X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

উড়িষ্যার লোককথা

দিদার মুহাম্মদ
০৬ জুলাই ২০১৭, ১৩:৩৬আপডেট : ০৬ জুলাই ২০১৭, ১৩:৪৫

উড়িষ্যার লোককথা

ছোটবেলায় প্রচণ্ড জোৎস্নায় বাড়ির উঠানে খড়ের উপর মাদুর পেতে বু’র (নানী) হাত-পাত-শরীর জড়িয়ে যখন আমরা রূপকথা শুনতাম তখন দখিনের খোলা মাঠ হতে হুঁ-হুঁ করে বাতাস আসতো। একটু বড় হয়ে ইশপ তারপর নাসির উদ্দিন হোজ্জা, আর একটু পর নাম্বির কথায় মুগ্ধ হয়েছি। মাসুদ রানা-জুলভার্ন পড়েছি। কিন্তু শৈশবের সেই রূপকথার রাজা-রাণী, রাজকুমার-রাজকুমারী, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মতো জীবনে আর কেউ এলো না। কোন অজানা স্রোতে ভেসে গেছে সব। গল্প শুনতে কার না মন চায়। সেই রূপকথা শোনার হয়তো বয়স থাকে, আমি কিন্তু এখনো এর পাগল। সম্প্রতি সৌভাগ্যক্রমে ভারতের উড়িষ্যার কতগুলো রূপকথা পাঠের সুযোগ আমি পেয়ে যাই।


উড়িষ্যা। ভারতের অন্যতম একটি কৃষিভিত্তিক প্রদেশ। যত পূর্ব আর উত্তরে যাবেন দেখবেন ধানের ক্ষেত। নারকেল আর সুপারি গাছের সারি তো প্রায় পুরো প্রদেশ জুড়েই, সমভূমি থেকে সাগরের তটরেখা পর্যন্ত। যদি দক্ষিণ আর পশ্চিমে যান দেখবেন পর্বতমালা আর ঘন অরণ্য। এখানের অধিবাসী যারা এখনও প্রকৃতির উপর নির্ভর করে তাদের জীবন বয়ে চলেছে তাদের এই চিরাচরিত জীবনচর্যা কেমন যেন মহাভারতের যুগে নিয়ে যাবে আপনাকে-ভাবনাকে।


উড়িষ্যার সাগর আর পাহাড়, সমভূমি আর মালভূমি পরস্পর রচনা করেছে বৈচিত্র্যের অসামান্য ঐক্য আর অন্তরঙ্গতা। শতকরা ৮২ ভাগ ওড়িয়া ভাষাভাষি মানুষের জীবনচর্যা এর ভাষা-সংস্কৃতিতে প্রতিবিম্বিত, প্রতিবিম্বিত আবহমান লোকসাহিত্যে। এর লোককথা বা গল্পগুলো মুখে মুখে হাজার বছর ধরে চলে এসেছে। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের গল্পের সঙ্গে মিল থেকে যায়। পশুকাহিনি, প্রেতকাহিনির মতো বাংলার সাত সমুদ্র তের নদীর সাদৃশ্য সত্যিই ভাল লাগার। তবে এর শুরুটা সাসপেন্স দিয়ে আর শেষটা কখনো ‘তারা অবশেষে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো’র মতো, কখনো দুর্বৃত্তের দমন কিংবা কখনো বিয়েগাত্মক। শুরুতে কথক প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন, উত্তর তিনি নিজেই দেন, উত্তর তার জানা; তার পরিকল্পিত প্রকাশভঙ্গি। শ্রোতা যেন আকর্ষিত হন, নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু এই প্রশ্ন কখনো মূলগল্পের কাহিনির সঙ্গে সম্পর্ক নাও রাখতে পারে। কখনো এর শুরুটা এমন–

