X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

লেখা দেন কিন্তু দেখা দেন না

মুহম্মদ মুহসিন
২১ জুন ২০১৭, ১৬:৪৪আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ২০:০৪

লেখা দেন কিন্তু দেখা দেন না
একজন লেখকের গল্প বলতে যাচ্ছি যিনি পাঠকের জন্য সারাজীবন ধরে লিখেছেন, সারা দুনিয়া জুড়ে পাঠকও তাকে পড়েছেন, কিন্তু পাঠককে কখনো দেখা দেননি। তাঁর নামটি কী ছিল, কিংবা তাঁর বাড়ি কোথায় ছিল তা-ও নিশ্চিত করে তাঁর জীবদ্দশায় পাঠকরা কখনো জানতে পারেনি। এখন অবশ্য দুনিয়ার মানুষ তাঁকে গোটা চারেক নামে চেনে।

চারটা নাম থেকে বেছে যে নামটা দিয়ে আমরা তাঁর বয়ানটা শুরু করতে চাই সেটি হলো তাঁর বইগুলোর কাভারে ব্যবহৃত নামটি। সেটি হলো বি. ট্রাভেন (B. Traven)। বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে তিনি ছিলেন সারা ইউরোপ জুড়ে ঝড় তোলা লেখক। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দি ডেথ শিপ’ ১৯২৬ সালে জার্মানির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘গুটেনবার্গ বুক গিল্ড’ থেকে বের হয় এবং হিটলারের ক্ষমতা দখলের পূর্বেই বইটির ২,০০,০০০ কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল শুধু জার্মানিতে। হিটলারের ক্ষমতা দখলের পরে নাৎসী জার্মানিতে তাঁর উপন্যাস অনেকটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এ সময় তাঁর উপন্যাসের ব্যাপক কাটতি শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৩৫ সালের এপ্রিলের পূর্বে একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘দি ডেথ শিপ’ ১৬,৫০,০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল। এমন ছিল ইউরোপে বি. ট্রাভেনের জনপ্রিয়তা।

এই জনপ্রিয় লেখকের ঘর কোথায় দেশ কোথায় তা তাঁর পাঠকেরা না জানলেও তাঁর প্রকাশক এইটুকু মাত্র জানতো যে তাঁর বাড়ি ইউরোপে নয়। গুটেনবার্গ বুক গিল্ডের পরিচালক তথা প্রকাশক ব্রুনো ড্রেসলার জানতেন যে, ট্রাভেনের বাড়ি যেখানেই হোক না কেন তিনি থাকেন মেক্সিকোতে যেহেতেু বইয়ের পাণ্ডুলিপিগুলো ডাকে তাঁর কাছে মেক্সিকো থেকে আসতো। ড্রেসলার একবার আরেকটু বেশি অনুমান করে বড় বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি অনুমান করে এবং একটু আহ্লাদী শখ করে নিজের নামের সাথে এই মস্ত লেখকের নামের মিল করে বলে ফেলেছিলেন যে বি. ট্রাভেনের নামের পূর্ণ রূপ হলো ব্রুনো ট্রাভেন। এই মন্তব্যের বিপরীতে চিঠিতে বি. ট্রাভেন তাকে ব্যাপক ঝাড়ি দিয়েছিলেন এবং এই ভুল তথ্যের জন্য ড্রেসলারকে সোজাসাপ্টা মাফ চাইতে হয়েছিল। শুধু তাই না, তিনি তওবা পড়েছিলেন এই লেখকের নামধাম কিংবা বাড়িঘরের খোঁজখবর আর তিনি ভুলেও নিতে যাবেন না।

এ কারণেই ১৯৩২ সালে নিউইয়র্কের বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আলফ্রেড. এ নপ্ফ, ইনকর্পোরেট- এর মালিক আলফ্রেড. এ নপ্ফ বার্লিনে বেড়াতে গিয়ে এমন জনপ্রিয় একজন লেখকের খোঁজ পেয়ে গুটেনবার্গ বুক গিল্ডের সম্পাদক বা পরিচালকদের কাছে যখন বি. ট্রাভেনের নাম ঠিকানা জানতে চাইলেন তখন পুরো গুটেনবার্গ বুক গিল্ড কোম্পানি যথারীতি মুখে কুলুপ এঁটে রইলো। অবশ্য কুলুপ খুললেও তো তাদের কাছে বলার মতো কোনো তথ্য ছিল না। শুধু ডাক বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় যে ঠিকানাটুকু আলফ্রেড. এ নপ্ফ যোগাড় করতে পেরেছিলেন  আমেরিকা ফিরে তাই দিয়ে তিনি বি. ট্রাভেনের সাথে পত্র যোগাযোগে সফল হলেন। প্রথমে অনীহা জানালেও পরবর্তীতে আলফ্রেড. এ নপ্ফ-এর অনুরোধে বি. ট্রাভেন তাঁর ‘দি ডেথ শিপ’ ‘দি ট্রেজারস অব সিয়েরা মাদ্রে’ এই শর্তে আমেরিকায় ছাপার অনুমতি দিলেন যে বইয়ে লেখকের পরিচিতি জাতীয় কিছু ফ্লাপে কোথাও লেখা যাবে না এবং লেখক সম্পর্কে কিছু জানতেও চাওয়া যাবে না।

আলফ্রেড. এ নপ্ফ থেকে এভাবে আব্রু রক্ষা করতে পারলেও ট্রাভেন বিপদে পড়লেন হলিউডের অন্যতম সফল সিনেমা পরিচালক জন হাস্টনকে (John Huston) নিয়ে। হাস্টনকে তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁর উপন্যাস ‘দি ট্রেজারস অব সিয়েরা মাদ্রে’ ভিত্তিতে সিনেমা বানাতে। এক পর্যায়ে হাস্টন নাছোড় বান্দার মতো এ মর্মে চাপ দিলেন যে সিনেমার প্রয়োজনে তাকে বি. ট্রাভেনের সাথে সামনাসামনি বসে প্রয়োজনীয় অনেক কথা বলতে হবে। বি. ট্রাভেন শেষ পর্যন্ত এইভাবে রাজি হলেন যে তিনি নন, বরং তাঁর পিএস এবং একই সাথে তাঁর গ্রন্থের অনুবাদক হল ক্রোভস (Hal Croves) তাঁর প্রতিনিধিরূপে প্রয়োজনীয় সকল কথাবার্তা সারবেন। হাস্টন বুদ্ধি করে ক্রোভসকে এই সিনেমার টেকনিকাল এ্যাভাইজার হিসেবে নিয়োগ দিলেন কারণ তিনি অনুমান করেছিলেন যে, এই ক্রোভসই মূলত ট্রাভেন। অবশ্য তাঁর এই অনুমান সত্য প্রমাণ করতে অনেক কাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল, ততক্ষণে ট্রাভেন আর ইহজগতে নেই। তাঁর জীবদ্দশায় বরং চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘লাইফ’ ও ‘টাইম’- এ উক্ত সিনেমার সমালেচনায় ক্রোভস ও ট্রাভেনকে অভিন্ন বলে মন্তব্য করা হলে ক্রোভসের লিখিত প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে পত্রিকাদুটোতে দুঃখ প্রকাশ করে উক্ত প্রতিবাদপত্র ছাপাতে হয়েছিল। 

এভাবে ‘কেএই বি. ট্রাভেন?’ মর্মে ঘনীভূত হয়ে ওঠা দুনিয়াজোড়া রহস্য ভেদ করতে যিনি প্রাণপণ করে নামলেন তিনিও মেক্সিকোর ইতিহাসে সেরা লেখকদের একজন- লুই স্পোতা (Luis Spota)। লুই স্পোতার জন্য এটি ছিল বিখ্যাত পত্রিকা ‘মানিয়ানা’র তরফ থেকে একটি এ্যাসাইনমেন্ট। অনেক মানুষকে অনেক ঘুষ-তোহফা দিয়ে স্পোতা শেষ পর্যন্ত তাঁর এ্যাসাইনমেন্টে সফল হলেন। তিনি যে ক্লু দিয়ে কাজটি শুরু করেছিলেন সেটি ছিল একটি ব্যাংক চেক। তিনি নির্ভরযোগ্যভাবে জানতে পেরেছিলেন যে, ক্রোভস সম্প্রতি একশো ডলারের একটি ঋণ চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। তিনি আরো জানতে পেরেছিলেন যে, ট্রাভেন আকাপুলকো শহরে কোথাও থাকেন। এই তথ্য নিয়ে আকাপুলকো শহরের বিভিন্ন ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে স্পোতা উদ্ধার করলেন যে ব্যাংকে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী ঋণ পরিশোধের ঐ চেকটির মালিকের নাম বেরিক টোর্সভান (Berick Torsvan)। ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তিনি জানতে পারলেন যে, বেরিক টোর্সভান পেশাগতভাবে একটি গার্ডেন রেস্টুরেন্টের মালিক বা ম্যানেজার জাতীয় কিছু এবং তিনি একজন ইমিগ্রান্ট।

এই তথ্য নিয়ে তিনি মেক্সিকোর ইমিগ্রেশন অফিসের রেকর্ডপত্র তন্নতন্ন করতে শুরু করলেন। সেখান থেকে তিনি আরো জানতে পারলেন যে, বেরিক টোর্সভানের পুরো নাম বেরিক ট্রাভেন টোর্সভান (Berick Traven Torsvan)। তাঁর বাবা-মা জাতিতে সুইডিশ এবং তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৯০ সালের ৩ মে আমেরিকার শিকাগোতে। এবার আর সন্দেহ থাকলো না যে, বি. ট্রাভেন আর বেরিক টোর্সভান আর হল ক্রোভস সবই একই আদমের নাম। এবার তিনি খুঁজতে শুরু করলেন আকাপুলকোর গার্ডেন রেস্টুরেন্টগুলো। আবিষ্কার করতে পারলেন যে এল পার্ক কাচি (El Parque Cachi) নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে যার সাথে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তিকে সবাই মূল নামে নয় বরং ‘এল গিরিঙ্গো’ (El gringo) নামে চেনে। স্পোতা বুঝতে পারলেন এটিই সেই আদম যে তাকে এভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন ছলে আটকে রেখে সেই আদমের সাথে পাঁচ ঘন্টা কথা বললেন। সরাসরি স্বীকার করাতে পারলেন না যে তিনিই বি. ট্রাভেন। তবে বেফাঁস কিছু শব্দ স্পোতাকে নিশ্চিত করলো যে স্পোতার অনুমান ঠিক আছে। ইনিই বি. ট্রাভেন। ১৯৪৮ সালের ৭ আগস্ট তারিখে ১৭ পৃষ্ঠার সন্ধানী প্রতিবেদনে মানিয়ানা পত্রিকায় উন্মোচিত হলো বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যঘেরা লেখকের পরিচয়। যদিও এরপরও ২০ বছর ধরে বি. ট্রাভেন তাঁর পাঠকদেরকে অনবরত জানিয়ে গেছেন যে, ঐ রিপোর্ট ঠিক নয়।

কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিক স্পোতার এই আবিষ্কারের মধ্যেই তাদের সন্তুষ্টি সীমায়িত করতে পারলেন না। তারা ভাবতে চাইলেন এ জটে আরো গিঁট রয়ে গেছে। এই ভাবনার সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন লিওপল্ড স্পিৎজেগার (Leopold Spitzeggae), ম্যানফ্রেড জর্জ (Manfred George), রলফ রেকনাগেল (Rolf Recknagel) প্রমুখ। তাঁদের অধ্যবসায়ী পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হলো যে বি. ট্রাভেন মূলত ছিলেন জার্মানীর নাগরিক। অবশ্য তাঁর জন্ম হয়েছিল ঠিকই শিকাগোতে ১৮৯০ সালে। তাঁর ছেলেবেলায়ই তাঁর বাবা-মা প্রথমে ইংল্যান্ডে ও পরে জার্মানিতে অভিবাসী হয়। এরপর জার্মানিতে তিনি বড় হন। জার্মানিতে তাঁর নাম ছিল রেট মারুট (Ret Marut)। জর্মানিতে তিনি একটি পত্রিকা বের করতেন যার নাম ছিল Der Zeigelbrenner. বোঝা যায় জার্মানিতে তিনি একজন কেউকেটা পর্যায়েরই ছিলেন। সে সুবাদে ১৯১৮ সালে মিউনিখকে রাজধানী করে গড়ে তোলা দুমাসের স্বাধীন দেশ ও সরকার বাভারিয়ান সোশালিস্ট রিপাবলিকের তিনি নেতা পর্যায়ের একজন ছিলেন। দুমাস পরে ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে ঐ সরকারের পতন হলে অনেকের সাথে তিনিও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।

তিনি পালাতে সক্ষম হন। এবার শুরু হয় তাঁর ফেরারী জীবন। কোনো নাগরিক কাগজপত্র ছাড়া উদ্বাস্তু রূপে ঘুরে বেড়ান ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। শেষ পর্যন্ত স্পেনের একটি ‘ডেথ শিপ’-এ কর্মচারী হিসেবে নাম লেখাতে সমর্থ হন। এই সুযোগেই ১৯২২ সালে পৌঁছতে সমর্থ হন মেক্সিকোতে। পরবর্তী ঘটনা স্রোতে ইতোমধ্যেই আমাদের জানা। শত মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুনিয়া খোঁড়াখুঁড়ি করে যখন এই সব বের করলো তখন তাঁর বিধবা স্ত্রী রোজা এলেন লুহান গম্ভীরভাবে মাথা নাড়া নিশ্চিত করলো-‘হ্যাঁ, তোমরা সবকিছু ঠিকঠাকই বের করে ফেলেছো’ ।

যাক তবু দুনিয়ার মানুষ শেষ পর্যন্ত বুঝলো রেট মারুট কেন নিলেন নতুন নাম বি. ট্রাভেন এবং কেনই বা তাঁর আজীবনের চেষ্টা ছিল নিজেকে লুকানোর।

 


আরও পড়ুন-

উন্মুক্ত জায়গা

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
মিরপুরে ‘হারল্যান স্টোর’-এর উদ্বোধন করেন নুসরাত ফারিয়া, পণ্য কিনে হতে পারেন লাখপতি
মিরপুরে ‘হারল্যান স্টোর’-এর উদ্বোধন করেন নুসরাত ফারিয়া, পণ্য কিনে হতে পারেন লাখপতি
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা