X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থী ক্যাম্প

মনির ইউসুফ
২১ জুন ২০১৭, ১৬:৫৫আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ২০:০২

শরণার্থী ক্যাম্প

বৃদ্ধ তৈয়ম গোলাল, বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল। তার যুবক বয়সেই মিলিটারি হামলা করেছিল ভুচিদং গ্রাম। অতর্কিত সেই হামলায় কিছু বুঝে উঠার আগেই তার বাপ-ভাই খুন হয়ে গেল, তার বউকে রেপ করল তিনজন সৈনিক এবং গুলি করল; সে লাফ দিয়ে ঘরের বেড়া চিরে বের হয়ে ভিটের এক কোণে লুকিয়ে সব দেখেছিল এবং নিজেও নিশ্চিত খুন হবে জেনে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছনে না ফিরে পালিয়ে এসেছে নাফের এ পারে। পিছনে পড়ে রইল তার মা-বাবা, ভাইসহ বউয়ের লাশ। পরিস্থিতি বাধ্য করেছে তাকে পালাতে। বাংলাদেশের কুতুপালং অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পে কেটে গেল বাকী জীবন। সবাই তাকে, কাক্কু বলে ডাকে। আর এ বছরও তার মত আরও জোয়ান মরদ, যুবতী, শিশু, বুড়োর দল কাতারে কাতারে দল বেঁধে পালিয়ে এসে জড়ো হচ্ছে কুতুপালং ক্যাম্পে। বুড়োর বুঝতে বাকী রইল না কত রক্তের নজরানা দিয়ে এই মানুষগুলোকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে হচ্ছে। আর কোনোদিন নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারবে না তারা। মাটির সুবাস ভরা ক্ষেতের জমি, ধানক্ষেত, শৈশবের নুড়ি ও বালু বিছানো পথ আর কখনও ফিরে পাবে না। ঝিঁঝিঁ ডাকা সন্ধ্যা, জোনাকির আলো আর আকাশের বুকে ঝুলে থাকা চাঁদ নিজের মত করে আর কখনও দেখতে পাবে না। ভাবতেই বুড়োর চোখের কোণে জমে ওঠে লোনাজল, টপটপ করে ঝরে পড়ে কপোল বেয়ে। এ কয়দিনে বুড়োর ঘরের পাশেই উঠতে থাকল আরও অনেকগুলো ঘর; কোনো রকম পলিথিন আর তাবু দিয়ে মাথা গোজার একটা ঠাঁই করে নিচ্ছে ভয়ে আতঙ্কে পালিয়ে আসা ঠাঁইনাড়া লোকজন। বুড়োর মুখে অজস্র বলিরেখা, বুকের ভেতরে যে দুঃখের দহন তা যেন তার দেশের মানচিত্র ও মনের অভিব্যক্তি হয়ে ফুটছে কপালে।

টিলার উপর পলিথিন মোড়ানো ঘর, ঠাসাঠাসি, বাতাসে গুয়ের গন্ধ, মুতের গন্ধ। বুড়ো তৈয়াম গুলাল, একটি রোহিঙ্গা যুবককে তার কাছে ডেকে নিয়ে পাশে বসায়, জিজ্ঞেস করে পরিস্থিতি কেমন, খুব বেশি রক্তপাত হয়েছে কি এ বছরও। যুবক কথা বলতে পারে না, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করে, কান্নার ধমকে বলে মা-বাবা-বউ ফেলে পালিয়ে এসেছি। কে কোথায় আছে জানি না। আমিও খুন হয়ে যেতাম, বাহুতে গুলি লেগেছে, বেহুশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আর কিছু মনে নেই। যখন হুশ হই তখন রাত। বাড়ির ভেতরে মা-বাবা, আর বউয়ের লাশ। তখনই সিদ্বান্ত নিলাম পালাতে হবে।

বুড়ো বলে, যেখানে পালিয়ে এসেছো সেটাও তো তোমার দেশ নয়। মৃত্যুর ঝুঁকি নেই, কিন্তু বাঁচার মত বাঁচা এই ক্যাম্পে হবে না কোনদিন। দেখ, কেমন শীত, আর ঠাণ্ডা বাতাস। বুড়োগুলো বাঁচবে কি করে আমি সেটাই ভাবছি। চারদিকে জঙ্গল, টিলার গৈরিক মাটি, চাড়াল ঘাস আর সর্তক পাহারা। এত ঠাসাঠাসি করে কি বাস করা যায়! এতগুলো মানুষ পরনের কাপড় নেই, খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই এ কোনো জীবন হয় না যুবক। আমার তো এই ক্যাম্পে কেটে গেলো ত্রিশ বছরের বন্দী জীবন। বলতেই বলতেই বুড়ো ফিরে যায় তার স্মৃতিময় যৌবনের গ্রামে। সেই কি বর্ধিষ্ণু গ্রাম; কাঠাল, আম, জাম, নারকেল, সুপারি, জাম্বুরা, ডালিম, কলা, লেবু, কামরাঙা, পিয়ারা, আমড়া। কামিনী, বেলি, জুঁই, ঘাসফুল আর লজ্জাবতী লতার বিতান। মসজিদে সকাল সকাল নামাজ পড়ে কাজে নেমে যাওয়া। এদিকে চাষের জমি, আরেক দিকে পাহাড়ি উপত্যকা; মূল্যবান আকিয়াব পাথর সংগ্রহ। বড় বড় গর্জন, সেগুন, মেহগনি, জারুল বৃক্ষে সবুজের বুকে স্বর্গ-উদ্যান। নদী নাশী ঝোরায় খালে-বিলে মাছ আর মাছ পাখি আর পাখি। বুড়োর চোখ লাল হয়ে ওঠে আরও। সেই চল্লিশ বছর আগের আরাকান, সেই বার্মা (মায়ানমার)। এত হিংসা কি করে একটি জাতি আরেকটি জাতির প্রতি পুষে রাখে, মনে মনে বলে বুড়ো। এই এতো বছর, চল্লিশ বছর কম কথা নয়।  যুবক বুড়ো হয়ে পড়ে, বুড়োরা মরে যায়, নতুন শিশুর জন্ম হয়। এরপরও একটা জাতির কোনো হিল্লে হয় না।

যুবক বলে, কাক্কু আমি যাই, ঘরটা তুলতে সাহায্য করি। আমার হাসপাতালেও যেতে হবে। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। বুড়ো বলে যাবে তো যাবে, মনে রেখ, এই ক্যাম্পও কিন্তু স্বর্গ নয়। যুবক চলে যায় পাশের ঘরে, পাশের ঘরে অসংখ্য নরনারীর শিশুর ভীড়, বাজু ও থামি পরা, ন্যাংটা শিশু, ছিটেফাটা কাপড় ও বোরকা পড়া যুবতী। শরণার্থী দল স্রোতের মত আসতেছে আর আসতেছে কুতুপালং ক্যাম্পে।

লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়ো ক্যাম্পে হাঁটে একা। যুবতীদের কাছে যায়, একদল যুবতী ভীড় করে পাহাড়ি টিলার একপাশে। চোখে মুখে আতঙ্ক সদ্য পালিয়ে এসেছে নিজের গ্রাম থেকে। এখনও ঘর তৈরি হয়নি তাদের। পাশের তৈরি ঘরে কোনো রকম রাত যাপন করেছে। আরেক দল যুবতী জাতিসংঘের দেওয়া অস্থায়ী হাসপাতালে ভীড় করছে, সদ্য রেপ হয়েছে, চিকিৎসার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। একটি যুবতীকে পাশে নিয়ে জিজ্ঞেস করে বুড়ো- কেমন করে এ পারে আসতে পারলে। যুবতী বুকের ওড়না ঠিক করে, থামিতে গিট দেয়, বলে- একদল মিলিটারি বন্দুক উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ভিটেয়, ঘরের দরজা খুলতেই বুটের লাথি এলোপাতাড়ি, চুল ধরে টান মারে তারপর আর কিছু মনে নেই, হুশ হওয়ার পর দেখি মরে পড়ে আছে বৃদ্ধ দাদা, ভাই-বোন, আমি কেবল বেঁচে আছি। আমার কোমরে তখন প্রচণ্ড ব্যথা, বঝুতে পারি তারা আমার কি করেছে। রক্ত যাচ্ছে যোণিদ্বার থেকে, কোনো রকম কাপড় গুজে দিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে বাড়ির পিছন দিয়ে পালাতে গিয়ে সখিনার সঙ্গে দেখা, আরও একদল মেয়ে তফুরা, জান্নাত, হালেছা, সলিম, আবু বদ্দা বেগ্গুন হনঅ না হনঅ ভাবে আহত। তখনই সিদ্বান্ত নিই পালাতে হবে। সকাল হলেই মরা ছাড়া উপায় নাই। অনেককে ধরে নিয়ে গেছে। রাতের বেলায় পালিয়ে এসেছি। বুড়োর চোখে ছানি পড়ছে, চারদিকে তাকায় বুড়ো আর বলে যেখানে এসছো সেটাও স্বর্গ নয় কিন্তু।

মাগরিবের আযান হচ্ছে, বুড়ো ঘরে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। কিছুদূর হেঁটে বসে পড়ে একা, মনে মনে বিড় বিড় করে, যেখানে এসেছো সেটাও স্বর্গ নয় কিন্তু। কি নিয়ে বিড় বিড় করে বুড়ো নিজেও বুঝে না, কিন্তু বাতাসে বিড়বিড় ধ্বনি একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একটি স্পষ্ট বেদনা অস্পষ্ট স্মৃতির পাখি হয়ে উড়ে। বুড়োর যৌবনের স্মৃতি, গ্রাম, মাটির সুবাস, মা-বাবার আদর, গোয়ালঘর, খড়ের গম্বুজ। পুরো ক্যাম্পটাই যেনো একটি স্মৃতির খামার হয়ে ওঠে। সব ক্যাম্পবাসীর মুখেই গ্লানি, বেদনাবোধ, উদাস দৃষ্টি, হতাশ ভঙ্গি। ক্যাম্প নামের যেনো মৃত একটি পৃথিবীতে তারা বসবাস করছে।

রাতের অন্ধকারে, যুবতীরা বুড়োকে ঘিরে গোল হয়ে বসেছে। বুড়ো চোখ বন্ধ করেই মুখ খোলে, বলে- কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবে এটা কেমন দেশ, নিজ দেশে খেয়ে পরে অভাবে-স্বভাবে বাঁচার মত সুখ পরদেশে কখনও পাবে না সখী লো। আমার জীবনের ত্রিশটি বছর কটে গেলো আশায় আশায়, দেশে ফেরার আশায় আশায়। এখানে থাকলে কোনোদিন নিজের দেশে ফিরতে পারবে না, নিজের মত করে থাকতে পারবে না। তার চেয়ে চেষ্টা তদ্বির করো, সৌদি আরব  চলে যেতে পার কি না, মোলেশিয়া চলে যেতে পার কিনা। রাতের চাঁদ আলো ঝরাচ্ছে, অচেনা এই পাহাড়ি টিলায় তাদের জিন্দেগীর সঙ্গে রাতের অন্ধকারও ঘন হয়ে আসছে। বুড়ো বলে যেখানে এসেছো এটাও স্বর্গ নয়। শোনো, দুনিয়া কিন্তু তোমাদের গ্রাম নয়, এখানে খলখলিয়ে হেসে খেলে কাটাবে। এটা ভিন দেশ, এই দেশের ধরণ-ধারণও ভিন্ন। তোমার দিকে খালি সন্দেহের চোখে তাকাবে এরা। ত্রিশ বছর এই গ্লানি নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে আমাদেরকে। জানো, আমি মানসিক দিক দিয়ে অবশ হয়ে গেছি। ভেঙ্গে গেছে সব মনের জোর। তোমারও এ ক্যাম্পে পড়ে থেকে মাজুর হয়ে পড়ো না। জীবনকে খুঁজো অন্য কোথায়, অন্যকোন খানে।

সকালে সূর্যের তীব্র আলোক রশ্মি এই পাহাড়ি টিলায় নতুন ভোরের একটা ধাঁধা লাগিয়ে দেয়, বাতাসে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। যুবক-যুবতীরা গাছের পাতা কুড়িয়ে আগুন ধরায়। আগুনে তাপ নেয়। হাত ছেকে। এই সকাল বুড়ো এসে তাদের পাশে বসে। গ্রামে যে হামলা হয়েছে তফুরা তা নিয়ে গল্প বলে, বেদনার গল্প- বাবার কি অবস্থা জানিনা, মাকে গোঙাতে শুনেছি। বড় ভাইকে পিছমোড়া করে বেঁধেছে দেখেছি। অনর নাতির হঅনঅ খবর ন পাই। বাঁচি আছে নে মরি গিয়ই। রাস্তার ওপারে গৃহস্থ বাড়ির মোরগ বাক দেয়। বাঙালি মুসল্লিরা মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হচ্ছে ক্রমে। পিচঢালা রাস্তায় দু’একটা গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে টেকনাফের দিকে আর কক্সবাজার শহরের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে।

বুড়ো বলে শোনো- ত্রিশ বছর ধরে বার্মাইয়া আর বার্মিজ গালি শুনতে শুনতে নিজের যে একটা গ্রাম ছিল, দেশ ছিল, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ছিল সব ভুলতে বসেছি। বাঙালি লোকজন আরারে খালি বার্মাইয়া বলে গাইল দেয়। বাঙালি লোকে খাঁটি প্রাকৃত রোঁয়াই ভাষায় বলে- ইতারা অয়দে হরাপ, নইলে ইতারারে মগঅলে এইল্লা নির্যাতন করে ক্যা। (রোহিঙ্গারা খারাপ তা না হলে তাদেরকে মগরা নির্যাতন করে কেন!)

শোনো, বুড়ো বলে- আরা অশিক্ষিত মুর্খর জাত। আরার যারা পন্না পইজ্জে উনও ন জানে আরার কওমর ইতিহাস। আরাকান আরার নাড়িকাটা দেশ। সাত পুরুষের বসতবাটি। একটা দেশ নিজের দেশ হতে কয় পুরুষের বসত করতে হয়? আর সেখানে অষ্টম-নবম শতাব্দী অইতে আঁরার বাপ দাদা বসবাস গরের। আর এড়ে আরার এখন কি নাজেহাল গরের। বিগত ত্রিশ বছরে আমি এখানে লেখাপড়া করে আমাদের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছি। তাতে স্পষ্ট বুঝেছি আমাদের এবং রাখাইনদের জন্মভূমি হচ্ছে এই আরাকান। আর বার্মিজরা বলে আমরা নাকি এদেশের নাগরিক নয়, বাংলাদেশের নাগরিক। কি মিথ্যিাচার! বাঙালিরা বলে আমরা নাকি বার্মাইয়া! ক্যাম্পের বাঙালি লোকজন আমারে ডাকে বার্মাইয়া কালু বলে। কি লজ্জা! কি গ্লানি! একদিকে দেশে নির্দয় নির্যাতন, ফিরতে না পারার তীব্র মানসিক যন্ত্রণা; আরেকদিকে বাংলাদেশে মানসিক নির্যাতন কোনখানে শান্তি নাই। ক্যাম্পে ত্রিশ বছর কাটানোর পর বুঝেছি মানুষের জন্য নিজের একটা দেশ কি জরুরি, নিজের একটা ঘর কি যে প্রয়োজন। যুবক-যুবতী বুড়োর কথা হা করে শোনে, আর চোখের পানি মুছে। দেশ, গ্রাম ফেলে আসা হাহাকারকে বুকে চাপা দেয়।

কতক্ষণ নিরব থেকে বুড়ো আবার বলতে শুরু করে-দশ বছর আগেও এ রকম হামলা হয়েছিল। তখন তোমাদের মত জোয়ান মরদা-মরদী স্রোতেরঢইল ধাই আসছিল, কে কোথায় গেছে কেউ জানে না। মা কোথায়? বাপ কোথায়? ভাই কোথায়? রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল গ্রামে। আমাদের সময়ও রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। কি নির্যাতন বাপরে, সাত জনমের শুত্রুও যেন এ রকম বিপদে ন পড়ে। হায়!  রোহিঙ্গা জন্ম, হায়! আরাকান।

তখন তোমাদের বয়স পাঁচ, ছয়, সাত এরকম হবে। দুধের মত সাদা একটা জোয়ান মেয়ে আর একটা জোয়ান বেটা, বুইজ্জনে, অল গরি পুইন্নঅ; বিয়ের দিনই গ্রামে হামলা! মানুষ কোথায় যাবে! বিয়ের আসরেই লাশ আর লাশ। নতুন বউ নিয়ে নতুন জামাই কিভাবে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিল আল্লাহই মালুম। তারপর এসে আমাদের সামনে কি কান্না, কি বিলাপ। ঐ খানে বিয়েও পড়ানো হয় নি। এখানে আমরা গাছের পাতা, ঘাসফুল দিয়ে তাবু সাজিয়ে মৌলবী ডেকে কোনো রকম বিয়ে পড়িয়ে দিই। বিয়ের সময় আরেক কাণ্ড। বাঙালি স্থানীয় মেম্বার এসে চাঁদা দাবী করে। তা না হলে বিয়ে করতে দেবে না বলে হুমকি। এ দুরাবস্থায় কউ তো, আমরা টাকা কোথায় পাব। একদিকে মন রক্তাক্ত, আরেক দিকে ক্যাম্পে খেয়ে না খেয়ে উপোস থাকার  জ্বালা। মেয়েটির মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। সেজেগুজে মরার মত পড়ে আছে। আরেকদিকে নির্যাতিত রোহিঙ্গা আসতেছে আর আসতেছে। মেয়েটি যে সুন্দর মেম্বার জেনে গেছে। এখন উপায়, মেম্বারের লোকেরা দুই ঘণ্টা সময় দিছে। আমি মুরব্বি। জান থাকিতে এই বেইজ্জতি হতে দিতে পারি না। কিন্তু পরদেশে কে মুরব্বি, কে অভিভাবক এসবের কোনো মূল্য নাই। মেম্বার আমার মেঝ ছেলের বয়সী হবে। আমারে খাঁটি প্রাকৃত চাঁটি ভাষায়- তুই তোকারি বা তাচ্ছিল্য করে বলে- এই বার্মাইয়া, এই কালু দশ হাজার টাকা দুই ঘণ্টার ভিতর পাঠাই দিবি, নইলে মেয়ে এইটা আমার সঙ্গে বিয়ে দিবি। আই তো তাজ্জব। মেম্বার কই কি! এ বয়সেও মেয়ে বিয়ে করার লোভ। এখানকার সব ক্যাম্পের দায়-দায়িত্ব এই মেম্বারের। সরকারি অনুদান, সামরিক অনুদান, ঠিকাদারি, বিদেশি কাজের ঠিকাদারি, জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ সব মেম্বার সামলায়। শোনো, আমরা জেনেছি এই মেম্বার, বহুত সুন্দরী যুবতী মেয়েরে নাকি বিয়ে করার লোভ দেখিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। আমরা কি করতে পারি পরদেশে, নিজ দেশে থেকে বিতাড়িত কিছু ক্যাম্প বন্দী মানুষ। এখানে ‘ঈদগাদ’ নামে একটা জায়গায় আমার আত্মীয় আছে। কুলসুমের বাবার মোবাইল থেকে তারে ফোন করে যেখান থেকে পারে তিন হাজার টাকা পাঠাতে বললাম। ভাগ্য ভাল ছিল, আমার বাঙালি আত্মীয়টি কথা শুনেছিল, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরে দিয়ে দু’হাজার টাকা পাঠাই দিয়েছিল। মেম্বারকে ওই দিয়ে রক্ষা। এ রকম অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি। একবারে চোখের সামনে যুবতী মেয়েদের নিয়ে যায় মেম্বার। যুবতী মেয়েদের নিয়ে কি গরে আর কি বুঝাই বলতে হবে, তোমাদের! যুবতীরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাই নিরবে। নিরবেই বলে- এক জিন্দিগীতে আর কত কি আছে কপালে আল্লাই জানে। আগুন নিবে যায়, কড়া করে রোদ উঠে, একবারে ঝাঁঝালো রোদ। ক্যাম্পে শিশু-কিশোরদের কোলাহল, হাঁসগুলোর ঘাত ঘাত ডাক, বাজু ও থামি পড়া রোহিঙ্গা মহিলা, লুঙ্গি পড়া তরুণ, যে যার কাজে নেমে গেছে। মেইন রোডে মেম্বারের মুদির দোকান, চায়ের দোকান। যা কিছু কিনবে রোহিঙ্গাদের এই দোকান থেকে কিনতে হবে।

বুড়ো উঠে যায়, নতুন আসা যুবক-যুবতীরা বসে থাকে, কোথায় যাবে তারা! লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়ো হাঁটে, বুড়ো সঙ্গে হাঁটে কয়েকজন যুবক-যুবতী। হাঁটতে হাঁটতেই ক্যাম্পের কবর স্থানের দিকে চলে যায় বুড়ো। কবর স্থানের মোরা অনেক বড়। সারি সারি কবর, ক্যাম্পে পালিয়ে আসা মানুষগুলো মরলে এখানেই কবর দেওয়া হয়। এক স্থানে গিয়ে দাঁড়ায় বুড়ো। একটি দ্বীর্ঘশ্বাস তার বুক থেকে বেরিয়ে পড়ে। দ্বীর্ঘশ্বাসটি বাতাসে মিলিয়ে যায় নীরবে। বুড়ো মনে মনে বলে- মানুষের জীবনে নীরবে কত কি ঘটে, কত কি। বুড়ো একদৃষ্টি চেয়ে থাকে কবরের দিকে। মনে মনে বলে আমারও আসার পালা হয়ে যাচ্ছে গো। যে কোনোদিন আমিও এখানের মাটিতে মিশে যাব। বুঝলে নাতি, মরলে আপসোস থেকে যাবে, নিজের দেশে, নিজের গ্রামের কবর স্থানে আমার কবর হল না। এই একটাই দুঃখ থেকে গেলো। আর দুঃখগুলো গুলো চুলোয় যাক। চাইলেও আমি তা দূর করতে পারব না। আমরা রোহিঙ্গারা যে ফাপরে পড়েছি আমাদের আর রক্ষে নাই। দেশ থেকে পালিয়ে এই পরদেশে, তারপর এই কবর স্থান। মানুষের মুক্ত জীবন কেমন, স্বাধীন জীবন! পৃথিবীতে এসেও এই স্বাদটা নিতে পারলাম না। অথচ, এই দেশে দেখ, মানুষ যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাচ্ছে; যখন ইচ্ছে তখন। আমরা কোথাও যেতে চাইলে পারমিশন, পাশ, কার্ড, মেম্বারের লোক, তারপর দিনের আলো থাকতে থাকতে ফিরে আসার তাগাদা। নিজ দেশে ফেরা সেতো  হল না ইহজীবনে।

সূর্য ডুব গেল ক্রমে ক্রমে। কখন যে বেলা শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারেনি কেউ, বুড়োও। ক্যাম্পে সময় স্তব্ধ হয়েই থাকে, ফুরাতেই চায় না দিন। অথচ, আজ খুব দ্রুতই চলে গেল সময়। আকাশে অজস্র তারা, সপ্তর্ষি, আদম সুরত বুড়োর মনের মধ্যে ব্যাকুলতা তৈরি করে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে একটানা। যত বেশি রাত হয়, তত বেশি দেশ ও মাটির জন্য বুক ভেঙ্গে যায়, বুড়ো বলে- কী আশ্চর্য, আমার দেশে আমি আর কোনোদিন ফিরতে পারব না; কোনেদিন ফিরতে পারব না। মনের আবেগ ও আকুলতা আর অক্ষমতাই কুকড়ে যায় বুড়ো। কুক কুক করে কাশতে থাকে। কাশতেই থাকে। বের হয় অজস্র কফ। যুবক-যুবতী বুড়োকে ধরেই ঘরে নিয়ে যায়।

বুড়ো সূর্য ওঠার পূর্বেই ঘুম থেকে ওঠে ক্যাম্পের মসজিদে নামাজ পড়তে গেলো। সুবেহ সাদিকের লালাভায় ক্যাম্প নামের এই পাহাড়ি টিলায় একটি লাবণ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আধো আলো ও অন্ধকারে মহিলারা কলতলায় গোসল করছে, কেউ অযু করছে, তাবুগুলো থেকে বাচ্চাদের কান্না, চিৎকার আর মা’দের ধমকমাখা আদর শোনা যাচ্ছে। বাতাসে তর খসখসানি। দূরে যুবক-যুবতীদের আবছা আবছা ছায়া। ক্যাম্পে কে রাখে কার খবর। সূর্য তার নিয়মেই আলো ছড়াচ্ছে, ক্রমেই ফর্সা হয়ে যাচ্ছে সকাল। মোরার ঢালুতে, ঢালু দিয়ে নিচে নেমে যাওয়া জমিতে সবজির চাষ করেছে বুড়ো। মরিচ, বেগুন, আলু, পেলম কত ধরনের সবজি। সকালের কুয়াশায় সবজিক্ষেতে এটা ওটা ঠিক করে দিচ্ছে বুড়ো। যেনো, যৌবনের উদ্দ্যম ফিরে পেয়েছে। আগাছা বাছা, পাতা থেকে পোকা ছড়ানো, ঠাণ্ডায় কুচকে যাচ্ছে তবুও বুড়োর উদ্দ্যমের শেষ নেই। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আমপারা নিয়ে মক্তবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে।

পাশের ঘরে টেপরেকর্ড ছেড়ে দিয়েছে, গান বাজছে-মেইট্টা গুদাম টইনর ছানি, ঝরঝরায়া পরের পানি, আঁই ভিজিলে যেনতেন তুঁই ভিজিলে পরান দরপরায়, অ হালা চান গলার মালা, পেট পুরুদ্দে তোয়াল্লাই, একটার পর একটা গান বাজতেছে।

- অরে ও বইন বাঁচনি হনে হইব জামাই কুয়ালত আছে নি। গানগুলো বাতাসে একটা সুরের সেতু তৈরি করে দিচ্ছে।

বুড়ো, গান শোনে আর স্মৃতির যুগে ফিরে যায়- মাটির গুদাম ঘর, টিনের ছানি, শ্যামল মেয়ে কালাচাঁন, আর নতুন গৃহস্থি। গোয়াল ঘর, অনেকগুলো গরু, খড়ের গম্বুজ। ‘বলীখেলা’য় গরুর লড়াই দেওয়ার জন্য গরুকে মোটাও লাল মরিচের গুড়ো শিংয়ে মিশিয়ে মেজাজী করে তোলার সেই দিনগুলোতে ভাসতে থাকে তার চোখের সামনে। ‘বলীখেলা’য় মানুষের ঢল, মানুষ আর মানুষ রোহিঙ্গা, রাখাইন, মগ সবারই উৎসব। বৈশাখের শুরুতে তীব্র গরম পড়লে বঙ্গোপসারের দুই তীরেই ‘বলীখেলা’র আয়োজন করে স্থানীয় যুবক-যুবতী। সে কি প্রাণের উৎসব। চাকতি খেলা, পুড়ামাটির খেলনা, ভোরে তমব্রুখেলা, সকালে গরু ও মোষের লড়াই, মেয়েলি জিনিসেরও বাহার বসে। সেইখানে বীরত্ব দেখানোর দুইটা পর্ব থাকে একটা হচ্ছে গৃহপালিত ‘গরু ও মোষ’ দিয়ে লড়াই, আরেকটা হচ্ছে মানুষে মানুষে ‘বলীধরা’। সেকি উত্তেজনা। উভয় জাতিরই প্রাণের মেলা। মগও গরু বলাই, রাখাইন-রোহিঙ্গা উভয়ই, একটু ভিতরে পাহাড়ি মুরং, চাকমা, মারমাও। এই জাতিগুলোর বীরত্ব ও সাহসেরে দেখা চলে ‘বলীখেলা’র মধ্য দিয়ে। টানটান উত্তেজনা। লড়াইয়ে কারও গরু জিতলে ঢোল তবলা দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। সেবার বলীখেলায় তরুণ তৈয়ম গোলালের গরু জিতে যায়, তখন পাড়ার লোকের কি উৎসব। তাকে কাধে তোলে নাচানাচি, ফুলের মালা পরানো, বাড়িতে পৌঁছে ছাগল জবেহ করে আনন্দ পালন করা। ভোজ উৎসব। আর কুইজ্জতলায় (খড়ের গম্বুজ) সেদিন রাতে ছফুরার আপেক্ষা- আর অনেকগুলো খাবার নিয়ে বসে আদর মাখানো সেই রাত, ভুলতেই পারে না বুড়ো। সেকি তরতাজা তারুণ্য, জোয়ানকি। সেই দেশ, সেই গ্রাম কি করে ভুলে থাকি এই ক্যাম্পে।

টেপ রেকর্ডে গান বাজতেছে - বুড়ো স্মৃতির যুগ থেকে ফিরে আসে দেখে একটা ছোটো ক্যাম্পে এক বিগত জমিতে চাষ করেছে সবজি আর সেখানে গানের আবেশ। বুড়ো বুঝে এই কুতুপালং ক্যাম্পই তার জিন্দেগীর সফর শেষ। আরাকান আর আরাকান নেই, সেখানে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসার একটা যুগ সৃষ্টি হয়েছে। এই হিংসার যুগের মানুষ আর আগের যুগের মানুষ কি বুঝতে পারবে দেশের জন্য রোহিঙ্গাদের মহব্বত কি রকম, বুড়ো ভাবে।

ক্যাম্পের একদল যুবতী বুড়োর কাছে আসে, বুড়োকে সঙ্গ দেয়, কল থেকে জগে ভরে পানি নিয়ে এসে পানি খাওয়ায়; বুড়ো তাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়- যে দেশে এসেছো সেটাও স্বর্গ নয় কিন্তু। জীবন এখানে নই, অন্য কোথাও, অন্যকোন খানে। সে স্থানটা খুঁজে বের কর। আমাকে দেখে শিখো- এই ক্যাম্প জীবন আমার মতো তোমাদেরও মাজুর করে দিক আমি চাই না, তোমাদের জামাইদের বুঝাও, ভাইদের বুঝাও। নিজেদের রক্ষা করো।


 

আরো পড়ুন-
মুসাফির

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া