‘চলো, আজ তোমাদের একটা গল্প বলি–


কীসের গল্প?
বাঘের গল্প...’
আবার কখনো শুরুটা হয় ছড়া কাটতে কাটতে–
‘সোজা কাটা হয়নি কাঠ
তেরসা করে কাটা।
জোড়া বলদ করল না চাষ
এক বলদের খাটা।’
কিংবা ধাঁধাঁ দিয়ে– যার উত্তর কথক জানে। যেমন ধরুন–
‘জীর্ণ এক দেশে ছিল দুটি গাঁও। এক গাঁওয়ে ছিল না কোন বাড়ি। সেথায় থাকতো তিন কুমোর। তাদের দু’জন দু’জনকে শোনাতো ‘অন্যজন বানায় না মাটির বাসন। যে জন থাকতো বসে, তাকে সহ তার তিনটি মাটির বাসন।’
একই ধাঁধাঁ আবার উড়িষ্যার বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়। যেমন পশ্চিম উড়িষ্যার বলাঙ্গির-কালাহান্দি অঞ্চলে শুরুটা করে এভাবে–
‘একটা গল্প বলি। একটা গল্প।
কিসের গল্প? এটা কুমোরের গল্প।
এক কুমোরের ছিল তিন ছেলে।
তার দুই ছেলে ছিল অন্ধ আর বাকি জন চাইতো না দেখতে।
অন্ধ একজন বানালো তিনটি পট।
তার দুটি গেলো ভেঙে আর একটি ধরার কেউ নেই।
তুমি পূব দিকে মুখ করে হু-হু করতে থাকো।’

কিছু গান হয়তো ঘুমপাড়ানি-কিছু কান্না, কিছু প্রবাদ-কিছু প্রার্থনা, কিছু ধাঁধাঁ-কিছু কথা জুড়ে থাকে একেকটি লোককথা। কখনো বা এর কিছু লাইন থাকে আবহ তৈরি করে, কবিতার মতো শোনায়, হৃদয় বিগলিত করে গল্পের শেষ টানে–
- ‘ফুল গাছটা মুরোলো, আমার গল্প ফুরলো।
   হায় ফুল গাছ! কে তোমায় মুরোলে?
- লাল পিঁপড়া আমায় কামড়ালো
- ওরে লাল পিঁপড়া, তুই আমায় কামড়া
   তবে আমার খোকন সোনাকে কোন?
- আমি মাটির নিচে থাকি আর কামড়াই
   যখনই কোন মিষ্টি-নরম মাংস পাই’

এভাবেও কথক গল্প শেষ করে–
‘... তারপর রাজকুমার আর রাজকুমারী সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকল। আমি তাদের কাছে গেলাম কিন্তু তারা আমার সঙ্গে কোন কথাই বলেনি।’– এই যে গল্পের শেষে এমন একটা কথা বলে শেষ করলো যে মনের মধ্যে হু-হু করে উঠলো।

উড়িষ্যার এর কথকদের খুব চমৎকার নামে ডাকা হয়। প্রথমে বলে নিই, এই কথক কিন্তু নারী পুরুষ উভয়ই হতে পারে। আর সাধারণত বড়রা ছোটদের কাছে গল্প বলে থাকে। তাদের অবশ্যই গল্প বলার ভঙ্গি আর দক্ষতা থাকে। তাদের এই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, এই বলা ও শোনা তাদের ভাষায়ও দারুণ প্রতিফলিত হয়েছে। পারিবারিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে প্রতিবেশির ছোট ছোট বাচ্চারাও এই গল্প শোনার উঠানে যোগ দেয়। গ্রামের লোকেরা এই কথকদের ডাকেন ‘কথার সাগর’ বলে। সারা সম্প্রদায়ে এদের বলে ‘কথাবিরমার’, কোরাপুট-কালাহান্দি অঞ্চলে ডাকে ‘গীতকুদিয়া’ বা ‘দেবগুনিয়া’। কিছু ঘরনা আছে যার জনপ্রিয় গায়করাও গল্প বলে। আর আদিবাসী এবং কৃষক সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই গল্প বা লোককথা জানে।
এই গল্প বলার নেপথ্যে কিছু কারণ খোঁজে বের করা গেছে। আগেই বলেছি, এরা বিশেষত কৃষক সম্প্রদায়। ধান বা শস্য কাটার মৌসুমে চোরের উপদ্রোব বেরে যায়। ধান বা শস্য মাড়াই করে কৃষকরা ক্ষেতে জমা করে রাখে। তখন চোরেরা আসে ওগুলো চুরি করতে। যদি এই গল্পগুলো চলতে থাকে তবে চোর চুরি করার সাহস পায় না। বুঝতে পারে ফসলের মালিক সজাগ। আর এ সময়গুলোতে গল্পগুলো হয় বর্ণনাত্মক, তারা লম্বা লম্বা গল্প শুরু করে লম্বা সময় নিয়ে বলার জন্য– এটাই রীতি। তাছাড়া যারা পাহারা দেয় তাদের মধ্যেও গল্প চলে। কাজের মধ্যে গল্প চলে। দীর্ঘ পথ হাঁটা কিংবা বিশ্রামের সময়ও গল্পগুলো বলা হয়।

