X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘বাংলাদেশ যে হবে এটার কোন গ্যারান্টি নাই’

শেরিফ আল সায়ার
২৪ জুন ২০১৭, ১৮:১২আপডেট : ২৪ জুন ২০১৭, ১৮:২৫

মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায় লে. কর্নেল মুহাম্মদ কাদিরের বাসায় ১৯৭১ সালের ২১ বা ২২ মার্চ জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া আসেন। দেশ তখন উত্তাল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। এমন সময়েই জিয়াউর রহমান আসেন লে. কর্নেল কাদিরের বাসায়। এ সময় তাদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে বাক বিতণ্ডা হয়।  পরবর্তীতে জানা যায় সেদিন জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হবে এটার কোন গ্যারান্টি নাই।  সুতরাং আমি এর মাঝে নেই। পরে দেশদ্রোহী হয়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।’ এমন ঘটনার বয়ান উঠে এসেছে সাংবাদিক নাদীম কাদির রচিত মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায় গ্রন্থে।
নাদীম কাদির রচিত বইটি একটি স্বচ্ছ ইতিহাস।  যা বলবে যুদ্ধপরবর্তী একটি শহীদ পরিবারের গল্প।  প্রতিটি শহীদ পরিবারের একটি গল্প আছে স্বাধীনতার পর থেকে।  বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে দেশ যেমন পড়েছিল এক অন্ধকার জগতে, ঠিক তেমনি তারচেয়েও গভীর অন্ধকারে পতিত হয়েছিল প্রতিটি শহীদ পরিবার। নাদীম কাদিরও নিশ্চয় সেদিন অসহায় হয়েছিলেন। তবুও নাদীম কাদির লড়াই করেছেন, তার পরিবার বিশেষ করে তার মা হাসনা হেনা কাদিরের যুদ্ধটাও অন্যরকম।
এই গ্রন্থে নাদীম কাদির যেমন তার বাবার গল্প বলেছেন, ঠিক আবার বলেছেন ১৯৭১ সালে হারিয়ে বাবাকে খুঁজে পাওয়ার গল্প। পাশাপাশি যেন দুই প্রজন্মের গল্প হেঁটেছে। গ্রন্থের ঘটনাগুলো গল্পের মতো করে নাদীম কাদির বললেও আসলে এটি বাংলাদেশেরই ইতিহাস।
নাদীম কাদির ১৯৭৭ সাল থেকে খুঁজে ফিরছেন তার বাবার কবরকে। কারণ তার মা বিশ্বাসই করতে পারেননি তার স্বামী এ পৃথিবীতে নেই।  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে রেডক্রস এজেন্সি জানিয়ে দিয়েছিল- লে. কর্নেল কাদির নিখোঁজ এবং ধারণা করা হয় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু হাসনা হেনা তা কিছুতেই মানতে নারাজ।
মাকে নাদীম কাদির কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারেননি। তবে চেয়েছেন মাকে অন্তত সান্তনাটুকু দিতে এই বলে যে, তার স্বামী একজন বীর, যার রক্তের বিনিময়ে রচিত হয়েছে একটি দেশ, একটি দেশের লাল সবুজ পতাকা।
‘মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায়’ গ্রন্থে নাদীম কাদির বাবাকে খুঁজে ফেরার যাত্রার গল্প বলেছেন, কিভাবে তিনি প্রান্তের পর প্রান্ত হাতড়িয়ে বেড়িয়েছেন বাবাকে। শুধু তাই নয়, আসলে কী হয়েছিল লে. কর্নেল কাদিরের সঙ্গে? এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খেয়েছে নাদীম কাদিরের হৃদয়ে। কিভাবে শহীদ হলো? বাবা কি করছিলেন তখন? কী বলেছেন? বাবার সাহসটা অন্তর দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন নাদীম।
তার গ্রন্থজুড়ে রয়েছে সেইসব গল্প। তিনি শুরুই করেছেন ২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, যেদিন লে. কর্নেল কাদিরের সমাধি পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনদাফন করা হয় কাদিরাবাদ সেনানিবাসে। এভাবেই তিনি গল্পের ভেতর প্রবেশ করেন। ধীরে ধীরে পেছনে যান নাদীম কাদির। কিভাবে তিনি পেলেন বাবার কবর। লেখক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ২০০৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে যান, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যাবেন এমন কিছু সেনা সদস্যের উদ্দেশে লেকচার দিতে। সেই লেকচারের সময় কথায় কথায় নাদীম কাদির বলেন, এই শহরেই তিনি তার বাবাকে হারিয়েছেন। তখনই সূত্র খুঁজে পান নাদীম কাদির। সেখানেই ডা. মাফুজুর রহমানের লেখা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ের কথা বলেন চট্টগ্রাম ব্রিগেডের লে. কর্নেল বায়েজিদ সারোয়ার। সেই বইয়ের ৩৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে লে. কর্নেল কাদিরসহ ৩৫ জন হত্যা করার কথা। সেখান থেকেই মূলত শুরু নাদীম কাদিরের যাত্রা।

তার গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে কিভাবে তিনি বাবার সমাধির সন্ধান পেলেন। কিভাবে নিশ্চিত হলেন। কারা তাকে সহযোগিতা করেছেন। সরকারি দফতরগুলোতে কিভাবে তিনি যোগাযোগ করেছেন। এ সব তথ্য অত্যন্ত সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। শুধু তাই নয়, এই গ্রন্থের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, নাদীম কাদিরের এই সংগ্রামে যতজন তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন সবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সবার নাম উল্লেখ করতে তিনি মোটেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। যেমন, ভোরের কাগজ পত্রিকার চট্টগ্রামের ব্যুরো চিফ সমরেশ বদ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ তিনিই প্রথম নাদীম কাদিরের এই সন্ধানের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার ২২ সেপ্টেম্বর যখন লে. কর্নেল কাদিরের পূর্ণ দাফনের দিন ঠিক হয়েছে ঠিক ওই সময়ে বিএনপি জামায়াত ২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। নাদীম কাদির তখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা শমসের মুবিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি নাদীম কাদিরকে জানান, ঢাকা থেকে কাদিরাবাদ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে যেন তাদের গাড়ি পৌঁছাতে পারে সেই ব্যবস্থা করবেন। নাদীম কাদির তাই শমসের মুবিন চৌধুরীর এই কৃতজ্ঞতার কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন।

নাদীম কাদির এই গ্রন্থের গল্পগুলোকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত বাবার কবরের সন্ধান, দ্বিতীয়ত কবর চিহ্নিতকরন ও নিশ্চিত হওয়া, তৃতীয় এবং শেষ ধাপ তার বাবার কবরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধি সংরক্ষণ করার পদক্ষেপ নেওয়া। নাদীম কাদির এই তিনটি ভাগ নিয়েই এই গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও। তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম থেকে লে. কর্নেল কাদিরের দেহাবশেষ নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনদাফন করা হয়। এজন্য শেখ হাসিনার প্রতি তিনি তার চির কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন।

এছাড়াও‌‌ গ্রন্থে আছে তার ছোট ভাই নাউইদ কাদিরের কথাও। তার একটি বক্তব্যও সংযোজিত হয়েছে এই গ্রন্থে।

নাদীম কাদির রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায়’ গ্রন্থটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই গৃহিত হবে। এই গ্রন্থে একজন মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাসের সঙ্গে তার একটি পরিবারের গল্পও জানবে পাঠক। এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন ইমরান মাহফুজ, প্রচ্ছদ করেছেন আড়াই রুকা এবং প্রকাশক হলো জাগৃতি প্রকাশনী। মূল্য ২০০ টাকা।

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!