X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উন্মুক্ত জায়গা

মূল : এঞ্জেলা হারনান্দেজ নুনেজ | অনুবাদ : ফারহানা রহমান
২১ জুন ২০১৭, ১৪:৫১আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ২০:০৭

উন্মুক্ত জায়গা

এঞ্জেলা হারনান্দেজ নুনেজ ১৯৫৪ সালের ৬ মে ডোমিনিকান রিপাবলিকের লা ভেজা প্রভিন্সের জারাবাকোয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ডোমিনিকান রিপাবলিকের একজন শিক্ষিকা ও ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী ছিলেন। তিনি অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অফ সান্টো ডমিঙ্গো থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন এবং ন্যাশনাল সেন্টার অফ আয়ুদা স্টুডিও ডি লা মুজের এর ডাইরেক্টর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়াও ডোমিনিকান রিপাবলিক অফ ক্রিটিসিজম এর সদস্য হিসেবে ল্যাটিন অ্যামেরিকার জন্য কাজ করেন এবং একই সাথে নারী কবিসংঘের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করতেন। তিনি সৃজনশীল নারী গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং ১৯৯৮ সালে তার ছোটগল্প ‘পেইদ্রা দি স্যাক্রিফিসো’ এর জন্য ডোমিনিকান ন্যাশনাল লিটারেরি এওয়ার্ড পান। তার স্প্যানিশ ছোটগল্প ‘ক্যাল্লালু’ কে ভ্যাসর কলেজের হিস্পানিক স্টাডিসের প্রোফেসর লিজাবেথ প্যারাভিনিসি গিবারট ইংরেজিতে ‘কমনপ্লেস’ হিসেবে অনুবাদ করেন।

বিষণ্ণ টানেলের দেয়ালটি গ্রাফিটিটে ভরা ছিল। আমি মেটাল পোলটি জড়িয়ে ধরে ছিলাম। অন্যরা একহাতে পোলটি আর অন্য হাতে বই বা নিউজ পেপার ধরে ছিল। আমরা মেটাল বারটির চারপাশে জড় হয়ে ছিলাম। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে আমাদের একে অন্যের সাথে ধাক্কা লাগছিলো। ক্ষণিকের জন্য যাত্রীরা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিল তবে পরমুহূর্তেই তা পাতার উপর ফিরে যায়। আমি মনোযোগ দিয়ে সঙ্কেতগুলো দেখতে পাইনি। তাই যেকোন ভুল ট্রেনেই উঠে যেতে পারতাম। এই ট্রেনটি সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি স্টেশনের নাম পড়লাম।

আমরা কি শহরের ভিতরে যাচ্ছি নাকি বের হয়ে যাচ্ছি?

মনে পড়লো ম্যাডামের নির্দেশাবলী, ‘যখন আমরা যাই তখন উপরে যাই, যখন ফিরে আসি নীচে ফিরে আসি’। আমি নীচে প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। ট্রেনটা সে সময়ই আসছিলো। আমার বা দিকে এটির নাম লেখা উঠলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো যে আমি এটি ধরবো নাকি পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করবো নাকি কিছু প্রশ্নের সাহায্যে প্রত্যেকটি সঙ্কেতের মানে খুঁজে বের করবো? আমি উঠে পড়লাম। মাথা কাজ করছিলো না। এটা ভুল ট্রেনও তো হতে পারতো। আমি অপেক্ষায় ছিলাম নিউজ পেপারের উপর থেকে নজর ফেরানো দুটো চোখের জন্য যাকে ট্রেনের গন্তব্যের ব্যাপারে জিগ্যেস করা যায়। আমার খুব কাছে চুল হাইলাইট করা একজন ভদ্রমহিলা চোখ বুজে বসে ছিল। তার ব্যক্তিত্ব আক্ষরিক অর্থেই তাকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। এক মুহূর্তের জন্য একজন আমার দিকে তাকালো। আমি মুখ খুলতে যাওয়া মাত্রই সে পত্রিকার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আমি ম্যাপটা তখনই দেখবো যখন পোলটা ছেড়ে দিতে আর কোন ঝুঁকি থাকবে না।

আমি কি গতকাল এই স্টেশনটিই দেখেছিলাম? গতকাল কিন্তু আমি আমার ম্যাডামের উপর ভরসা করেছিলাম।

‘নামগুলো দ্যাখো আর সতর্ক থাকো। সামনের স্টেশনে নামার জন্য তৈরি থাকো। যদি স্টেশন মিস করো তাহলে অন্য দিকটিতে যাও এবং নিজের পথে আবার ফিরে আসো।’ এতে কোন কন্ডাক্টর নেই। দরজাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলে এবং বন্ধ হয়। যন্ত্রের উপর কি এভাবে বিশ্বাস রাখা যায়? কোন সঙ্কেত ভুল হয়ে যেতে পারে বা একটি ভুল নাট-বল্টু, খোদা মালুম! আমার যাতায়াতের সময় কিছু তো স্লিপও করতে পারে। আর ঠিক তখনই আমি আঁটকে যেতে পারি। আমার শরীর ট্রেনের সাথে আঁটকে থাকবে আর ট্রেন ছেড়ে দেবে। টানেলের ভিতরে বরফ-শিতল পরিবেশ, এতো অন্ধকারেও তুমি গ্রাফিটি দেখতে পাবে। আর আমি? মৃত অথবা ভীড়ের ভিতরে ভর্তা (চূর্ণবিচূর্ণ) হয়ে আছি যে সবাইকে যাওয়ার পথে একটু কৌতূহলী করবে। ভিড়টিকে দরদ দেখতে পাদ্রীরা আমার দিকে এগিয়ে আসবে আর মানুষের দৃষ্টি দিয়ে আমাকে সাহায্য করবে যাতে আমি ইঁদুরের মতো রাস্তায় মরে পড়ে না থাকি। ওহ! ইদুর! গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আমিও ভিজে গেলাম। এ কারণেই হয়তো আমার মস্তিষ্ক আমাকে প্রতিরক্ষক হিসেবে প্রথম দেখা ট্রেনটিতেই উঠতে বাধ্য করেছিল।

‘এটা কী ট্রেন?’ আমি কৃষ্ণ নারীটিকে জিজ্ঞেস করলাম যার বর্ণের মধ্যে ক্রান্তীয় এলাকার প্রভাব আছে। সে নিশ্চয়ই কোন একটি দ্বীপের হবে।

‘এটি ওয়াই ট্রেন’ সে হেসে উত্তর দিল।

ম্যাপে কোন ওয়াই ট্রেন ছিল না। ‘এটি কি ‘এ’ ট্রেন না?’ আমি তার কাছে জানতে চেলাম। স্পষ্টভাবে মনে আছে যে আমি বর্ণমালার প্রথম বর্ণটিকেই বড়হাতে লেখা দেখেছিলাম যা ট্রেনের পাশে উজ্জ্বল সাদা আলোর চলন্ত ফিতার মধ্যে যাচ্ছিলো। তবে এ লেখাটি কিছুটা  চৌকোণ ছিল। এমনও হতে পারে যে এটা আসলে কোন বর্ণই নয়। আবার এমনও হতে পারে যে এটা একটি আঁকা ছবি আসলে আমি তাড়াহুড়োয় ওটাকে নিজের সুবিধা মতো ভেবে নিয়েছি। ট্রেনটি থামল। মহিলাটি চলে যাওয়ার আগে আবারো আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। (তার নিশ্চয়ই মাথা চক্কর দিচ্ছিল বা ঘুমঘুম পাচ্ছিলো। যেন সে মনোমুগ্ধকর সুরভীতে বা পামগাছের ছায়ায় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলো এবং হঠাৎ চলন্ত কবরে হতভম্ব হয়ে জেগে উঠলো)। আমি ম্যাপটি আমার পার্স থেকে বের করলাম। এক হাতের তালু দিয়ে ও অন্য হাত দিয়ে ধাতব বারটিকে মাঝখানে জড়িয়ে রেখে ম্যাপটাকে মেলে ধরলাম। কোণার একটি মুখ যেন আমায় গিলে খাচ্ছিল। প্রত্যেকের চোখগুলো আমার দিকে ফিরে তাকাল। ইতিমধ্যে তারা জেনে গেছে যে আমি হারিয়ে গেছি। তবে সেটা তাদের আকর্ষণ ধরে রাখার মতো যথেষ্ট নয়। তারা দ্রুতই তাদের বই এবং সংবাদ পত্রে মনোযোগ ফিরিয়ে নিলো। গতকাল রাস্তা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি কাগজের উপর যে চিহ্নগুলো রেখেছিলাম সে ব্যাপারটা নিতে বিশ্লেষণ করলাম।

‘এটা কি এ ট্রেন?’

‘হ্যাঁ।’ অনেকগুলো কণ্ঠস্বর একসাথে বলে উঠলো। স্পেশাল গাড়িটির ধাতব স্লাইডিং দরজাটি খুললো। তিনজন কালো মিউজিশিয়ান। তাদের হ্যাশহ্যেশে সুরেলা কণ্ঠস্বর যেন রৌদ্রোজ্জ্বল সমুদ্রবন্দর এবং বাঁশঝাড় থেকে ভেসে ভেসে আসছে যা ক্ষণিকের জন্য হৃদয় উদ্বেলিত করে। তারা টাকা সংগ্রহ করে পরের গাড়ির দিকে হেঁটে যায়। দরজাটি আবারো খোলে। একটি দুঃস্থ মহিলার আবির্ভাব হয়। তার গলায় একটি বাক্স ঝোলানো। ‘ভদ্রমহিলা এবং মহাদয়গণ...।’ বলে সে বোঝাতে লাগলো যে সে গৃহহীন একজন মানুষ। সে কানের দুল বিক্রি করছে যাতে সে একটি মাথা গোঁজার জায়গা ভাড়া নিতে পারে। তার মুখে চিকেন পক্সের ক্ষতের দাগ। সে যেকোন দেশেরই একজন হতে পারে। (সে ভাবে ‘ট্রেনটি অনন্ত সময় ধরে যাচ্ছে’) আবার লোহার ঘড়ঘড় শব্দ...। এবার একটি চাইনিস লোক যিনি সাবওয়ে কারের শ্রোতাদের সাথে কথা বলছেন। তিনি মেঝেতে একটি মোটরগাড়ি রাখলেন। খেলনাটি দ্রুত এগিয়ে গেলো, পায়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে হোঁচট খেতে লাগলো। সে একটা উজ্জ্বল ইয়োইয়ো দোলাতে লাগলো। সে ভয়ঙ্কর চেহারার কিছু পুতুল দেখালো। বিক্রেতারা চারপাশের ক্রেতাদের বারবার আকর্ষিত করে। ট্রেনটি থামেনা কেন? এটি গতি কমিয়ে, না থামিয়েই স্টেশন ছেড়ে একটি অন্ধকার টানেলের মধ্যে ঢুকে গেলো। এটি আমার ষ্টেশনের পাশ দিয়ে যাবে। এটি একটি এক্সপ্রেস ট্রেন! (সে নিশ্চয়ই কানে শুনছে না, আর মনে পড়ে তার হল্যান্ডের পনির ছিল, টাটকা তৈরি কমলার রস, রুটি আর ডিম ভাজা ছিল নাস্তার জন্য। সে নিশ্চয়ই ভাবছে যে এই গাড়ির প্রত্যেকে প্রচুর পরিমাণে খেতে পায়। সে নিশ্চয়ই সবাইকে খুবই হৃদয়হীন ভাবছে)। ম্যাডাম আমার কাছে বর্ণনা করেছিলো, ‘এটি খুব ভালো চাকরী। এটা সত্যি যে এটা একটু দূরে। তোমার দূরের যাতায়াতে অভ্যস্ত হতে হবে। এখানে কোন কিছুই কাছে নেই।’ আমি একের পর এক স্টেশন বলদাই। যাওয়ার পথে প্রতিটি সাইন পড়ি। আমি এভাবেই স্বাবলম্বী হয়েছি। আমি প্রতিদিন আট ঘণ্টা বোতলে মাংস ভরার কাজ করি। ‘ওরা তোমাকে পোশাক ও অন্যান্য সবকিছুই দেবে।’ বোতলগুলো সহজেই খোলা যায়। মাংস নিয়ে এর মধ্যে ভালো করে ভরে দিতে হয়। অনেক বোতল থাকে। কিছু বোতল খালি অবস্থায় চলে যায়। কিছু কিছু বোতলের ঢাকনা কুঁচকে থাকে। আমি কি ওগুলো খুলে শক্ত করে আটকাবো নাকি ওভাবেই রেখে দেবো? কাজ শেষে বোতলগুলো পরীক্ষা করা হবে। তারা খুব সামান্য পরিমান ভুল পর্যন্ত গ্রহন করে। বেল্টটি ট্রেনের মতোই দ্রুত পাত্রগুলো নিয়ে বহন করে নিয়ে আসে। ‘এটি কোন খারাপ কাজ না।’ ম্যাডাম কলম্বিয়ান। বেশ বয়স হয়েছে। তবু এখনো যথেষ্ট সুন্দরী। চোখগুলোও সুন্দর। ‘তুমি এখানে আমাদের জন্য সঠিক মানুষ নও। যদি তুমি চাও তো পরিস্কার পরিচ্ছন্নের কাজটা এরমাঝে করতে পারো।’ সে আমাকে বিপদে ফেলতে চায়নি। আমি ভীষণ অসুস্থবোধ করছি। ‘আমরা একটা সভ্রান্ত জায়গা চালাই। আমাদের সব মেয়েরাই ১৫ থেকে ২৫ বছরের। কোন কোন জায়গা সত্যি খুব চাহিদাজনক। আমি আমার বয়স ২৩ বছরও বলতে পারি। কিন্তু কি লাভ যদি আমাকে যদি ৩০ এর বেশি বয়স্ক দেখায়? উনি আমাকে ভদ্রভাবে বিদায় দিলেন। তোমাকে সাহায্য করার জন্য আমি একটি মেয়ে পালতে পারি’। পরে তিনি আমাকে একটি কাজ পেতে সাহায্য করলেন। সাদাচুলের লোকটি তার সিট থেকে আমার দিকে তাকায়। সে তাকিয়ে থাকল যতক্ষণ না আমি খেয়াল করি। এক্সপ্রেস! ‘নিয়মানুবর্তী হও। একদম সঠিক সময়ে কার্ড পাঞ্চ করব’। বোতলের সারিগুলো অবিরামভাবে গতিময় বেল্টের সাথে চলে যেতে থাকে। আর আমি ভিড় কমানোর জন্য তাদের ব্যবস্থা করি। কালো টুপিওলা গাঢ় নীল পোশাকের মহিলারা তাদের ১০০ হাতে দিয়ে টানেলের থেকে অক্ষত অবস্থায় আসা মালের ভিড় না লাগার ব্যাপারে কাজ করে। মনে হচ্ছে আমাকে অবশ্যই এসব চিন্তা দূর করতে হবে। মাংস সংরক্ষিত। কোথায় এবং কারা এসব খায় যেগুলো আমি তাড়াহুড়ো করে বোতলে ভরি? হয়তবা, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কোন সৈনিক একটু অবসরে, অথবা দাসত্ব চোখের কোন বিধ্বস্ত মানুষ যে চোখে প্রশংসা নিয়ে, যার চিবানোর ক্ষমতা নেই, আমি খবরে দেখেছিলাম একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে মরুভূমিতে কসাইখানায়, অথবা একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা তুরিন বা বেলফাস্টের রেস্টুরেন্টে বসে আছে (সুন্দর নামের শহরগুলো)! এটা আমার চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করছে। অন্যান্য বোতলগুলো চলে যাচ্ছে যদিও আমার আঙ্গুলগুলো দ্রুত, একটি বেসমেন্টে, অথবা সাগরের একদম নীচে বা ময়লার ট্যাংকিতে বিক্রি বা শেষ নাও হতে পারে।