আর সচরাচর যেটা ঘটে, মা বা দাদী বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় আর ঘুমপাড়ানোর সময় গল্প বলে। বাচ্চাদের একটা কল্পজগত তৈরি হয় মনোজগতে। মানসিক বিকাশ আর ভাবনাশক্তি তৈরি হয়। এগুলো বাচ্চাদের মধ্যে ভালোবাসা, দুঃখবোধ, কান্না, ভয়, সাহস আর মানবিকতা-মূল্যবোধ তৈরিতে সাহায্য করে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, উড়িষ্যার কৃষকরা বাস করে গাঁও-গ্রামে, আর আদিবাসীরা পাহাড়-অরণ্যে। বাস্তবে সেখানে না আছে রাজ-রাণী, রাজকন্যা-রাজপুত্র-রাজপ্রাসাদ আর না আছে সওদাগর। তাহলে কেন লোককথাগুলো রাজকীয়তা অধ্যুষিত! এ প্রশ্নটি মাথায় এসেছিল যখন মাথায় বুদ্ধি ধরা শুরু করেছিল আমার। এখন যখন দেখি গহীন-অরণ্যের আদিবাসীদের গল্পগুলোও রাজকীয়তা অধ্যুষিত তখন প্রশ্নটি প্রগাঢ় হলো। মজার বিষয় হলো এই রাজ-রাণী, রাজকন্যা-রাজপুত্র-রাজপ্রাসাদের সঙ্গে তারা অরণ্যের পশু-পাখি-গাছ, পাহাড়-নদী-মাছ, রাক্ষস-দেবতাদের সম্পর্ক বুনে দেয় অনায়াসে। আসলে ভারতীয় মানসিকতা বেদ-পুরাণ আর রাজা-রাণী অধ্যুষিত হতেই পারে। হতেই পারে অরণ্যের পশু-পাখি, গাছ-নদী, রাক্ষস-দেবতা অধ্যুষিত। আর তাই মিরাক্কেল প্রপঞ্চগুলো জায়গা করে নিয়েছে। আসলে মানুষ তার সমস্যা সমাধান করতে অক্ষম, প্রকৃতির কাছে অসহায়; জীবনের প্রতি ধাপে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধান করতে না পেরে এক প্রবল শক্তির কল্পনায় অপেক্ষামান। এই অপেক্ষা সীমাহীন। এমন সময় কেউ আসে মিরাক্কেল-সুপারন্যাচারাল শক্তি নিয়ে। চরিত্র আর গল্প তৈরি হয়, তোঁতা কিংবা সাপ কথা বলে ওঠে, সহায়ক হয়ে ওঠে, তারা উপর্যুপুরি নায়ক-নায়িকা হয়ে ওঠে। তারপরও শ্রোতার মনে এই গল্প যেন পটে গেঁধে যায়। তারপরও বারবার একই গল্প শোনার আনন্দও কমে না। কেননা, এই গল্প জীবন সমস্যা আর কল্পরাজ্যের সঙ্গে মিলে যায়। যারা আগে শুনেনি তারা এক রোমাঞ্চকর সময় পার করে। গা কাঁটা দিয়ে ওঠে, হৃদয় বিগলিত হয়, কখনো গাল ভরে আসে হাসির ফোয়ারা। কিন্তু এই গল্পগুলো আজীবনই বানয়াট, কথকমাত্রই নিজের মতো বানায়। কেউ এর রচয়িতা নয়, কারণ সবাই এর রচয়িতা।

উড়িষ্যার লোককথা বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে ঠিক এই কথাগুলোই আমার মনসপটে ভাসছিল। বলে ক্ষ্যান্ত হলাম। এবার অনূদিত লোককথা পড়ার পালা। ভাবানুবাদ অবশ্যই। গল্পের মান ও মানে অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা ছিল। সত্য হলো তা পুরো পূরণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। হয়তো ভাবের নিকটবর্তী, বোধের নিকটবর্তী, অর্থের কাছাকাছি। (চলবে– প্রতি বৃহস্পতিবার)


 

লেখক : দিদার মুহাম্মদ। আইসিসিআর স্কলার, মাস্টার অফ পারফর্মিং আর্টস (এমপিএ), ব্যাঙ্গালুর ইউনিভার্সিটি, কর্ণাটক, ভারত।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা