X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

একজন বুদ্ধিজীবীর গল্প

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন
২১ জুন ২০১৭, ১৭:৫৪আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ১৯:৫৮

 

একজন বুদ্ধিজীবীর গল্প

মাঝরাতেই ঘটনাটি ঘটে।

জমিলা বেগম চিৎকার দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। কিতাব আলী চ্যাংদোলা হয়ে ঘুমোচ্ছে আর ঘুমের ঘোরেই বকবক করছে।

কিতাব আলীর বকবকানিতেই ঘুম ভেঙে যায় জমিলার। তাও প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে। জমিলা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছে অনেকবার। বালিশের উপর-নিচ পাল্টেছে কয়েকবার। কিন্তু ঘুম আর আসে না। বেশ কিছুদিন ধরে ইনসমনিয়াও যাচ্ছে তার। আর এদিকে কিতাব আলীর বকবকানিও থামে না।

খাটে পা ঝুলিয়ে বসে জমিলা। কিতাব আলীকে ডাকে।

অ্যাই..। অ্যাই শুনছো...।

কিতাব আলীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না জমিলার ডাক। তিনি বকবক করেই চলেন। রেগে যায় জমিলা। অ্যাই শুনছো... কিতাব আলীর গা ধরে হেঁচকাতে হেঁচকাতেই ডাকে জমিলা।

আরে ভাই, রাখেন তো... ঘুমের ঘোরেই বলে কিতাব আলী। এক মিনিট। আমার কথাটা শেষ করতে দিন, বললেন কিতাব আলী।

জমিলা চমকায়। তাহলে কি কিতাব আলী জেগেই বকবক করছে! কিন্তু কথার তো আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

বকবকানির ফাঁকে কিতাব আলীর পরিচয়টা একটু দিয়ে নি।

কিতাব আলী। ষাটোর্ধ্ব একজন বুদ্ধিজীবী। পুরো যৌবন আর বিবাহ-পরবর্তী সময় কেটেছে সাংবাদিকতা পেশায়। তখন সংবাদপত্র জগতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। বছরে কয়টা পত্রিকা পাল্টেছেন তার ঠিক নেই। পত্রিকা জগতেই তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি ছিল। বয়স ষাটের পর তিনি অবসর নিলেন। অবশ্য ইতোমধ্যে তিনি ঢাকা-শহরে ফ্লাট এবং গাড়ির মালিক বনে গেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একটু আঁতাত করে চলতে জানলেই ঢাকা-শহরে ফ্লাট, বাড়ি, গাড়ির মালিক হওয়াটা একেবারেই নস্যি।

সে যাই হোক। অবসরে যাওয়ার পর কিতাব আলীর আর সময় কাটে না। তাই তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে আর দেশের কয়েক ডজন প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানালে টক্শো করেই সময় কাটান। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক-সংগঠনের তিনি সভাপতি, উপদেষ্টা আরো কত কি। কলাম লিখে, টেলিভিশনে টক্শো করে, দেশের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সামাজিক সংগঠনগুলোর গোল-টেবিল বৈঠক করে ভালোই আয় হয় কিতাব আলীর। রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুবাদে ফ্লাট পেলেও সংসার চালানোর খরচ মেঠায় কিতাব আলী এসব করেই। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটেছে অন্য জায়গায়।

কয়েকটা টেলিভিশন চ্যানেলে টক্শো করে বাড়ি ফিরতে প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে যায় কিতাব আলীর। টেবিলে খাবার ঢেকে রাখে জমিলা। কিতাব আলী কখনও খায় আর কখনো বাইরেই খেয়ে আসে। কিতাব আলীর লেটনাইট ফেরা নিয়ে কোন আপত্তি নেই জমিলার। আপত্তি কিতাব আলী বিছানায় যাওয়ার পর।

শোয়ার দশপনের মিনিট পরই বকবকানি শুরু হয় কিতাব আলীর। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টক্শোতে যা বলে এসেছেন তাই বিড়বিড় করতে থাকেন। এবং তা ননস্টপই চলতে থাকে। জমিলা মাঝে মাঝে কিতাব আলীর গা ধরে ধাক্কা দেন। তখন কিছু সময়ের জন্য থামে। কয়েক মিনিট যেতে-না যেতেই ভাঙা রেকর্ডার রিপ্লেতে বাজতে থাকে। আর এতেই ঘুম ভেঙে যায় জমিলার।

জমিলার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে কিতাব আলীর।

কী ব্যাপার! কী হলো? এতো রাতে চেঁচামেচি করছো কেন? বলতে বলতেই চোখ কঁচলাতে কঁচলাতে উঠে বসেন কিতাব আলী।

কিছুই হয় নি। যাও। এখান থেকে বেরিয়ে যাও। ড্রইংরুমে গিয়ে ঘুমাও। বলল জমিলা।

ঘুমের তোড়ে চোখ মেলতে পারেন না কিতাব আলী। তারপরও আধো-মেলা চোখে জমিলার দিকে তাকান। জমিলা বিছানা ছেড়ে মেঝেতে গিয়ে বসেছে। কিতাব আলী পুনরায় চোখ কঁচলায়, ভাবে, নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, না হয় জমিলার এভাবে রি-অ্যাক্ট করার কথা নয়।

জমিলা কী হয়েছে বলতো? বললেন কিতাব আলী।

বললাম তো কিছুই হয়নি। বালিশটা নিয়ে ড্রইংরুমে যাও। বলল জমিলা।

রাত ক’টা বাজে দেখেছ? তোমার মাথা-টাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? বললেন কিতাব আলী।

জমিলা ও কিতাব আলীর চেঁচামেচি শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে তাদের একমাত্র মেয়ে মিলা। মিলা ভার্সিটিতে পড়ছে।

দরজায় টোকা দেয় মিলা।

বাবা...। বাবা। মা...। মা।

সেরেছে। এবার যাও। মিলাকে সামলাও। বললেন কিতাব আলী।

জমিলা গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়। মিলা ভেতরে ঢোকে। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়।

কী হয়েছে বাবা? বলল মিলা।

তোর মাকেই জিজ্ঞেস কর।

কী হয়েছে মা?

কিছুই হয়নি। তোর বাবাকে বলেছি বালিশটা নিয়ে ড্রইংরুমে যেতে।

কেন মা? চোখ কপালে তুলেই বলল মিলা।

তোর বাবা সারাদিন-রাত সমাজ কর্ম আর টেলিভিশন টক্শো করে বেড়ায়।

তাতে কী হয়েছে? বরং বাবাকে নামকরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে দেশের সবাই জানছে। বলল মিলা।

হ্যাঁ, তাই। তোর বাবা দেশখ্যাত, পৃথিবী-খ্যাত বুদ্ধিজীবী হোক তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার রাতের ঘুমটাতো শান্তিতে যেতে হবে নাকি?

বাবা কী করেছে?

সারাদিন-রাত যা বকবক করে তাই ভাঙা রেকর্ডের মতো রিপ্লে চালিয়ে দেয় ঘুমের ঘোরে। একটুও ঘুমোতে পারি না। বলল জমিলা।

এতোক্ষণে কিতাব আলী বুঝতে পারে জমিলার চিৎকার-চেঁচামেচির আসল কারণ। মাথা নিচু করে থাকে কিতাব আলী। মিলা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।

বাবা! ডাকলো মিলা।

চমকে তাকায় কিতাব আলী।

তুমি বালিশটা নিয়ে ড্রইংরুমে যাও।

শেষ পর্যন্ত তুইও তোর মা'র পক্ষ নিলি।

পক্ষ-বিপক্ষ নয় বাবা। তুমি এখন ড্রইংরুমে যাও। আর যা হবার তা কাল নাশতার টেবিলে হবে। বলল মিলা।

কিতাব আলী বালিশ বোগলদাবা করে বেরিয়ে যায়। যাবার কালে একবার ফিরে তাকায় জমিলার দিকে। জমিলা কিছুই বলে না।

ড্রইংরুমের সোফায় বালিশ রেখে কাত হয়ে ঘুমায় কিতাব আলী। ঘুম আসে না। ভাবছে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের বৈবাহিক জীবনে কখনো আলাদা বিছানায় শোয়নি কিতাব আলী। জমিলাও সেটা চাইতো না। অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে অথবা দেশের বাইরে গেলেই কেবল ওরা আলাদা বিছানায় শুয়েছে। না হয় সুখে-দুঃখে সব সময়ই তারা এক বিছানায়ই শুয়েছে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর। কতবার অসুস্থ হয়েছে কিতাব আলী। রাত জেগে সেবা দিয়েছে জমিলা। মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। ঔষধ খাইয়েছে। হাত-পা টিপেছে। কিন্তু আজ! ভাবতে পারে না কিতাব আলী। আমি কি তাহলে জমিলার কাছে বোঝা হয়ে গেলাম?

ওদিকে বিছানায় ছটফট করে জমিলা। কিতাব আলীর সাথে এ ধরনের ব্যবহার কি ঠিক হলো? বিয়ের এতোটা বছর কেটে গেল। কখনোই তো এমন করিনি। তাহলে আজ কেন হঠাৎ এমন হলো। আর একটু কী সহ্য করা যেত না?

অন্তর্দহে জ্বলে জমিলা।

পরদিন সকাল হয়।

নাশতার টেবিলে কিতাব আলী ও মিলা। জমিলা নাশতা এগিয়ে দেয়। কারো মুখে কোন কথা নেই। মুখ ভার করে বসে আছে কিতাব আলী।

কী করা যায় বলতো বাবা? নিরবতা ভাঙে মিলা।

কী আর করা যাবে? এখন থেকে আমি ড্রইংরুমেই শুব। তোর মায়ের সমস্যা তো চুকে গেল। বললেন কিতাব আলী।

কাল রাতে অতোটা রেগে যাওয়া আমার ঠিক হয়নি। কিন্তু তুমি যে সারাটা দিন-রাত মাছির মতো ভনভন করে চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টে টক্শো করছো, সমাজ কর্মের নামে, সেমিনার-গোলটেবিল করছো তাতে কার ফায়দাটা হচ্ছে বলো? থামে জমিলা। তারপর পুনরায় শুরু করে। অবশ্য কারো কোন ফায়দা না হলেও তোমার বেশ লাভ হচ্ছে। যেখানে লিখছো। আর যেখানে বলছো সবদিক থেকেই টাকা পাচ্ছো। বলল জমিলা।

তোমাদের টাকার দরকার নেই? বললেন কিতাব আলী।

শুধু টাকার দিকে দেখলে তো চলবে না। বয়সের দিকেও দেখতে হবে। তাছাড়া তোমার ছেলে তো আমেরিকা থেকে টাকা পাঠাচ্ছেই। বলল, জমিলা।

বাবা। ডাকলো মিলা।

হুঁ।

মা কিন্তু কথাটা খারাপ বলেনি। তোমার তো শরীরের দিকেও দেখা দরকার, তাই না? বলল মিলা।

আর একটা কথা। জমিলা বলল।

মিলা ও কিতাব আলী চোখ তুলে তাকাল।

তুমি যে সভা-সেমিনারে, টেলিভিশন-টকশোতে এতো নীতিবাক্য বলো, তার ক’টা নিজে মানো বলতো? বলল জমিলা।

কিতাব আলী চুপচাপ।

সেদিন কোন চ্যানেলে তুমি যাকাতের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করছিলে। আচ্ছা, বলতো তুমি নিজে ঠিক মতো যাকাত দাও? নামাজটা ঠিক মতো পড়ো? পড়ো না। কোনটাই নিজে করো না অথচ মানুষকে বলো। এটা কি হিপোক্রেসি নয়? আর সুযোগ পেলেই কী সব ছাইপাস গিলে বাসায় ফিরো। ভণ্ডামি করে টাকা-রোজগারের কোন মানে হয় না। একনাগাড়ে বলে থামলো জমিলা। কিতাব আলীর মুখে কোন রা নেই। মিলাও চুপ করে আছে।

কিতাব আলী সকালের নাশতাটা প্রতিদিনের মতো সারতে পারে না। কারো সাথেই কোন কথা না বলে নাশতার টেবিল থেকে উঠে বেরিয়ে পড়ে।

মুখ খোলে মিলা।

মা তুমি যে সত্যি কথাগুলো এভাবে বলতে পারবে তা আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না।

সত্যিকথা বলতে কখনো ভয় পাবি না। সে যেই হোক। বলল জমিলা।

কিতাব আলী রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছে। গন্তব্যহীন। পত্রিকার অফিস থেকে, টেলিভিশন-চ্যানেল থেকে ফোন আসে। একের পর এক মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। কিতাব আলী কোন কলই রিসিভ করে না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। রমনাপার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে কিতাব আলী। পকেটে মোবাইল বাজছে। টেলিভিশন-চ্যানেলের ফোন মনে করে মোবাইল দেখে না। বেশ কয়েকবার রিং পড়ার পর মোবাইল দেখে কিতাব আলী। মিলা ফোন করছে। কিতাব আলী রিসিভ করে।

হ্যালো। কিতাব আলী বলল।

বাবা, মা স্ট্রোক করেছে। বলল মিলা।

কিতাব আলী আর কিছুই শুনতে পায় না। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর জমিলার সাথে, সংসার জীবনের দৃশ্যপটগুলো রমনাপার্কের হাজারো বৃক্ষের উপরে সাদা মেঘের স্ক্রিনে ভাসতে দেখে।


আরো পড়ুন-




একটি দৈনিকের সংবাদ প্রতিবেদন

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া