‘তুমি খুব ধীরে কাজ করছো ডোমিনিকান।’ সুপারভাইসারটি ইটালিয়ান। সে আমার হাত খেয়াল করে। আমি বললাম, ‘আমি ইলিশ।’ তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে যে তাকে বলি আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। আমি বোকা নই যখন এরকম চিন্তা আসে যে সে কালকেও আমার নাম ধরে ডাকবে। সাবওয়ে কারে একটি মেয়ে নিজে নিজে হাসে। কে জানে কত ইতিহাস একইসাথে একটি আত্মাতেই বাস করে? কল্পনা করছি ঠাণ্ডারবোধ আসলে ঠাণ্ডার মতো না। তাপমাত্রার সাথে রঙও বদলে যায়। ঘড়ঘড় শব্দে ট্রেনটি আস্তে আস্তে দুলতে থাকে। এটি গতি কমায়। কোন দিকের দরজাটি খুলবে? আমি ট্রেনের আর সবাইকে ফলো করি। আমি আবারো নিজেকে বলি, তারা কোথায় যাবে তারা জানে। দেয়ালটি সাদা টাইলস দিয়ে ঢেকে আছে। (সে এমনভাবে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নামলো যেন সে জ্বরগ্রস্ত অসুস্থতায় ভুগছে। ‘আধুনিকতা তাকে জাহান্নামী করেছে।’ সে নিজেকে জিজ্ঞাসা করে যে শব্দগুলো কোথা থেকে উদ্ভূত হলো, সে নিজের কাছে স্বীকার করে যে সে নিজেকে হতভম্ব হওয়া থেকে রক্ষা করতে এরকম হিংস্রতার ভান করেছে)। আমি একটি বেঞ্চে বসলাম। ম্যাপটি খুললাম। আমি আমার আঙ্গুল দিয়ে ট্রেনের গতিপথ অনুসরণ করি, কোন স্টেশন থেকে আমি উঠেছিলাম আর এখন আমি কোথায় আছি। আমার পাশের লোকটি মরা কুকুরের মতো দুর্গন্ধ ছড়ায়। আমি জানি সে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমিও একনজর তাকে দেখলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি গ্রাহ্য করি না। লোকটি আমাকে সাহায্য করতে চায়। উনি আমার ভাষাতেই কথা বলে। আমাকে কোথায় যেতে হবে সেটার বর্ণনা দিলাম তার কাছে। লোকটি দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলো। অনেকগুলো পরিবর্তন। আমি নিঃশ্বাস না ফেলে তার কথা শুনতে থাকি, মৃদুভাবে তার উদারতায় সাড়া দিতে থাকি। আমার কোন দিক নির্দেশনার ধারণা নেই। আমি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, উপরে নীচে ঘুরে বেড়াবো, আমি কী বা জানি? টানেলের মধ্যে হারিয়ে গেছি, প্রচারিত পোস্টারগুলো না থাকলে আমি দেয়ালে হয়তো ধাক্কা খেয়ে মরতাম। আমি হয়তোবা ভুল পথে যাওয়ার জন্য ভুল ট্রেনে চরবো। শেষ পর্যন্ত যখন ক্লান্ত হয়ে যাবো তখন ফোন খোঁজার জন্য বরফ ঠাণ্ডা হয়ে উঠবো আর ম্যাডামের কাছে সাহায্য চাইবো। আমি তোমাকে সাহায্য করার জন্য তোমার সাথে যাবো? লোকটি মৃদুভাবে কথাগুলো বললো। গাড়িতে অন্যরা ভয়ে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকল, তারা আমাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে সিটের শেষের এক কোণার দিয়ে ঝুঁকে বসলো বা দূরের পোল ধরে দাঁড়ায়ে থাকলো। এমনকি আমাদের কাছে বসা লোকগুলো নিজেদেরকে উৎকট গন্ধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নানা চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা একেবারেই শুধু নিজেদের মতো বসে থাকলাম। লোকটি আমার সাথে ভদ্রতার সাথে দূরত্ব রেখে কথা বলল। আমি অবাক হয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম কে এই ভবঘুরে, যেহেতু একপাশ থেকে আমি তার পরিস্কার নিখুঁত খাঁড়া নাকের নীচে তার ঘন ময়লা দাড়ি দেখতে পাই। আমি ভাবতে শুরু করলাম যে সে একজন ধনীপাগল যে তার অঢেল আরাম আয়েশে বিরক্ত হয়ে উঠেছে বা একজন খুঁতখুঁতে কবি, কোন হেনরি মিলারের মতই হয়তবা কেউ। আমি অপেক্ষা করি যাতে সে আমার কাছ থেকে কিছু জানতে চায়, আমি  উন্মুখ হয়ে থাকলাম তাকে আমার সিঁড়ির নীচের তেলতেলে ছাত্রাবাসের গল্প শোনানোর জন্য, মোমবাতি নিয়ে প্রার্থনারত বাড়িওয়ালীর গল্প, পাদ্রীর ছবিগুলো উলটো করে টাঙ্গিয়ে রাখার গল্প, আমার ছোটবেলার গল্প, আমার জীবনের একটি পুরুষের গল্প যে বিশাল গ্ল্যাডিওলাস ফুলের তোরা নিয়ে এসেছিলো (কারণ আমি গ্ল্যাডিওলাস খুব পছন্দ করি) এবং আমার সেই সেমিস্টারের টিউশন ফি নিয়ে ভেগে গিয়েছিলো, আমার সেসব বোতলের গল্প যেখানে আমাকে অবশ্যই মাংস ভরতে হতো। এমন এক নারীকে নিয়ে আমার সেইসব গল্প যে ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে একজন বুড়ো বেশ্যাদের দালালের হয়ে কাজ করতো। আমি লোকটির দিকে জেদি চোখে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু সে তার নিজের সম্পর্কে কিছুই বললো না এমনকি সে আমার সম্পর্কেও কিছু জানতে চাইলো না। আমরা পৌঁছে গেলাম। আর নামলাম। আর যখনই আমি সিঁড়ি বেঁয়ে রাস্তায় উঠতে গেলাম ঠিক তখনই লোকটি আমার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকলো যেন তার আমাকে বলার মতো অনেক কথা আছে। এমন ভাবেই তাকিয়ে থাকলো আর বললো ‘তুমি কি আমাকে একটা টাকা দিতে পারবে?’


 

আরো পড়ুন-
সেভলদ পুদোভ্কিন : সোভিয়েত সিনেমার অগ্রদূত

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