘অক্টোবর’-এর [Oktyabr; ১৯২৮] মতো পুদোভ্কিনের ‘দ্য এন্ড অব সেন্ট পিটার্সবুর্গ’ ও ঐতিহাসিক ঘটনার উদ্যাপন ও সর্বহারার একনায়কতন্ত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য।

সেভলদ পুদোভ্কিন : সোভিয়েত সিনেমার অগ্রদূত পুদোভ্কিনের এই সিনেমা, আইজেনস্টেইনের সিনেমাটির মতোই, অক্টোবর বিপ্লবের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে নির্মিত। থিম ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ দুটির প্রেক্ষাপট একই। তবু, মন্তাজ ও এডিটিং টেকনিককে শক ও স্টার্টলরূপে জাহির করেননি পুদোভ্কিন; বরং সৃষ্টি করেছেন বিপ্লব ও পরিবর্তনের একটি সুসঙ্গত ও একত্রিভূত চেহারা। মাঠ ও আকাশ, দারিদ্র ও দুরাবস্থার মধ্যে বসবাসরত প্রান্তিক মানুষের জীবন- এইসব প্রাকৃতিক দৃশ্যের শট দিয়ে সিনেমাটির শুরু। দিনমজুর পরিবারের রমনী, এক মায়ের মৃত্যু- পুরনো সাম্রাজের অধীনে গণমানুষের জীবনের নিছক নৈরাশ্যের একটি প্রতীক এখানে। এরপর ফিল্মটির প্রেক্ষাপট চলে যায় সেন্ট পিটার্সবুর্গে- যেখানকার বিখ্যাত ল্যান্ডমার্কগুলোর কয়েকটি দীর্ঘস্থায়ী শট দেখার পর, আমরা মুখোমুখি হই কারখানার কর্মপরিবেশের নরকক্ষেত্রে। মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যকার বিরোধের মধ্য দিয়ে, ফিল্মটিতে শ্রেণি সচেতনতার সূত্রপাত ঘটে। এখানে গণমানুষকে ফুটিয়ে তুলতে মন্তাজের ব্যবহার বেশ তুখোড়ভাবে করেছেন পুদোভ্কিন। ধনি ও গরিবের বৈপরীত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বহুমুখী ও স্বচ্ছভাবে। শহুরে শ্রমিকদের নিপীড়নকে প্রান্তিক দারিদ্রের জাক্সটাপজিশনের মাধ্যমে, ধনি ও গরিবের মধ্যে ফারাককে বিশাল করে দেখানো হয়েছে এখানে। বিশেষ করে, শিশুদের ক্ষুধার্ত মুখের ইমেজগুলো হয়ে আছে মানবতার জন্য গ্লানিকর সত্যের বাহক। সেন্ট পিটার্সবুর্গের পুঁজিবাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের হট্টগোল যেন ইঁদুরের মতো। অন্যদিকে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সর্বহারাদের দেখানো হয়েছে দুর্মর ও দৈহিকভাবে শক্তিধর হিসেবে- যেন যে যন্ত্রগুলোতে এই শ্রমিকেরা কাজ করে, সেই সব যন্ত্রের শক্তি তাদের শরীরেও প্রবাহিত হয়ে আছে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের ল্যান্ডমার্কগুলোর শট যে লোকগুলোর ইমেজের সঙ্গে ইন্টার-কাট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেই ইমেজগুলোতে মানুষ হাজির থেকেছে ব্রিজ ও বিল্ডিং, উড়ে যাওয়া মেঘ ও বয়ে যাওয়া জলস্রোতের সামনে ফ্রেমবন্দি হয়ে। আর এ সবই সময়ের প্রবাহমানতা ও ইতিহাসের আসন্ন পরিবর্তনের একেকটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল অস্থিতিশীলতাকে পুদোভ্কিন ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচিত বিন্যাসে। এখানে কাজের সময়কাল বাড়ানোর প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে শ্রমিকেরা। তাদের উপর পুলিশের আক্রমণ এবং কর্তৃপক্ষের উসকে দেওয়া সংঘর্ষকে চিত্রিত করা হয়েছে গ্রাফিক্যালি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যুদ্ধকে বলশেভিকরা অভিহিত করে শ্রমিকদের [জার্মান ও রাশিয়ান] বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ হিসেবে; আর পরিখা থেকে পরিখার সংঘাত, মৃত্যু ও দুর্দশাকে দেখানো হয়েছে সন্তোষজনক ও যথেষ্ট মর্মভেদী রূপে। ফিল্মটির এডিটিং ক্রিস্প ও ড্রামাটিক- যেখানে সেন্ট পিটার্সবুর্গের ফ্রন্ট লাইন থেকে ছুটে যাওয়া হয়েছে ব্যাক লাইনে।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের যে বৈপ্লবিক উৎসাহ পুদোভ্কিন জাহির করেছেন, সেখানে জার’কে নিপাতিত হিসেবে অতটা পরিত্যাজ্য করে তোলা হয়নি। অর্থাৎ, সেটির উল্লেখ করা হলেও সিনেমায় তা দেখানো হয়নি। সময় ফুরিয়ে আসার প্রতীক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি ঘড়িতে সময় দেখিয়ে; আর অক্টোবরে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সৈনিকদের পাশে নিয়ে শ্রমিকদের উত্থানের মধ্য দিয়ে। উইন্টার প্যালেসে ‘অ্যাভরো’র গুলিবর্ষণ আর প্যালেসের উপর এটির নিজের আক্রমণ- এসব দেখানো হয়েছে খুবই সংক্ষেপে; আইজেনস্টেইনের ‘অক্টোবর’- এর মতো বড় পরিসরে কিংবা বাহাদুরি জাহির করে নয়। ঐতিহাসিক আন্দোলনের চেয়ে পুদোভ্কিনের বরং আগ্রহ বেশি ছিল- ব্যক্তি মানুষের জীবন এবং চারপাশের ঘটনা তাদেরকে কতটা প্রভাবিত করে- সেটির প্রতি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই সিনেমায় লেনিনকে দেখানো হয়নি; এমনকি সিনেমার শেষবেলায় তার নাম মাত্র একবারই উল্লেখ করা হয়েছে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের পতনের পর, এই জারবাদী নামটি পরিবর্তন করে লেনিনগ্রাদ রাখার সময় আমরা একটা স্লোগান দেখতে পাই : ‘লং লিভ দ্য সিটি অব লেনিন’ বা ‘লেনিনের শহর দীর্ঘজীবী হোক।’

আইজেনস্টেইনের সিনেমাটির তুলনায় পুদোভ্কিনের সিনেমাটিতে আড়ম্বরতা ও পরিধির ঘাটতি থাকলেও, তিনি এমন একটি সুসঙ্গত সিনেমা সৃষ্টি করেছেন- যেখানে ন্যারেশনের মধ্যে কিছু সুনিশ্চিত মোটিফ জুড়ে আছে। সময়ের প্রবাহ ও ইতিহাসের পরিবর্তন বোঝাতে মেঘ ও জলের ব্যবহার; এবং পানি ভর্তি পরিখার মধ্যে মৃতদেহের শটের মাধ্যমে সেই যুদ্ধের ভূতুড়ে ও অনিষ্টরূপ ছবিতে ফুটিয়ে তোলা- যে যুদ্ধ শ্রমিক শ্রেণির মৃতদেহের উপর পুঁজিবাদী শক্তির বিকাশের কৃত্রিম সূচনাবাহী।

‘স্টর্ম ওভার এশিয়া’- পুদোভ্কিনের ‘সোনালী যুগের’ শেষ সিনেমাই শুধু নয়, বরং ১৯২০ দশকে তার সর্বশেষ সফল সিনেমাও। এর প্রেক্ষাপট ১৯২০ সালের মঙ্গোলিয়া এবং সেখানকার সেইসব শিকারি- যারা ফাঁদ পেতে ধরা নিজেদের শিকার অ্যাংলো-আমেরিকানদের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে পরশ্রমজীবী জীবন কাটায়। এই সাম্রাজ্যবাদীরা [অ্যাংলো-আমেরিকান] স্থানীয় অধিবাসীদের বাধ্যগত ও নিশ্চুপ রেখে নিজেদের সুবিধায় কাজে লাগাতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অবজ্ঞা ও ধর্মকে [বৌদ্ধ]। এখানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও আন্তর্জাতিক পুঁজির খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় শিশু দালাইলামাকে। নিজের শিকার করা একটি রূপালি শিয়ালকে কম দামে আমেরিকান ক্রেতা হিউজেসের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে শিকারি থেকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা তুখোড় সামরিক নেতা অ্যামোগোলান। আর তাতেই সংঘাত ত্বরান্বিত হয়। বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে পালিয়ে, রাশিয়ান পার্টিজানে যোগ দেয় সে। এখানেও নাচ, মুখোশ ও মিউজিকের সন্নিবেশে স্থানীয় সংস্কৃতির একত্রিভূত রূপ এবং সম্প্রদায় ও বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য মন্তাজ হিসেবে ব্যবহার করেছেন পুদোভ্কিন। পাহাড়, বন ও আকাশের প্রকাণ্ড ল্যান্ডস্কেপ ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে এই সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততাকে ফুটিয়ে তুলেছেন; অন্যদিকে দেখিয়েছেন- কী করে এই মানুষদের জীবন ও চলার পথ পুরোটাই প্রাকৃতিক ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অতিবাহিত হয়।

ব্রিটিশরা অ্যামোগোলানকে গ্রেফতার করে এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। সে চেঙ্গিস খানের বংশধর- সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত একজন তাকে এই পরিচয়ে সনাক্ত করলে, সেই দণ্ড থেকে পরে রেহাই পায় সে; আর তাকে ব্রিটিশ উপনিবেশ শক্তির একজন নিখুঁত পাপেট বা খেলনা নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমরা জানতে পারি, লন্ডনে বসে চার্চিল স্বয়ং এ সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়েছেন। যদিও সেই ঘোষণাটি পৌঁছুতে এতটাই দেরি হয়ে যায়, ততক্ষণে অ্যামোগোলানকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে নেয়া হয়েছে। একটি বিস্ময়কর রকমের অবদমিত ও গ্লানিকর দৃশ্যে, জনৈক ব্রিটিশ সৈনিক ভীষণ অনিচ্ছায় তাকে গুলি করে হত্যা করে; আর তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ এলে, সেই সৈনিকটিই অ্যামোগোলানের মৃতদেহ নিয়ে হাজির হয়। এরপর তাকে একজন জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়; যদিও এই ব্যক্তিকে ব্রিটিশরা মশকরা ও অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে দেখিয়েছে; অন্যদিকে, তারা ছিদ্রান্বেষির মতো বলে বেড়িয়েছে- এই রাজ্যে শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শাসক হিসেবে এই অ্যামোগোলানকেই তারা যোগ্য মনে করে। অথচ সত্য হলো, তাদের আচরণ ছিল দখলবাজের মতো। অন্যদিকে, আমেরিকান হিউজেসের আগমন ঘটেছিল অ্যামোগোলানের কাছ থেকে রূপালি শিয়াল চুরি করে নেওয়ার জন্য। আর সেই কাজে সে সফল হয়েছিলও শুরুতে। পরে অ্যামোগোলান সেটি উদ্ধার করেছিল। আর তাতেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের সূচনা ঘটে।

নিজের চোখের সামনে যখন নিজেরই স্বদেশি এক সহযোদ্ধার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, অ্যামোগোলান তখন নিজের ‘উপকারিদের’ বিরুদ্ধচারি হয়ে ওঠে। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে নিজের পালানোর পথ খুঁজে নেয় সে; এবং শেষবার আমরা তাকে দেখি, হাজারও অশ্বারোহী সেনার প্রধান হিসেবে- তাদেরকে দখলবাজ শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে। এভাবে সে হয়ে ওয়ে চেঙ্গিস খানের সত্যিকারেরই বংশধর, এক নির্ভীক ও আত্মপ্রত্যয়ী যোদ্ধা- যে বিদেশি আক্রমণকারীদের কাছ থেকে নিজের ভূমিকে রক্ষা করতে নিজের লোকদের নেতৃত্ব দিয়েছে যুদ্ধে।

অ্যামোগোলান ও পেলাজিয়া ভ্লাসভ- দুটি চরিত্রই সোশ্যালিস্ট রিয়ালিস্ট টার্মিনোলজিতে ‘ইতিবাচক নায়ক-নায়িকা।’ ‘মাদার’ ও ‘স্টর্ম ওভার এশিয়া’- দুটি সিনেমাই সেই আমজনতার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও আদর্শবাদী প্রতীজ্ঞার জন্মকে প্রতিকৃত করে- যে মানুষগুলো প্রাথমিকভাবে রাজনীতিকে এড়িয়ে চলত, এবং যে মানুষগুলো নিজ নিজ অনিবার্য অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়েই ভাবত শুধু। তারা নিজেদের জীবনের পরীক্ষা ও ক্লেশের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিবর্তনের হাতিয়ার করে তোলে। তাদের চোখে সংকল্পের আগুন জ্বলে ওঠে; তাদের কর্মকাণ্ডের তাদের বিচারবোধের প্রত্যয় দেদীপ্যমান; আর তাদের লড়াইয়ের উদ্দেশ্য- একটা বাসযোগ্য পৃথিবী। তবু, তারা একলা-মানুষই রয়ে যায়। তারা ভুল করে; আর ফুটিয়ে তোলে মনুষ্য দুর্বলতাগুলো।

বিষয়বস্তু নির্বাচন ও সিনেমাটিক মন্তাজের সম্ভাবনাসমূহ সৃষ্টি করতে গিয়ে- পুদোভ্কিন আর আইজেনস্টেইনের কাজ নানাদিক থেকেই একাকার হয়ে গেছে। তবে একদিক থেকে তারা একেবারেই আলাদা- সিনেমায় অভিনেতার ভূমিকা। সিনেমা দেখতে বসে দর্শক যেন কেন্দ্রীয় চরিত্রটির প্রয়োজনীয়তাকে সনাক্ত, এবং মানবিক আবেগ-অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে পারে- সে ব্যাপারে সজাগ ছিলেন পুদোভ্কিন। এ ব্যাপারে সমালোচক রিচার্ড টেইলরের মন্তব্য :

‘পুদোভ্কিনের সিনেমার নায়কোচিত চরিত্রগুলো যেখানে ব্যক্তিমানুষ, সেখানে আইজেনস্টেইনের সিনেমায় তারা বেনামি গণমানুষের প্রতীক হয়ে আছে। উদাহরণ দিয়ে এই পার্থক্যটা ধরা যেতে পারে-  পুদোভ্কিনের ‘মাদার’ সিনেমার ট্রাজিক ব্যক্তিত্ব মা ও তার পুত্রটির সঙ্গে ‘ব্যাটলশিপ পতেমকিন’- এর [Bronenosets Patyomkin] স্টেরিওটাইপ ইমেজারি; ‘দ্য এন্ড অব সেন্ট পিটার্সবুর্গ’- এর চরিত্রগুলোর সঙ্গে ‘অক্টোবর’- এর প্রতীক; এবং ‘দ্য হ্যের অব চেঙ্গিস খান’- এর নায়কের সঙ্গে ‘দ্য ওল্ড অ্যান্ড দ্য নিউ’র [Staroe I Novoe] নায়িকার তুলনা করে। পুদোভ্কিনের সিনেমায় চরিত্রগুলো ব্যক্তিমানুষ বা ইনডিভিজ্যুয়াল, সাধারণ মানুষ; অন্যদিকে, আইজেনস্টেইনের সিনেমায় তারা স্রেফ প্রতীক, ইতিহাসের স্রোতে ভাসা কীট।’

সোভিয়েত সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্যতম স্থায়ী এক পরিহাস হলো, ১৯২০ দশকে সোশ্যালিস্ট রিয়ালজমের চাহিদা অন্য যেকোনো ফিল্মমেকারের চেয়ে বেশিমাত্রায় পূরণ করে, সেটিকে [সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম] ১৯৩৪ সালে অফিসিয়াল পলিসি হিসেবে ফর্মুলাভুক্ত হওয়ার নেপথ্যে ভূমিকা রাখা পুদোভ্কিন নিজেই ১৯৩০ দশকে স্তালিনবাদী সমালোচকদের তুমুল নিন্দায় জর্জরিত হন- তার কাজে যথেষ্ট মাত্রায় আদর্শবাদী বিষয়বস্তু না থাকার অভিযোগে। ‘অ্যা সিম্পল ইনসিডেন্ট’ ও ‘দ্য ডেজার্টার’- এর মতো, তার পরবর্তী সময়ের সিনেমাগুলো ফরমালিজম, এবং আদর্শগত ফোকাসে ঘাটতির দায়ে সমালোচিত হয়। অন্যদিকে তারই ১৯২০ দশকের বানানো সিনেমাগুলো পালন করতে থাকে সোভিয়েত সিনেমা বিকাশের নেপথ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

ডেভিড গিলেস্পি। রাশিয়ান অধ্যাপক ও সিনে-তাত্ত্বিক

গ্রন্থসূত্র : আর্লি সোভিয়েত সিনেমা : ইনোভেশন, আইডোলজি অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা/ ডেভিড গিলেস্পি। ওয়েলফ্লাওয়ার পাবলিশিং লিমিটেড। লন্ডন। ২০০০


 

আরো পড়ুন-
ওয়েলিংটন টু পিকটন : যে পথে সবুজ পাহাড় এসে মিশে গেছে সাগরের নীলে

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!