X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

লেখকদের কিছু রঙ্গ-রসিকতার ঘটনা

হামীম কামরুল হক
২১ জুন ২০১৭, ১৩:৩১আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ১৬:৪০

লেখকদের কিছু রঙ্গ-রসিকতার ঘটনা
লেখক-জীবন কোনো আনন্দ-মজার জীবন নয়। গুস্তাভ ফ্লবেয়ারে মতে নাকি, লেখকের জীবন হলো কুকুরের জীবন, কিন্তু এটাই একমাত্র জীবন যা যাপনযোগ্য। কাজী নজরুলের কথা, জগতে দুঃখ বলে কিছু নেই। যা আছে সেটা আসলে আনন্দেরই অংশ। -এই কথার ভেতরে লুকানো কথাটি হলো- ওই বুদ্ধের কথা মতো, জগৎ দুঃখময়, কিন্তু আধুনিক মানুষের উচিত সেই দুঃখকেও আনন্দের সঙ্গে আস্বাদ করা। রবীন্দ্রনাথ যে আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ জানান, সেই জগৎ আনন্দফুর্তির জগৎ নয়, সেখানে আনন্দ মানে আস্বাদের আনন্দ। দুঃখ-বেদনাকষ্টকে সচেতনভাবে ভোগ করা, তাকে আস্বাদের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার নতুন পথ তৈরি করা। সেসবকে সৃষ্টিশীলভাবে কাজে লাগানো। লালনের কু থেকে সু-ফল পাওয়ার ব্যাপারও তাই। এজন্য লেখক তার জীবনের কষ্টগুলিকে আনন্দে পরিণত করতে পারেন। দুঃখ তার জীবনের সমস্ত কাজের উৎসধারা হয়ে থাকে। তার একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা এবং তার থেকে পাওয়া বেদনাকে তিনি ঝিনুকের মতো কুক্ষিগত করে তাকে মুক্ততে পরিণত করেন।

ছোট ছোট নানা বিরক্তি, না পাওয়া, ছোট ছোট স্খলন-পতনগুলিকে আত্মসমালোচনা-আত্মনিরীক্ষণের ভেতরে দিয়ে তিনি এমন করে মানুষ ও জীবন সম্পর্কে নানান বোধে সিদ্ধান্তে উপনীত হন। বাংলা সাহিত্যের কজন সিদ্ধপুরুষের জীবনের কটি ছোট ছোট মজার ঘটনা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, তাতে বোঝা যাবে সৃষ্টিশীল মানুষরা কতটা রসিক ছিলেন। জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলিকে, বিরক্তিকর ঘটনাগুলিকে রসিকতার সঙ্গে নিতে পারার যে সামর্থ্য কোনো ছোটখাটো সামর্থ্য নয়।

`বিদ্যাসাগর-রচনাসম্ভার’সম্পাদনা করার সময় প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্র কেবল বিদ্যাসাগর বা করুণার সাগর নন, রসসাগরও বটে।‘ কেননা আমরা বেশির ভাগই মনে করি, বিদ্যাসাগর মানুষটা বড়ই সিরিয়াস। তার জীবনে রঙ্গরসিকতার কোনো জায়গা নেই। এমনিতে কঠিন শ্রম নিয়ে কষ্ট করে নিজেকে নিজে গড়েছেন, তেমনি ছিলেন নিরন্তর কর্মী মানুষ। বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য কঠিন সংগ্রাম করেছেন। রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে ভয় না পেয়ে নিজের প্রত্যয়কে অক্ষুণ্ন রেখেছেন। বলাবাহুল্য যে, বিধবার বিয়ে কোনো হাসি ঠাট্টার বিষয় নয়। তারপরও বিধবাদের বিয়ের আসরে তিনি রঙ্গ রসিকতা করতেন। বিধবা বিবাহের কোনো আয়োজন হলেই তার ডাক পড়ত। এতে একে তাকে সম্মান জানানো হতো, অন্যদিকে তার উপস্থিতির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঠেকানোর কাজটা হতো। কারণ বিদ্যাসগারের ব্যক্তিত্ব ও প্রতাপের সামনে দাঁড়ানোও সামান্য লোকের কাজ ছিল না। এ দুটি বিবেচনায় বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দিত। এমননি এক বিধবার বিয়ে দেওয়ার আসরে বিদ্যাসাগর গেছেন। সেখানে তাঁর এক বন্ধুর মেয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করলে, তিনি সবাইকে শুনিয়ে বললে, বেঁচে থাকো মা। বিয়ে হোক, বিধবা হও, আমি আবার বিয়ে দিই।

তাঁর কথায় উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। বিদ্যাসাগর সবাইকে বললেন, আরে তোমরা এত হাসছ কেন? এ পোড়া দেশে বাল-বিধববার তো অভাব নেই। কিন্তু তেমন করে কজন বিধবার বিয়ে হচ্ছে? আমার বন্ধুদের মেয়েরা বিধবা না হলে আমি কার বিয়ে দেব?

রবীন্দ্রনাথের একটি ঘটনা : শান্তিনিকেতনে একটি লোক এসে অনেকদিন থাকছে। তাও থাকছে সপরিবারে। খাচ্ছে দাচ্ছে। দিব্যি সময় পার করছে। যাওয়ার নাম করে না। তারপরও অনেকদিন হয়ে যাওয়ায় নিজের বোধোদয় হয় যে, এবার যাওয়া দরকার। তো লোকটি লটবহর নিয়ে বেরিয়েছে। পথে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা। রবীন্দ্রনাথ একজন শান্তিনিকেতনের তার ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির সঙ্গে পথে হাঁটতে বেরিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ তাকে দেখে বললেন, তা যাচ্ছেন বুঝি।

আজ্ঞে গুরুদেব।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, অনেকদিনই তো থাকলেন, তা আরো কটা দিন থেকে গেলেই পারতেন।

লোকটি বলছেন, গুরুদেব যখন বলছেন, তা-ই সই।

বলে, লোকটি আবার সপরিবারে থাকার জন্য ফিরল।

রবীন্দ্রনাথ লোকটিকে ফিরে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে সঙ্গের লোকটিকে বললেন, মানুষের সঙ্গে কি ভদ্রটাটুকুও করা যাবে না।

রবীন্দ্রনাথের জীবনজুড়ে এমন কত কত ঘটনা। ‘ছিন্নপত্রাবলী’র শুরুতেই আছে মজার একটা ঘটনা। ট্রেনে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে লিখছেন, ‘সে গাড়িতে আর দুটি বাঙালি ছিলেন। তাঁরা ঢাকা থেকে আসছেন, দেখে কেমন ঢাকাই মনে হয়- তাঁদের মধ্যে একজনের মাথা টাকে প্রায় পরিপূর্ণ এবং ভাষা অত্যন্ত বাঁকা- তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার পিতা দার্জিলিং ছিল? লক্ষ্মী থাকলে এর যথোচিত উত্তর দিতে পারত; সে হয়তো বলত, ‘তিনি দার্জিলিং ছিল, কিন্তু তখন দার্জিলিং বড়ো ঠাণ্ডা ছিলেন বলে তিনি বাড়ি ফিরে গেছে।’ আমার উপস্থিত মত এ রকম বাংলা জোগালো না। বোঝা যায় বাঙালদের একটু ঠাট্টা চোখেই দেখতেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ। যদিও নিজের শেকড়ও বাঙালই ছিল। বাঙালির তিন মহান কবির শেকড় বাংলাদেশেই। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশ।

এর সঙ্গে মনে পড়ছে, ঘটনাটি অভিজিৎ সেনের কাছ থেকে শোনা। কলকাতায় এক ট্রেনে বা ট্রামে এক বাঙাল উঠেছে। তাকে দেখে কলকাতার এক লোকের একটু আগ্রহ হলো। তিনি দুয়েকটা কথা জিগ্যেস করছেন, আর বাঙালটি বড়ই বিরক্ত। এক সময় কলকাতার লোকটি জিগ্যেস করে, তা দাদা আপনার বাসা কোথায়?

তখন বাঙালটি হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে, তর বাপে শকুন!

কলকাতার লোকটি তো হতভম্ব! ‘সে কী দাদা! আপনি আমায় গালি দিচ্ছেন?’

‘গালি দিব না তো কী দিব? বাসাটাসা আবার কী! হুম! মানুষের বাসা হয় নাকি, মানুষের থাকে বাড়ি, আর বাসা থাকে পাখির, শকুনের।’

লেখকদের জীবনে মজার ও এই রকম বিরক্তির ঘটনাগুলি অবিরাম ঘটে। সমাজের নানান অসংগতি নিয়েই তো তার কাজ। আবার স্রেফ মজার করার জন্যও বলা কত না কথা। আধুনিক বাংলা গল্প-উপন্যাসের তুখোড় এই দুজন লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ও মতী নন্দী একে ছিলেন বন্ধু, তায় আবার ভায়রা ভাই। শ্যামল মজা করে মতীকে একদিন বললেন, তোর নামটা একটু দেখে শুনে রাখবেন তোর বাবা-মা?

- কেন রে?

- আরে ভায়া, আমাদের নামের আগে যে একটা ‘শ্রী’ বসাতে হয়, সেটা তোর বাবা-মায়ের একটু খেয়াল করার দরকার ছিল না।

এটা তো স্রেফ মজার জন্য মজা।

আমাদের বাংলাদেশের নাট্যকার সেলিম আল দীনের সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাঁর নানান বিচিত্র কথা ও মজার ঘটনার সাক্ষী। আমার কিছুদিন তাঁর সঙ্গে মেশার ভাগ্য হয়েছিল। একদিন তিনি তাঁর নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে কাজ করছিলেন। তাঁর নিজের গানের দল ‘কহনকথা’ নিয়ে মহড়া দিচ্ছিলেন। সময়টা সন্ধ্যা হয় হয় এমন। এসময় আমাদের ওপরের ক্লাসে পড়েন এক নাট্যকর্মী, তিনি একটি নাট্যদলের প্রধান, এলেন তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে তাঁদের দলের আয়োজনে একটি নাটক হতে যাচ্ছে, তার আমন্ত্রণ জানাতে।

সেলিম আল দীন, তাদের আমন্ত্রণ-পত্রটি দেখলেন। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা তোমরা নাটক কেন করো বলো তো?

- স্যার, নাটক হলো সমাজের দর্পন।

- নাটক সমাজের দর্পন! (আমি জানি নাটক নিয়ে, এই জাতীয় কথায় স্যার বড়ই বিরকক্ত হতেন) তা এ কথাটা একটি অথেনটিক বইতে আমাকে তুমি দেখাতে পারো? শোনো, পত্রপত্রিকাও তো সমাজের দর্পন, তাই না? এমন আরো আছে, বাজারে গেলে সমাজ চেনা যায়। এমন কত না দর্পন আছে। এক সময় আবার শুনলাম শিক্ষা জাতির মেরুড়দণ্ড, আবার শুনলাম তরুণ সমাজ জাতির মেরুদণ্ড, এখন শুনি নারীপ্রগতি জাতির মেরুদণ্ড। এত মেরুদণ্ড নিয়ে একটা জাতি কি হাঁটতে পারে?

সেলিম আল দীন যে-মজা করে বলছিলেন, হাতে নানান ভঙ্গি আর তার চোখের মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে, তাতে কথাটা শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠেছিলাম।

এমন অসংখ্য ঘটনা নানান রসিকতায় সিক্ত থাকে লেখকের জীবনে। কেউ কেউ লেখকের নাম সংক্ষেপ করে করে দেখেন সংক্ষিপ্ত নামটাও অর্থপূর্ণ। যেমন সন্জীদা খাতুনের নাম সংক্ষেপে তিনি লেখেন স.খা। তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সংগীতের একজন সাধিকা। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিকাশের ইতিহাসে একজন সুহৃদ। সেই দিক থেকে সখাও। আবার এমন নামের সংক্ষেপে বিচিত্র সব হাস্যকর অর্থ তৈরি হয় অনেকেরই। তাই ওই নাম রাখার সময় একটু খেয়াল করা যেতে পারে। সেলিম আল দীনের সংক্ষিপ্ত নাম ইংরেজিতে হয়ে ওঠে স্যাড। আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভাগ নাটক ও নাট্যতত্ত্ব মানে ইংরেজিতে ড্রামা অ্যান্ড ড্রামাটিক্স-এর সংক্ষিপ্ত নাম হয় ড্যাড। এজন্য বলা, তাকে অনেক সময় বলা হতো ড্যাড ডিপার্টমেন্টের স্যাড স্যার।

ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় আমাদের একজন স্যার ছিলেন রিয়াজুদ্দিন প্রামাণিক নামে, আরেক জন ছিলেন মোসাদ্দেকুল ইসলাম চৌধুরী। ইংরেজিকে একজনের নাম আর. ইউ. প্রমাণিক। আরেকজনের এম. আই চৌধুরী। আমাদের হাসপাতালের এম আই রুম নামে একটা কক্ষ। আমরা মজা করে বলতাম, এম. আই আর রুমে এম. আই চৌধুরী স্যার আর ইউ প্রামণিক স্যারকে দেখে প্রথম দিন বলেন, হ্যালো, আর ইউ প্রামাণিক, তখন প্রামাণিক স্যার কী বলবেন?

- এমন কত না মজার ঘটনা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। দুঃখ উজিয়ে সেসব মনে রাখতে পারলে জীবনটা সত্যিই রসসিক্ত থাকে। সেই থাকাটা জীবনের জন্য সবদিক থেকে বড়ই দরকারি।

 


 

আরও পড়ুন-

সেভলদ পুদোভ্কিন : সোভিয়েত সিনেমার অগ্রদূত

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক