X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুসাফির

নাহিদা নাহিদ
২১ জুন ২০১৭, ১৬:৫৩আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ২০:০৩

মুসাফির
আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন? ডক্টরের এই প্রশ্নে আমি মাথা নিচু করে ফেলি, মনোযোগ ধরে রাখতে মেঝের কার্পেট দেখি, কেমন লাল টকটকে পশমি কাপড়ে চারকোণা ছোপ ছোপ নকশা । ছিটকে যাওয়া রক্তের মতো প্রায়!!

হু রক্ত, আমি টের পাই আমার বসে থাকা চেয়ারের লাল পশমি কাপড়ও ভিজছে এখন!! রক্ত, লাল টকটকে রক্ত!!

-কেন করতে চাচ্ছেন এমনটা?

নকশার মাঝখানে থকথকে কালো রং মিশে যাচ্ছে বয়ে যাওয়া তরল স্রোতের সাথে, আমার মনোযোগ এখনো লালে।

-কথা বলছেন না কেন?

আমি এবার কার্পেটের নকশা ছেড়ে ডক্টরের মুখের দিকে তাকাই, করুণ চোখ আমার, ডক্টরের মুখ পাথর। রাগে কাঁপছেন তিনি।

-আপনি একটা উন্মাদ!! আমার কাছে না এসে ভালো কোন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলে ভালো হতো!!

এসময় আমি ঝুপ করে ডক্টরের পায়ের কাছে বসে যাই, ফেলে দিন না স্যার, ফেলে দিন প্লিজ! আমি একা একা চেষ্টা করে পারিনি। আপনি করে দিন না প্লিজ!!

আমার অক্ষমতা এর বেশি আর বোঝাতে পারি না, ব্যথায় কুকড়ে যাই, গলা ধরে আসে, বসে পড়ি মেঝেতে।

শুয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত আমার চোখ ছিল করুণ মিনতি মিশ্রিত আর্দ্র !!

লোকাল ইনস্থশিয়ায় কেমন ভোঁতা একটা অনুভূতি, পিনপিন করে মগজে, আমি ওটির ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকি একটানা, ভাবলেশহীন!! ডাক্তার বিরক্ত। অনেক বিরক্ত। আমায় হয়তো ওটিতে আনতেন না তিনি, নিতান্তই দয়ায় এনেছেন!! এ কদিন ধরে রোজ দেখছেন হসপিটালে , ঘ্যান ঘ্যান করেছি অনেক, কারণটাও জানেন, প্রথম প্রথম ভেবেছেন এটা সাময়িক উত্তেজনা, পরে আমার জেদ দেখে রেগে গেলেন খুব। একদিন বললেন পুলিশে দিয়ে দেবেন, এখনো দেননি কেন জানি না । কে বলে ডাক্তারদের আবেগ নেই!

প্রেসক্রিপশান হাতে নিয়ে পথে বের হই, ডাক্তার আমার কথা রাখেননি। আমার জেদ চাপে আবার, ইচ্ছে হয় খুলে ফেলি বেন্ডেজ, সুতো, সেলাই, পারি না, ব্যথা খুব!! হাতের প্রেসক্রিপশন দেখি। হিজিবিজি কত কি লেখা, ঘাঁ শুকাতে সময় লাগবে বললেন, আমি যেন ভবিষ্যতে কোনদিন তার চোখের সামনে না পড়ি সে কথাও বলে দিলেন অনেক করে!!

মাইদুলের মেসটা খুঁজে বের করি, আমাকে দেখে মাইদুল ভূত দেখে-

তোর এ কী অবস্থা? হারামজাদা তোকে কত খুঁজছি আমি!!

আমি কথা খুঁজে পাই না বলার মতো, এনস্থশিয়ার ঘোর এখনো কিছুটা আছে, ডাক্তার এম্বুলেন্সে পৌঁছুতে সাহায্য না করলে বিপদ ছিলো।

লুঙ্গি পরা কেন তোর? এই বুড়ো বয়সে খৎনা?? ভালো তো খুব!!

আমি ওর রসিকতার উত্তর দেই না, ক্লান্ত লাগে। হাই তুলি, বালিশ খুঁজি হাতড়ে।

আমার ক্লান্তিতে মাইদুল সিরিয়াস হয়ে ওঠে। ছুটে আসে কাছে কপালে হাত রাখে, জ্বর কিনা দেখে, আমি হাত সরিয়ে দেই, লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি, ঘুম আসে, গভীর নয়, তন্দ্রা!

ঠাণ্ডা জলের শীতল আরাম তপ্ত কপালে, চোখ মেলে দেখতে পাই মাইদুলের মুখ, উৎকণ্ঠিত আবেগময়।

তোর কি হয়েছে বলবি? কথা বলার আগেই বেহুঁশ, জ্বর বাধলো কেমন করে? কি করেছিস?

কিছু করিনি, করতে পারিনি। পেনিসটা গোড়া থেকে কেটে ফেলতে চেয়েছি। পারিনি একা, ব্যথা হয় খুব! ডাক্তারের সাহায্যে গিয়েছিলাম, উল্টো সেলাই করে জুড়ে দিলেন আগের মতো!

আমার কথা শুনে মাইদুল থ!! তেড়ে আসে।

-শালা এটা কোন কথা! সাইকিক একটা! পুরুষ না হয়ে তোর মেয়ে হওয়া দরকার ছিল, পাগল! তোকে গারদে রেখে আসা উচিৎ!!

-হু উচিৎ, আমি আর পুরুষ থাকতে চাইনা, পুরুষাঙ্গ দিয়ে কী হবে? সঙ্গম এইতো?? প্রয়োজন নেই এর! ভীতু বিকলাঙ্গ বিকৃত পুরুষ আমি, সিয়ামকে বাঁচাতে পারিনি, এবার পুরোপুরি নপুংসক হতে যেতে চাই ।

মাইদুল আমার গালে ঠাস করে একটা চড় মারে, চুপ কোন কথা বলবি না বেকুব, রামছাগল!

মার না খেলেও আমি হয়তো এখুনি চুপ হয়ে যেতাম । এমনিতেও আর কিছু বলতে পারছিলাম না আমি, কেমন অবশ লাগছে শরীর। ঘুম অথবা তন্দ্রা আমায় গ্রাস করে নিচ্ছে টের পাচ্ছি। কার কবিতায় যেন পড়েছিলাম ‘ঘুম এলো তো তুমি এলে, তুমি এলে তো স্বপ্ন এলো’ আমার ঘুমের সাথে স্বপ্ন নয় সিয়াম আসে!! এই তো সিয়াম! আমার সামনে দাঁড়িয়ে!! একদম চোখের সামনে, আমার হাসফাঁস লাগে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, আমি হাত বাড়াই সিয়ামকে ছুঁয়ে দেয়ার জন্য, সিয়াম হারিয়ে যায়। আমার বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার লাগে, হু হু করে, আমি কাঁদি, ফুঁপিয়ে উঠি, মাইদুল ধাক্বা দেয়, জাগায়-

-ভাই আমার, সোনা আমার, সিয়ামের ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া যায় না?

-কেমন করে? সেই রক্তাক্ত মুখ, থেতলে যাওয়া মগজ আমি চাইলেও কী ভুলে যেতে পারবো ? তুই জানিস সেদিন রাতের আঁধারেও সিয়ামের চোখ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছিল ঘৃণায়! ভুলে যাবো! ভুলে যাওয়া যায়?

মাইদুল আর কথা খুঁজে পায় না।

দিনকতক পর মাইদুলকে না জানিয়েই একদিন পথে বের হই, একেবারে ভোর সকাল তখন। কোথায় যাবো, রাজশাহী না ময়মনসিংহ দ্বিধায় ভুগি, কাটা চামড়ায় ব্যথা হচ্ছে, হোক। এগুতে পারি না। ঝিগাতলা থেকে ধানমণ্ডি ৩২ এসেই হাঁপিয়ে উঠেছি। পকেটে এখনো কিছু নগদ টাকা অবশিষ্ট আছে, নিজের কাছে রাখবো না কাউকে দিয়ে দেবো? পিচ্চি একটা ছেলে লেগুনার দরজায় দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকছে। এই এক নম্বর, এক নম্বর, এক নম্বর। আমি উঠে বসি। যাক গুলশান বা মিরপুর, এক জায়গায় গেলেই হবে। হু, এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে সিয়াম নেই। মিখাইল নেই। হু, মিখাইল, সাংসদ বাবার যোগ্য পুত্র মিখাইল। ইস! আমি যদি আর একটু সাহসী হতাম, তবে কী সিয়াম বাধ্য হতো আত্মহত্যা করতে? আমি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে গালি দেই-

নপুংসক!! নপুংসক!! নপুংসক!!

লেগুনার ছেলেটার চিৎকারে আমার ঘোর কাটে। কোথা থেকে উঠেছিলাম? ঝিগাতলা না ধানমণ্ডি? আমাকে এখন কোথায় নামিয়ে দিল ছেলেটা? দু'পায়ের ফাঁকে চামড়া সেলাইয়ের ব্যথা, টনটন করে। রাস্তায় হাঁটতে পারি না। বড় একটা হাইরাইজড বিল্ডিং দেখে ঢুকে পড়ি, ঠাণ্ডা বাতাস, সারি সারি পুতুল। বড় বড় থাই গ্লাসে নিজের প্রতিবিম্ব দেখি, জন্তু সাদৃশ! একদম অচেনা। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল আরো ঘন হয়ে উঠেছে । কতদিন কাটা হয় না। মাঝখানে কিছুদিন ভদ্রই ছিলাম, সিয়াম ছিলো । অপেক্ষা করেছিলাম একটা গাঢ় সময়ের, গাঢ় সময় এসেছিলো ঠিক, জমাট গাঢ় অন্ধকার সময়!!

পৃথিবী গোলাকার আমি ঘুরে ফিরে আবার মাইদুলের মেসে চলে এসেছি, মাইদুল জোর করে আমায় গোসল করায়, সেলাইয়ের জায়গাটা যত্ন করে পরিষ্কার করে, মাথায় ডলে ডলে শ্যাম্পু লাগিয়ে দেয়। আমার মনে হয় মাইদুল আমার মা, অথচ কত বছর হয় কাউকে মা বলা হয় না । পার্লার আর সিরিয়ালে অভ্যস্ত বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঘেন্না হয় আমার। বাসার আরো কত কি যে ঘেন্না হয়!! আচ্ছা, মা বেঁচে থাকলে কী জীবনটা আমার এমন হয়ে যেতো?

আমার চোখ জ্বালা করছে।

মাইদুল নরম গামছা এনে ভেজা মাথা মুছে দেয়, চোখও।

আমি মাইদুলের হাত চেপে ধরি, মাইদুল আমি আর বাঁচতে চাই না, জীবন এমন কেন! সবাই শুধু ছেড়ে চলে যায়।

আচ্ছা বাঁচিস না, মরে যাস। কবে মরবি বল, মরে যাওয়ার আগে খোরমা খেজুর খা , মরুভূমির পবিত্র ফল। নে ধর।

আমি মাইদুলের বাড়িয়ে দেয়া ফলগুলো হাতে নেই, কেন জানি না হঠাৎ আমার বুকের ভেতরে একটা হাল্কা বাতাস বয়ে যায়, জোরে শ্বাস নেই। আহা এখনো এই পৃথিবীতে কেউ আছে আমাকে ভালোবাসবার মতো! আমি মাইদুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। মাইদুল তুই এত ভাল কেন? তোকে আমার মা বলতে ইচ্ছে করছে । তুই আমাকে একটু ভাত মাখিয়ে দিবি, অনেকদিন আরাম করে ভাত খাই না।

হা হা হা, তুই একটা পাগল!

 

২.

এ পর্যন্ত আমাদের গল্পটা এক রকম প্রেম ও বন্ধুত্বের গল্পই ছিলো, কেন্দ্রিয় চরিত্রে আমি আর মাইদুল। সেখানে হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন হাফিজ নামক এক চরিত্র। ফর্সা চামড়ার শ্মশ্রু গুল্ফ সমেত এক সৌম্য পুরুষ! উপর থেকে দেখলে তাকে আমার শ্রদ্ধাই লাগে! আমি এখন সেই মানুষটার সামনে বসে আছি। আমাকে তিনি প্রশ্ন করে যাচ্ছেন একের পর এক। তার টেকনোক্র্যাট প্রশ্নে আমি কোণঠাঁসা। ভয়ে ভয়ে একেকটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি, তিনি ভাবলেশহীন মুখে শুনছেন। আমার নিজেকে কেমন বিভ্রান্ত লাগে; আমি কী কোন সন্ত্রাসী?

আমার কী কোন বিচার হবে এখন!!

হাফিজ ভায়ের কাছে ছুটে আসার আমার অনেকগুলো কারণ ছিলো। কিছুদিন ধরে দেখছিলাম মাইদুলের কেমন দিশেহারা অবস্থা, সবার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কোন চক্করে পড়লো না তো?? কারো প্রেমে পড়েনি এটা নিশ্চিত কারণ মাইদুল প্রেমে পড়ার মতো হিরো নয়, নারীসঙ্গে অতিশয় ভীরু! নিশ্চই ঘাপলা আছে অন্য কোথাও!

মাইদুলের মেসে নতুন একটা ছেলে উঠেছে, কি যেন নাম। অস্থির একটা ছেলে!! ধর্ম নিয়ে অসুস্থ রকম উত্তেজনা। বিজাতীয়দের প্রতি উগ্র হিংসায় ছেলেটা ছটফট করে সারাক্ষণ। আধুনিকতার ধোঁয়া তার সহ্য হয় না। জ্বর আসে । মাইদুল এখন এই ফতোয়াবাজ বুড়ো ছেলের দখলে ভাবা যায়? এখন কলিকাল না মান্ধাতার আমল কে জানে!! মাইদুলের এই এক দোষ, যখন তখন যে কেউ দখল করে ফেলে তার অস্তিত্ব, মুহূর্তেই গিরগিটির মতো পাল্টে ফেলে নিজের অবস্থান! কারও প্রতি স্থির আবেগ নেই ! আজব! আমার অভিমান হয় খুব। এমনিতেই সিয়ামের কেসটা কোর্টে উঠেছে তাই নিয়ে আমার মেজাজ খারাপ তার মধ্যে এই!! সময় খারাপ হলে এমনই হয়! মিখাইল এখনো ফেরার, হয়তো দেশের বাইরে আছে। মিডিয়া সাপোর্ট পেয়েছে সিয়াম। তবে সেটা এখন তার হিতে বিপরীত! রক্ষণশীল মানুষদের কাছে সিয়ামের বেপর্দা চলাফেরা দোষের ছিল। রাত বিরাতে সিনেমা দেখা, মেয়ের জীবনে তো এমনটা হবেই, তার উপর বাপ করে রাজনীতি, যেন এমনটা হওয়াই তার জীবনের জন্য নির্ধারিত। এখন সিয়ামের শ্লীলতাহানী বা আত্মহত্যার প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে বড় হয়ে উঠেছে তার চারিত্রিক শুদ্ধতার প্রশ্ন! আমার আর ভালো লাগে না এসব, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই সমাজটাকে ধর্ষণ করে গলাটিপে ফেলে রাখি ডাস্টবিনের পাশে, তারপর আমার জেল হয় হোক, ফাঁসি হয় হোক!! কে পরোয়া করে। ফাক দিস বুলশিট সোসাইটি!

মাইদুলকে মেসে আগের মতো পাই না, কোন কারণ নেই তবুও সে কোন একটা কিছু নিয়ে বেশ উত্তেজিত বুঝতে পারি, ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময়! যাই হোক, আমাকে জানতেই হবে মাইদুলের সবটা। বুকে সাহস নিয়ে লেগে যাই বন্ধুর পিছু। এক ভুলে সিয়ামকে হারিয়েছি, আর কোন ভুলে মাইদুলকে হারানো সম্ভব না।

চেষ্টায় কি না হয়!! শেষ পর্যন্ত হাফিজ ভায়ের নজর পড়ে আমার উপর! তার জরুরি তলবে এখন আমি এই গোপন আস্তানায়। এই সেই রহস্যময় ব্যক্তি; মুফতি হাফিজ!!

আমাকে বেশ কদিন ভালো রকম পর্যবেক্ষণ করেন হাফিজ ভাই। আমি হাড়-হাভাতে, প্রায় এতিম সন্দেহজনক কিছু পাওয়া কঠিন? শেষকালে কিছু না পেয়ে মনোযোগী হন আমার অন্যান্য বিষয়ে।

-হাফিজ ভায়ের চোখে যথেষ্ট কৌতূহল!! চোখের কোণায় চক চক করে জ্বলে রহস্যের পারদ !! একসময় আমি নিজেকে বুদ্ধিমান বলেই দাবী করতাম, আজ দেখলাম প্রকৃত বুদ্ধিদীপ্ত চোখ!! তবে এই চোখকে বুদ্ধিদীপ্ত না বলে চতুর চোখ বললেও অত্যুক্তি হবে না। আমি দ্বিধায় ভুগি এই চোখের নাম কী?

হাফিজ ভাই আমার সাথে বসার আগে আমাকে পাক সাফ হওয়ার জন্য ওজু করে আসতে বললেন, আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই, তবে এও সত্য ওজু করে আসার কারণে হাফিজ ভায়ের প্রতি একটা নরম অনুভূতি আগেই জন্মে যায়। মনে হয়, তিনি যা বলবেন হয়তো তা অবশ্যই ভাল কিছুই হবে। তিনি শুরু করেন সালাম দিয়ে। গলা পরিষ্কার করে সহজ কথায় শুরু করেন আলোচনা। এরপর একে একে চলে আসে নানা প্রসঙ্গ। আমি খেয়াল করলাম হাফিজ ভাই আমার দুর্বল অংশগুলোয় বেশি মনোযোগী। সিয়ামের ঘটনাটা শুনলেন খুব মনোযোগ দিয়ে। সিয়ামের জন্য হাত তুলে দোয়াও চাইলেন আল্লাহর কাছে। আমার হাফিজ ভাইকে খুব আপন লাগছিল প্রথম দিনেই। ইচ্ছে করছিলো উগরে দেই ভেতরে চেপে রাখা সব কষ্ট। এর মধ্যে আযান হয়, হাফিজ ভাই আমাকে সাথে নিয়ে নামাজে দাঁড়ান। আমার ভালো লাগে। আহা, কত কত দিন পর স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ!

মাইদুলের সাথে এখন নিয়মিত আসি এখানে। হাফিজ ভায়ের সাথে থাকলে কোন অস্বস্তি কাজ করে না, ধীরে ধীরে কেমন করে যেন এই আস্তানাটা আমার পরিবার হয়ে উঠেছে আমি টের পাই না, পাশে মাইদুল, মাথার উপর হাফিজ ভাই! আর কি চাই! তবে একথা সত্যি হাফিজ ভায়ের কিছু বিষয় খুব অদ্ভুত, এই যেমন কখনো তিনি খুব নরম আবার কখনো কট্টর। কখনো সাদাসিধে আবার কখনো ভয়ঙ্কর, তাল পাইনা মাঝে মাঝে। ধর্মের ব্যাপারে খুব কড়া, কোন ছাড়াছাড়ি নাই। তার কল্যাণে একটু একটু করে আচরণিক পরিবর্তন ঘটছে আমার, মাইদুলের বা আস্তানা আর সকালের! আরেকটা বিষয় তিনি মনে হয় সবার মন পড়তে পারেন, একঘর মানুষের মধ্যেও কারো ভেতর কোন কোন প্রশ্ন বা দ্বিধা দেখা দিলেই মধ্যরাতে ডাক পরেন হাফিজ ভায়ের ঘরে। প্রশ্ন করেন একের পর এক, সাড়াশি দিয়ে টেনে বের করে আনেন মনের ভেতরে লেগে থাকা প্রশ্নের কাঁটা। আমারও ডাক পরে হঠাৎ একদিন, সেদিনই প্রথম হাফিজ ভাই আমাদের সামনে জেহাদের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, জেহাদ কী, এই বয়সে জেহাদের গুরুত্ব কতটুকু, আর কেন আমাদের জেহাদে যাওয়াটা জরুরি এইসব! আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমার কেমন অপ্রাসঙ্গিক আর খাপছাড়া লাগছিলো সব! ধর্ম কর্মের মাঝখানে হঠাৎ এই জেহাদের বিষয়টা আলোচনায় আসলো কেন !সত্যি কি আমাদের এখন জেহাদের সময় উপস্থিত? কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম এ বিষয়ে কথা বলতে বলতে হাফিজ ভায়ের চোখ লাল হয়ে ওঠছে, চোখের মধ্যে জ্বলছে বিজাতীয়দের প্রতি ঘৃণার আগুন ! আমার খটকা লাগে । নিজের মনেই খুঁজতে থাকি বিধর্মীদের সাথে আমাদের সংঘর্ষের কার্যকর দিক ! অদ্ভুত ব্যাপার ঠিক সে রাতেই আমার ডাক পড়ে হাফিজ ভায়ের ঘরে, মাইদুল এসে ডেকে নিয়ে যায়। মাইদুল রাগে গজগজ করছে, কেন আমার ডাক পড়লো এই মধ্যরাতে, নিশ্চই আমি কোন ওলটপালট কিছু করেছি। মাইদুলের এই আর এক, সবকিছুতে খালি ঘ্যান ঘ্যান করে, যুক্তিহীন! বোকা!

হাফিজ ভাই আমার পিঠে হাত রাখেন, কি একটা দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দেন। তার আন্তরিক স্পর্শে আমার জড়তা ভাঙে, আমি সহজ হই। এবার মনে হয় হাফিজ ভাই এখন যা বলবেন সব ঠিক বলবেন, আমিই এতক্ষণ যা ভাবছিলাম সব ভুল ভাবছিলাম!! আমার বয়স কত? আমি এই দিন দুনিয়ার কি বুঝি! শুধু শুধু প্রশ্ন করে নিজের ভেতর কেন নিজে পুড়ি!

হাফিজ ভাই আমার চোখে তাকান, নরম স্বরে বলেন-

ভাইলোগ, আপনি কি নিয়ে চিন্তিত? আপনি আমার মুসলিম ভাই, আপনার রক্ত আমার রক্ত এক, আপনি আপনার মনের কথা বলুন, আপনার মনের দ্বিধা দূর করা আমার কর্তব্য। আসেন আপনি আমার চাদরের নিচে আসেন আমরা কথা বলি। হাফিজ ভাই আমায় কাছে টেনে নিয়ে কাঁধে হাত রাখেন । একফাঁকে সে হাত পিঠে চলে যায়! আমি চমকে উঠি, ধিক্কার দেই নিজের কুৎসিত জঘন্য চিন্তায়। এরপর দেখি হাফিজ ভাই নিজেই কথা বলে উঠছেন আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহ যেমন মানুষ যেমন তৈরি করেছেন তেমনি শয়তানও বানিয়েছেন। আপনার আমার মাঝে আছে সেই বিপদগামী শয়তান। আমি লজ্জিত হই। মাথা নিচু করি হাফিজ ভাই বলেন, আপনি কী জানেন এই শয়তানই এক মুসলমানকে আরেক মুসলমানের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আমি মাথা নাড়ি, অলক্ষেই সরে আসি হাফিজ ভায়ের অনেক কাছে।

দুজন হাত তুলে পানা চাই আল্লাহর কাছে। এরপর হাফিজ ভাই ডুবে যান ভাবের ঘোরে আর আমি উসখুস করি। নিজের দিকে তাকিয়ে শাসন করি নিজেকে! কেমন মানুষ আমি?

অস্থির ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাস শূন্য এক মানুষ, এ কারণে শয়তানের ধোঁকায় বার বার হই বিভ্রান্ত !

কোন কিছুতেই কেন আমার কোন স্থির বিশ্বাস নেই? না বিশ্বাস ধর্মে, না বিশ্বাস মানুষে! তবে কেউ তো কখনো বলেও না আমার সমস্যাটা কোথায়!!

হাফিজ ভাই ঘোর শেষে আবার আমার সাথে আলোচনায় বসেন, রাত প্রায় শেষ, তার পুরুষালী কণ্ঠের গমগম করা আলাপে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, ভাইলোগ তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা কি পেরেছে আপনাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে?

আমার উত্তর জানা নেই।

এই প্রগতিশীল সমাজের কাছে কী পেয়েছেন সিয়ামের সুরক্ষা?

আমি নিরুত্তর!

এবার বলেন আমরা এখন যে সময় অতিক্রম করে চলছি তা কি সামনের দিকে যাচ্ছে না পেছন দিকে?

আমি আবারও নিরুত্তর।

ভেবে দেখবেন আমাদের আজকের এই আধুনিক সমাজের মডেল কারা দিয়েছেন আমাদের?

মুসলমান নাকি ইয়াহুদি, কাফের নাকি মুনাফেকের দল?

আমাদের চোখ বেঁধে দিয়ে কারা হাসছে নীরবে? আর আমরা কোন লোভে বলছি জি হুজুর, জি হুজুর!

আমি অস্থির হয়ে পড়ি হাফিজ ভাইয়ের প্রশ্নে। উত্তর খুঁজি, পাই না। জানি না কেন এরপর থেকে রোজ রাতেই আমার ডাক পড়তো হাফিজ ভায়ের চাদরের নীচে, দীর্ঘ সময় চলতো প্রশ্নোত্তর পর্ব! অদ্ভুত ব্যাপার তিনি যখন প্রশ্ন করেন তখন আমার মাথা কেমন ঝিম ঝিম করে, সোজা তাকিয়ে থাকেন চোখের দিকে, ঠাণ্ডা শীতল চোখ। তিনি ধাপে ধাপে প্রসঙ্গ বদলান, একবারে না । সমাজ থেকে প্রসঙ্গ পাল্টে ধর্ম, ধর্ম থেকে আইন, আইন থেকে যুদ্ধ। শরিয়াহ, মহাম্মদী মজলিশ শুরা থেকে আফগান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, আরব আর ইরানের কেচ্ছা কাহিনি। শুনে শুনে রোজ আমার রক্ত গরম হয়ে যেতো, নিজেকে গালি দিতাম! কেমন মুসলমান আমরা?

নামকাওয়াস্তা!

আদর্শহীন!

তেজহীন!

মালাউনের জাত সব!

হাফিজ ভায়ের নিরলস পরিশ্রমে বুঝতে পারি আমাদের দেশ আজ রসাতলে কেন! প্রগতিশীল, সেক্যুলার, নাস্তিকদের ঠেলায়। কিছুই নাই আর এদেশে। অতীত শান, শওকাত সব ধূলায়!

বিধর্মীরা আমাদের রোজ বেচে একঘাট থেকে অন্য ঘাটে!

সবকয়টা মুসলিম শত্রু! সবকয়টা শয়তানের দোসর!

-এরা শেষ, তো আমাদের অপমানের দিনও শেষ।

এর মাঝেই চাদরের নীচ থেকে নিচু গলায় জানতে চান হাফিজ ভাই

এর জন্যই কি চাই আমাদের ?

আমিই এবার নিজের মনেই নিজে উত্তর পাই-

জেহাদ!!

রক্ত!!

যতই আমি উপরে উপরে যুক্তি দেখাই না কেনো আমিতো জানি আমি ভেতরে ভেতরে কতটা আশ্রয়হীন, কতটা আবেগসর্বস্ব মানুষ! তার উপর হাফিজ ভায়ের মতো এমন একজন পাকা খেলোয়ারের সার্বক্ষণিক প্রভাব, ক্রমেই আমিও আসক্ত হয়ে পরি মুসলিমদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে! লোকটা জাদু জানেন, কখন কি বলতে হবে মনে মনে প্রস্তুত করে রাখেন! তবে মাঝে মাঝে যে সংশয় জাগে না তা নয়! প্রশ্ন করি নিজেকে এটাই কী তবে প্রকৃতই জ্ঞান! ধুর নিজে নিজেই আবার নিজের মনের শয়তান তাড়াই! যা হয় হবে হয়তো একটা কিছু, এত ভেবে আর কি হবে? তার চেয়ে এইতো বেশ ভালো আছি, হাফিজ ভায়ের সম্মোহনী বিদ্যার গরম আবেশে ভালই কাটছে সময়, ঘরের আর সকলের চেয়ে হাফিজ ভায়ের কাছে আমার গুরুত্ব একটু বেশি, কেন জানি না তবে নিশ্চিত বেশি এ বিষয়ে কোন ভুল নেই, হাজার মানুষের মধ্যেও হাফিজ ভায়ের চোখ খুঁজে খুঁজে আমায়, আটকে রাখে মুগ্ধতার চোরা স্রোতে। এটাই বা কম কী! জীবন এমনিতেও আনন্দহীন একঘেয়ে! এখানে আছি বলেই ভুলে আছি অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত!

এখন আমি হাফিজ ভায়ের আস্তানায় সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মী! এটাকে জেহাদী তৈরির কারখানাও বলা যায়! ভালোই চলছে সব, চলুক! এই আস্তানায় আমাদের মতো এডভেঞ্জারাস তরুণদের আকৃষ্ট হবার আরো একটা প্রধান কারণ ছিলো হাফিজ ভায়ের যুদ্ধ সরঞ্জাম। টিভি সিনেমা আর ভার্চুয়াল জগতের বাইরেও এ এক অন্য ধরনের নেশা। আমরা ধর্ম-কর্ম-কম বুঝি, আমরা নির্বিষ পরজীবী মানুষ। হঠাৎ জেহাদের নামে এত এত অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছি। এখন চাই গরম কিছু, একদম নতুন! আনকোরা কিছু!

এটাকে যে জঙ্গি বাহিনি বলে জানা ছিল না আমার, জঙ্গি শব্দটা তখনো এদেশে খুব একটা পরিচিতি পায়নি। না জেনেই আমরা জড়িয়ে পড়েছি এই নতুন আকর্ষণে। আমাদেরকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে সেশন আর সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। আমরা বুঝে গেছি বিধর্মী নাস্তিক, কাফের, ইয়াহুদী আর মোনাফেকদের সাথে আমাদের যুদ্ধ সম্ভাব্য, প্রস্তুতি চলছে জোর। আমাদের হাতে হাতে বিস্ফোরক দ্রব্য। আহা বন্দুক, বারুদ আর রক্ত। কেমন জানি লাগছে সব! আত্মবিশ্বাস বাড়ে, এখন থেকে আমি আর অতীতের আমি নই, আমি জেহাদী, সৈনিক। পথে পথে লেগুনায় চড়ে পরাজিত আমাকে খুঁজবো না আর। গুলশান বা মিরপুরের রাস্তায় পুরনো ক্ষত বিক্ষত আমাকে আর দেখা যাবে না উদভ্রান্ত, বিপর্যস্ত! নিজের অজান্তেই আরেকবার ছুঁয়ে দেখি সেলাই করা কাটা পেনিস!! এত দিনে ঘাঁ শুঁকিয়েছে!!

এখানে প্রথম থেকেই আমাদের ধর্মীয় শিক্ষায় উৎসাহিত করা হয়ছে বেশ ভালো রকম, তবে কোরআন বা হাদীসের আলোকে নয়, তাদের রচিত কিছু নিজস্ব জেহাদী বইয়ের আদলে। যেহেতু আমাদের ধর্মশিক্ষা খুব একটা নেই, তাই বুঝতামও না কোনটা কোরআনের কথা, কোনটা হাদিসের কথা আর কোনটা এই জেহাদী বইয়ের কথা। আর যাদের ধর্ম সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান ছিল তারাও মুফতি হাফিজ ভাইয়ের অসাধারণ বয়ান কৌশলে কোন ফাঁকফোকড় খুঁজে পেত না, হাফিজ ভাই আর তার দলের লোকজন কিসের সাথে যেন কি মিলিয়ে দিতেন, আর মিলেও যেত চমৎকার আমরা বুঝতামও না কি হচ্ছে! শুধু বুঝতাম আমরা বদলে যাচ্ছি একে একে। দিনে দিনে আফিমের মতো আমাদের রক্তে ধ্বংসের নেশা ছড়িয়ে পড়ে। এ নেশা একদিনে হয়নি। একটু একটু করে ধর্মের সিরিঞ্জে পুশ করা হয়েছে বহুযত্নে। এখন হাফিজ ভাই কিছু বলতে শুরু করলেই আমাদের বুকের রক্ত টগবগ করে ফোটে। কেমন যে লাগে তখন!! শুধু কিছু একটা করার জন্য পাগল হয়ে উঠি । আমরাই নই একা, দূর দূরান্ত থেকেও রোজ আসে নতুন নতুন যুবক, তরুণ! এ সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সব শ্রেণির যুবকদের ভীড়ে ভরে উঠছে হাফিজ ভায়ের আস্তানা, আমি বিস্মিত!! আহা দেশে এত এত জেহাদ পাগল মানুষ!! এখানে না এলে এসব কিছু জানাই হতো না আমার! আহা আমাদের মৃত্যুপথের সাথী, আমাদর ভাইলোগ! আমাদের মিশন এক, ভিশন এক।

আমাদের সেশনগুলো বিভিন্ন রকম। হাফিজ ভাই প্রয়োজন অনুযায়ী ফতোয়া দেন, বাইরে থেকে দুজন আসে সামরিক ট্রেনিং দিতে, বন্দুক চালানো থেকে শুরু করে বিস্ফোরক প্রস্তুত করণ ও ব্যবহার বিধি; চরম উত্তেজনাকর একেকটি পর্ব। এছাড়াও বিভিন্ন ওয়েব সাইট সিকিউরিটি হ্যাক, ভিডিও লিঙ্ক শেয়ার ও বিভিন্ন মুসলিম কান্ট্রির উপর নির্যাতনের নিউজ সংগ্রহ করতে করতে আমাদের কত সময় কেটে অনেক, কোথা দিয়ে সময় যায় আমরা টের পাই না। ক্রমে বুঝতে পারি কাজটা শুধু হাফিজ ভায়ের একার না তার উপরেও মাথা আছে!! বড় বড় মাথা! অবশ্য এর বেশি কিছু ভাবার মতো আমাদের অবসরও ছিলো না , শিডিউল অনুযায়ী শেসন, ট্রেনিং, গ্রাফিক্স,নিউজ হ্যাক আর রাত্রিবেলা হাফিজ ভায়ের ওয়াজ-

ভাইলোগ, আপনারা সব আল্লাহর প্রেরিত মুসাফির। দুনিয়ায় এসেছেন জেহাদ করতে, আল্লাহর রাস্তা পরিস্কার করতে, সমাজের অনাচার দূর করতে, ব্যভিচার আর অশ্লীলতা দূর করতে, সুদখোর-হারামখোর নিধন করতে, বিধর্মী পাপীদের থেকে নিজ ধর্ম রক্ষা করতে, কাফের মোনাফেকদের শাস্তি দিতে। নাস্তিকরা আজ দেশ দখল করে বসে আছে। তাদের শাস্তি দেয়া আমাদের ফরজ; কালিমা, নামাজ, রোজার চেয়ে বেশি ফরজ জেহাদ। বেশির ভাগ মুসলিম ভাই এই সত্য জানে না, তারা অন্ধ, তারা ভুল পথে আছে। ভাইলোগ, দুনিয়াতে এই আরাম আয়েশের জীবন কিছুই না। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেন এই আরাম আয়েশের লোভ কারা দেখিয়ে কারা আজ স্বার্থ হাসিল করছে! বিধর্মী লানায়েতের দল! আফসোস সেই মুসলমানদের জন্য! যারা সব ভুলে আছে দুনিয়ার সুখে, হায় তাদেরতো স্মরণে নাই তাদের জন্য অপেক্ষায় আছে দোজখের লকলকে আগুন, আর এখন আপনারা যারা এই দুনিয়াকে শস্যক্ষেত্র তুল্য ভেবে জীবনের মোহ ত্যাগ করে জেহাদের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে এসেছেন তাদের জন্য রয়েছে বেহেশতের সুশীতল আশ্রয়, প্রিয় মানুষদের সঙ্গ, বীরের সম্মান। সবাই একসঙ্গে বলুন আমিন।

রোজ একই ওয়াজ তবুও সেই পুরনো কথায় আমরা একসাথে সমস্বরে বলে উঠি- আমিন।

মাঝে মাঝে এতসব প্রলোভনের মধ্যে হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় সিয়ামের মুখ। আহা বেহেস্ত!! প্রিয় মানুষের সঙ্গ!

কেউ তো জানে না আমার সুখ অথবা কষ্টের নাম সিয়াম! শুধু সিয়াম!

আজ আমাদের দশজনকে নিয়ে একটা টিম তৈরি হলো, কেন এখনো বিষয়টা পরিস্কার না। তবে কোন একটা অপারেশনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে এটা নিশ্চিত, অনেক গোপনীয়তা সত্ত্বেও উপরের মহলের ঘন ঘন টেলিফোনের ভারী কথোপকথনের কিছুটা কানে আসে। আমি আর মাইদুল আছি এ নতুন টিমে। মেসের নতুন ছেলেটিকে রাখা হয়নি, তার নাকি ইমানের জোর কম। আমাদের সাথে আরো আটটা ছেলে আছে। এদের কয়েকজন আবার বেশ স্মার্ট, এদের কেউ কেউ ধন্যাঢ্য পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান ছিলো একসময়, এখন সহজ রাস্তায় শুদ্ধ হতে চাইছে, হাফিজ ভাই কোথা থেকে এনেছেন এদেরকে কে জানে, ইংলিশ মিডিয়াম বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো তাদের কয়েকজন, এদের সাথে কেন জানি পরিকল্পনায় আমাদের মিলছে না অনেক কিছুই, বেহুদা জট পাকায়! একটা ছেলে আছে পুরো এডিক্টেড, নেশা ছেড়ে এদলে ভিড়েছে, এখনো মাঝে মাঝে তার নেশা চড়ে যায়, আবোল তাবোল বকে, ভাল্লাগে না । যাইহোক, এখন আমরা একদলে। তবে একসাথে থাকতে থাকতে স্বাভাবিক আত্মিক সম্পর্ক যে আমাদের নেই তা কিন্তু না। এই আমাদের নিয়েই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। বাইরের মানুষের আনাগোনাও বেড়েছে, দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং চলে, হাফিজ ভাই এখন আর আমায় ডাকেন না মধ্যরাতের চাদরের উষ্ণতায়, আমরা সবাই ব্যস্ত যার যার মতো নিজ দায়িত্ব বুঝে নিতে।

সম্ভাব্য সকল হিসেব নিকেশ অনুযায়ী আগামীকাল আমাদের মিশন ধার্য করা হয় ! আমরা আজ শেষবারের মতো একসাথে সেশনে দাঁড়াই। ঘরের দেয়াল জুড়ে বিশাল প্রজেক্টর, শেষ মটিভেশন ক্লাস! হাফিজ ভাইয়ের মুখ থমথমে! এই যে ইমাম হাসান, এই যে ইমাম হোসেন, এখানে দুলদুল ঘোড়া, ফোরাত নদীরকূল। মুসলিমদের জন্য একে একে মরছে এমন কত বীর, সব আসে একে একে পর্দায়। আসে কত দেশ মহাদেশ! এই যে এখানে ইসরায়েল, এখানে ফিলিস্তিন, রক্ত। মুসলিমদের রক্ত নদী! পুলসিরাত!

প্রজেক্টরে এরপর ভেসে ওঠে একটা ফুটফুটে শিশুর মুখ, মায়ের দুধ খাচ্ছিলো বাচ্চাটা, এক হিজাব পরিহিতা নারী তার মা, মুসলিম! আহা ঐ তো আসছে হায়েনার দল, ইসরাইলি দস্যু, শিশুর মাথাটা পায়ের তলায় জীবন্ত পিষে দিলো নরপশুর দল, রক্ত ছিটকে পড়লো এখনে সেখানে। শিশুটির মা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে আহারে মা টা কেমন করেছে! কী বিভৎস নিদারুণ অত্যাচার! আমাদের চোখ ধক করে জ্বলে ওঠে ঘৃণায়, মুখে জমে ওঠে থুতু! মনে হয় খামচে ছিড়ে দেই এক একটা পশুর মুখ!

এরপর পাল্টে গেলো দৃশ্যপট, একটা নেকাব ঢাকা মেয়ের মুখ, আহা মেয়েটাকে একে একে বিবস্ত্র করছে জালেমরা, ইয়াহুদি নমরুদ। এ দৃশ্যে মুহূর্তেই আমার শরীরে হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে যায়, ইস এ মেয়েতো অন্য কেউ নয়, এর নাম নিশ্চয়ই সিয়াম! মনে পড়ে তার আত্মহত্যার দৃশ্য। আমি কোন ভুলে ভুলে ছিলাম সব!! চমকে উঠি! বিস্মিত হই! আমি পুরুষ নাকি নারী! ঐ তো মিখাইল আর তার দলবল, কোথায় আছে সেই পশু! আমার মনে হলো টিভি স্ক্রিনে তাদেরকেও দেখাচ্ছে। সিয়ামকে তারা উলঙ্গ করছে। আমার হাত কাঁপে, পা কাঁপে। আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল সিয়ামের ঘটনাটা, সিয়ামের খোলা বুকে, জঙ্ঘায় সিগারেটের ছেকা দিয়েছে মিখাইল, দলের প্রত্যেকটা ছেলে। সিয়ামের স্তনে হাত রেখে কুৎসিত জোকস করছিল তারা সিয়ামকে নিয়ে, আমি নিজ কানে শুনেছি সেসব বিকৃত বচন! সেদিনের ঘটনাটা আবার জ্বলে ওঠে মস্তিষ্কে। রিক্সায় রাত করে ফিরছিলাম, ওকে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিলো আমার। পারলাম না। আমার চোখের সামনে মেয়েটাকে নামালো মিখাইল আর তার দলের ছেলেরা, সিয়ামের বাবার সাথে ওদের পুরনো পলেটিকাল ঝগড়া, একদল মাতাল অপজিট গ্রুপের হয়ে এসেছে সিয়ামকে র‌্যাগ দিতে। কী কুৎসিত! জঘন্য প্রতিশোধ! অস্ত্রের মুখে ওরা আমাকেও নেংটো করে ফেলে, চিৎকার করে খুব!

যা হট, পালা পালা; না হয় তোর সামনেই রেপড হবে তোর মধুরানী। এরপর ভিডিওটা ভাইরাল করে দেবো সবখানে, থাকবি এখানে? দেখবি মজা?

আমি লজ্জায়, ঘৃণায় বিমূঢ়! কথা সড়েনি মুখে!

প্রাণ যায় যেতো তবু যদি একবার সিংহের মতো গর্জে উঠতে পারতাম সেদিন!  যদি পারতাম একবার শুধু রুখে দাঁড়াতে? তবে কী পারতো ঐ হায়েনার দল এতটা নগ্ন উচ্ছ্বাসে তাণ্ডব নৃত্য করতে? হয়তো পারতো না, কোথাও তাদের বাধতো তাদের! সিয়ামেরর আত্মহত্যায় নিজেকে খুব দায়ী মনে হয় আমার! 

কাপুরুষ আমি। কেন যে সেদিন রাতের অন্ধকারে লজ্জাস্থান ঢেকে দৌড়ে পালিয়েছিলাম, জানি না, সত্যি জানি না। সিয়াম আমায় ক্ষমা করেনি এমনকি তারপর থেকে নিজেও নিজেকে ক্ষমা করিনি আর কোনদিন!

হায় আমিও মানুষ! আমিও বেঁচে আছি!!

হাফিজ ভাইয়ের তীক্ষ্ণ ভরাট কণ্ঠের আওয়াজে আমার ধ্যান ভাঙে, আমার তাৎক্ষণিক ভাবে মনে হলো আমাদের মতো পোড় খাওয়া মানুষগুলোকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্যই হাফিজ ভাইয়ের জন্ম! আমার সন্দেহ হয় আমার আশেপাশের ছেলেগুলোরও নিশ্চই এমন বা এরচেয়েও ভয়ঙ্কর কোন ক্ষত হওয়ার ইতিহাস থাকতে পারে। এবার হাফিজ ভাই আমাদের ত্রাণ করবেন! ভুলিয়ে দেবেন সব ইতিহাস, আমরা সবাই বেঁচে যাব তার পবিত্রতার আশ্রয়ে। তিনি মুফতি, তিনি আমাদের কমাণ্ডার, আমি পরম নির্ভরতায় পরম বিশ্বাসে হাফিজ ভায়ের বক্তব্য শুনি-

প্রিয় হাজেরান, মানবতা আজ বিপন্ন! মুসলিমরা আজ সারাবিশ্বে নিপীড়িত, নিগৃহীত। মায়ের বুকে আজ যুবতী মেয়েরা নিরাপদ নয়, ইয়াহুদি নাসারারা খুন, ধর্ষণ, লুটপাট করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে, এককালে সারাবিশ্ব শাসন করা মুসলিমদের আজ এই অবস্থা! যে শিশুটিকে পায়ে পিষে মারা হল, তার প্রতিশোধ আমরা নেব না?

ক্রোধে চকচক করতে থাকা আমাদের চোখগুলো বলে উঠি, ইনশা আল্লাহ!! যে বোন ইজ্জত বিসর্জন দিলো আমরা তার প্রতিশোধ নেবো না? আমরা বলি ইশাল্লাহ। নেবই নেবো, আমাদের রক্তে তখন প্রচণ্ড এক নাচন শুরু হয়ে যায়, ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় কোন বিধর্মী খতমে।

তিনি আবার প্রজেক্টরে যান, সেখানে এক মুসলিমকে বেধে রেখেছে কাফের সৈনিকরা, তাদের কমান্ডার প্রশ্ন করলো তুই মুসলিম? যুবকটি মাথা উচু করে গর্বের সাথে উত্তর দিলো 'হ্যাঁ, আমি মুসলিম'। সাথে সাথে বেয়নেট এর খোচা শুরু হলো, পেছন থেকে এক কমান্ডার ছেলেটার টুটি চেপে ধরে বলতে লাগলো 'বল, তুই মুসলিম নস, তুই যদি তোর ধর্ম ছেড়ে আমাদের সাথে আসিস তাহলে আমরা তোকে ছেড়ে দেবো, সাথে থাকবে তোহফা!

মুসলিম ছেলেটি মাটিতে একদলা থুতু ফেলে বলে তোহফা? ঘৃণা করি তোদের ঐ তোহফাকে, আমি মুসলিম, ইসলাম আমার গর্ব! ইমান আমার জোর!

মুহূর্তেই একঝাক গুলি এসে ঝাঝড়া করদিলো তরুণ ছেলেটার শরীর, রক্তে লাল হয়ে গেলো তার সাদা কুর্তি আমাদের মনে হলো ছেলেটার সাথে সাথে আমাদের শরীরটাও ঝাঝড়া হয়ে গেলো, টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত!!!

হাফিজ ভাই বলছেন আবার! ভাইলোগ, দেখলেন আপনারা, কি অত্যাচার! কি ভয়ংকর আচরণ। যে ভাই হাসতে হাসতে এভাবে জীবন দিলো তারজন্য কি আমাদের আজ গর্ব হয় না? এমন শাহাদাতি মরণ কজন মরতে পারে?

হাফিজ ভাই ছেলেটার কথা বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, আমার বুকের ভেতর অসহায় লাগে, হাহাকার লাগে, হাফিজ ভায়ের জন্যও লাগে আবার ঐ মুসলিম ভাইটির জন্যও লাগে। হাফিজ ভাই কাঁদেন আর বলেন, ভাইলোগ আপনারা জানেন ইসলাম সত্যের ধর্ম, ইসলাম সাম্যের ধর্ম, ইসলাম অনাচার সহ্য করে না, যেখানেই অনাচার সেখানেই ইসলাম তার হাতিয়ারের আঘাত হেনেছে! নবীজী আর তাঁর সাহাবীগণ যে শিক্ষা রেখে গেছেন সে শিক্ষা আমরা ভুলতে পারি না! আমরা মুসলিম, ঈমানী রক্ত টগবগ করছে আমাদের শরীরে, আমাদের শরীরে সত্যিকারের মুমিনের রক্ত আছে কি না বলেন?

আমরা সবাই সমস্বরে বলে উঠি, আছে!!

তাহলে আমরা কি এখন প্রস্তুত জেহাদে নামার জন্য?

আমরা বলি প্রস্তুত।

আমাদের সম্মতিতে হাফিজ ভাইয়ের বুকের সাহস বাড়ে। ধীর স্থির স্বরে বলেন মুজাহিদ ভাইলোগ আমার আসলাম,আপনাদের সাহসের তারিফ। আওয়াজ একটু নিচু রেখে এবার বলতে আরম্ভ করলেন, মুমীন মুসলিম ভাইয়েরা আমার এতদিন আপনারা বেপথ মুসাফির ছিলেন আজ থেকে আল্লার ওয়াস্তে মুজাহিদ হলেন। আপনাদের আমাদের শেষ রক্ত বিন্দু আজ থেকে ন্যায়ের জন্য উৎসর্গীকৃত। আমরা আমাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে এদেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে যাব, ইসলামের শাসন এদেশে আনবই! আর এজন্যই আমাদের এই ইহুদী নাসারার মদদপুষ্ট সরকারকে ধূলিস্মাৎ করে দিতে হবে! এই সরকারের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে, বেছে বেছে এর মাথাগুলোকে ক্বতল করে দিতে হবে!! আমরা জেহাদ করবো, আমরা লড়বো, আগামিকাল আপনাদের নামতে হবে একেকটা বড় বড় অপারেশনে ! মনে রাখবেন আগাছা কাটতে গেলে কিছু ভাল চারাও তার মধ্যে কাটা পড়তে পারে, এজন্য আফসোস করবেন না ভাইলোগ, আমরা বাগানকে আগাছামুক্ত করতে এই বিসর্জন দেবই। আমরা সব কটা মিশনেই চেষ্টা করব যথাসম্ভব নিরীহ মানুষদের কম আক্রান্ত করতে! আর হ্যাঁ, যারা নিরীহ নিরীহ বলে চেঁচায়, তারাও কি আদৌ নিরীহ? তাদের ভেতরে ইসলামের শত্রু নাই? এদের মধ্যে মদখোর, জ্ঞানপাপী, নাস্তিক নাই? আছে তো! তো এদের ক্বতল আর ইহুদি ক্বতলের মধ্যে পার্থক্য কী?

আমরা নিশ্চুপ আমরা বিমূঢ়, আমাদের রক্ত ফুটছে শুধু, কি আর বলবো এখন!!

এরপর হাফিজ ভাই আমাদের প্রস্তুত করেন জেহাদের জন্য, সময় খুব কম হাতে। আমাদের জানানো হয় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মিশন, আগে জানানো হয়নি নিরাপত্তার কথা ভেবে, একই এলাকায় দুটো স্পটে একইদিন অপারেশন, একটা টার্গেট মাল্টিন্যাশনাল শপিংমল আরেকটা টার্গেট ব্যাপক লোক সমাগম হয় এমন এক বিখ্যাত মসজিদ! মসজিদের প্রসঙ্গে আমরা হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে পরি, সবচেয়ে বেশি ভ্যাবাচেকা খায় মাইদুল, সে প্রশ্ন করে বসে মসজিদ কেন?

হাফিজ ভাই ব্যাখ্যা করেন?

ভাইলোগ, আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, মহানগরের এত বড়, এত জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদে সাধারণ মুসলিমের প্রবেশ আছে কিনা? সবচেয়ে বেশি ভীড় হয় কখন? কোন দিবস এবং কারা করে এসব মসজিদে ভীড়?

উত্তর হচ্ছে, জুম্মাবার অথবা ঈদের দিন, ঠিক কিনা বলেন? সাধারণ খাঁটি মুসলিমদের চেয়ে অসৎ পয়সাওয়ালা মানুষগুলোই যায় এসময়ে, এসব আনুষ্ঠানিক এবাদত তাদের জন্য যারা ঘুষখোর পাপী! আমাদের টার্গেটতো তারাও, ভণ্ড মুসলমান। তারাও ইসলামের শত্রু, তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের জেহাদ, আপনারা কি চান না, আমরা মুসলমানদের সকল প্রকার শত্রু ধ্বংস করি। নিশ্চিহ্ন করি কাঁটা?

আমরা কেউ একটু বুঝে কেউ বা না একটু না বুঝেই একসাথে সমস্বরে চিৎকার করে উঠি, চাই চাই চাই!

হাফিজ ভাই তখন আমাদের সবাইকে একে একে বুকে জড়িয়ে ধরেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন ভাইলোগ, আজ আপনারা যারা এই জিহাদে প্রাণ দিতে যাচ্ছেন তারা জেনে রাখবেন আপনারা সবাই জান্নাতের সূরা পান করছেন, সবাই শহীদী মর্যাদা পাবেন!! আর যাদের মারছেন তাদের কোন ক্ষতি আপনারা করছেন না বরং তাদের পাপ ধুয়ে দিচ্ছেন। তারাও জান্নাতবাসী হবেন, এক মুসলিম আরেক মুসলিমের জান্নাত লাভে সহায়তা না করলে কে করবে? এভাবেই একদিন আমরা এ পৃথিবী থেকে সব পাপ নিশ্চিহ্ন করে দেব! বলুন, ইনশাল্লাহ, আল্লাহু আকবার!!

আমরা জেহাদে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে পর্যন্ত বলতেই থাকি বলতেই থাকি।

আল্লাহু আকবর!! আল্লাহু আকবর!!

 

৩.

আজকের দিনটা আমাদের এই আস্তানাবাসীদের জন্য অন্যরকম দিন। আজ আমাদের প্রথম অভিযান। আমরা সকাল থেকে ভেতরে ভেতরে অনেক বেশি উত্তেজিত! উত্তেজনা প্রকাশ করছি একেকজন একেকভাবে! কেউ চুপ মেরে আছে একদম কথা বলছে না কোন! আবার কেউ অকারণে কথা বলছে, কোন প্রয়োজন নেই তবু। মধ্যরাতে আমাদের শেষ বৈঠক সমাপ্ত হলে আমরা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরি। তখনও আমরা ছিলাম জেহাদী জোয়ারে একেবারে টগবগে কিন্তু ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় কেমন জানি ভাটা আসে মনে, আসলে বিষয়টার গুরুত্ব যে কতখানি বা পরিণতি যে কী হতে পারে সে বোধ আমার ধারণা এখানকার কারোরই স্পষ্ট নয়! আজ ভোর সকালেই শুরু হয়েছে তোড়জোড়! কিছুক্ষণ পর গাড়ি আসবে আমাদের কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্য! সেখানে আমাদের প্রস্তুত করা হবে অভিযানের প্রয়োজনীয় সাজ সজ্জায়, আজ জুম্মাবার, পাশাপাশি ছুটির দিন, শপিংমল ও মসজিদ কোথায় ভীড়ের কমতি থাকার কথা না। আমাদের ভেতরটা কেমন জানি লাগছে, সবার মনের মধ্যেই কু ডাকছে, কিন্তু কেউ কাউকে বলছে না! মাইদুল আমার সাথে লেপ্টে আছে রাত থেকেই, ঘ্যানর ঘ্যানর করছে অনবরত! এটা ওর স্বভাব কি আর করা! অস্থিরতা কাটাতে কেউ নামাজ পড়ছে, কেউ আবার একে অন্যকে বলছে নিজের ব্যক্তিগত দুঃখের কথা! আমাদের দলের আফতাব একটু ঘাড়ত্যাড়া, এখানে আসার আগে কোন একটা বড় রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ছিলো সম্ভবত! এখনও তার হাবভাব সেরকমই আছে। আফতাব এই অভিযানের অধিনায়ক হতে চাইছে। আমার হাসি পায়! বোকা ছেলে! কিছুক্ষণ পর আমাদের জীবনেরই কোন অস্তিত্বই থাকবে না আর সে হুজুগে আছে তার আধিপত্য নিয়ে! পাগল! আজীজকে ধরেছে মেয়েলি রোগে।ফিচফিচ করে কাঁদছে, অভিযানে যেতে চাইছে না মনে হয়। হয়তো শেষমুহূর্তে মায়ের কথা মনে পড়েছে, এই ছেলেটা নেশাগ্রস্ত থাকতো আগে বাপ মায়ের বখে যাওয়া আজীজ বিন মূসা! আহ্লাদী বাপের আহ্লাদী ছেলে প্রেম করে ছেকা খেয়েছিলো একসময়, আমার বিরক্ত লাগে একে সবসময় এমন ছিঁচকাঁদুনে ছেলের ছেঁকা খাওয়াই উচিৎ! তবে আজীজের কারণেই হাফিজ ভায়ের আরেক রূপ দেখলাম আজ, এই শেষ সময়ে! হাফিজ ভাই আমাদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন, মিলিটারি কায়দায় একে একে দেখলেন সবার চোখ, এ চোখ গত রাতের চোখ নয়, এতদিন চিনে আসা চোখ নয়! আমার গা শিরশির করে, শিরদাঁড়া বেয়ে নামে শীতল স্রোত! এ কী মানুষের চোখ! এ চোখ আগে দেখিনি কেন আমি? সেই প্রথমদিন থেকে গতরাতের কান্না পর্যন্ত এ চোখ কতটা সতর্ক ছিলে ভেবে চমকে উঠি মনে মনে! তাহলে কি করা উচিৎ! আমি সবার দিকে তাকাই, তারাও কি আমার মতো ভাবছে কিছু, নাকি সেই চাদরতলে বসার আগের সেই শয়তানি আবার ভর করেছে আমার উপর! কি জানি কোনটা সত্যি! তবে এটা নিশ্চিত আজকের এই চোখের জাত আলাদা। হাফিজ ভাই ঠিক এই মুহূর্ত থেকে অচেনা হয়ে যাচ্ছে আমার! ভুলে যাচ্ছি গতরাতেই তার চোখের জলের ঈমানী কান্নায় আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করবো, এই মানুষটার জন্যই কি, এত এত রাত জেগে জেগে কাটিয়েছি? হাফিজ ভাই আজিজের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছেন আপনি কি জানেন আপনাদের এই প্রজক্টে কতটাকা খরচ করেছি আমি? হিসেব আছে? এখন আপনি চোখে জলে সব ভাসিয়ে দিচ্ছেন! হাল্কা করে দিচ্ছেন সকলের মনের জোর! বেত্তমিজ! নালায়েক! মুনাফেক!

আমি তাকিয়ে আছি, তাকিয়েই আছি। আমার স্মৃতিতে এখন তার চাদরের নীচের উষ্ণতা নেই, শীতল হয়ে গেছে সব, শুনতে পাচ্ছি হায়েনার ডাক, হিসহিস শব্দ! মাথায় ঘুরছে প্রজেক্ট! হাফিজ ভাইয়ের চিৎকার!

বেত্তমিজ! নালায়েক! মুনাফেক!

ঠিক সে মুহূর্ত থেকে আমি অনেক অনেক কিছু দেখতে শুরু করি, হাফিজ ভায়ের নাড়িভূড়ি পচে যাওয়া মাংসল পেট! আলজিভের কালো কুচকুচে রং! উর্দির ভেতরের লোভ! আমি মাইদুলের হাত চেপে ধরি মাইদুল আমাদের ফেরার উপায় নাই! শুনতে পাচ্ছিস বাইরে গর্জন! ঘেউ ঘেউ ঘেউ!

 

এরপর আমার সামনে থেকেই একে একে আজীজ, মুসতাসিম, শাহীন আর মাইদুলকে ডেকে নিয়ে গেলো, একদম পাশের ঘরেই হাকডাক, হাত-পা বাধা নেই তাদের, তবুও আমি দেখলাম তাদের হাতে পায়ে গলায় এক অদৃশ্য লোহার চেইন। চকচক করছে! দূর থেকেও স্পষ্ট সব! হাফিজ ভাই দাঁত চিবিয়ে কথা বলছেন, আমি শুনতে পাই দাঁতে দাঁত চাপার কড়কড় শব্দ।

আপনারা ভাবছেন আপনাদের অন্যকিছু ভাবার সুযোগ আছে? বাইরে তাকিয়ে দেখেন সব প্রস্তুত কেউ বিকল্প কিছু ভাবার চেষ্টা করলে আল্লাহর পথে মরার আগেই ঝাঝড়া হয়ে যাবেন একদম, সহী শহিদি মৃত্যুতে বেহেস্ত পাওয়ার কথা কিন্তু এই কাপুরুষী মৃত্যুতে কি পাবেন দোজখ, ডালকুত্তার কামড়!

এই মুহূর্তে কেউ পালিয়ে যেতে চাইলে সে বেইমান! আপনাদের জেনে রাখা ভালো আমরা আল্লাহর সাথে মোনাফেকি করা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখি না, তারা পৃথিবীর শত্রু! আপনারাইতো নিয়ত করেছেন আল্লাহর পথে জীবন দিবেন, আল্লাহ আপনাদের নিয়ত কবুল করেছেন, এখন আপনি পবিত্র! আপনি জানেন বেহেস্তের দরজা শহিদ মুসাফিরের জন্য অপেক্ষা করে আছে? আর আপনারা করছেন নাপাক দুনিয়ার চিন্তা! শয়তানের প্ররোচনায় দুনিয়ায় মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? আখিরাতের জন্য প্রস্তুত হন! আপনি মুমিন, আপনি আল্লাহর পথে কোরবান!

এরপরের ঘটনা অল্প, আমাদের মধ্য থেকে পাঁচটা ছেলেকে বাছাই করা হলো, শপিং মলে যাবে আগেই তার প্রস্তুতি দরকার কিছু। মাইদুল খামচে ধরে আছে আমার হাত! আমি নির্বিকার কি আর করার আছে আমার! আফতাব অধিনায়ক হতে চেয়েছিলো, এই দলে আফতাবই অধিনায়ক!

আফতাব জহির, ইকরাম, লাচ্চু আর মুনিম! মুনিম চলে যাওয়ার আগে আমায় একটা সেলাম ঠুকলো! মুনিমের টলটলে চোখে এত মায়া, মাদ্রাসায় পড়তো, প্রচণ্ড আল্লাহপ্রীতি, সুশ্রী অভিজাত মুখশ্রীর এই ছেলেটাকে দেখলে এমনি আমার আদর লাগতো, তার পরিমিতি বোধও ভালো শ্রদ্ধা লাগে। ছেলেটা আমায় পছন্দ করতো খুব, কেন জানিনা আমায় দেখলেই ভাইয়া ভাইয়া করতো, হয়তো তার পরিবারে আমার মতো কোন এক দুর্ভাগা ভাই ছিলো । পাঁচজনের কাঁধে পাঁচটা ব্যাগ ভিড়ে মিশে যাওয়ার মতো সাধারণ পোশাক, এখন আর কাউকে আলাদা আলাদা সনাক্ত করা যাচ্ছে না মনে হচ্ছে সবাই এক জনতার মুখ!

বাইরে গাড়ি প্রস্তুত একবার শুধু ঘরের মধ্যে বিস্ফোরণের মত শব্দ হলো- নারায়ে তকবীর! সব মুসাফির একসাথে বলে ওঠে

-আল্লাহু আকবর!

চলে গেলো কচি পাঁচটা প্রাণ, ঘরের মধ্যে সারি সারি নেটওয়ার্কিং সাইট, দেয়াল জুড়ে পর্দা, আমরা জানি আমাদেরও যেতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমরা জানি আমাদের এই ঘরের ছেলেগুলোই কিছুক্ষণ পর সারাবিশ্বেট খবর হয়ে যাবো

বুকের ভেতরে রাতের আঁধারে ফুটেছিল যে রক্তের স্রোত আতঙ্কের শীতল স্পর্শে এখন তা গাঢ় জমাট বাঁধে আছে!

দুপুর হবার আগেই আমরা প্রস্তুত হই, একসাথেই শুরু হবে দুটো অভিযান! তুলনামূলকভাবে একটু চতুর, বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো এমন ছেলেগুলো ছিলো ঐদলে । আমাদের পাঁচজনের দলটায় বোকাদের সংখ্যাই বেশি, আমাকে আবার সে দলের অধিনায়কও করা হয়েছে। আজীজ এখনো বিমর্ষ। মুহতাসিম আর শাহীন চলনসই, মাইদুলের হাবভাব এখন আর বোঝা যাচ্ছে না। ঐদলের নাম ছিলো জামিয়াহ্, আমরা শরিয়াহ্! এই মুহূর্তে আমাদের একটা গোপন বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে, ঘণ্টা খানেকও হয়নি আরো কম সময় হবে। এই বিল্ডিংটা আমাদের টার্গেটকৃত মসজিদের খুব কাছে। ঘরের দেয়ালে এখন সে মসজিদের বড় একটা নকশা। সামনে আর পেছনের দরজায় কে কোথায় অবস্থান নেবে চিহ্নিত গোল লাল বৃত্ত একে দাগানো আছে। শাহীনের অবস্থান একদম আমার সামনে অর্থাৎ নামাজিদের পেছন অংশে, ইমামের পেছন দিককার অংশে থাকবে মুহতাসিম আর আজিজ, মাইদুলকে থাকতে হবে দরজায়। মাইদুল একথায় বেঁকে বসে তার সাফ কথা হামলা করার সময় সে আমার আশেপাশে থাকবে অন্যকোথাও যাবে না সে! আমার মায়া হয় আহারে মাইদুল আমি যদি পারতাম এই মুহূর্তে তার মাথাটা নরম গামছা দিয়ে মুছে দিতাম, এই গরম ঘর্মাক্ত দুপুরে আরাম পেতো ছেলেটা! মাইদুলের ইচ্ছা পূরণ করা হয়। হামলার পরিকল্পনার অনুযায়ী আমি মাইদুল আজীজ, শাহীন আর মুসতাসীম ছড়িয়ে পড়লাম মসজিদের এদিক সেদিক। যে যার পজিশান মতো।

বিস্ফোরক নিয়ে মসজিদের ভেতরে আমাদের ঢোকাটা খুব একটা সহজ ছিল তা বলবো না, তবে জুম্মার দিন বলে মসজিদে প্রচণ্ড ভীড় তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা শিথিল ছিল বলা যায়! আরো একটা বিষয় টের পেলাম মসজিদ প্রবেশ পথের চেকিংয়ে প্রত্যেকটা জায়গায় পূর্বপরিকল্পিত কয়েকজন করে পূর্বনির্ধারিত মানুষ ছিলো যারা প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এই অভিযানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ত।

সারি সারি মুসলিম এককাতারে নামাজ পড়ছে, মাথার উপরে টিক টিক করে ঘুরছে ঘড়ি, আমরা জানি আমাদের পেটের মধ্যেও সমানতালে দুলছে কাটা।

টিক!

টিক!

টিক!

মসজিদের একটা আলাদা ঘ্রাণ আছে, প্রভাবক শক্তি আছে, এখানে মাতাল লাগে, ঐশ্বরিক পবিত্রতায় শীতল হয়ে যায় শরীর! একসাথে শত শত মানুষ একধ্যানে মাথা নত করছে সমান তালে, কি চমৎকার সুন্দর! আমার মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যেতে ইচ্ছে করে আমি কোন অভিযানে এসেছি! সেজদারত শত শত মানুষের মাঝে আমি আর মাইদুল। সমবেত আত্মায় একসাথে স্মরণ করছি আল্লাহর নাম! এই জমায়েতে এখন আমরা একে অপরের কত আপন! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আর আপন থাকবো না হয়ে যাব ঘাতক হন্তারক! ভাবা যায়!

এইমাত্র নামাজ শেষ হলো , আর বেশি সময় নাই, কাউন্ট ডাউন চলছে এখন, আমি আর মাইদুল বসে আছি একদম পেছনের সারিতে, সবার সাথে একসাথে হাততুলে আছি আল্লাহর দরবারে। শুরু হয় মোনাজাত-

ইমাম সাহেবের সহী কণ্ঠের আত্মনিবেদন, ক্ষমা প্রার্থনার করুণ আর্তি-

হে আল্লাহ তুমি মানব জাতিকে আজ উদ্ধার করো, মানব জাতির আজ বড় সংকটকাল! তুমি রাহমানুর রাহিম তুমি গাফুরুর রাহিম। তুমিই পারো রক্ষা করতে। যুগে যুগে বার বার বিপদগ্রস্ত মানবজাতিকে তুমিই রক্ষা করেছো, পথ দেখিয়েছো! আজ দিকে দিকে অন্ধ মানুষ! একে মারছে অন্যকে, তুমি তাদের জ্ঞান দাও প্রভূ। আলো দাও। মানুষ হত্যা মহাপাপ এই সত্য ভুলে গেছে তোমার আশরাফুল মাখলুকাত। আজ হিংসার আগুনে একে একে পুড়ছে ধর্ম, পুড়ছে জাতি। চারিদিকে চলছে ক্ষমতা প্রদর্শনের নগ্ন রাজনীতি! মানুষরূপী কিছু শয়তান আজ সেই সুযোগে ব্যবহার করছে দ্বীনের কালামহীন কিছু অন্ধ আইন। ইসলাম ধ্বংসের পায়তারায় আজ উগ্র ফতোয়ায় দমিয়ে রাখছে সবার মুখ। যারা ইসলামের নামে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে তাদের হাত থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করো প্রভু। আমাদের সকলের পাপ তুমি ক্ষমা করো। পাক রাহমানুর রাহীম আজ আমরা হাজার হাজার মানুষ একসাথে তোমার দরবারে একসাথে হাত তুলেছি, তুমি সকল ধর্মের সকল জাতির সকল মানুষরের পাপ ক্ষমা করো, তাদের সহীহ জীবন দান করো ও শাহাদাতি মৃত্যু দিও। আমরা যেন শয়তানের প্ররোচনায় কখনো বিভ্রান্ত না হই, পবিত্র আত্মা নিয়ে যেন পৌঁছাতে পারি জান্নাতের দরজায়!

হঠাৎ মাইদুলের ফুপিয়ে ওঠা কান্নায় আমার চমক ভাঙে, আমি এতক্ষণ ডুবে ছিলাম ইমামের সাথে প্রার্থনায়। মাইদুল আমার হাতটা বুকের কাছে টেনে নেয় ফিসফিস করে বলে-

বলতো খোকন তুই আমি আর আমরা কী পাপ করেছিলাম দুনিয়ায়? এত এত মানুষের আমলনামার বোঝা কাঁধে নিয়ে আজ তুই আর আমি পথে নামবো, মুসাফির আমরা! কোথায় যাবো বলতো? বেহেস্তে তাই না? তারপর মাইদুল শব্দহীন চিৎকারে কেমন করে হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে তার হেঁচকি উঠে আসে। হেঁচকির সাথে চলে প্রলাপ-

দেখ খোকন তোর, আমার আর আমাদের কেমন ভাগ্য! আমরা আজ বেহেশতের ইজারাদার! হা হা হা কী ভাগ্য আমাদের!

আচ্ছা তোর কি মনে আছে সেই যে তুই যেদিন পেনিস কেটে আসলি, কত জ্বর ছিল তোর, আমি রোজ তোকে ভাত মেখে খাইয়ে দিতাম মনে আছে তো? দেখ দেখ ঐ যে সামনের সারিতে মোনাজাতে হাত তুলে বসে আছে সাড়ে তিন বছরের এক মাছুম বাচ্চা তাকেও নিশ্চই ওর মা এমন করে মুখে ভাত তুলে খাওয়ায়। খাওয়ায় কি না বল? বল না খোকন?

আমি কথা বলি না, এই শেষ বেলায় এসে মাইদুল পাগলামি করছে! করুক। মাইদুলতো আমার মতো জীবনের বার বার সংকটকাল দেখেনি, এই প্রথম পাগলামিতো করবেই!

বাবার সাথে নামাজে আসা বাচ্চাটা কি বুঝলো মোনাজাত রেখে আমাদের দুই বন্ধুকে দেখে ঠোঁট গোল করে একটা হাসি দিলো, মাইদুল আবার ডুবে যায় পাগলামিতে!

আমার মনে হলো বাতাস এখানে থেমে আছে অনেক্ষণ, আমরা পাঁচজন মৃত্যু পেটে নিয়ে বসে আছি পাঁচ দিকে। কখন হবে সময়, টিক টিক টিক!

আমাদের মানুষ হওয়ার কথা ছিলো, হয়েছিতো, হাত আছে, পা আছে, নাক আছে, মুখ আছে। সব আছে। শুধু চোখগুলো আজরাইলের! মৃত্যু খুঁজছি এদিক সেদিক! হাফিজ নেই এখানে, নেই মেসের সেই নতুন ছেলেটাও!

 

সাইরেন বাজছে তবুও আমার চোখ থামেনা। আমি চোখে চোখে খুঁজে যাই শাহীন আজীজ, মুহতাসিম, মাইদুল আর আমার মতো বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো কিছু উদ্ভ্রান্ত মানুষের মুখ! নাহ মানুষ না আমরা। আমাদের পরিচয় আমরা জঙ্গি, একেকটা জঙ্গি একেকটা সুইসাইড স্কোয়াড! পেটে মৃত্যু ডিম ছুঁয়ে দেখি শক্ত, শীতল!

মাইদুল আমার হাত ধরে টানে, মিনতি নিয়ে বলে-

-খোকন আমায় একটু বাইরে নিয়ে যাবি, দম আটকে আসছে, আমি একটু বাঁচতে চাই! নিবি?

আর কিছু বলার সুযোগ হয় না, বিকট একটা শব্দ। অন্ধকার, ধোয়া আর আগুন কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আমি জানি না, আমার জ্ঞান ফিরেছে নাকি ফেরে নাই তাও জানি না । আমি হয়তো বেঁচেই নেই, মৃত্যুর পর নরকে আছি, কালো অন্ধকার ধোঁয়া আমার চারপাশে, বিস্ফোরক গল্ধ, মাংস পোড়া বাতাস। পেটে হাত চলে যায় অজান্তে। ফাটেনি এখনো!! শীতল! আচ্ছা কেন ফাটেনি!! আমার চোখের সামনেইতো মাইদুল ফেটে গেলো, ঠাস!! আমি মৃত্যু পাহাড়ে রক্ত নদীতে টের পাই পোড়া লাশের ভিজে ওঠা থকথকে তরল অবস্থা। এত এত ফেটে যাওয়া খণ্ড খণ্ড মানুষের মাঝে নিশ্চই আমার মাইদুলও আছে। আমি হাত বাড়াই একেকটা লাশ সরিয়ে খুঁজি মাইদুলের মুখ, এইতো একটা হাত এখনো শক্ত করে ধরে আছে আমার হাত। শরীরটা নেই উড়ে গেছে। খুঁজতে হবে আবার! মাইদুল, শাহীন, আজীজ, মুহতাসীম কে কোথায় এখন! মাইদুল বাঁচতে চেয়েছিল শেষকালে, একটু বাইরেটা দেখতে চেয়েছে, অবশ শরীরে আমি আগাই। আহা আগে টের পাইনি আমারও একটা পা উড়ে গেছে। যাক । চারপাশে সারি সারি মুখ। ঝলসে যাওয়া পুড়ে যাওয়া, ঐতো সামনের পড়ে আছে একটা ছোট্ট মাংসের পুটলি । হায় সেই সাড়ে তিন বছরের বাচ্চাটা! আমি আর এগুই না, যদি অজান্তে এই হাত ছুঁয়ে ফেলে এই নিষ্পাপ পবিত্র শরীর, নাহ আর না । হাফিজ ভাইকে মনে পড়ে একে একে, মনে পড়ে ইমামের শেষ বলা কথা গুলো! হায়রে শহিদি মরণ! হায়রে জেহাদ! এই প্রথম আমি উপলব্ধি করি আমি সৃষ্টির সেরা জীব নই, আমি আল্লাহর পথের পবিত্র এক মুসাফিরও নই এমন কি পেনিস কাটা নপুংসকও নই, আমি নিকৃষ্ট এক অনুজীব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাপী, আমি জঙ্গি, ধর্মের নামে মানুষ হত্যাকারী এক নরপশু!


আরও পড়ুন-

দৈহিক মিলন হবে বিশুদ্ধ আত্মার ঘ্রাণ

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী